<p>বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার <img alt="ব্যাংকব্যবস্থা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা" height="420" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p8-2.jpg" style="float:left" width="350" />নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলছে। আগে যেখানে নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছি, পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে বাড়তে এখন ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তার পরও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।</p> <p>বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব মতে, গত নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১.৩৮ শতাংশে। গত চার মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার। শহর, গ্রাম—সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩.৮০ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই হার গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৪.১০ শতাংশে উপনীত হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য অর্থনীতিতে মুদ্রার জোগান কমিয়ে এনে চাহিদা সংকোচনের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলেও এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতের ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সংকট মোকাবেলার জন্য সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা মূলধন সহায়তা দিয়েছে। এর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মূলধন সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু আগে যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান ছিল, সেইসব ব্যাংক নির্দিষ্ট সুদহারে (১৩ শতাংশ) দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মূলধন সহায়তা প্রদান করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছেপে দুর্বল ব্যাংকগুলোর <img alt="ব্যাংকব্যবস্থা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা" height="457" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p8-3.jpg" style="float:left" width="350" />তারল্য সংকট মেটানোর ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এ ধরনের সহায়তার কথাও বলা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে মূলত আমানতকারীদের নিশ্চিত করার জন্য যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থসংকট নেই। তাঁরা চাইলেই তাঁদের প্রয়োজনমতো সঞ্চিত আমানতের অর্থ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারবেন। আর সেটা করা হলে ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে না। মূলত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা প্রদান এবং আমানতকারীদের নিশ্চিত করার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবস্থা নিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা, তাতে এটা ছাড়া গ্রহণযোগ্য তেমন কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো মূল্যেই হোক আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমানতকারীরা যদি তাঁদের চাহিদামতো টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে না পারেন তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাক, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কখনোই তা চাইতে পারে না।</p> <p>এখন প্রশ্ন হলো, যেসব ব্যাংক নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী চলতে পারছে না, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে কত দিন তাদের এভাবে সহায়তা দেবে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর এরই মধ্যে চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো কি ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা করেছে? তারা কি নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে? এসব বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। অথবা তারা কি এমন কোনো সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সাময়িকভাবে তাদের সহায়তা প্রদান করে তাহলে তারা আগামীতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে? অতীতে এসব ব্যাংক দুর্নীতি, অনিয়ম বা অন্য যেসব কারণে দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে, সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে তারা কতটা উদ্যোগী হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যেসব ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তাদের বিভিন্ন তথ্য জনসমক্ষে আনা প্রয়োজন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিগত চার মাসে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কি কমেছে, না বেড়েছে? বিগত চার মাসে তারা কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে, তারা খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা জনগণকে জানানো দরকার। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন কি না? থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা সবাইকে জানানো প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে তারা কতটা উদ্যোগী হয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করলে ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারবে কি না।</p> <p>খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি ব্যাংককে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। সেই সময়ের মধ্যে কোন কোন সূচকে কতটা উন্নতি করতে হবে তা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সূচকে কতটা উন্নতি করতে সক্ষম হলো সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন থাকা দরকার। যেসব ব্যাংক প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারবে না তাদের ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঢালাওভাবে মূলধন সহায়তা দিলে কোনো লাভ হবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে, কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ক্রমাগতভাবে সাহায্যনির্ভর করে রাখা সংগত নয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে অবাধ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কোনো ব্যাংকের অবস্থা যদি এমন হয় যে তারা ভালোভাবে চলতে পারছে না, ভবিষ্যতেও ভালো করবে বলে আশা করা যায় না, তাহলে সেইসব ব্যাংকের যে নিজস্ব সম্পদ আছে তা বিক্রি করে আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।</p> <p>বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এবং প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই মনে হয়। কোনো ব্যাংক যদি নিজস্ব সামর্থ্য বা ক্ষমতাবলে চলতে না পারে তাহলে সেইসব ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়াই উত্তম। একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার অথবা অধিগ্রহণের মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘটানো যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের প্রায় সবই ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই তাদের নিজস্ব সামর্থ্য মোতাবেক টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়ে চলছে তাদের ব্যাপারেও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুস্বাস্থ্য একান্ত প্রয়োজন।</p> <p>এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থার যে দুর্বলতা বিদ্যমান, এটিও কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটা বড় কারণ হিসেবে বিদ্যমান। বর্তমান সময়ে সব পণ্য, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার অত্যন্ত নাজুক। এসব পণ্যের যে মূল্যশৃঙ্খল, এতে যেসব অংশগ্রহণকারী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু কিছু অংশগ্রহণকারী অত্যন্ত ক্ষমতাধর, যাঁরা মূল্যব্যবস্থাকে নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম। এবং তাঁরা সেটাই করছেন অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করার জন্য। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ভোজ্য তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি। একদিকে সরকার আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে তাঁদের সহায়তা করছে, অন্যদিকে তাঁরা বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে ভোক্তা ও সরকারকে জিম্মি করে ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে সক্ষম হবে না।  </p> <p>বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায়, সরকার যদি সার্বিকভাবে চাহিদা ও সরবরাহসহ সব বিষয়ের একটি সঠিক ও সমন্বিত কাঠামোগত নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম না হয় তাহলে বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার সম্ভাবনা সুদূরপরাহতই রয়ে যাবে।</p> <p> </p>