<p>গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০০০ সাল থেকে গড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি, মানব উন্নয়নে লক্ষণীয় অর্জন এবং শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অর্থনীতিতে নিম্ন ভঙ্গুরতা নিশ্চত করতে সহায়ক হয়েছে। এসব অর্জনের ফলে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সুপারিশ অনুযায়ী <img alt="বাংলাদেশ বিনির্মাণে জোর দিতে হবে বাণিজ্য সংযোগে" height="400" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p10-2.jpg" style="float:left" width="350" />বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।</p> <p>চিত্তাকর্ষক সাফল্যের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার বৃহৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ (এসডিজি) অর্জনে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই কিছু এসডিজি লক্ষ্য পূরণের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সঠিক পথে রয়েছে, তবু অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের কয়েক লাখ মানুষ বেকার এবং প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে এবং দারিদ্র্য কমাতে আরো বেশি এবং উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।</p> <p>বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে রপ্তানিনির্ভর ছিল, যা ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ১৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ এখনো তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, যা মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশ। আবার পোশাক খাতের মধ্যেও অল্প কিছু নিম্নমূল্য সংযোজন পণ্যের ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীলতা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ তার রপ্তানি গন্তব্যে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। সীমিত কিছু গন্তব্যের বাইরে অন্যান্য <img alt="বাংলাদেশ বিনির্মাণে জোর দিতে হবে বাণিজ্য সংযোগে" height="545" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p10-3.jpg" style="float:left" width="350" />বৃহৎ ও উদীয়মান দেশ, বিশেষত প্রাচ্যের বাজারে প্রবেশের সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। এটি বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর, বিশেষত ভিয়েতনামের কৌশলের বিপরীত।</p> <p>রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী, উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে উৎপাদনশীল এবং উচ্চমূল্য সংযোজন খাত এবং একই সঙ্গে এগুলোর পশ্চাৎ সংযোগ খাতে স্থানীয় বেসরকারি বিনিয়োগ ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে হবে। এ ছাড়া মানবসম্পদ ও বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নতি করতে হবে, রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে সফলভাবে একীভূত হতে হবে।</p> <p>অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য কমানোর জন্য ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডায় বাণিজ্যকে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাড়তে থাকা বেকারত্বের হার এবং তুলনামূলকভাবে ছোট অভ্যন্তরীণ বাজারের কারণে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজার আরো গভীরভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের  ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান চালক রপ্তানি খাত এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধি এবং অধিকতর কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জনে ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক বাজারে অংশীদারি বাড়াতে বাংলাদেশকে নতুন পণ্যসহ নতুন বাজারে প্রবেশ করতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল বাধা কোথায়</strong></p> <p>ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মূল্যায়ন সম্পর্কিত ২০১৯ সালের সংস্করণে বাংলাদেশ ১৪১টি দেশের মধ্যে ১০৫তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান রপ্তানিতে প্রধান প্রতিযোগী বেশির ভাগ দেশের তুলনায় অনেক নিচে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নির্ভর করে মূলত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনের মাত্রা, কর্মীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমান্তে সহজ প্রক্রিয়া, সহায়ক অবকাঠামো এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর।</p> <p>বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতিতে ভুগছে, যার ফলে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্চমূল্যের এবং জটিল পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। এদিকে ক্রেতাদের কার্বন নিঃসরণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে এবং তারা বেশি দামে উচ্চমানের, টেকসই পণ্য কেনায় অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে টেকসই উৎপাদন ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠবে। বিদেশি প্রযুক্তির কাছে বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের সুবিধার বিষয়টি আর খুব বেশি কাজে লাগবে না। এ কারণে প্রতিযোগীসক্ষম থাকতে ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া ও লিড টাইম বা সরবরাহ সময় কমানো অত্যন্ত জরুরি। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং কাঠামোগত রূপান্তর দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রপ্তানি টেকসই রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবসা পরিবেশ ২০৪১ সাল নাগাদ উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার ভিশনকে সমর্থন করার মতো অবস্থানে নেই। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বৈশ্বিক ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে নিম্ন অবস্থানে রয়েছে। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। বাংলাদেশের ডিস্ট্যান্স টু ফ্রন্টিয়ার (ডিটিএফ) স্কোর ৪০.৯৯, যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড় ৫৩.৬৪-র তুলনায় অনেক কম। বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি কার্যকর করা, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া এবং সম্পত্তি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি, সীমান্ত বাণিজ্য, ঋণপ্রাপ্তি এবং দেউলিয়া সমস্যার সমাধানের মতো ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে।</p> <p>বিশ্বব্যাংকের ‘ট্রেডিং অ্যাক্রস বর্ডার’ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম, যা আফগানিস্তানের চেয়ে মাত্র এক ধাপ ওপরে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড় ১০৯। রপ্তানির সময় সীমান্ত ও ডকুমেন্টের কমপ্লায়েন্সের জন্য বাংলাদেশে গড়ে যথাক্রমে ১৬৮ ও ১৪৭ ঘণ্টা সময় লাগে, দক্ষিণ এশিয়ার যেখানে আঞ্চলিক গড় যথাক্রমে ৫৩.৪ ও ৭৩.৭ ঘণ্টা।</p> <p>বছরের পর বছর বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম অতিরিক্ত সময় ও খরচের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ডকুমেন্ট ও সীমান্ত কমপ্লায়েন্স এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবহন অবকাঠামোর দুর্বলতার সঙ্গে সম্পর্কিত।</p> <p> </p> <p><strong>বাণিজ্য অবকাঠামোতে গুরুত্ব দিতে হবে</strong></p> <p>বাংলাদেশে দুর্বল অবকাঠামো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করেছে। দেশের অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক লজিস্টিক সিস্টেম ব্যবসার খরচ ও সময় উল্লেখযোগ্য অঙ্কে বাড়িয়ে দেয়। ওয়্যারহাউস থেকে বন্দর বা সীমান্তে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে যানজট ও পুলিশ চেকিং এবং বন্দরে পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ে সক্ষমতা ঘাটতি যার অন্যতম কারণ। দুর্বল এই পরিস্থিতি ‘গ্লোবাল কানেক্টিভিটি ইনডেক্স’-এ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২১তম এবং স্কোর মাত্র ৩৪.৪। বিশ্বব্যাংকের ‘লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম (২০২৩)। এ ছাড়া ‘অ্যাজিলিটি ইমার্জিং মার্কেটস লজিস্টিকস ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশ ৫০টি উদীয়মান বাজারের মধ্যে ৩২তম (২০২৪) অবস্থানে রয়েছে। এসব সূচকে নিম্ন অবস্থানের মূল কারণ অবকাঠামোর দুর্বলতা।</p> <p> </p> <p><strong>নতুন ও আধুনিক বন্দর প্রয়োজন</strong></p> <p>ইউএন এসকাপের গবেষণা অনুযায়ী, উন্নত অবকাঠামো ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৩৫.৫ বিলিয়ন ডলারের বাড়তি আয় সৃষ্টি করতে পারে। দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং অব্যাহত সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসা পরিবেশের উন্নতি এবং অবকাঠামো দুর্বলতা দূর করে বাংলাদেশ রপ্তানিতে অনেক বৈচিত্র্য আনতে পারে এবং প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে উচ্চমূল্য সংযোজনের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্রের আশপাশে প্রায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে কয়েকটি বিশেষত বন্দর এলাকার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত কার্যকর করা হোক এবং এগুলোকে ভবিষ্যত্মুখী ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে মানানসই করা হোক, যা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত হিসেবে কাজ করবে।</p> <p>এ ছাড়া বন্দর এবং অন্যান্য বাণিজ্য গেটওয়ের ক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কনটেইনার লোডিং-আনলোডিং এবং তাদের পরিচালনা সামগ্রিক কানেক্টিভিটি বা সংযোগে মূল ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বর্তমান বন্দরব্যবস্থা উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের বাণিজ্যকে সমর্থন দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। দেশের ৯০ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয় এবং বর্তমানে এই বন্দরের জাহাজ থেকে মালপত্র খালাস এবং কনটেইনার ইয়ার্ড থেকে মালপত্র ছাড় করার জন্য সময় এই অঞ্চলের বেশির ভাগ বন্দর থেকে অনেক বেশি, যা খরচ বাড়ায় এবং বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এই পরিস্থিতি একটি উন্নত ও আধুনিক বন্দর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক টার্ন অ্যারাউন্ড ও ক্লিয়ারেন্স সময় নিশ্চিত করার জন্য সেরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রূপকল্প-২০৪১-এর সফল বাস্তবায়নে একটি জোরালো সংকেত দেবে। স্বল্প মেয়াদে বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়াতে প্রযুক্তিগত উন্নতিসহ বন্দরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যোগ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে এবং দীর্ঘ মেয়াদে বন্দরের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং তা টেকসই রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p> </p> <p> </p>