<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দুর্নীতি ও সুশাসন পরস্পর বিপরীত হলেও এদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশে সুশাসনের পথে যেসয বাধা রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি। জন কোয়া নামের এক গবেষক তার একটি লেখায় সুশাসন ও দুর্নীতির সম্পর্ক ও বৈপরীত্য ব্যাখ্যা করেছেন। দেখিয়েছেন, সুশাসন কিভাবে দুর্নীতির পথ বন্ধ করে আর দুর্বল নীতি ও শাসন কিভাবে দুর্নীতির পথ তৈরি করে। তার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কিভাবে দুর্নীতির পথ সুগম করে অথবা এর রাশ টেনে ধরে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, একটি দেশের সরকারব্যবস্থায় যদি প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন ও নিয়মের মধ্যে ভারসাম্য থাকে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা থাকে এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকে, তাহলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। কোয়া তার মডেলে আরো অনেক উপাদান ব্যবহার করেছেন এবং বিভিন্ন পরিসংখ্যান ব্যবহার করে মডেলের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তার মতে, সুশাসন একটি স্বাধীন চলক, কিন্তু দুর্নীতি নির্ভরশীল চলক। এই স্বাধীন চলক নির্ধারণ করে শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতির প্রভাব কতটা থাকবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সরকারের পতনের পর থেকে সরকারি থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ব্যক্তি বদল হচ্ছে। কোথাও স্বেচ্ছায়, কোথাও বাধ্য হয়ে অনেকে পদত্যাগ করছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা জোর করে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সরিয়ে দিয়েছে। কোথাও তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা হয়েছে। এমনকি শিক্ষকদের নামে মামলাও হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। অনেকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে, তাদের জায়গায় নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। অতীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এমনটা হয়েছে, তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমাদের ছাত্রসমাজ দেশের আমূল পরিবর্তনের আশায় আছে, তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও। সরকারও সংস্কারের কথা বলছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="দুর্নীতি বন্ধে কাজ করতে হবে" height="285" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/20-11-2024/66.jpg" style="float:left" width="321" />প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কার কার হবে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্যক্তির, নাকি প্রতিষ্ঠানের? ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ থেকে শুরু করে অনেকেই বারবার বলছেন যে তারা বাধ্য হয়ে অনেক কিছু করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, অপরাধ সব হুকুমদাতাদের; তাদের নয়। তাদের যুক্তি যেমন অগ্রাহ্য করা যায় না, তেমনি তাদের নিরপরাধ বলারও সুযোগ নেই। হুকুম পেলেই যদি বিনা প্রশ্নে সব বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে আইন আর নীতির প্রয়োজনীয়তা থাকছে না। দায়িত্বশীল হিসেবে তাদের পেশাদার ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কখন কোনো প্রশ্ন না করেই হুকুম পালন করে? আর ভবিষ্যতে যদি একই পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে তাদের ভূমিকা কী হবে? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে এবং এখানেই হয়তো সমাধানের একটা পথ বের হবে বলে মনে করি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের প্রশাসন ও পুলিশে, সঙ্গে অন্যান্য সংস্থায়, ব্রিটিশদের তৈরি করা তাঁবেদারি সংস্কৃতি আজও বহাল আছে বলে আমরা স্বাধীন মানসিকতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোও এটা পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অপরাধবিজ্ঞানে একটা কথা আছে, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্লেজার অ্যান্ড পেইন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। অর্থাৎ অপরাধের পেছনে অপরাধীর প্রাপ্তিযোগের বিষয়টি বিবেচনায় থাকে। যারা বলছেন হুকুম পালন করতে বাধ্য হয়েছেন, তারা কি </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গিভ অ্যান্ড টেক</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নীতির সুবিধা নেননি? আবার তাদের তদারক করা যাদের দায়িত্ব ছিল, তারাও চুপ থেকেছেন। বলা যায়, এখানে ব্যক্তি নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া নষ্ট হয়েছে। ফলে দুর্নীতি আর অরাজকতা চরম আকার ধারণ করেছে। এভাবে কেউ হয়েছেন বেগমপাড়ার বাসিন্দা, কেউ করেছেন রিসোর্ট বা অন্য কিছু। স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজ আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য পেশার কতজনকে দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা প্রকাশ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">৫ আগস্টের পর থেকে সচিবালয় ও সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে অনেক কর্মকর্তা তাদের বঞ্চনার কথা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে খুব দ্রুত পদোন্নতিসহ বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয়েছে। বিপরীতে আগের সরকারের সময়ের অনেককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং চুক্তি বাতিল করা হয়েছে, যা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু শুধু এর মাধ্যমেই অরাজনৈতিক ও সেবাধর্মী আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব নয়। যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি, তাহলে সেখানে ভিসিদের ব্যাপক প্রভাব থাকে। কিন্তু তারাই একমাত্র ব্যক্তি নন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট বা সিনেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং আরো অনেক কমিটি থাকে। কিন্তু কোনো সমস্যা হলে শুধু ভিসিদের সরিয়ে দেওয়ার দুর্বল নীতি কতটা উপকার করে, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকতে দেখেছি, এখন শিক্ষক হিসেবে দেখছি, ফায়দা নেওয়ার জন্য কিছু মানুষ ওত পেতে থাকে। পদ পাওয়া বা নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সবই হয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পদে তাদের অনুসারীদের নিয়োগ দেওয়ার রীতি থেকে বের হতে না পারলে শুধু ব্যক্তি পরিবর্তনে সমস্যার সমাধান হবে না।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন; যদিও নির্বাচন কমিশনের পিয়ন থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পরিবর্তন করে পরবর্তী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত করার নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। কেননা ব্যক্তির চেয়ে প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়া, স্বাধীনতা এবং আইনের উপযুক্ত প্রয়োগের ওপর। নব্বইয়ের পর থেকে কোনো নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কি ধন্যবাদ দিতে পেরেছে? নিশ্চয়ই আমাদের প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও বড় গলদ আছে, যা বারবার বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরিবারতন্ত্র আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পরিচয় হয়ে আছে। এমনকি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো নেতা অপকর্ম বা অপরাধ করলে খুব সহজেই বলা হয়, ব্যক্তির অপরাধ দল নেবে না। কিংবা দল থেকে বহিষ্কার করে সব দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। আজ পরিবর্তিত বাংলাদেশে মানুষ প্রত্যাশা করে, রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ঘোষণা করবে। নিয়োগ, পদোন্নতিসহ অন্যান্য কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। সব সরকারি কর্মচারী, এমপি-মন্ত্রীসহ নেতাদের সম্পদের হিসাব বছর বছর নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান করা হবে। মানুষ দেখতে চায়, প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। প্রত্যাশা করে, দুর্নীতি দমন কমিশনের সবাই দুর্নীতিমুক্ত। আর নির্বাচন কমিশন হবে জাতির ভরসার স্থান।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মানুষ প্রত্যাশা করে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ থাকবে, হলগুলো হবে ছাত্রবান্ধব। অতীতের মতো আবার ছাত্রসংগঠনের কালো ছায়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রক্তাক্ত করবে না, হারিয়ে যাবে না নতুন কোনো আবরার। ভিসি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক শুধু দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে কারো পক্ষাবলম্বন করছেন। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমলা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কেউ আর কথায় কথায় বলবেন না যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছি। আরো আশা করে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই গণতান্ত্রিক হবে, দলের প্রধান হবেন যোগ্যতার ভিত্তিতে। মানুষ দেখতে চায়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো উল্লেখিত বিষয়ে পরিষ্কার ঘোষণা দেবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জন কোয়ার মডেল ছাড়াও অনেক গবেষক সুশাসন নিশ্চিতকরণের বিভিন্ন ধারণা দিয়েছেন; এবং সবার ধারণা কাছাকাছি। একটি বিষয় এখানে সাধারণ, সেটা হচ্ছে নিয়ম, আইন, নীতি এবং এর সঠিক ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের ওপর সুশাসন নির্ভর করে। ব্যক্তির জন্য যেমন ব্যাপক হারে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ কম, তেমনি শুধু ব্যক্তিকে পরিবর্তন করেই সুশাসন নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়। বরং দরকার এমন একটি প্রক্রিয়া, যা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধে কাজ করবে। শাসকের সদিচ্ছার পাশাপাশি থাকতে হবে উপযুক্ত আইন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান সংস্থা।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সরকার পতনের পর অনেকের উচ্ছ্বাস দেখে মানুষের মনে আবার অতীতের স্মৃতি ভাসছে অজানা আতঙ্কে। আমাদের সাহসী কিন্তু সরলমনা শিক্ষার্থীরা এখনো রাজনীতির অন্ধকার জগৎ দেখেনি। বুঝতে হবে, ব্যক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম আর অপসংস্কৃতি রাতারাতি বদলে যায় না। এর জন্য দরকার কাঠামোগত পরিবর্তন, নিয়মের প্রয়োগ ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তা না হলে শত শহীদের রক্ত ক্ষমা করবে না।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট</span></span></span></span></p>