তাঁর রক্ত যেন মহাস্থানগড়ের পরশুরামের সেই জিয়ৎ কুণ্ডের পানির কিংবদন্তির মতো, যে পানির স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেত মৃত মানুষও। কিংবা তাঁকে তুলনা করা যায় জীবনবৃক্ষের সঙ্গেও, যে বৃক্ষটি মানুষসহ দেড় শতাধিক প্রজাতির প্রাণীর প্রাণ ধারণের অনুষঙ্গ। কারণ এক-দুই শ-হাজার কিংবা লাখো নয়, ২.৪ মিলিয়ন মানে ২৪ লাখ শিশুর প্রাণ রক্ষা পেয়েছে তাঁর রক্তের প্লাজমা পেয়ে। বিরল এই কীর্তিমান, সাহসী আর সহৃদয় মানুষটি অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসন।
১৭ ফেব্রুয়ারি নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি নার্সিং হোমে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নিজ দেশে পরিচিত ছিলেন ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম’ হিসেবে।

২০১৮ সালে ১১৭৩তম এবং শেষবারের মতো রক্তদানের সময় জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসন। ছবি : গেটি ইমেজ
কী ছিল তাঁর রক্তে
হ্যারিসনের রক্তে ছিল বিরল একটি অ্যান্টিবডি অ্যান্টি-ডির উপস্থিতি।
এই অ্যান্টি-ডি সেই সব গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, যাঁদের রক্ত গর্ভের সন্তানটির জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন অনাগত শিশুর ভ্রূণ ও নবজাতক শিশুর হেমোলাইটিক রোগ (এইচডিএফএন) নামের প্রাণঘাতী রক্তজনিত ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। মায়ের লোহিত কণিকা অনাগত সন্তানের রক্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এই রোগ হয়ে থাকে। এর ফলে মায়ের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) শিশুর রক্তকণিকাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তা ধ্বংসের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এতে শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে—রক্তস্বল্পতা, হৃদরোগ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত।
অ্যান্টি-ডি চিকিৎসা
এই চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে দুর্লভ এক বস্তু খুঁজে পাওয়ার মতো। অস্ট্রেলিয়ার লাইফব্লাডের গবেষণা পরিচালক ডেভিড আরভিং এটিকে তুলনা করেছেন নাইটদের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত বস্তু ‘হলি গ্রেইল’-এর সঙ্গে। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝিতে অ্যান্টি-ডি চিকিৎসা চালু হওয়ার আগে এইচডিএফএনে আক্রান্ত প্রতি দুই শিশুর একজনের মৃত্যু ঘটত। লাইফব্লাড বর্তমানে কাজ করছে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার ও এলিজা হল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল রিসার্চের সঙ্গে, যেখানে হ্যারিসন ও তাঁর মতো অন্যান্য দাতার রক্ত ও ইমিউন কোষ থেকে অ্যান্টি-ডি অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
কী আর কেমন করে এলো
১৯৫১ সালে ১৪ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রে সমস্যা ধরা পড়ে হ্যারিসনের। দরকার হয় বড় অস্ত্রোপচার। এ সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এই রক্ত নিতে গিয়েই পণ করেন রক্ত দিয়েই রক্তঋণ শোধ করবেন। এ জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি রক্তদান শুরু করেন। প্রথম কয়েকবার রক্ত দেওয়ার পরই ধরা পড়ে তাঁর রক্তে ডি-আরএইচ গ্রুপ অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী এবং স্থায়ী অ্যান্টিবডি রয়েছে, যা আরএইচ-ডি পজিটিভ শিশু এবং আরএইচ-ডি নেগেটিভ মায়ের ক্ষেত্রে সৃষ্ট নবজাতকের হোমলাইটিক রোগ (এইচডিএন) প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৪ বছর বয়সে প্রচুর রক্ত নেওয়ার ফলে এটি হতে পারে।
রক্তদানে তাঁর অবদান
১৯৬৯ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস আরএইচ প্রগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা দাতাদের একজন ছিলেন তিনি। এর পর থেকে ক্রমাগত রক্ত দিয়ে আসছেন। সম্পূর্ণ রক্তের বদলে শুধু প্লাজমা দান করলে দুই সপ্তাহ পর পর দান করা যায়। তিনি তা-ই করতেন, যার ফলে ২০১১ সালের মে মাসে ১০০০তম রক্তদান সম্পন্ন হয়। এটির জন্য তাঁকে ৫৭ বছর ধরে গড়ে তিন সপ্তাহে একবার প্লাজমা দান করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ মে ৮১ বছরের বাধা মেনে ১১৭৩তম এবং শেষবারের মতো রক্তদান সম্পন্ন করেন হ্যারিসন। অস্ট্রেলিয়ায় ৮১ বছরের পর রক্তদান নিষিদ্ধ। হ্যারিসনের অনুদানের মাধ্যমে নিউ সাউথ ওয়েলস আরএইচ প্রগ্রামের সদস্যরা লাখ লাখ ডোজ অ্যান্টি-ডি সরবরাহ করে হাজার হাজার মৃত্যু এবং মৃত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করতে সাহায্য করেছেন। সেই সঙ্গে এইচডিএনের কারণে অসুস্থতা ও অক্ষমতার আরো অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করেছেন। ৭ জুন ১৯৯৯ সালে হ্যারিসনকে অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া (ওএএম) পদক প্রদান করা হয়।
রক্ষা পেয়েছে নিজের নাতনিও
হ্যারিসনের দুই নাতি-নাতনিও অ্যান্টি-ডি ইমিউনাইজেশনের সুবিধাভোগী। হ্যারিসনের মেয়ে ট্রেসি মেলোশিপ বাবার রক্তদান সম্পর্কে বলেন, ‘বাবা কোনো প্রতিদান বা কষ্টের চিন্তা না করেই এতগুলো জীবন বাঁচাতে পেরে গর্বিত ছিলেন। বাবা আমাদের মতো অনেক পরিবারের গল্প শুনে খুশি হতেন, যারা তাঁর উদারতার কারণে টিকে আছে।’
তাঁর ছিল আশা
বলা হয়ে থাকে, মহৎ জীবন এগিয়ে চলে নিশানা রেখে। জিয়ৎ কুণ্ডই বলি আর জীবনবৃক্ষ—পৃথিবীর সব জীবনপ্রদীপই একদিন নিভে যাবে। অসংখ্য প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে ৮৮ বছরে নিভে গেলেন হ্যারিসন নিজে। তাঁর গড়া রেকর্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আশা করি, এই রেকর্ড ভাঙবে। কারণ যদি এটি হয়, তাহলে তারা এক হাজারবার রক্ত দান করেছে।’
তথ্যসূত্র : বিবিসি, দি বিজনেস স্টেনডার