ঢাকা, বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫
৩ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৬

নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলেও সংকট সহজে কাটবে না

  • ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শেয়ার
নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলেও সংকট সহজে কাটবে না

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার মেঘ লেগেই আছে। পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনও কোনোভাবেই চোখে পড়ছে না। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য-বিবৃতিতে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ-উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া বেফাঁস বক্তব্য, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, পাল্টা-আক্রমণ চোখে পড়ার মতো।

এমনকি সংস্কার-নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এমন দ্বন্দ্ব ক্রমেই সংঘাতের দিকে এগোতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মনে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। এ থেকে আদৌ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে সংশয় রয়েছে অতিমাত্রায়।
রাজনীতি মানেই যেন দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অশ্রদ্ধা এবং অপসংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার রোডম্যাপ না দিলে মাঠের আন্দোলন শুরু করতে পারে বিএনপি। নবগঠিত এনসিপি চায় সংস্কার ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এখন মাঝামাঝি অবস্থানে।

তারা বলছে, নির্বাচন এবং সংস্কার সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর (২০২৫) ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তিনি বারবার নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিলেও কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে তাদের স্থির মনোভাব পোষণ করছে না। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো কেন বিষয়টি অনুধাবন করছে না সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তারা অভিযোগ তুলছে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নির্বাচনের ঘোষিত সময় ঠিক থাকলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়ার যথেষ্ট সময় সরকারের হাতে রয়েছে। তবে ডিসেম্বর থেকে জুনএই বড় সময় নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনের বিষয়টি এমন হওয়া উচিত যে ডিসেম্বর না হলে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারির মধ্যে হতে পারে। কিন্তু ডিসেম্বর না হলে জুনের মধ্যে হবেএমন বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।

নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে এ বিষয়ে নবগঠিত এনসিপির মতামত ও অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিতে তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের এই দলটি কিংস পার্টি হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এই দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছে। তারা কখন কিভাবে নির্বাচন চাইবে, কোন সময় চাইবেএসবের সঙ্গে সরকারের সদিচ্ছার প্রসঙ্গটি থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে বলেই সাধারণভাবে অনুমান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেমন রোডম্যাপ সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক রোডম্যাপ যথাযথভাবে ঘোষণা করেনি। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে কিংবা জনসমর্থন বাড়াতে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। চোখে পড়ার মতো কোনো রাজনৈতিক রোডম্যাপ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে জনগণ পাচ্ছে না। জনগণের কাছেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বার্তা পৌঁছাচ্ছে না। বরং বিএনপির মতো বড় দলের আন্তঃকোন্দল বেড়েই চলেছে।

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ সাধন করা। এ ক্ষেত্রে জনগণ যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ হওয়ার জন্য সব পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করা হবে কি না, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, এ সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো সরকার কিভাবে মোকাবেলা করবেএসব নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। কাজেই নির্বাচন এগিয়ে আসা মানেই সব সংকটের অবসান ঘটা তেমনটি আশা করার কোনো কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

আমরা আশা করব, সব দল এবং দলের নেতারা সহনশীল হবেন, সংযত হবেন। অতীত বা বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীর কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, যাতে দেশ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে, যাতে দেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। রাজনীতিতে টানাপড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবেএ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। এ কারণে প্রয়োজন একটি উইন-উইন পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন-উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না।

যেকোনো রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। বৈধ এবং সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করেও ক্ষমতায় আসে এবং আসার চেষ্টা করে। আমাদের দেশে বিদ্যমান নামসর্বস্ব দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই। সম্প্রতি বিবিসি জরিপ থেকেও কিছুটা অনুমান করা যায় যে কোন দলের কেমন জনভিত্তি রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তাদের নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি অন্য যেকোনো দলের তুলনায় ভালো। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে আওয়ামী লীগ সক্রিয় রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে রেখেছে।

ভোটের রাজনীতিতে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলে এবং জনসমর্থন না থাকলে সেই দল নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে না। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে নতুন দলগুলোর উচিত সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রমী চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না। ফলে জনসমর্থনও বাড়ে না। এতে নির্বাচনের ফলাফলও নেতিবাচক হয়।

কাজেই নতুন নতুন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সৃষ্টির যে প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, সেটি সত্যিকার অর্থে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করবে কি না সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জনসমর্থন বাড়ানোর রাজনৈতিক কর্মসূচি গঠনই রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কার্যক্রমের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে মাসুল দিতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, দিনশেষে তাদেরকে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবেই।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আমাদের অহংকার

    ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
শেয়ার
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আমাদের অহংকার

দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব ও ঐক্যের প্রতীক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। সশস্ত্র বাহিনীর গৌরব শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় বাংলাদেশেও সমানভাবে অবদান রেখে চলেছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্বে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশকেই সম্মানিত করেছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে কাজ করে শুধু সেসব দেশে শান্তি ফিরিয়েই আনেনি, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসন ক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন।

এভাবে সশস্ত্র বাহিনী আজ জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেম।

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত।

আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সমুন্নতি বিধান এবং সর্বোপরি দুর্যোগ মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই জাতির জন্য ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে দেশের তরে নিজ প্রাণ সঁপে দিয়েছিল উদ্দীপ্ত বাঙালিরা।

৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছিল এই স্বাধীন ভূখণ্ড। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়লাভ করা বিরল ঘটনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জনের  পেছনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠের মতো। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য তাঁদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক।

১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে জাতীয় অখণ্ডতা, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অব্যাহত অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের ভালোবাসাএ দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সেনাবাহিনীর দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের আদর্শ ও দেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকারী সেনাবাহিনী তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ আলোর দিশারি। আমার বিশ্বাস একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশসেবায় সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/16-04-2025/kalerkantho-ed-1a.jpg১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পরপরই বাঙালি নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেছিলেন যে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বাঙালিদের মুক্তি নিহিত নয়। কারণ যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে, বাঙালির ভাষা কেড়ে নিতে চায়, সেই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য নয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তৎকালীন শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। বাংলার মানুষ তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে পরাধীন বাংলাকে মুক্ত করার জন্য উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতে দখলদার হানাদার বাহিনীর বুলেট আঘাত হানতে থাকে নিরস্ত্র, নিরীহ, নিরপরাধ, বিপন্ন ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। অপারেশনের অন্যতম লক্ষ্য ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ইপিআরসিসহ সারা দেশের সামরিক-আধাসামরিক সৈন্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতির ওপর হানাদার বাহিনীর এই কুখ্যাত পূর্বপরিকল্পিত ন্যায়নীতিবহির্ভূত গণহত্যাটি অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই হানাদার বাহিনীর হামলার জবাবে ভীত কিংবা হতবিহ্বল না হয়ে সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিক বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সরাসরি বিদ্রোহ করে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের দুরন্ত, অকুতোভয় বীর বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গঠিত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিক, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করা শুরু করে।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনসংক্রান্ত সমন্বয় সভায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ, সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি, একক কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন, সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ফোর্সেস গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আগের সিদ্ধান্তের আলোকে গোটা দেশকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়।

১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী সরকার শপথ নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ একটি সুপরিকল্পিত রূপ লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১০ থেকে ১৭ জুলাই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের এক সম্মেলনে অপারেশন চালানোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিভক্ত করে পেশাদার দুরন্ত, অকুতোভয় বীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের এসব সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর গঠিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ওপর সেক্টরগুলোয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ সময় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রতিটি সেক্টরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগত যুবকদের স্বল্প সময়ের মধ্যে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি রেজিমেন্ট ও পরবর্তী সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ৯, ১০ ও ১১ ইস্টবেঙ্গল মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেয়। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ৫ ইস্টবেঙ্গল পাকিস্তানের শিয়ালকোট সীমান্তে, ৬ ইস্টবেঙ্গল পেশোয়ারে ও ৭ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট রাজস্থান মরুভূমিতে নিয়োজিত ছিল। পরে যুদ্ধ চলাকালীন সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জেড ফোর্স, এস ফোর্সকে ফোর্স নামে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ১, ৩ ও ৮ ইস্টবেঙ্গল নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই ময়মনসিংহের বিপরীতে তুরা পাহাড়ের পাদদেশে সংগঠিত হয়েছিল জেড ফোর্স। আগরতলায় ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ৪, ৯ ও ১০ ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কে ফোর্স মেলাঘরে গঠন করা হয়। ২ ও ১১ ইস্টবেঙ্গল নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ হেজামারা এস ফোর্স গঠিত হয়েছিল।

বিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ আট মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিপাগল দেশপ্রেমিকদের সম্মিলিত আক্রমণে যখন হানাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছিল, তখন জেনারেল ওসমানীসহ তৎকালীন উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক দূরদর্শী সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধে নতুন গতিশীলতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাধ্য হতে থাকে পশ্চাদপসরণে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে লাখো জনতার সম্মুখে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অবনত মস্তকে প্রায় ৯৩ হাজার দখলদার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও দখলদার হানাদার বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই আত্মসমর্পণের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনজন বীরশ্রেষ্ঠসহ এক হাজার ৫৩৩ জন সেনা সদস্য শাহাদাতবরণ করেন এবং ২৯১ জন সেনা সদস্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সংকটের সময়েও জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে অবদান রেখে চলেছে।

বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য জীবন দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেকোনো ক্রান্তিকালে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে র‌্যাবের সদস্য হয়ে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও জাতির ওপর অর্পিত দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি করে দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। পদ্মা সেতু, জাতীয় মহাসড়ক, মহিপাল ফ্লাইওভার, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফুট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফুট খালখনন প্রকল্প হাতিরঝিল, স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রো রেল, পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতাবিশিষ্ট বর্ডার সড়কসমূহ, মেরিন ড্রাইভসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনাসমূহ তৈরিতে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সশস্ত্র বাহিনী নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছে। তার অন্যতম উদাহরণ মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লকডাউন কার্যকর, ত্রাণ সহায়তা, বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ করোনা মোকাবেলায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

২০২৪-এর এই গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সংকটময় সময়ে বর্তমান সেনাপ্রধান এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান খুব সুন্দরভাবে ও অসাধারণ পরিপক্বতার সঙ্গে দেশের দায়িত্ব ড. ইউনূস সরকারের কাছে হন্তান্তর করেন। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে অনেক সংকট ও সমস্যা সমাধানে সরকারকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। বিশেষত সরকার গঠনের প্রথম দিকে বাংলাদেশ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ও করছে।

সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ পেশাগত উৎকর্ষে বিশ্বের যেকোনো বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। মিসাইল, আধুনিক ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সব শাখাসহ সেনাবাহিনী এমন সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিদ্যাপীঠ ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বর্তমান সময়ে সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখাকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, দুটি পদাতিক ব্রিগেড, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি ও জেসিও-এনসিওস একাডেমির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধে নয়, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। রণক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া একটি সেনাবাহিনী অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ অনেক দক্ষ, সুসংগঠিত এবং দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা দেশপ্রেমিক গণমানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি জাতির বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিকালে যথাযথ ভূমিকা পালন ও অবদান রাখার দৃষ্টান্তে আমাদের সেনাবাহিনী নিয়ে আজ এ দেশের আপামর জনসাধারণ গর্বিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ একটি পরিচিত এবং গর্বিত নাম। জাতির গর্বে গর্বিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাই আজ জাতির আস্থার প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সব সাফল্যমণ্ডিত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে বিশাল সম্মান বয়ে এনেছে, তা শুধু সেনাবাহিনীর নয় বরং এ দেশের সবার অহংকার ও গৌরব।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

মন্তব্য

‘সেরা সংগঠক’ বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
‘সেরা সংগঠক’ বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান

আমরা আমাদের নিজেদের রাষ্ট্র পেয়েছি ১৯৭১ সালে। এর আগে রাষ্ট্র নামে জাতির এই বৃহত্তর সংগঠনটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। এর ফলে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা সব সময় থেকেছে নির্জীব এবং ফ্যাকাসে। এ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি এবং প্রো-অ্যাক্টিভনেস বিষয়টি কখনো আমলে আসেনি।

সুযোগও ছিল না। পাকিস্তানিরা অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো প্রথম থেকেই বাঙালি সংগঠকদের ক্রীড়াঙ্গনে দায়িত্বভার ও পরিচালনার ক্ষেত্রে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বাঙালিরা সংগঠন গড়ে তোলা ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে স্বাধীনতার পর জাতির ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে এলে। শুরু হয় ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালির সংগঠনের যুগ।
নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া।

ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, ধারণা প্রতিষ্ঠা সংগঠকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ এবং চ্যালেঞ্জ। এটি প্রথম থেকেই বোঝা গেছে। মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা এবং সৃষ্টিশীল এটি ঠিক, তবে এর বিকাশের জন্য সময় ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

এটি থেকে বাঙালিরা উপেক্ষিত ছিল দীর্ঘ ২৪ বছর। তাই ইতিহাসের ধারা বদলে দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়ে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। এটিই বাঙালির ক্রীড়াঙ্গন শুরুর প্রেক্ষাপট বা ইতিহাস। যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন গত ৫৪ বছরের ক্রীড়াঙ্গনের ঘটনাপ্রবাহ ঘটনাবহুল মনে হয়।

অনাবিষ্কৃত উদ্যোক্তাসুলভ সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ক্রীড়া অবকাঠামো বলতে তো কিছুই ছিল না। এর পরও একদল ক্রীড়াপাগল সংগঠক কঠোর পরিশ্রম করেছেন। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেনহাল ছেড়ে দেননি। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে বছরের পর বছর চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করেছেন ক্রীড়াচেতনা এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে। তাঁরা চেয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে সংগঠকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ। দেখেছেন সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার স্বপ্ন।

গত ৫৪ বছরের ক্রীড়াঙ্গনে যে কয়জন উদ্যমী ক্রীড়া সংগঠক পেশাদারিসুলভ মনোভাবের মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার ক্ষেত্রে আলোচনার জন্ম দিয়ে বারবার আলোড়িত হয়েছেন, দেশ ও দেশের বাইরে ক্রীড়াপ্রেমী বড় জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত হতে পেরেছেন, লালিত স্বপ্নকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন, দেশের বৃহত্তর সমাজে আদর্শ, অনুসরণীয় এবং বাতিঘর হিসেবে চিহ্নিত হতে পেরেছেনতাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রীড়া-অন্ত প্রাণ ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয় ক্রীড়া সংগঠক মো. ইমরুল হাসান। এই মানুষটি ফুটবলে ক্লাব সংস্কৃতি এবং বৃহত্তর ফুটবল ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে গেছেন। ইমরুল হাসান প্রমাণ করেছেন ক্লাব হোক বা খেলার সবচেয়ে বড় সংগঠন হোক, সবাইকে নিয়ে যদি পেশাদারিসুলভ মনোভাব উজ্জীবিত করে শৃঙ্খলা, সততা, নীতি, দায়িত্বশীলতা, সুশাসন, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক চর্চাকে সমুন্নত রেখে, হাতে হাত রেখে কাজ করা সম্ভব হয়, তাহলে সাফল্য ধরা দেবেই। পরমতসহিষ্ণু, মতের পার্থক্যকে সব সময় সম্মান প্রদর্শন এবং নৈতিকতার পূজারি ইমরুল হাসান সবাইকে নিয়ে যেভাবে দেশের ফুটবল সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধনে অবদান রেখেছেন, যেভাবে আস্থা ও বিশ্বাসের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন, এর তুলনা করার মতো উদাহরণ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এখনো সৃষ্টি হয়নি। ইমরুল হাসান জানেন গোলাপ ফুলের পাশাপাশি কাঁটাও আছে! তাই সব পরিস্থিতিকে সহজভাবে মোকাবেলা করতে পারেন।

‘সেরা সংগঠক’ বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানতাঁর পরিচালিত ক্লাব ফুটবলের বড় আসরে (প্রিমিয়ার লীগে) খেলতে নেমে (২০১৮-১৯) একনাগাড়ে পাঁচবার শিরোপা জিতে যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, এই নজির দেশের ফুটবলে নেই। ছয়-সাত বছরের মধ্যে ১৬টি ট্রফি বসুন্ধরা কিংসের ডিসপ্লে কেবিনেটে স্থান পেয়েছেএত অল্প সময়ের মধ্যে আর কোনো ক্লাবের পক্ষে এত বেশি ট্রফি জয় সম্ভব হয়নি। দেশের ফুটবল ইতিহাসে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো করপোরেট দল এত বিজয়ের সান্নিধ্য ভক্ত ও সমর্থকদের উপহার দিতে পারেনি, যা পেরেছে বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। ফুটবলের এই দলটিকে মাঠে আনার পেছনে ক্রীড়াপ্রেমিক আহমেদ আকবর সোবহান, চেয়ারম্যান, বসুন্ধরা গ্রুপের নির্দিষ্ট লক্ষ্য, স্বপ্ন এবং দায়বদ্ধতা আছে। তিনি সময় ও প্রয়োজনীয়তাকে সঠিক সময়ে পড়তে পেরেছেন। তাই তিনি চেয়েছেন বসুন্ধরা গ্রুপ গুড করপোরেট সিটিজেন হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলায় কার্যকর অবদান রাখুক। বিশেষ করে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের সুবর্ণময় অতীত আবার ফিরে আসুক। মানুষ আবার প্রাণের খেলা নিয়ে মেতে উঠুক। ফুটবল মাঠ দর্শকের কলহাস্যে আবার মুখরিত হোক। দেশের ফুটবলের সংস্কৃতি এবং পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হোক। আর এর জন্যই তিনি বৃহত্তর ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসকে নামার সবুজ সংকেত দিয়েছেন। পাশাপাশি চেয়েছেন দেশের ফুটবলের মানোন্নয়নে অন্য অংশীদার সম্পৃক্ত করে লক্ষ্য সাধনের পথে হাঁটতে। বসুন্ধরা গ্রুপে বৃহৎ স্পোর্টস কমপ্লেক্স এবং তাদের আধুনিক কিংস অ্যারেনা এরই মধ্যে শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সাড়া জাগিয়েছে।

২০১৭ সাল থেকে মো. ইমরুল হাসান বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। করপোরেট গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ক্রীড়াপিপাসু এবং ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার ধারক ইমরুল হাসানের দক্ষতা ও সামর্থ্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা নিয়েই গ্রুপ তাঁকে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ইমরুল হাসান তাঁর স্বপ্নকে শুধু নিজের ভেতরে লালন করেননি, তিনি তাঁর স্বপ্ন, প্রত্যয় ও ইচ্ছাশক্তিকে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে স্বপ্নের বন্দরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। একই সঙ্গে গ্রুপের বড় প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বসুন্ধরা কিংসের বড় কৃতিত্ব হলো দলটি খেলার সফলতা এবং আবেদনের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে বসুন্ধরা গ্রুপের করপোরেট ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীড়াঙ্গনজুড়ে নৈতিকতার সংকট চলছে। বিরাজ করছে ক্রীড়াঙ্গনে আদর্শগত শূন্যতা। বিভিন্ন কারণে সংগঠকদের অনেকের ভাবমূর্তি নিম্নমুখী। তাঁদের অনেকেই নিজেদের পায়ের নিচের মাটি হারিয়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য সুশাসন দরকার। জবাবদিহি ছাড়া উন্নয়ন কোনো ক্ষেত্রে কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারবে না।

স্বপ্নচারী ইমরুল হাসানের নিজস্ব একটি জগৎ আছে ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যে। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে সবাইকে সামনে এগিয়ে দিয়ে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে কাজ করতে বিশ্বাসী। তাঁর একটাই কথা আমি নয়আমরা। স্বপ্ন জয় একজনের নয়, সবার। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি সবার। গত বছর অক্টোবরে বাফুফের নির্বাচনে ইমরুল হাসান সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগের টার্মে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত নির্বাচনের আগে মো. ইমরুল হাসান একমাত্র ফুটবল সংগঠক, যিনি নির্বাচনে নামার আগে ফুটবল ৩৬০ নামে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো দিয়েছিলেন ৪৭ পৃষ্ঠার, যা আমাদের ফুটবল অঙ্গনে নজিরবিহীন। এটি দিয়েছেন তিনি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে। তাঁর দর্শন থেকে।

২০২৪ সালটি বসুন্ধরা কিংসের জন্য স্মরণীয়। তারা শুধু পঞ্চমবারের মতো শিরোপা জিতে প্রথম খেলতে নেমে কলকাতা মোহামেডানের রেকর্ডের সমতুল্য হয়নি, পাশাপাশি ঘরোয়া ফুটবলে ট্রেবল জিতেছে। দেশে ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ) ইমরুল হাসানকে দেশের সেরা সংগঠক হিসেবে মনোনীত করে সম্মানিত করেছে। এই সম্মান ছিল তাঁর প্রাপ্য। তাঁর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি। এই সম্মান অন্য সংগঠকদের অনুপ্রাণিত করবে।

যখন ভবিষ্যতে কোনো ক্রীড়া ইতিহাসবিদ বিএসপিএ স্পোর্টস অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ নিয়ে লিখবেন, তাঁর মনে হবে সময়ের সেরা পেশাদারি ও ভিশনারি ক্রীড়া সংগঠক মো. ইমরুল হাসানকে সেরা সংগঠকের পুরস্কারে সম্মানিত করে, তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে শুধু তাঁকে সম্মানিত করা হয়নি, বরং দেশের সবচেয়ে বনেদি ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান বিএসপিএ নিজেও মহিমান্বিত হয়েছে।

মো. ইমরুল হাসান, আপনি দেশের সেরা সংগঠক হিসেবে মনোনীত হওয়ায় ক্রীড়ামোদীমহল ও বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

 

মন্তব্য

বাংলা নববর্ষ উদযাপনে চাই উৎসবের আমেজ ও সৃষ্টিশীলতা

    আবুল কাসেম ফজলুল হক
শেয়ার
বাংলা নববর্ষ উদযাপনে চাই উৎসবের আমেজ ও সৃষ্টিশীলতা

সময় বলে কি কিছু আছে? মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর, শতাব্দী ইত্যাদির ধারণা কী করে মানুষ অর্জন করল? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, জন্মের পর শিশু মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকে শুনে শুনে ভাষা শেখে। তারপর ছাত্র হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে একাধিক ভাষা শেখে। কিন্তু সুদূর অতীতে এমন সময় তো ছিল, যখন কোথাও কারো কোনো ভাষা ছিল না।

সে অবস্থায় কী করে মানুষ ভাষা সৃষ্টি করল? বর্ণমালা ও লেখা সৃষ্টি করল? ভাষা নিয়ে এসব প্রশ্নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী করে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে? মানুষ তার সৃষ্টি সামর্থ্যের বলে সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ভাষা সৃষ্টি করেছে। লিপি কিভাবে সৃষ্টি করেছে? এমনই অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায় না। তবু এসব প্রশ্ন এবং এগুলোর উত্তর সন্ধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
মানুষ কি মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে? মানুষ তো জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজের ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব অর্জন করে।

দিন, মাস, বছর ইত্যাদি গণনার জন্য কোনো কোনো জাতির মধ্যে নিজেদের সন বা সাল আছে। যেমনবাংলা সন, হিজরি সন, খ্রিস্টীয় সন ইত্যাদি। আধুনিক যুগে খ্রিস্টীয় সন বা খ্রিস্টাব্দ সব রাষ্ট্রেই ব্যবহার করা হয়।

তার পরেও দেখা যায়, অনেক রাষ্ট্রে নিজেদের সন-তারিখও রক্ষা করা হয়। যেমনবিপ্লব-উত্তর চীন। চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে তারা খ্রিস্টাব্দই ব্যবহার করে। তাদের নিজেদের সন ধরে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উৎসবাদির মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে। তাদের এই নববর্ষ পালনকে তারা জাতীয় ঐক্য ও ঐতিহ্যের অন্যতম অবলম্বন মনে করে।
পাশ্চাত্য ঐতিহ্য ও সৃষ্টিশীলতা থেকে তারা অনেক কিছু গ্রহণ করে বিচার-বিবেচনার মধ্য দিয়ে। পশ্চিমা জাতিগুলো থেকে যা কিছু তারা গ্রহণ করে, সবই নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য। তাদের নিজেদের নববর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের স্বকীয়তা-সচেতন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-সচেতন থাকতে এবং সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চেষ্টা করে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর অন্ধ অনুসারী তারা হয় না।

বাংলা নববর্ষ উদযাপনে চাই উৎসবের আমেজ ও সৃষ্টিশীলতাবাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে আমাদের উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি কী? আন্তরিকতাহীন উৎসব অনুষ্ঠান দ্বারা কি কোনো জাতির, কোনো রাষ্ট্রের কল্যাণ হয়?

বাংলা সনের উদ্ভব ও তার ব্যবহার নিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন। এতে দেখা যায়, জমিতে ফসল বোনার ও জমি থেকে ফসল তোলার জন্য যে সন-তারিখের প্রয়োজন হয়, তার জন্য সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন উদ্ভাবন ও কার্যকর করা হয়। বাংলা ভাষার ভূভাগে গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হতো। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে এটাও ছিল এক পার্বণ। এ উপলক্ষে বাংলা ভাষার দেশে প্রায় সর্বত্রই মেলা হতো। শিশু-কিশোরদের কাছে নতুন বছরের মেলা খুব আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। বাবা-চাচা, বড় ভাইয়ের সঙ্গে তারা মেলায় যেত। খেলার নানা রকম সরঞ্জাম মেলায় পাওয়া যেত। বাতাসা, নানা রকম খই, নানা রকম মিষ্টি, বাদাম ভাজা, বুট ভাজা, কদমা, জিলাপি ইত্যাদি মেলায় বিক্রি হতো। মেলা থেকে এসব কিনে আনা হতো। বাঁশের তৈরি, কাঠের তৈরি নানা জিনিস মেলায় পাওয়া যেত। কাঠের তৈরি খাট-পালংও মেলায় পাওয়া যেত। এসব কেনা হয়। মেলার আগে ও পরে কয়েক দিনের মধ্যে দোকানে দোকানে সন্ধ্যায় গদিসাইদ (হালখাতা) নামে অনুষ্ঠান করা হতো। দোকানদাররা তাঁদের গ্রাহকদের থেকে বাকি পড়া টাকা উদ্ধার করতেন। ছেলেমেয়েরা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যেত। বাংলা ভাষার দেশে এসবের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো বাংলা নববর্ষে। কিন্তু সবই হচ্ছে শুধু গ্রামাঞ্চলে। শহরে যারা থাকত, তাদের মধ্যে শহুরে বা নাগরিক মনোভাব খুব জোরদার ছিল। গ্রাম্য, গেঁয়ো এসব কথা বলা হতো। গ্রামের লোকদের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব ছিল শহরের লোকদের মধ্যে। পল্লীকবি, নাগরিক কবি ইত্যাদি কথা প্রচলিত ছিল। দেখেছি, কবি জসীমউদ্দীন পল্লীকবি বলে অবজ্ঞাতই হতেন। আর নাগরিক কবি বলে শামসুর রাহমান প্রথম থেকেই সম্মানিত হতেন। এখনো কবি জসীমউদ্দীন কলকাতায় যতটা গুরুত্ব পান, ঢাকায় ততটা গুরুত্ব পান না। আমার ধারণা, জসীমউদ্দীন কবি হিসেবে অনেক বড় ছিলেন এবং কবিতায় সম্পূর্ণ তিনি ছিলেন আধুনিক মনের ও চিন্তার অধিকারী। তিনি আমাদের শীর্ষস্থানীয় কবিদের একজন। তাঁকে পল্লীকবি বলে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে শুধু কবি বলে অধিকতর মর্যাদা দেওয়া উচিত। শরত্চন্দ্রের উপন্যাস ও জসীমউদ্দীনের কাব্য-কবিতা ও গদ্য-রচনাবলি তরুণ পাঠকদের মনে শুভকর প্রভাব ফেলে। এসব বিষয় নানাভাবে বিচার-বিবেচনা করে দেখা উচিত। কবি জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ কিংবা কবি ফররুখ আহমদের সমকক্ষ কোনো কবি কি এখন ঢাকায় কিংবা কলকাতায় আছেন?

আজ বাংলা নববর্ষে আমরা উপলব্ধি করি যে শিল্পকলা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও সৃষ্টিশীলতার দিক দিয়ে আমরা যেন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি।

পৃথিবীতে ২০০ ভাষা আছে, যেগুলোতে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। তুলনামূলক বিবেচনায় গেলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওই ২০০ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান উচ্চতার দিক দিয়ে প্রথম ২০টি ভাষার মধ্যেই থাকবে। এই ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষার উন্নতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উন্নতি সমানুপাতিক। বাংলা ভাষাকে উন্নতিশীল রাখতে পারলেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে আমরা উন্নতি করতে পারব। অন্যথায় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করতে পারব না। আমরা আমাদের ভাষা ও রাষ্ট্রকে উন্নতিশীল রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাই।

সন-তারিখের দিক দিয়ে অবশ্যই যে বাস্তবতায় আমরা আছি, তাতে খ্রিস্টাব্দই আমরা ব্যবহার করব। গ্রামাঞ্চলে বঙ্গাব্দ যতটা ব্যবহৃত হয়, তা আমরা রক্ষা করব। অবস্থার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও প্রগতির ধারা ধরে এগোব। জাতীয় হীনতাবোধ ত্যাগ করে, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস অবলম্বন করে আমরা সাফল্য ও উন্নতির দিকে অগ্রসর হব। যেসব দোষত্রুটি আমাদের জনজীবনে মানুষের মধ্যে আছে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেগুলো ক্রমিক গতিতে দূর করব এবং মনুষ্যত্ব সাধনার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করব। গোটা মানব প্রজাতির কল্যাণেও আমরা কাজ করব। আজকের পৃথিবীতে বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা কী চাই এবং কী চাই না, তা খুব স্পষ্টভাবে আমরা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ করব।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখকে আমরা নববর্ষের দিনরূপে পালন করব আমাদের জাতীয়তাবোধকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার জন্য। আমরা বাংলা সন-তারিখের পরিসর বাড়াতে চাইব না। বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমরা করব উৎসবের মধ্য দিয়ে। এদিনে আমরা আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে আলোচনা করব উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর জাতীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা আমাদের ভবিষ্যেক সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল করব। আমরা পরিকল্পনা ও কর্মনীতি অবলম্বন করে কাজ করব। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে সর্বজনীন কল্যাণে আমরা কাজ করব। বাংলাদেশের অবস্থা ও বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনা করে আমরা গণতন্ত্রের ধারণাকে নবায়িত করব এবং তা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়াসপর থাকব। জাতিসংঘকে আমরা সর্বজনীন কল্যাণে নবায়িত করার জন্য অন্য সব রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে কাজ করব। পৃথিবীকে আমরা যুদ্ধমুক্ত করতে চেষ্টা করব। আমরা চাই জাতিসংঘের পরিচালনায় একটি সেনাবাহিনী রেখে সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করতে। এভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্য নির্ণয় করে কাজ করলে অবশ্যই আমাদের কাজ সফল হবে এবং গোটা মানব প্রজাতি তার দ্বারা উপকৃত হবে।

বাংলাদেশে এখন চিন্তাচর্চা, সৃষ্টিশীলতা ও  উৎপাদনশীলতার নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও সৃষ্টিশীলতার যে ঐতিহ্য বাংলা ভাষার দেশে ছিল এবং আছে, তা আমাদের নতুনভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। নতুন কর্মসূচি ও নতুন কাজের ধারা সৃষ্টি করতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জাগাতে হবে। তারা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ।

 

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সভাপতি, বাংলা একাডেমি

 

মন্তব্য

আমাদের উৎসব, আমাদের ধর্ম

    অদিতি করিম
শেয়ার
আমাদের উৎসব, আমাদের ধর্ম

অবশেষে বদলে গেল মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাল, শোভাযাত্রার নতুন নাম হবে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। নাম বদল নিয়ে কেউ কেউ নানা রকম কথা বলছে, কিন্তু এতে বর্ষবরণ উৎসবের কোনো ছন্দঃপতন হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রধান উৎসব।

বর্ষবরণের আবহে বাঙালিরা উৎসবে মাতে। বাংলাদেশের জনগণের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে পহেলা বৈশাখ একটি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীই বর্ষবরণ উৎসব করে। খ্রিস্টীয় নববর্ষ বিশ্বজুড়ে পালিত হয় উৎসবে।
আরবি নববর্ষ মুসলিম দেশগুলো ঘটা করে পালন করে। কিছু বছর ধরে চীনা নববর্ষ পালিত হচ্ছে বিপুল সমারোহে। জাতিগোষ্ঠীর এই উৎসব আবহমান, স্বতঃস্ফূর্ত। এবার পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং অনভিপ্রেত বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা চলছে, যদিও অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।
পহেলা বৈশাখকে রাজনৈতিক আবরণ থেকে মুক্ত করে জনগণের উৎসবে পরিণত করার যে আয়োজন চলছে, তা প্রশংসার দাবিদার। বিগত সরকার সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্য পহেলা বৈশাখকে ব্যবহার করেছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, পহেলা বৈশাখী উৎসব কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। এটি বাঙালির উৎসব। কিন্তু বিগত সময়ে এই উৎসবকে কুক্ষিগত করা হয়েছে এবং ধর্মবিরোধী উৎসব হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল; যে কারণে ধর্মপ্রাণদের মধ্যে এই ধরনের উৎসব সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত একটি দেশ। এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেমন মুসলমান, তেমনি বাঙালি। আমরা বাঙালি জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের একটি ছিল সব ধর্মের সহাবস্থান। বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’—এই চেতনাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র। বাঙালিরা কখনোই ধর্মীয় উগ্রবাদকে লালন করে না বা ধর্মের নামে হানাহানি, সহিংসতা পছন্দ করে না। এই অঞ্চলের ঐতিহ্য হলো প্রতিটি ধর্মের মানুষ তাদের নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করে। ঈদ উৎসবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা মুসলিম বাড়িতে যায়। সেমাই-পায়েস খায়, উৎসবের আনন্দ মিলেমিশে উদযাপন করে। ঠিক তেমনিভাবে দুর্গাপূজা বা ক্রিসমাসে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টানরাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করে। এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এ দেশের মুসলমানরা কখনোই ধর্মান্ধ নয়। তারা অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা, ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করার সংস্কৃতিকে লালন করে না। কিন্তু গত ১৫ বছর একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে ধর্মহীনতার একটি সংস্কৃতিকে বিকশিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ইসলাম ধর্মকে খাটো করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে জাতির সঙ্গে। এ কারণেই একটি গোষ্ঠী বাঙালির উৎসবকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। এটি কখনোই করা উচিত হবে না। অতীতে যে ভুলগুলো হয়েছে, সেই ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি আমরা না করি, সেটি আমাদের বুঝতে হবে। বাঙালিদের একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনা রয়েছে, কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক চেতনায় কখনোই ধর্ম উপেক্ষিত নয়, বরং ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির একটি সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ধর্মকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি কাজ। এই জায়গা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। কাজেই আমাদের কোনো সংস্কৃতির মধ্যেই ধর্মকে উপেক্ষা করতে পারি না। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ তৈরি করতে পারি না। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি যে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে কোনো কোনো মহল বিভিন্ন রকমের বক্তব্য দিচ্ছে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের প্রধান ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো পহেলা বৈশাখ নিয়ে কোনো নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেনি, বরং একটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ক্ষেত্রে একটি অংশগ্রহণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে এবং সব গোষ্ঠীকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের দুটি উৎসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, অন্যটি মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পাকিস্তান আমলেও হয়েছে। সদ্যঃপ্রয়াত সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসবে একটি বড় অনুষঙ্গ। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে ছায়ানট ছিল সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রেরণা। সেই থেকে এখনো ছায়ানট আমাদের গৌরব। প্রতিবছর ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বর্ষবরণ শুরু করি। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে আমরা দেখলাম রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে দিয়ে সুরের ধারা সৃষ্টি করে ছায়ানটের বিকল্প তৈরির চেষ্টা হলো। বন্যাকে দেওয়া হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সংস্কৃতি বিভাজনের এই চেষ্টা ছিল নিন্দনীয়। এর বিপরীতে নতুন বাংলাদেশে সংস্কৃতির ঐক্য দরকার। বর্ষবরণের এই ভোরের উৎসবে আমরা দেখেছি যে বিভিন্ন গোত্রের, বর্ণের মানুষ সেখানে জড়ো হয়। কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ সেখানে থাকে না। বর্ষবরণ যেমন কোনো ধর্মবিরোধী উৎসব নয়, তেমনি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর উৎসব নয়। এটি সবার আনন্দ উপলক্ষ। সেভাবেই যেন এই উৎসবটি হয়। তাই বর্ষবরণ উৎসবটিকে রাজনীতি এবং সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতেই হবে। আমাদের এই উৎসব এবং আমাদের সংস্কৃতিকে আমাদেরই লালন করতে হবে। এটি আমাদের বাঙালি চেতনার একটি বড় অনুষঙ্গ। ছায়ানটের উৎসবের সঙ্গে কখনোই ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বরং লক্ষ করা যায় যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও এই উৎসবে যোগ দেয়, প্রাণভরে অনুষ্ঠান উপভোগ করে এবং বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।

দ্বিতীয় যে উৎসবটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্ক হচ্ছে, তা হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্বসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এটির মূল উদ্যোক্তা, আয়োজক মূলত চারুকলা বিভাগ। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে নববর্ষের একটি চেতনাকে লালন করা হয়। সেই চেতনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে তরুণ-তরুণীরা বর্ষবরণের উৎসব করে। শোভাযাত্রার উৎসবটি নিয়ে অতীতে কখনোই বিতর্ক লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, সাবেক সরকার সব কিছু দলীয় ও নিজেদের কুক্ষিগত করতে গিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আর এই ব্যবহারের কারণেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে অতীতে কখনো কোনো রাজনৈতিক আবহ আনা হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের অভিপ্রায় অনুযায়ী মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম ঠিক করা হতো। এটি সাবেক সরকারের সমস্যা বা যারা অতি উৎসাহী, চাটুকারদের সমস্যা। এটি মঙ্গল শোভাযাত্রার সমস্যা নয়। এবার যে শোভাযাত্রার মূল বিষয় নির্বাচিত করা হয়েছে, তা অত্যন্ত ভালো। ছায়ানটের উৎসবের সঙ্গে যেমন কোনো ধর্মের বিরোধ নেই, তেমনি আনন্দ শোভাযাত্রার সঙ্গে ধর্মের বিরোধ থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ এটি নতুন বর্ষবরণের একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের উৎসব। তবে বিভিন্ন সময়ে এই উৎসব হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। যেমন নব্বইয়ে স্বৈরাচারীর পতনের পর ওই উৎসব ছিল স্বৈরাচারের পতন উদযাপনের উৎসব, ঠিক তেমনি এবার ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর প্রথম পহেলা বৈশাখ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় উৎসব। কাজেই এই উৎসবকে আমাদের অবগাহন করতেই হবে। আমরা এবার দেখেছি ঈদ উৎসবে এক ধরনের বৈচিত্র্য আনা হয়েছিল। আমাদের পুরনো দিনের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ছিল ঈদ আয়োজনে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কারণ তরুণদের জন্য তিনি ঈদকে উৎসবমুখর করেছিলেন। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে কিছু মহল এর সমালোচনা করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় যে এই সমালোচনা করা উচিত নয়। প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়, তেমনি যেকোনো সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডকে ধর্মের প্রতিপক্ষ বানানো ঠিক নয়। দুটির পাশাপাশি অবস্থান চলবে। সংস্কৃতি ও ধর্ম রেললাইনে দুটি ধারার মতো। আমাদের সংস্কৃতিতে প্রচুর ধর্মীয় উপাদান আমরা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে এই অঞ্চলে ইসলামের জাগরণের পর আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ইসলামের প্রভাব অনস্বীকার্য।

ধর্ম কখনোই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ধর্মকে যারা সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে, তারা আসলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে, যেটি বাংলাদেশ কখনোই নয়। এ দেশের মুসলমানরা যেমন পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে, তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। ধর্ম যার যারএই চেতনায় এই বাঙালি জাতিই বিকশিত হয়েছে, বেড়ে উঠেছে। কাজেই আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি এই দুটি সত্তা গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দুটি সত্তার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রাখতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি যে প্রগতিশীলতা চর্চার নামে ধর্মহীনতার সংস্কৃতিকে উসকে দেওয়া হয়েছে। এটি যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনি ধর্মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করাও অগ্রহণযোগ্য। দুটির মধ্যে আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। আর এই ভারসাম্যই এ দেশের শক্তি, আমাদের ঐতিহ্য।

লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

auditekarim@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ