<p>সব রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী সাবেক এমপি বজলুল হক হারুন। ঝালকাঠি-১ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য ‘বি এইচ হারুন’ নামেই এলাকায় পরিচিতি পেলেও সুনামের চেয়ে তাঁর দুর্নামই বেশি। এমপি ছিলেন ঠিকই; তবে এলাকায় যাতায়াত ছিল কম। তবে নিজে না থাকলেও এলাকা দাপিয়ে বেড়াতেন তাঁর ছোট ভাই মুজিবুল হক কামাল।</p> <p>বলা যায়, তিনিই ছিলেন এলাকার অলিখিত এমপি, যাঁকে সবাই ‘বিকল্প এমপি’ বলেই জানত। সব চলত তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। ছোট ভাই কামালকে এক পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও বানিয়েছিলেন বি এইচ হারুন। এমপি হারুন আর তাঁর ভাই মিলে ত্রাণের অনুদান থেকে শুরু করে গত ১৫ বছরে কাবিটা-কাবিখার বেশির ভাগই আত্মসাৎ করেছেন।</p> <p>ক্ষমতায় থেকে এই পরিবার এখন অন্তত ৬০০ কোটি টাকার মালিক বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। <br /> গত কয়েক দিন রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  ছোট প্রকল্পে ৫০ হাজার বরাদ্দ হলে সেখানে খরচ করা হতো মাত্র ১০ হাজার টাকা। বাকি ৪০ হাজার টাকাই আত্মসাৎ করতেন। আবার অপ্রয়োজনীয় কাজও করেছেন।</p> <p>যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে কালভার্ট করেছেন। সরকারি অর্থে নিজ স্বজনদের ঘর পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দিয়েছেন। নিজের পরিবারের প্রয়োজনে সরকারি অর্থে নতুন নতুন রাস্তা করেছেন, করেছেন সংস্কারও। এর বাইরে সব রাস্তাই ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা। ফলে দুই উপজেলার মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখনো। অসহায়দের জন্য বরাদ্দকৃত টাকাও আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে দুজনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন স্কুলে নিয়োগ দিয়েও টাকা হাতিয়েছেন তাঁরা।</p> <p>ইসমাইল হোসেন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির অভিযোগ, কাজ না করেই প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, আবার আংশিক কাজ করে প্রকল্পের টাকা তুলে নেওয়াই ছিল এমপি হারুনের প্রধান কাজ। তবে খাতা-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হলেও এসব প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানে না স্থানীয়রা। ২০২১ সালে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাবিটা কর্মসূচির আওতায় রাজাপুরে সাড়ে ২১ লাখ এবং কাঁঠালিয়ায় ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এর কাজের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে।</p> <p>স্থানীয় রাজা সিকদারের নেতৃত্বে একটি লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন হারুন ও কামাল। এই সন্ত্রাসী বাহিনী বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি করত। সালিস বৈঠকের নামে গ্রামে আদালত বসাত। টাকা দিলে তার পক্ষে রায় দিয়ে দিত।</p> <p>ঢাকার আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনায় করা হারুন ছাত্রাবস্থায় স্থানীয় এক ব্যক্তির ট্রাভেল ব্যবসায় যুক্ত হন। ‘রাজবীথি ট্রাভেলস’-এর ব্যানারে সৌদি আরবে মানুষ পাঠাতেন। ব্যয়ের ১০ গুণ টাকা নিতেন গ্রামের অসহায় ও দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে।</p> <p>একসময় জামায়াতের সঙ্গে সখ্য ছিল হারুনের। কিন্তু সুবিধা করতে না পারায় যোগ দিয়েছিলেন বিএনপিতে। পরে বিএনপি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। সেখানেও সুবিধা না করতে পেরে ভেড়েন নৌকায়। আর নৌকা ব্যবহারের অসৎ সুবিধাই তাঁর পরিবারকে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বানিয়েছে।</p> <p>জানা যায়, বি এইচ হারুন ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিতে যোগ দিয়ে পিরোজপুর-২ আসন থেকে অংশ নেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে জামানত হারিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলেও তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। ১৯৯৮ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-১ আসন থেকে ‘নৌকা’ প্রতীক পেলেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তবে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ২০১৪, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে এমপি হয়েছিলেন। ২০২৪ সালে প্রথমে দলীয় মনোনয়ন পেলেও শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিলে শাহজাহান ওমরকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়। এর পর থেকেই প্রভাব কমতে শুরু করে হারুন ও তাঁর ভাইয়ের। </p> <p>অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগে হারুনের প্রভাব ছিল না। কিন্তু তারপরও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যান।</p> <p>দশম জাতীয় সংসদে হারুন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। এই প্রভাবে রাজাপুরের নিজ ঘরের পাশে সরকারি অর্থায়নে ইসলামিক মিশন হাসপাতাল চালু করেন। এখানে নিয়োগ দেন নিজ বাসার কর্মচারীদেরও। এ ছাড়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ও সরিয়ে নিজের ঘরের সামনে নিয়ে আসেন। এ নিয়ে এলাকার মানুষের ক্ষোভ থাকলেও কারো প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না।</p> <p>রেইনট্রি হোটেল বিতর্ক : এমপি থাকাকালেই রেইনট্রি হোটেল বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে অস্ত্র দেখিয়ে ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়। এই ঘটনায় তাঁর এক সন্তানের জড়িত থাকারও অভিযোগ এসেছিল। এ ছাড়া হোটেল ভবন নির্মাণ ও হোটেল চালু করতে তিনি রাজউকের কোনো নিয়মনীতি মানেননি। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য রেইনট্রি ঢাকা লিমিটেড’ নামে রেইনট্রি হোটেল চালু হয়। এর পরিচালকরা ছিলেন বি এইচ হারুনের স্ত্রী মনিরা হারুন, তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বেআইনিভাবে পরিচালিত হওয়ায় হোটেলটি সিলগালা করে দিয়েছিলেন রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই অভিযানে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু তার রাজনৈতিক ও আত্মীয়দের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই আবার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়ে যান। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকেও পার পেয়ে যান।</p> <p>চেক জালিয়াতি :  ২০০৮ সালে তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংক থেকে রুমি এন্টারপ্রাইজের চেক জালিয়াতি করে ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়লেও তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চেক জালিয়াতির প্রমাণও মেলে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে এসব অভিযোগ থেকে রক্ষা পান তিনি।</p> <p>জানা যায়, সৌদি সরকারের সাহায্যে ২০০৮ সালে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ১৫ হাজার ঘর নির্মাণের ২০৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। তাঁর হিসাব ছিল বেসরকারি একটি ব্যাংকের বংশাল শাখায় এবং কাজ চলাকালে ২৯৭টি চেকের পাতার মাধ্যমে ৭০ কোটি টাকা তিনি উত্তোলন করেন। কাজ শেষে বাকি টাকা তোলার জন্য খলিলুর বংশাল শাখায় গিয়ে দেখেন, হারুন তাঁর সব টাকা তুলে নিয়ে গেছেন এবং হিসাবও বন্ধ করে দিয়েছেন। খলিলুর দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়ে বলেছেন, তাঁকে না জানিয়ে অতিরিক্ত ৩৮৮টি চেক বই ইস্যু দেখিয়ে জাল সইয়ের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন বি এইচ হারুন। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে জাল সইয়ের প্রমাণও পায়। কিন্তু হারুন তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানাভাবে নাজেহাল করেন খলিলুর রহমানকে। এখনো খলিলুর রহমান টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন দপ্তরের সহায়তা চাইছেন।</p> <p>সম্পদের পাহাড় : ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় বি এইচ হারুন ৩৮ লাখ টাকার অর্থসম্পদ দেখান। এর মধ্যে ছিল শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকে ছয় লাখ ৬২ হাজার টাকা, বাড়ি/দোকান ভাড়া থেকে ১৬ লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে ১৪ লাখ টাকা এবং সম্মানী বাবদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা আয়। স্ত্রী মনিরা হারুনের নামে তখন কিছুই ছিল না।</p> <p>কিন্তু ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় বি এইচ হারুন দেখান, তাঁর নিজের ও স্ত্রীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নগদ দুই কোটি ৯০ লাখ, ব্যাংকে ৬৭ লাখ এবং ব্যাংকে স্থায়ী আমানত তিন কোটি ৬৮ লাখ টাকা, গাজীপুরে ১৭ কাঠা, মিরপুরে পাঁচ কাঠা, বনানীতে সাড়ে ছয় কাঠা, বারিধারায় ছয় কাঠার একটি ও সাড়ে চার কাঠার আরেকটি প্লট রয়েছে তাঁর। ছোট ছেলে আদনান হারুনকে দুটি জাহাজ কিনতে ১৩ কোটি টাকা এবং বড় ছেলে নাহিয়ান হারুনকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক হতে ২০ কোটি টাকা দেন। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ভাই ফয়জুর রব আজাদের নামে জমা রাখেন ১৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের  হলফনামায় বি এইচ হারুন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, স্ত্রীর কাছ থেকে তিন কোটি ২০ লাখ এবং বৈদেশিক মুদ্রায় এক কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণ নেন বলে দেখান।</p> <p>স্থানীয়রা জানিয়েছে, হলফনামার বাইরে আরো সম্পত্তি রয়েছে হারুনের। সম্পত্তি রয়েছে নামে-বেনামে, নিজ ভাই ও ভাইয়ের ছেলেদের নামেও।</p> <p>টাকা নিয়েও চাকরি দেননি অনেককে : হারুনের ভাই ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুল হক কামাল বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েও চাকরি দেননি। এ নিয়ে বিভিন্ন মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিতেন তিনি। কানুদাশকাঠি গ্রামের জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ইভা সুলতানাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাসপাতালে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এই ঘুষ নেন কামাল। এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, সংসদ সদস্যের বাড়ির সামনে অবস্থিত ইসলামিক মিশন হাসপাতালে কম্পিউটার-কাম-অপারেটর পদে নিয়োগের জন্য ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মুজিবুল হক কামাল ওই পদে আমার স্ত্রী ইভা সুলতানাকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। তাঁর কথা অনুযায়ী তিন দফায় পাঁচ লাখ টাকা দিই। পরে ওই পদে আমার স্ত্রীকে চাকরি না দিয়ে স্থানীয় মারুফ আকন নামের এক যুবককে চাকরি দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার অন্তত ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে টাকা কামিয়েছেন এই কামাল হোসেন। রাজাপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির এমনই একটি অভিযোগে হারুনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বঞ্চিত চার প্রার্থী।</p> <p>এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য বি এইচ হারুন ও তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। তবে নিজ এলাকার স্থানীয়রা বলছে, তাঁরা দুই ভাই ঢাকার কোথাও আত্মগোপনে রয়েছেন। ঢাকায় তাঁদের বাড়িতে গেলেও কোথায় আছেন এ বিষয়ে কেউ কিছু বলতে রাজি হয়নি।</p>