<p style="text-align:justify">মাটির মধ্যে মাকে খোঁজা শুরু হয়েছিল একেবারে শৈশব থেকেই। বিশ্বজিৎ পালের মা-বাবা দুজনই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মৃিশল্পী ছিলেন। হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। জন্মস্থান রাজবাড়ী থেকে বাবার সঙ্গে চলে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়।</p> <p style="text-align:justify">দেখতেন বাবা বিনয় কৃষ্ণ পাল কী নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলছেন দেবীর অবয়ব। সেই যে মাটির মায়ায় পড়ে গেছেন আর ছাড়েননি। পরে বিশ্বজিৎ পড়াশোনার বিষয়ও করেছেন এই ভাঙা-গড়ার খেলাকেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন।স্নাতকোত্তর করেছেন ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।</p> <p style="text-align:justify"><img alt="মৃত্তিকায় মাকে গড়েন বিশ্বজিৎ" height="54" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/12-10-2024/56677.jpg" style="float:left" width="259" />১৯৯৬-৯৭ সালের ঘটনা। তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএফএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। রাজশাহীর সাহেববাজারের কাছে আলুপট্টি নামে একটা জায়গা আছে। সেখানকার মণ্ডপে দুর্গার প্রতিমা বানিয়েছিলেন। পেশাদার শিল্পী সেটাই বিশ্বজিৎ পালের গড়া প্রথম প্রতিমা। এরপর দেশের নানা জায়গায় গেছেন। তবে বেশি বানিয়েছেন চট্টগ্রামে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>এবার পাঁচ মণ্ডপে</strong></p> <p style="text-align:justify">এ পর্যন্ত শতাধিক দুর্গামণ্ডপের প্রতিমা বানিয়েছেন বিশ্বজিৎ পাল। তাঁর অধীনে এখন কাজ করেন পাঁচজন। এবার মোট পাঁচটা মণ্ডপের প্রতিমা গড়েছেন। চট্টগ্রাম শহরে তিনটা—ঘোসাইলডাঙা কল্পতরু সংঘ, পাথরঘাটা পাঁচবাড়ি, উত্তর নলাপাড়া কাত্যায়ানী পূজামণ্ডপ। শহরের বাইরে ছোট কুমিরার কাছে বাঁশবাড়িয়া রামবাবুর বাড়ি একটা, অন্য মণ্ডপটা চন্দনাইশে। বললেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে যত বড় বড় কাজ হয়েছে, বেশির ভাগ আমার করা। নোয়াখালীতেও অনেক বড় বড় পূজা হয়। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আমার কাজ আছে।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>আলাদাভাবে নজর কাড়ে  </strong></p> <p style="text-align:justify">প্রতিবার কাজ করার সময় শিল্পকর্মকে নতুনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন বিশ্বজিৎ পাল। ২০১০ সাল থেকে চট্টগ্রাম শহরের পূজায় থিমের ব্যাপারটা চালু হলো। সঞ্জয় নামে এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে এটা শুরু করেছিলেন তিনি। বললেন, ‘সব সময় চেষ্টা করি, প্রতিমার মাধ্যমে সমাজকে একটা বার্তা দিতে। ক্ষমতার পালাবদলের আগে-পরে মানুষ মরেছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে—এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই এবার প্রতিমার থিম করেছেন।  বললেন, ‘ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন ক্ষোভ এবং কোপটা যায় আমাদের ওপর দিয়েই। এবার মণ্ডপে প্রতিকীরূপে তুলে ধরেছি—সব কিছু পুড়ছে। চট্টগ্রামের বংশালের পাঁচবাড়ি পূজামণ্ডপে গেলে দেখবেন, দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুর। পেছনে মানুষরূপী ১৫টি অসুরের মূর্তি। রণভঙ্গিতে সশস্ত্র দেবী এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পায়ে। সমাজে মানুষরূপী অসুর বেড়েছে বিধায় আমরা দেবীর পেছনে অসুর বেশি দিয়েছি। মাকে রেখেছি রণভঙ্গিতে। তিনি সাম্প্রদায়িকতাসহ সব ধরনের অপশক্তিকে বিনাশ করে এগিয়ে যাবেন।’</p> <p style="text-align:justify">‘তোমার দুর্গা মাটির তৈরি, সেজে ওঠে অলংকারে, আমার দুর্গা মায়ের রূপে, ঠাঁই পায় না ঘরে’, ‘আমার দুর্গা ঘরে সংসারে অক্লান্ত খেটে চলে, আমার দুর্গা একটু কষ্টে ডাকে আয় খোকা বলে’,—এমন সব কবিতার পঙক্তির সঙ্গে ছবির দৃশ্যায়ন দেখা যাবে বিশ্বজিতের করা ঘোসাইলডাঙা মণ্ডপে।</p> <p style="text-align:justify">‘একজন নারী পেশাজীবী বা গৃহিণী তিনিই আবার কারো মা, কারো বোন, কারো সহধর্মিণী। কিন্তু এই মাতৃরূপা নারীকেই প্রতিদিন পথ চলতে নিরাপত্তার শঙ্কায় থাকতে হয়। প্রত্যেক নারীকে যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে পারলেই সব নারীর বিকাশ সম্ভব। এই ভাবনাটাই উপস্থাপন করতে চেয়েছি।’ বললেন এই শিল্পী।</p> <p style="text-align:justify"><strong>বিশ্বজিৎ পালকে চেনেন?</strong></p> <p style="text-align:justify">এক আত্মীয়ের সঙ্গে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলেন একটা মন্দিরে। সেখানকার প্রতিমা শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিটাগাঙে কাজ করেন, বিশ্বজিৎ পালকে চেনেন?’ পাশে থাকা বিশ্বজিতের আত্মীয় বললেন, ‘আরে, এই-ই তো বিশ্বজিৎ পাল।’ তখন সেই ভদ্রলোক কাজটাজ ফেলে বিশ্বজিৎকে এসে জড়িয়ে ধরলেন! বললেন, ‘আপনার কথা কত শুনেছি। অনেকবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু সাহস পাইনি।’ আরেকবার আরেকটা মণ্ডপে প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এক যুগল বলছে, ‘দেখো এটা বিশ্বজিৎ পালের কাজ। বেশ ক্রিয়েটিভ। তিনি অন্যরকম চিন্তা করেন।’ এটা অনেক বড় পাওয়া বলে মানেন বিশ্বজিৎ পাল। বললেন, এই কাজে অমানবিক পরিশ্রম। কখনো পুরো টাকাটাও পাওয়া যায় না। তার পরও কাজ শেষে এমন কথা শুনলে আনন্দ লাগে। অনেক সময় কাজ সম্পাদনে দেরি হলে আয়োজকদের গালমন্দ শুনতে হয় শিল্পীকে। চেষ্টা করি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজটা বুঝিয়ে দিতে।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>যেভাবে মূর্ত হয় দেবী</strong></p> <p style="text-align:justify">একেকটা মণ্ডপের প্রতিমা গড়তে প্রায় মাস দুয়েক লাগে। দুর্গাপূজার প্রতিমা বেশি বানান। সরস্বতী পূজা, কালী পূজার সময়ও কাজ থাকে। এর বাইরে সারা বছর টেরাকোটা, সিমেন্ট, ফাইবার ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন বিশ্বজিৎ। সহজ করে প্রতিমা বানানোর প্রক্রিয়াটাও জানালেন তিনি—প্রথমে প্রতিমার নকশা করা হয়। তারপর নকশা অনুযায়ী কাঠামো বানানো হয়। প্রতিমা বানাতে মাটি, পানি, বাঁশ, খড়, পাট এসব লাগে। মাটির মধ্যে বেশি লাগে এঁটেল মাটি। বেলে মাটি, দো-আঁশ মাটিও লাগে পরিমাণমতো। মাটিতে পাটের আঁশ দেওয়া হয় বন্ধনটা শক্ত করার জন্য। মূল কাঠামোর সঙ্গে হাত, মাথা ইত্যাদি জোড়া লাগানোর কাজে খড় ব্যবহার করা হয়। কাঠামো বানানো শেষে তাতে নকশা অনুসারে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর শুকানোর জন্য রাখা হয়। এবার রং লাগানোর পালা। এরপর চলে অলংকরণের কাজ।</p> <p style="text-align:justify"><strong>জননী চিরদিনের</strong></p> <p style="text-align:justify">বিসর্জনের দিন হু হু করে কেঁদে ওঠে বিশ্বজিতের মনটা। কোনোমতে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন—যেন দিনটা পার হলেই বাঁচেন। ভীষণ খারাপ লাগে বিধায় বিসর্জনের সময় কখনো উপস্থিত থাকেন না। বললেন, ‘আমি তো নিজ হাতে গড়ি। সন্তানের কাছ থেকে মাকে কেড়ে নিলে যেমন লাগে, বিসর্জনের দিন আমার ঠিক তেমন লাগে। আমার কাছে জননীর কোনো বিদায় নেই!’</p> <p style="text-align:justify"><strong>অনেক সংগ্রাম করেছেন</strong></p> <p style="text-align:justify">জীবন মানেই যুদ্ধ—এটা বিশ্বজিতের চেয়ে ভালো আর কে বোঝে। ২০০৮ সালে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন গ্যালারি কায়ায়। কিন্তু প্রদর্শনী করার মতো অর্থ ছিল না বিশ্বজিতের হাতে। পরে এগিয়ে এলো এক বন্ধু। তবে শর্ত ছিল—শিল্পকর্মগুলো তৈরি করবেন বিশ্বজিৎ, কিন্তু অর্ধেক কাজ যাবে সেই বন্ধুর নামে!</p> <p style="text-align:justify">তখন তিনি থাকতেন মিরপুরের পাইকপাড়ায়। সেবার গুলশান থেকে ফিরছিলেন। ভরদুপুর। ভাত খাওয়ার পয়সা নেই। মহাখালী রেলগেটের কাছে পৌঁছানোর পর ভাবলেন, হোটেল থেকে দুটো সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খাবেন। পকেটে হাত দিয়ে দেখেন দুই টাকার একটা নোট আছে মাত্র! কী আর করা। হোটেল থেকে কেবল জল খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন। হেঁটেই চলে গেলেন মিরপুর। এ রকম সময় কম যায়নি বিশ্বজিতের জীবনে।</p> <p style="text-align:justify">এখন অবশ্য দিন বদলেছে। বললেন, ‘আগে প্রতিমাশিল্পীদের টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য ছিল। এখন ভালো কাজ করলে ভালো পারিশ্রমিক মেলে। তবে আরেকটা দিক আছে। আগে হয়তো অতটা আড়ম্বর ছিল না, কিন্তু মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। প্রতিমাশিল্পীদের অনেক সম্মান করত। এখন তো সব কিছু বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। কাজের বৈচিত্র্য বেড়েছে, জৌলুস বেড়েছে। কিন্তু মানুষের আন্তরিকতা কমে গেছে। অনেকে মনে করে, টাকা দিয়ে দিলেই সব হয়ে যায়।</p> <p style="text-align:justify"><strong>তারপর কে?</strong></p> <p style="text-align:justify">বংশ পরম্পরায় প্রতিমা বানিয়ে আসছেন বিশ্বজিৎ পাল। তবে পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার মতো তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। বললেন, ‘আমার ছেলে নেই। দুই মেয়ে। তারা তো এই পেশায় আসবে না। আমি চলে গেলে বংশপরম্পরার এই কাজ শেষ। তাই যত দিন পারি কাজটা চালিয়ে যাব। আমার শীষ্য আছে ১০ জনের মতো। এর মধ্যে দুই-তিনজন খুবই ভালো কাজ করছে। তাদের মাধ্যমে হয়তো ঐতিহ্য টিকে থাকবে।’</p>