<p style="text-align:justify">উত্তরের বাতিঘর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ১৬টি বছর শেষ করে ১৭ বছরে পদার্পণ করেছে। ‘ধন্য বেরোবি, গড়ব দেশ, আবু সাঈদের বাংলাদেশ’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে আজ ১২ অক্টোবর, ২০২৪ বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। জুলাই ছাত্র-জনতা বিপ্লবের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সারা বিশ্বে বিশেষ পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার দুই হাত প্রসারিত করে আত্মত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।</p> <p style="text-align:justify">সেই বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে রংপুরে একটি পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে রংপুর সার্কিট হাউসে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। </p> <p style="text-align:justify">পরবর্তীতে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। শুরুতে ৩০০ জন শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক নিয়ে রংপুর শহরের লালকুঠি এলাকায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমান। অস্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি কারমাইকেল কলেজের ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিকাংশ অবকাঠামো তার হাত ধরে গড়ে উঠলেও নানা দুর্নীতির অভিযোগে তিনি মেয়াদপূর্তির এক দিন আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।</p> <p style="text-align:justify">পরবর্তীতে ৭ মে ২০১৩ তারিখে অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণকালে বিগত প্রশাসনের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগজনিত জটিলতা ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হোন। তৃতীয় উপাচার্য তার পুরো মেয়াদকালে বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় আপৎকালীন সংকট মোকাবেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে ১০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে প্রাথমিক সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবে পুরো মেয়াদকালে বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন ও সমালোচনার মধ্যে দিয়ে অধ্যাপক নূর-উন-নবী মেয়াদ পূর্ণ করে চলে যান। </p> <p style="text-align:justify">পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ২০১৭ সালের ১৪ জুন চতুর্থ উপাচার্য  হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনিও নানা সমালোচনার জন্ম দেন। তার বিরুদ্ধে বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করেছিলেন। তার চার বছর মেয়াদ শেষে ১৪ জুন ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদকে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ থেকে পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মাথায় ২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনিও ৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করেন। </p> <p style="text-align:justify">সর্বশেষ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ উপাচার্য পদে নিয়োগ প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকাত আলীকে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি উত্তরের বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলার আশা ব্যক্ত করেন। দুঃখজনকভাবে প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও কোনো উপাচার্য এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেননি। </p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর নামে একটি আইন থাকলেও এত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নেই কোনো সংবিধি ও প্রবিধি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে চরম শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক সংকট। শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো টিএসসি, অডিটরিয়াম ও জিমনেশিয়াম। এমনকি যার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্যাম্পাসে নেই তার কোনো প্রতিকৃতি। বর্তমান উপাচার্য কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে ইতিবাচকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এমন প্রত্যাশা সবার।</p> <p style="text-align:justify">নানা সংকটের মধ্যেও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসর বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে ছয়টি অনুষদে ২২টি বিভাগের শিক্ষার কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক রয়েছেন ২০১ জন ও শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার। নির্মীয়মাণ একটি ছাত্রী হলসহ মোট চারটি আবাসিক হল, প্রশাসনিক ভবন, চারটি একাডেমিক ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, মসজিদ, কাফেটেরিয়া এবং শিক্ষক আবাসিক স্থাপনা রয়েছে। সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে দ্রুত নির্মীয়মাণ হল ও রিসার্চ সেন্টারের কাজ শেষ করে শিক্ষা ও গবেষণার পথ প্রসারিত করবে বলে আশা করছি। </p> <p style="text-align:justify">গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও ১৬ বছরের পথচলায় শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য মেধার প্রমাণ রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েব ম্যাট্রিকস র‍্যাংকিংয়ে ২৩তম অবস্থানে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এতে গতবারের তালিকা হতে অষ্টম ধাপ এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। </p> <p style="text-align:justify">উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের বাতিঘর হয়ে উঠুক। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হোক বিশ্ববিদ্যালয়টি। আবু সাঈদের আত্মত্যাগ যেভাবে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে। ঠিক সেভাবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের মানুষের আলোর দিশারি হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর।</p> <p style="text-align:justify"><strong>লেখক :</strong> ড. মো. হারুন-আল-রশীদ, সহযোগী অধ্যাপক-রসায়ন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। <br /> ই-মেইল: harun.brur.bd@gmail.com</p>