কারণ ছাড়াই বেড়েছে চালের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
কারণ ছাড়াই বেড়েছে চালের দাম
ফাইল ছবি

কোনো কারণ ছাড়াই দেড় মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে কয়েক দফা চালের দাম বেড়েছে। নতুন করে চিকন ও মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে। তবে দাম বৃদ্ধি বাজারভেদে কিছুটা কম বেশি লক্ষ করা গেছে। কোথাও কোথাও কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা, আবার কোথাও তিন-চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁও কলমিলতা, ঠাটারীবাজার ও কুড়িল বিশ্বরোডের মুক্তিযোদ্ধা কেবি বাজার ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। 

বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে কুড়িলে। এই বাজারটিতে মাঝারি ও চিকন জাতের চাল কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কলমিলতা ও ঠাটারীবাজারে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির পরিমাণ বাড়লে দাম কমে আসবে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় প্রতি কেজি মিনিকেট (চিকন) চাল মানভেদে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়, ব্রি-২৮ কেজি ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় এবং নাজিরশাইল মানভেদে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধা কেবি বাজারের মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘গত এক-দেড় মাসে বাজারে দফায় দফায় চালের দাম বেড়েছে। নতুন করে চিকন ও মাঝারি মানের চাল কেজিতে পাঁচ থেকে সাত টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

কলমিলতা বাজারের শহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের বাজারে চালের দাম অন্য বাজারের চেয়ে কিছুটা কম। গড়ে কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। তা ছাড়া চালের আড়ত থেকে বলা হচ্ছে, নতুন করে চাল নিতে হলে দাম বেশি দিতে হবে।’

ঠাটারীবাজারের তরিকুল ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী হাজি মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে চাল আমদানি বাড়লে দাম কমতে পারে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বিনিয়োগ করে অসহায় ব্যবসায়ীরা

ফারুক মেহেদী
ফারুক মেহেদী
শেয়ার
বিনিয়োগ করে অসহায় ব্যবসায়ীরা

দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান করে, অর্থনীতির চাকা সচল রেখেও এখন সবচেয়ে অসহায় দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ধারদেনা করে কিংবা সারা জীবনের সব পুঁজি ব্যবসা বা শিল্পে খাটিয়ে, সেখানকার আয়ের একটি বড় অংশ সরকারকে কর দিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না তাঁদের। নানান ছুতায় সব সরকারের সময়ই ‘শিকার’ বানানো হয় ব্যবসায়ীদের। যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, ব্যবসাকে জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থে তাঁদের ব্যবহার করে।

প্রয়োজন ফুরালে মামলা-হামলাসহ নানান ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে জেল-জরিমানা আর হয়রানিতে জীবন বিষিয়ে তোলে। ওয়ান-ইলেভেন, নির্দলীয় অথবা রাজনৈতিক—সব সরকারই ব্যবসায়ীদের দেখে সন্দেহের চোখে। যতই ‘অভাগা ব্যবসায়ীরা’ ছাই-ভষ্ম থেকে বারবারই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তার পরও কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র ঠিকই তাঁদের ব্যবসা-উদ্যোগকে টার্গেট করে পেছনে লেগে থাকে। বিভিন্ন সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া যায়।


কিছুদিন ধরে দেশের শীর্ষ কয়েকজন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাতে জানা যায়, জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে কিংবা সরকারের তহবিলে বেশির ভাগ রাজস্ব দিয়েও কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কখনো ভুলনীতি, কখনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় তাঁদের শিল্প-ব্যবসা-বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধ, প্রাকৃতিক কিংবা মানুষের তৈরি দুর্যোগও তাঁদের শিল্প বা উদ্যোগের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাঁরা জানান, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে নিরাপত্তাহীনতা, মামলা-হামলা, উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি সংকট, অতিমাত্রায় ইউটিলিটির খরচসহ নানান সংকটে তাঁদের ব্যবসা-শিল্প এখন নাজুক পরিস্থিতি পার করছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রের ‘সন্দেহ বাতিক’ চোখ। আগের সরকারের সময়ের ‘সুবিধাভোগী’ তকমা দিয়ে পক্ষভুক্ত করার ঝড়ও তাঁদের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এখন চরমভাবে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন।
দেশের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হামীম গ্রুপ। এই গ্রুপের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ।

তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআিইয়েরও সাবেক প্রেসিডেন্ট। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও জোর করে টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগ তো হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। এখন যে প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার জন্য আসলে এই সরকার নয়; বরং অতীতের সরকারগুলোই দায়ী।  কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট করা হয়েছে। ডলারসহ নানান সংকটে সব দিকে কেবলই শূন্যতা। এ অবস্থার মধ্যে ব্যবসায়ীদের সাফার করতে হচ্ছে। বহুমুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সুদের হার ৯ থেকে বেড়ে ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া এই সরকার ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে পরামর্শ করছে না। এটা আরেকটা সমস্যা। পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এমনটি হতো না। আগের রাজনৈতিক সরকারগুলো তাই করত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে।’

সরকার সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন ও সহায়তা দিতে এসংক্রান্ত বাছাই কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির অন্যতম সদস্য ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিল্পপতিদের আস্থায় নিতে হবে। বিশেষ করে তাঁদের কারখানায় কোনো ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে অ্যাক্টিভ করতে হবে। যেকোনো লোক এসে, ছাত্র-ছাত্রীরা এসে মহাখালীতে রাস্তা দখল করে ফেলল, কেউ এসে আমাদের লাইফ লাইন রাস্তা বন্ধ করে দিল—এয়ারপোর্টে কেউ যেতে পারছে না। দিস মাস্ট স্টপ। টেক ইট অর লিভ ইট। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রাইওরিটি দিতে হবে। সত্যিকারের যাঁরা উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী, যাঁরা সমস্যায় পড়ে গেছেন, যাঁদের ব্যাংক ব্যাকআপ করতে রাজি আছে, সব নিয়মনীতি মেনে যদি মনে করা হয়, কিছু টাকা পেলে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভাবছি তাদের কিভাবে সহায়তা করা যায়। আমি সরকারের তিনটি কমিটিতে কাজ করছি। কিভাবে ৫০ কোটি টাকার ওপরে ঋণগুলোকে রিভিউ করা যায়, এ ব্যাপারে আমরা অলমোস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় আরো জানা যায়, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২-২৩ সালের একটি জরিপের তথ্যে বলা হয়েছে, দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২৩.১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের অবদানই ১১.২০ শতাংশ। বড় শিল্পে ভর করে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকারও বড় হচ্ছে।

বিবিএসের ২০২২ সালের আরেকটি জরিপের তথ্য বলছে, দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকার পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৮৬ লাখ মানুষ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় জড়িত। ২০২৩ সালে বিবিএসের আরেকটি জরিপ বলছে, দেশের সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। এর মাত্র ৫ শতাংশেরও কম সরকারি চাকরিতে। ফলে বেশির ভাগই বেসরকারি কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। সরাসরি ব্যক্তি খাতেই কাজ করছেন ৪৭.৯ শতাংশ মানুষ। সুতরাং তথ্য-উপাত্ত বলছে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। যার নেতৃত্ব দেন দেশের শিল্পোেদ্যাক্তারা। অথচ তাঁরাই এখন নানান সংকটের মুখে।

একটা সময় হরতাল-অবরোধে বিপুল ক্ষতি হতো ব্যবসার। ২০১৫ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই জানিয়েছিল, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে শুধু হরতাল অবরোধে তাঁদের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছিল। ওই সময় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক গবেষণায় বলা হয়, করোনাকালে বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

এ রকম ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরাসহ নানান দুর্বিপাকে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও শ্রমিক অসন্তোষেরও শিকার হয় ব্যবসা ও শিল্প-কারখানা। ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁরা প্রাকৃতিক কিংবা মানুষের তৈরি সব সংকট কাটিয়েও নিজেদের শিল্পকে চালু রাখতে চান। মানুষ যাতে কর্মহীন না হয়, সরকার ও দেশ যাতে লাভবান হয়—এই প্রচেষ্টা তাঁদের থাকে। তবে কখনো কখনো সরকারের ‘সন্দেহ বাতিক’ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যখন তাঁরা টার্গেটে পরিণত হন, তখন টিকে থাকাই দায় হয়ে যায়।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকার এসেই রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি টার্গেট করে ব্যবসায়ীদের। এ সময় শীর্ষ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের আগের বিএনপি জোট সরকারের ‘পক্ষভুক্ত’ ও ‘বিশেষ সুবিধাভোগী’ আখ্যা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করে। মামলা-জেল-জরিমানায় জড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে ৪০ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অন্যায্যভাবে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা জোরপূর্বক নিয়ে নেওয়া হয়। আর ওই টাকা দুই শটি চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ০৯০০ অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকার এসে ওই টাকা নেওয়ার ঘটনাকে অনৈতিক আখ্যা দিলেও তাদের ১৬ বছরের শাসনামলে আদতে তা ফেরতও দেয়নি। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা কানে তোলেনি ওই সরকার। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকার টাকা তো ফেরত দেয়ইনি বরং বছরের পর বছর ফেরত দেওয়ার ‘মুলা’ ঝুলিয়ে ব্যবসায়ীদের নিজেদের ‘পক্ষভুক্ত’ বানিয়ে ছেড়েছে।

দেশের ৪০ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নেওয়া বিপুল অঙ্কের ওই টাকা নেওয়ার ফলে তাঁদের অনেকের ব্যবসা-শিল্প রুগ্ণ হয়ে যায়। অনেকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। অনেকের প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় তাঁদের শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁরা বঞ্চিত হন মুনাফা থেকেও।

ব্যবসায়ীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন সরকার তাঁদের বিএনপি জোট সরকারের ‘পক্ষভুক্ত’ করে যে ক্ষতি করে; আওয়ামী লীগ সরকার এসেও সন্দেহমুক্ত হতে পারেনি। বরং এটাকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়ে, তাঁদের শিল্প-ব্যবসাকে জিম্মি করে তাদের পক্ষের তকমা দেওয়ার চেষ্টা করে।

তাঁরা আরো জানান, শিল্প-ব্যবসায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, এসব শিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, যার একটি বড় অংশ ব্যাংক ঋণ। সরকারের রোষানলে পড়লে তাঁদের শিল্প-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ কাজ হারাবে। ব্যাংক ঋণের কিস্তি পাবে না। এত সব ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের কেউ কেউ শিল্প রক্ষায় সরকারের পক্ষ নিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁরা কোনো রাজনীতি করেন না। বরং দুষ্টু রাজনীতির চালের শিকার হয়ে সরকারের বলির পাঁঠা হন তাঁরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক ব্যবসায়ীকে বিএনপি জোট সরকারের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়ে তাঁদের মামলায় জড়ানো হয়। ওই সময় তাঁদের অনেককে জেলও খাটতে হয়। অনেকে ব্যবসা বাঁচাতে সরকারের পক্ষ নিতে বাধ্য হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টানা ১৬ বছরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারকে সায় দিতে হয়েছে তাঁদের অনেককে।

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর পরও ব্যবসায়ীদের অনেককে ‘পক্ষভুক্ত’ করার অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই তাঁদের অনেককে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে শিল্পে-ব্যবসায়। তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতা কাজ করছে। ব্যবসায় বাড়তি খরচ ও নানামুখী সংকটের পাশাপাশি তাঁদের ‘পক্ষভুক্ত’ করার কারণে শিল্প ও ব্যবসা রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেও ব্যবসায়ীরা নিজেদের এখন সবচেয়ে অসহায় বোধ করছেন।

তাঁরা বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে আর সরকারকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব দিয়েও তাঁরাই আজ নাজুক পরিস্থিতির শিকার। সরকার যেখানে তাঁদের আস্থায় নিয়ে পাশে থাকার কথা, সেখানে তাঁদের দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে। তাঁরা দাবি করেন, ব্যবসায়ীদের প্রকৃতই কোনো দল নেই। তাঁরা সরাসরি কোনো রাজনীতি করেন না। পরিস্থিতির শিকার হয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী বিশেষ কারণে আগের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হলেও প্রকৃতই তাঁরা তাঁদের শিল্প বাঁচাতে চেয়েছেন। এখনো তাঁরা দেশ, অর্থনীতি ও মানুষের স্বার্থে তাঁদের শিল্পকেই অগ্রাধিকার দেবেন। তাঁরা সব সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে চান। কিন্তু যে সরকারই আসে, তারা মনে করে ব্যবসায়ীরা আগের সরকারের লোক। বিষয়টিকে একটি ভ্রান্ত ধারণা বলেই অভিহিত করেন ব্যবসায়ীরা।

নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের উদ্যোক্তা ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন ‘সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি এ সরকারের কাছে যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পায়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে একটা ওয়েআউট করার চেষ্টা হতো। ওই জায়গায় একটা বড় ধরনের ঘাটতি আছে। ব্যবসায় যে সংকট তা উত্তোরণের জন্য যে সময় লাগবে মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে এটা আরো দীর্ঘায়িত হবে। কারণ আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই মনে করছি, ব্যবসায় সরকারের যথেষ্ট ফোকাস নেই, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের মধ্যেও ইউটিলিটির পেছনে বাড়তি খরচ, আবারও দাম বাড়ানোর উদ্যোগ; সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে কিংবা যাবে—এটাই স্বাভাবিক। যখন-তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সাত দিন-১০ দিন সময় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না। কোনো একটি সিদ্ধান্তের পর এর প্রভাব কী হতে পারে তা পর্যালোচনা করা দরকার আগে। এটা করলে আর অস্থিরতা তৈরি হতো না। সমাজে সবাই খারাপ ব্যবসায়ী না। সবাই চোর নয়; ভালোও তো আছেন। তাঁদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’

দেশের অন্যতম শীর্ষ আরেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও এমডি আবদুল কাদির মোল্লা ওয়ান-ইলেভেনের সময় হয়রানির শিকার হন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব সরকারের সময়ই রোষানলে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। কোনো সরকারই ব্যবসায়ীদের আপন করে নিতে পারে না। অথচ মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করে শিল্প গড়েছি। এর সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে। সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ও হয়রানি থেকে বাঁচতে পারিনি। আমরা চাই ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে এ সরকার কাজ করুক।’

জানা যায়, ব্যবসা-উদ্যোগ এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। পতিদিনই বন্ধ হচ্ছে কোনো না কোনো শিল্প-কারখানা। এরই মধ্যে বেক্সিমকোর বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মাঠে আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। তাঁরা ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধ করছেন। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। দেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না, বিদেশি বিনিয়োগও তলানিতে। সর্বশেষ হিসাব বলছে, বিদেশি বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমেছে। উচ্চ সুদের হার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের উচ্চ দরও ভোগাচ্ছে মানুষকে। যার ফলে ব্যবসায় মন্দা চলছে। এতে সরকারের আয় কমেছে। যার প্রভাবে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনীতির এমন অস্থির সময়ে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের সন্দেহের চোখে না দেখে, তাঁদের আস্থায় নিয়ে, পাশে রেখে কাজ করা। কারো কোনো ফৌজদারি অপরাধ থাকলে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অগ্রাধিকার দিতে হবে দেশের অর্থনীতি। প্রবৃদ্ধির চাকা যেন সচল থাকে, সেই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ তাঁদের।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত
প্রতীকী ছবি

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২-২৩ সালের একটি জরিপের তথ্যে বলা হয়েছে, দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২৩.১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের অবদানই ১১.২০ শতাংশ। বড় শিল্পে ভর করে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকারও বড় হচ্ছে।

বিবিএসের ২০২২ সালের আরেকটি জরিপের তথ্য বলছে, দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকার পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৮৬ লাখ মানুষ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় জড়িত। ২০২৩ সালে বিবিএসের আরেকটি জরিপ বলছে, দেশের সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। এর মাত্র ৫ শতাংশেরও কম সরকারি চাকরিতে।

ফলে বেশির ভাগই বেসরকারি কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। সরাসরি ব্যক্তি খাতেই কাজ করছেন ৪৭.৯ শতাংশ মানুষ। সুতরাং তথ্য-উপাত্ত বলছে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। যার নেতৃত্ব দেন দেশের শিল্পোদ্যাক্তারা।
অথচ তাঁরাই এখন নানান সংকটের মুখে।

একটা সময় হরতাল-অবরোধে বিপুল ক্ষতি হতো ব্যবসার। ২০১৫ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই জানিয়েছিল, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে শুধু হরতাল অবরোধে তাঁদের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছিল। ওই সময় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক গবেষণায় বলা হয়, করোনাকালে বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

এ রকম ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরাসহ নানান দুর্বিপাকে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও শ্রমিক অসন্তোষেরও শিকার হয় ব্যবসা ও শিল্প-কারখানা। ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁরা প্রাকৃতিক কিংবা মানুষের তৈরি সব সংকট কাটিয়েও নিজেদের শিল্পকে চালু রাখতে চান। মানুষ যাতে কর্মহীন না হয়, সরকার ও দেশ যাতে লাভবান হয়—এই প্রচেষ্টা তাঁদের থাকে। তবে কখনো কখনো সরকারের ‘সন্দেহ বাতিক’ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যখন তাঁরা টার্গেটে পরিণত হন, তখন টিকে থাকাই দায় হয়ে যায়।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

‘ব্যবসা-বাণিজ্য যথাযথ গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
‘ব্যবসা-বাণিজ্য যথাযথ গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে’

নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের উদ্যোক্তা ফজলুল হক বলেছেন, ‘সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি এ সরকারের কাছে যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পায়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে একটা ওয়েআউট করার চেষ্টা হতো। ওই জায়গায় একটা বড় ধরনের ঘাটতি আছে। সম্প্রতি কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

 

ব্যবসায় যে সংকট তা উত্তরণের জন্য যে সময় লাগবে মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে এটা আরো দীর্ঘায়িত হবে। কারণ আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই মনে করছি, ব্যবসায় সরকারের যথেষ্ট ফোকাস নেই, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের মধ্যেও ইউটিলিটির পেছনে বাড়তি খরচ, আবারও দাম বাড়ানোর উদ্যোগ; সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে কিংবা যাবে—এটাই স্বাভাবিক। যখন-তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সাত দিন-১০ দিন সময় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না।

কোনো একটি সিদ্ধান্তের পর এর প্রভাব কী হতে পারে তা পর্যালোচনা করা দরকার আগে। এটা করলে আর অস্থিরতা তৈরি হতো না। সমাজে সবাই খারাপ ব্যবসায়ী না। সবাই চোর নয়; ভালোও তো আছেন।
তাঁদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’

মন্তব্য

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার : এ কে আজাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার : এ কে আজাদ
হামীম গ্রুপের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ।

নিরাপত্তাহীনতা, মামলা-হামলা, উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি সংকট, অতিমাত্রায় ইউটিলিটির খরচসহ নানান সংকটে এখন নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের ব্যবসা-শিল্প খাত। সমস্যা সমাধানে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের শীর্ষ কয়েকজন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

দেশের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হামীম গ্রুপ।

এই গ্রুপের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআিইয়েরও সাবেক প্রেসিডেন্ট। 

ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও জোর করে টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগ তো হচ্ছে না।

নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। এখন যে প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার জন্য আসলে এই সরকার নয়; বরং অতীতের সরকারগুলোই দায়ী। কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ডলারসহ নানান সংকটে সব দিকে কেবলই শূন্যতা।

এ অবস্থার মধ্যে ব্যবসায়ীদের সাফার করতে হচ্ছে। বহুমুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সুদের হার ৯ থেকে বেড়ে ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া এই সরকার ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে পরামর্শ করছে না। এটা আরেকটা সমস্যা।
পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এমনটি হতো না। আগের রাজনৈতিক সরকারগুলো তাই করত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে।’

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ