তাঁর রক্তে বেঁচেছে ২৪ লাখ প্রাণ

  • মহৎ জীবন এগিয়ে চলে নিশানা রেখে—কথাটি বোধ হয় জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসনের বেলায় শতভাগ খাটে। হ্যারিসনের রক্তে ছিল বিরল একটি অ্যান্টিবডি অ্যান্টি-ডির উপস্থিতি। ২৪ লাখ শিশুর প্রাণ বেঁচেছে তাঁর রক্তের প্লাজমায়। ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম’ হিসেবে খ্যাত অস্ট্রেলিয়ার এই কীর্তিমানকে নিয়ে লিখেছেন মাসুম সায়ীদ
শেয়ার
তাঁর রক্তে বেঁচেছে ২৪ লাখ প্রাণ
এমন লাখো শিশুর মাঝে বেঁচে থাকবেন জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসন

তাঁর রক্ত যেন মহাস্থানগড়ের পরশুরামের সেই জিয়ৎ কুণ্ডের পানির কিংবদন্তির মতো, যে পানির স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেত মৃত মানুষও। কিংবা তাঁকে তুলনা করা যায় জীবনবৃক্ষের সঙ্গেও, যে বৃক্ষটি মানুষসহ দেড় শতাধিক প্রজাতির প্রাণীর প্রাণ ধারণের অনুষঙ্গ। কারণ এক-দুই শ-হাজার কিংবা লাখো নয়, ২.৪ মিলিয়ন মানে ২৪ লাখ শিশুর প্রাণ রক্ষা পেয়েছে তাঁর রক্তের প্লাজমা পেয়ে। বিরল এই কীর্তিমান, সাহসী আর সহৃদয় মানুষটি অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসন।

১৭ ফেব্রুয়ারি নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি নার্সিং হোমে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নিজ দেশে পরিচিত ছিলেন ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম’ হিসেবে।

তাঁর রক্তে বেঁচেছে ২৪ লাখ প্রাণ

২০১৮ সালে ১১৭৩তম এবং শেষবারের মতো রক্তদানের সময় জেমস ক্রিস্টেফার হ্যারিসন।    ছবি : গেটি ইমেজ

কী ছিল তাঁর রক্তে

হ্যারিসনের রক্তে ছিল বিরল একটি অ্যান্টিবডি অ্যান্টি-ডির উপস্থিতি।

এই অ্যান্টি-ডি সেই সব গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, যাঁদের রক্ত গর্ভের সন্তানটির জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন অনাগত শিশুর ভ্রূণ ও নবজাতক শিশুর হেমোলাইটিক রোগ (এইচডিএফএন) নামের প্রাণঘাতী রক্তজনিত ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। মায়ের লোহিত কণিকা অনাগত সন্তানের রক্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এই রোগ হয়ে থাকে। এর ফলে মায়ের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) শিশুর রক্তকণিকাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তা ধ্বংসের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
এতে শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে—রক্তস্বল্পতা, হৃদরোগ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত।

 

অ্যান্টি-ডি চিকিৎসা

এই চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে দুর্লভ এক বস্তু খুঁজে পাওয়ার মতো। অস্ট্রেলিয়ার লাইফব্লাডের গবেষণা পরিচালক ডেভিড আরভিং এটিকে তুলনা করেছেন নাইটদের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত বস্তু ‘হলি গ্রেইল’-এর সঙ্গে। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝিতে অ্যান্টি-ডি চিকিৎসা চালু হওয়ার আগে এইচডিএফএনে আক্রান্ত প্রতি দুই শিশুর একজনের মৃত্যু ঘটত। লাইফব্লাড বর্তমানে কাজ করছে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার ও এলিজা হল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল রিসার্চের সঙ্গে, যেখানে হ্যারিসন ও তাঁর মতো অন্যান্য দাতার রক্ত ও ইমিউন কোষ থেকে অ্যান্টি-ডি অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

 

কী আর কেমন করে এলো

১৯৫১ সালে ১৪ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রে সমস্যা ধরা পড়ে হ্যারিসনের। দরকার হয় বড় অস্ত্রোপচার। এ সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এই রক্ত নিতে গিয়েই পণ করেন রক্ত দিয়েই রক্তঋণ শোধ করবেন। এ জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি রক্তদান শুরু করেন। প্রথম কয়েকবার রক্ত দেওয়ার পরই ধরা পড়ে তাঁর রক্তে ডি-আরএইচ গ্রুপ অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী এবং স্থায়ী অ্যান্টিবডি রয়েছে, যা আরএইচ-ডি পজিটিভ শিশু এবং আরএইচ-ডি নেগেটিভ মায়ের ক্ষেত্রে সৃষ্ট নবজাতকের হোমলাইটিক রোগ (এইচডিএন) প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৪ বছর বয়সে প্রচুর রক্ত নেওয়ার ফলে এটি হতে পারে।

 

রক্তদানে তাঁর অবদান

১৯৬৯ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস আরএইচ প্রগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা দাতাদের একজন ছিলেন তিনি। এর পর থেকে ক্রমাগত রক্ত দিয়ে আসছেন। সম্পূর্ণ রক্তের বদলে শুধু প্লাজমা দান করলে দুই সপ্তাহ পর পর দান করা যায়। তিনি তা-ই করতেন, যার ফলে ২০১১ সালের মে মাসে ১০০০তম রক্তদান সম্পন্ন হয়। এটির জন্য তাঁকে ৫৭ বছর ধরে গড়ে তিন সপ্তাহে একবার প্লাজমা দান করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ মে ৮১ বছরের বাধা মেনে ১১৭৩তম এবং শেষবারের মতো রক্তদান সম্পন্ন করেন হ্যারিসন। অস্ট্রেলিয়ায় ৮১ বছরের পর রক্তদান নিষিদ্ধ। হ্যারিসনের অনুদানের মাধ্যমে নিউ সাউথ ওয়েলস আরএইচ প্রগ্রামের সদস্যরা লাখ লাখ ডোজ অ্যান্টি-ডি সরবরাহ করে হাজার হাজার মৃত্যু এবং মৃত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করতে সাহায্য করেছেন। সেই সঙ্গে এইচডিএনের কারণে অসুস্থতা ও অক্ষমতার আরো অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করেছেন। ৭ জুন ১৯৯৯ সালে হ্যারিসনকে অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া (ওএএম) পদক প্রদান করা হয়।

 

রক্ষা পেয়েছে নিজের নাতনিও

হ্যারিসনের দুই নাতি-নাতনিও অ্যান্টি-ডি ইমিউনাইজেশনের সুবিধাভোগী। হ্যারিসনের মেয়ে ট্রেসি মেলোশিপ বাবার রক্তদান সম্পর্কে বলেন, ‘বাবা কোনো প্রতিদান বা কষ্টের চিন্তা না করেই এতগুলো জীবন বাঁচাতে পেরে গর্বিত ছিলেন। বাবা আমাদের মতো অনেক পরিবারের গল্প শুনে খুশি হতেন, যারা তাঁর উদারতার কারণে টিকে আছে।’

 

তাঁর ছিল আশা

বলা হয়ে থাকে, মহৎ জীবন এগিয়ে চলে নিশানা রেখে। জিয়ৎ কুণ্ডই বলি আর জীবনবৃক্ষ—পৃথিবীর সব জীবনপ্রদীপই একদিন নিভে যাবে। অসংখ্য প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে ৮৮ বছরে নিভে গেলেন হ্যারিসন নিজে। তাঁর গড়া রেকর্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আশা করি, এই রেকর্ড ভাঙবে। কারণ যদি এটি হয়, তাহলে তারা এক হাজারবার রক্ত দান করেছে।’

তথ্যসূত্র : বিবিসি, দি বিজনেস স্টেনডার

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

[ দিনগুলি মোর ]

অনু কি তাকে ভালোবাসবে?

শেয়ার
অনু কি তাকে ভালোবাসবে?
অলংকরণ : তানভীর মালেক

লিস্ট ধরে ধরে সব ব্যাগ চেক করে নিচ্ছে অনু। এটিই ডরমিটরিতে তার শেষ রাত। কাল সকালেই লুটনের বাস। ইরাসমাস স্কলারশিপ পেয়ে ইউনিভার্সিটি অব বেডফোর্ডশায়ারে মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে সে।

অজানা ভয়, উত্তেজনায় হাজারটা চিন্তা মাথায় আসছে। এই সময় তন্ময়কে বেশ মনে পড়ছে। যোগাযোগ থাকলে হয়তো কোনো না কোনোভাবে হেল্প করত। তবে আসার আগেই একটি রুম বুকড করেছে।
থাকার সমস্যা নেই। তবু তন্ময়ের শহর লুটন, এই উত্তেজনায় মাথা থেকে সব বের হয়ে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে ভার্সিটির ফর্মালিটি শেষ করে রুমে ফিরেছে। ক্লাস শুরু হতে এক সপ্তাহ বাকি।

সময়টা কিভাবে কাটাবে সেই প্ল্যান করছে অনু। তন্ময় ইউনিভার্সিটি অব বেডফোর্ডশায়ারের লেকচারার। পয়েন্ট ২৫ বেসিসে পড়ায়। এখন ওর সামার ভ্যাকেশন চলছে। আগস্ট থেকেই আবার ক্লাস, সেমিনার, কনফারেন্স, থিসিস সুপারভিশন শুরু।

দেখতে দেখতে দুই মাস অতিবাহিত। অনু ক্যাম্পাসের গার্ডেনে বসে বই পড়ছে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটু দূরে, ওই মানুষটা কে তন্ময় না? হ্যাঁ তন্ময়ই তো, লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে।

অনু চাইলেও চোখ ফেরাতে পারল না। কেমন আছে তন্ময়? বিয়ে করেছে? এখানে কী করছে? কারো সঙ্গে প্রেম করছে? একটানা অনেকগুলো প্রশ্ন মনে নড়াচড়া শুরু করল। এই চার বছরে যে অভিমান বুকের মধ্যে জমা করে রেখেছে, তার পুরোটাই তন্ময়ের জন্য।

তন্ময় ক্লাস নিয়ে বাসায় ফিরছে। হঠাৎই ভীষণ চমকে গেল। ও কে, অনু?

সেই অনু, যাকে প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখে। মুহূর্তও যাকে ভুলে থাকা যায়নি। কিন্তু তন্ময় যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেনি, খোঁজও নেয়নি ইচ্ছা করে।

অনু আর তার আলাদা পৃথিবী, দুজনে কখনো এক হতে পারবে না স্বাভাবিকভাবে। তন্ময়ের বাবা বেঁচে নেই। মা-ই তাকে মানুষ করেছেন। মা সব সময় চাইতেন বোকাসোকা সুন্দরী একটি মেয়ে তাঁর ছেলের বউ হোক। কিন্তু অনু বেশ বুদ্ধিমতী, সুন্দরী। যে কেউই অনুর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়বে।

সামনাসামনি হতেই তন্ময় হাসল। অনু চোখ নামিয়ে না নিলেও অন্যদিকে তাকাল। তন্ময়ের মনে অনেক প্রশ্ন আসে, হয়তো ইংল্যান্ডের আবহাওয়া অনুর মন থেকে তন্ময়কে মুছে দিয়েছে।

—অনু, তুমি এখানে?

—এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আপনি?

—ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে আছি।

—ও আচ্ছা আচ্ছা। আমার এখনই ক্লাস শুরু হবে, আসছি।

তন্ময় ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে অনুর যাওয়ার পথে। তন্ময়ের প্রথম অনুভূতি অনু...কিছুতেই ভুলতে পারছে না সেই সময়গুলো। এখন আফসোস হচ্ছে। অনু কি কখনো তাকে ভালোবাসবে?

 

ফাতেমা সুলতানা

ইংরেজি বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ

মন্তব্য

মায়ের নামে ছেলের পাঠাগার

    নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের শাহেদা স্মৃতি পাঠাগার। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ এই পাঠাগার আলো ছড়াচ্ছে গ্রামবাসীর মাঝে। লিখেছেন মো. হারুন মিয়া
শেয়ার
মায়ের নামে ছেলের পাঠাগার
শাহেদা স্মৃতি পাঠাগারে নিয়মিত পড়তে আসে শিক্ষার্থীরা। ছবি : লেখক

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন আনসার উদ্দিন খান পাঠান। স্নাতক সম্পন্ন করে ১৯৮৯ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। ২০২২ সালে অবসরে যান তিনি। এখন গ্রামেই থাকেন।

গ্রামবাসীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে পাঁচ শতাধিক বই নিয়ে ২০১১ সালে বসতবাড়ির পাশেই চালু করেন পাঠাগার। মায়ের নামে নাম দেন শাহেদা স্মৃতি পাঠাগার। ২০১৯ সালে পাঠাগারটির জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করেন। যে কেউ ইচ্ছা করলেই গ্রামের মেঠোপথ ধরে সহজে পাঠাগারে প্রবেশ করতে পারে।
পাঠাগারে সদস্য এখন পাঁচ শতাধিক। বই আছে পাঁচ হাজারের বেশি। নিয়মিত রাখা হয় কয়েকটি জাতীয় সংবাদপত্র। ৪০ জন একসঙ্গে বসে পড়তে পারে।
আছে নিরাপদ পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থাও। পাঠাগারটির দেয়ালে টাঙানো নেত্রকোনার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি। লাইব্রেরিয়ান লেনিন খান পাঠান জানালেন, দৈনিক গড়ে ৩০ জন পাঠকের সমাগম হয়। গ্রামের মানুষ বই বাসায় নিয়েও পড়তে পারে। জাতীয় দিবসগুলোতে আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়।
সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি চাকরিপ্রত্যাশীরা পাঠাগারে আসেন চাকরি সহায়ক বই পড়তে। তাঁদের একজন মো. সারোয়ার হোসেন। ৪০তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। এখন নাটোরের গুরুদাসপুরে বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের প্রভাষক। তিনি বলেন, ‘চাকরির প্রস্তুতিমূলক বই কেনার মতো অবস্থা ছিল না আমার। সাইকেলে গৌরীপুরের কাউরাট থেকে নিয়মিত এই পাঠাগারে পড়তে আসতাম।’

আনসার উদ্দিন খান পাঠান বলেন, ‘পাঠাগারটিতে সৃজনশীল অনেক বই আছে। চাকরিপ্রত্যাশীদের কথা ভেবে চাকরি সহায়ক বইও রেখেছি। ভবিষ্যতে এর পরিসর আরো বাড়বে।’

 

মন্তব্য

আলান এখন টেসলায়

    ঢাকার নাখালপাড়া থেকে আলান কবির এখন টেসলার এরিয়া পার্টস ম্যানেজার, সুইডেনে কর্মরত। তাঁর টেসলাযাত্রার গল্প শুনেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম
শেয়ার
আলান এখন টেসলায়
সুইডেনে টেসলার ১২টি অফিসে ২৫ জন পার্টস অ্যাডভাইজার কর্মরত। তাদের ম্যানেজার আলান কবির। ছবি : সংগৃহীত

বাবা শিক্ষক। মা গৃহিণী। ছেলেবেলা থেকেই ইচ্ছা প্রকৌশলী হব। পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা সব সময় চাপে রাখতেন।

কখনো রেজাল্ট খারাপ হলে বাসায় রীতিমতো মিটিং বসাতেন। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সাহিত্যের বইও পড়তাম। নাখালপাড়া হোসাইন আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন থেকেই ভর্তি হলাম বুটেক্সে (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত কলেজ) অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে।
৩.২০ সিজিপিএ নিয়ে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি।

 

দেশ-বিদেশে চাকরি

পেশাজীবন শুরু হয় নরসিংদীতে থার্মেক্স গ্রুপে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ডিউটি। রাতবিরাতেও কাজ করতে হতো।

দুই বছরে টেক্সটাইলসংক্রান্ত সাপ্লাই চেইনের প্রক্রিয়াটি এখানে রপ্ত করি। এরপর ইপিলিয়ন গ্রুপে হেড অব প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পদে যোগদান করি। বছর দুয়েকের মাথায় বনানীতে সুইডিশ বায়িং হাউস কাপএলে (KappAhL) চলে আসি। ফ্যাক্টরি থেকে বায়িং হাউসের কাজের ধরন আলাদা। এরই মধ্যে ২০১৫ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম অ্যাক্সিকিউটিভ এমবিএতে।
এখানে পড়তে অ্যাক্সিকিউটিভ হিসেবে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এমবিএ শেষে গুলশানে এইচ অ্যান্ড এম পোশাক কম্পানিতে চাকরি নিলাম। এখানে বিভিন্ন দেশের সহকর্মীদের সান্নিধ্যে প্রায় দুই বছর কাটাই। এরপর হামস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সুইডেনে গেলাম। এটি ছিল সেকেন্ড মাস্টার্স। সুইডেনে এসে জিমের ম্যাটেরিয়াল ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি ‘এলাইকো (Eleiko)’তে কাজ নিলাম। প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে সাত বছর ছিলাম।

তত দিনে বিভিন্ন বিষয়ে শতাধিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কোর্স করেছি প্রায় ৪০টি। ধারাবাহিকভাবে শেখার মধ্যে থেকেছি। একসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজারের লাইসেন্স পেলাম। ফলে ‘প্রজেক্ট ম্যানেজার’ হিসেবে আমেরিকান কম্পানিতে বছরখানেক ভলান্টিয়ার হিসেবে রিমোট জব করি।

 

সবখানেই প্রত্যাখ্যাত হই

বেশ কয়েকটি কম্পানিতে চাকরি করেছি। তবে টেসলায় চাকরির কথা কখনো ভাবিনি। ২০২১ সালে টেসলার গাড়ি কিনি। এটি আমার আগের সাতটি গাড়ি থেকে ভিন্ন। কনফিগারেশন দারুণ। তখনই একদিন আমার স্ত্রী সুইটি টেসলায় চাকরির কথা বলে। টেসলায় চাকরি পেলে সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে। তবু সুইটির অনুরোধে টেসলার ক্যালিফোর্নিয়া ব্রাঞ্চে ৪০টি পজিশনে আবেদন করলাম। সবখানেই প্রত্যাখ্যাত হলাম! পরে এইচআরের মেইল, ‘তোমার প্রফাইল ভালো। টেসলা আমেরিকার জন্য কোনো ওয়ার্ক পারমিট দেয় না। চাকরি করতে চাইলে আমেরিকায় এসে আবেদন করতে হবে।’

 

যেভাবে টেসলায়

কয়েক দিন বাদে টেসলা থেকে ফিরতি মেইল। সুইডেনের জন্য একজন ‘এরিয়া ম্যানেজার’ নেবে। ন্যাড়া কয়বার বেলতলায় যায়? তাই শুরুতে আগ্রহ দেখাইনি। তবে সুইটির চাপে ২০২৪ সালে আবেদন করলাম। দীর্ঘ আট মাস পর টেসলা থেকে মেইল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি ফরম পূরণ করে দিতে হবে। এবারও আগ্রহ জন্মাল না। কারণ টেসলায় জব পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিছু ইন্টারভিউ ইলন মাস্ক নিজেই নিয়ে থাকেন। পরদিনই এইচআর ফোনে ফরম পূরণ নিয়ে আলাপ করলেন। সত্যতা যাচাইয়ের পর এক দিনের মাথায় ইন্টারভিউয়ে বসতে হয়। এখানে আমার ব্যক্তিত্ব, মনমানসিকতা, ব্যবহার, বিগত চাকরি—এসব বিষয়ে ঘণ্টাখানেক কথা হয়। কয়েক দিন বাদে এইচআরের মেইল। তখন অফিসের মিটিংয়ে। এসএমএসে জানালাম, ‘তোমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই, ইন্টারভিউ ভালো হয়নি। মেইলে জানিয়ে দিলেই হবে।’ এইচআরের ফিরতি মেসেজ, ‘ইন্টারভিউয়ের পরের ধাপ নিয়ে কথা বলব।’ পরের সপ্তাহে ৩০ মিনিটের সিলেকশন রাউন্ডের প্রথম ইন্টারভিউয়ে বসতে হয়। ছয়জন বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। ইন্টারভিউয়ের চার দিন পরও সাড়া পেলাম না। সুইটিকে বলছিলাম, ‘আমাকে মনে হয় বাদ যাওয়ার তালিকায় রেখেছে।’ সপ্তাহখানেক পর এইচআরের ফোন, ‘তোমাকে সেকেন্ড সিলেকশন রাউন্ডের জন্য ইন্টারভিউয়ে বসতে হবে।’ এই রাউন্ডে উতরানোর পর জানানো হলো, ‘ফাইনাল রাউন্ডের পর তোমার আইডেন্টিটি ভেরিফাই করা হবে। তারপর অফার।’ ফাইনালে আমাকে একটি সমস্যার (কেস) ওপর প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। এক ঘণ্টার ইন্টারভিউ। ৪৫ মিনিট পর রিক্রুটার ম্যানেজার থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমার ইন্টারভিউ শেষ। আমরা বিদায় নিচ্ছি। এইচআর যোগাযোগ করবে।’

ইন্টারভিউ শেষ না হতে থামিয়ে দেওয়ায় হতাশা বাড়ল। তবে কিছুদিন বাদে এইচআর ডকুমেন্ট ভেরিভিকেশনের জন্য ফরম পূরণ করতে বলেন। ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর টেসলা থেকে ফোন, ‘আলান, ইউ হ্যাভ বিন সিলেক্টেড ফর দ্য পজিশন অলরেডি।’ খবরটি সুইটিকে জানাই। তার চোখে জল। মা-বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন।

 

টেসলায় কী কাজ

সুইডেনের গোথেনবার্গ শাখায় ‘এরিয়া পার্টস ম্যানেজার’ হিসেবে যোগদান করি এ বছরের জানুয়ারিতে। সুইডেনে টেসলার ১২টি অফিসে প্রায় ২৫ জন পার্টস অ্যাডভাইজার। গাড়ির বিভিন্ন পার্টস সার্ভিসিং এবং কাস্টমারকে ডেলিভারি করার প্রক্রিয়ায় যেসব পার্টস অ্যাডভাইজার কাজ করেন, আমি তাঁদের ম্যানেজার। অফিস গোথেনবার্গে হলেও দেশে দেশে ভ্রমণ করতে হয়। গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতে চোখ রাখতে হয়। সার্ভিস টিমের সঙ্গে ব্যস্ততা থাকে। টেসলার মিশন অর্জনের জন্য টিমকে ট্রেনিং এবং ডেভেলপমেন্টের মধ্যে রাখতে হয়। টেসলায় থেকে বিশ্বের বড় বড় ও মেধাবী প্রকৌশলীদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বের সর্বশেষ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অচিরেই ইলন মাস্কের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে চাই। টেসলার জার্মানি, চীন ও টেক্সাসের গিগাফ্যাক্টরিগুলো ঘুরে দেখব। ভবিষ্যতে আমার কাজের অভিজ্ঞতা দেশের তরুণদের জানাতে চাই।

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
[ প্রাণ প্রকৃতি ]

ও মেঘকুমারী

    শরীফ তানভীর আহম্মেদ
শেয়ার
ও মেঘকুমারী
মেঘকুমারীকে বলা হয় বনের নীরব সৌন্দর্যের দূত। ছবি : লেখক

গবেষণাকাজে গিয়েছিলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। খুব ভোরে বেরিয়েছিলাম প্রকৃতির রূপ দেখতে। শিশির ভেজা সকাল। ভোরের মিষ্টি আলো উঁকিঝুঁকি মারছে।

হঠাৎ উদ্যানের ঘন সবুজ বনে দেখা মিলল অপরূপ এক প্রজাপতির। দেখতেও যেমন, নামটিও তেমন সুন্দর—মেঘকুমারী। বৈজ্ঞানিক নাম Parthenos sylvia, দ্য ক্লিপার নামেও পরিচিত এটি। বাংলাদেশে এই প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পাওয়া অত্যন্ত বিরল ঘটনা।
বনায়ন ধ্বংস, কৃষিতে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহারসহ নানা কারণে প্রজাপতির এ ধরনটি বিলুপ্তির পথে। সাধারণত সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু ঝরনা বা ছড়ার কাছাকাছি জায়গায় এখনো কালেভদ্রে এদের দেখা মেলে। অনেক সময় ভেজা মাটিতে নেমে আসে তারা। ডানা মেলে রোদ পোহায়।
মেঘকুমারী প্রজাপতি মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অধিবাসী। এদের ছড়ানো ডানার মাপ ৯৫ থেকে ১০৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। সামনের ডানাটি লম্বাটে ও ত্রিকোণাকৃতির। ডানার রং ওপরের দিকে উজ্জ্বল সবুজ, তার ওপর সাদা ও নীল রঙের আকর্ষণীয় দাগ দেখা যায়। এই প্রজাতির প্রজাপতির ডানার নকশা অনেকটাই বুনো মেঘের মতো।
তা থেকেই হয়তো বাংলায় মেঘকুমারী নামটি এসেছে। ডানার তীক্ষ প্রান্তগুলো বাতাসে ওড়ার সময় ক্লিপারের মতো দ্রুতগতিতে ছুটে চলার ইঙ্গিত দেয়।

অন্যান্য প্রজাপতির মতো মেঘকুমারীর জীবনচক্র ও চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়—ডিম, শূককীট (লার্ভা), পিউপা (কোকুন) এবং পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি। মেঘকুমারী সাধারণত বর্ষাকালে ডিম পাড়ে। লাউয়াছড়ার মতো উষ্ণ এবং আর্দ্র পরিবেশ এদের জন্য আদর্শ। এরা প্রাথমিকভাবে ফুলের মধু পান করে। গাছের পাকা ফলের রসও এদের পছন্দ।

মেঘকুমারী প্রজাপতি শুধু পরিবেশের সৌন্দর্য বাড়ায় না, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপকও। মেঘকুমারীর উপস্থিতি একটি স্বাস্থ্যকর এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা বাস্তুতন্ত্রের পরিচায়ক। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যাপ্ত গবেষণা ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করলে এই প্রজাতিসহ অন্যান্য প্রজাপতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁচাতে হবে বনের নীরব সৌন্দর্যের এই দূতকে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ