<p style="text-align: justify;">স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। দুই ধরনের বিতর্ক প্রতিযোগিতা রয়েছে। নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর প্রস্তুতি নিয়ে তার্কিকরা পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়। বিচারকমণ্ডলীর রায়ে এক পক্ষ বিজয়ী হয়, অন্য পক্ষ হেরে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">তবে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক নির্বাচিত হয় ব্যক্তিগত যোগ্যতায়। সেটি পক্ষেরও হতে পারে, বিপক্ষেরও হতে পারে। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আরেকটি প্রথা রয়েছে। সেটি অনেকটা লটারির মতো, যার ভাগ্যে যে বিষয় পড়ে, তাকে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সে বিষয়ে বলতে হয়।</p> <p style="text-align: justify;">এটিকে বারোয়ারি বিতর্ক বলা হয়ে থাকে। এখানে মূলতই উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। বারোয়ারি বিতর্ক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে হয় না। তবে সেটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উপভোগ্য হয় যদি বিতার্কিকরা পারদর্শী হয়। না হলে বিতর্ক প্রতিযোগিতাই ঝুলে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">রাজনৈতিক আন্দোলনেও বারোয়ারিদের অবস্থা মোটেও ভালো হয় না। সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক দাবি নিয়ে যে আন্দোলন হয়, তার পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং সম্পৃক্ততা ঘটলে আন্দোলন সফল হতে পারে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন বারোয়ারি কর্মসূচিতে রূপ নিয়েছে। এক দিন হরতাল ডাকা হয়, অন্য দিন ডাকা হয় অবরোধ।</p> <p style="text-align: justify;">এভাবেই এক মাস চলে গেল। জনগণ বুঝতে পারছে না হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্য কী। বিএনপিও বলতে পারবে না আসলেই তাদের হরতাল হরতাল কি না, অবরোধও অবরোধ কি না। কিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে ভয়ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির ফলে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্যবাহী ট্রাক রাস্তায় নামতে পারছে না। আবার একেবারেই যে সব পরিবহনই বিশ্রাম নিচ্ছে, তা-ও নয়। যানবাহন চলাচল করছে; অফিস, দোকানপাট, কলকারখানা স্বাভাবিকভাবেই চলছে। </p> <p style="text-align: justify;">ভোগান্তি হচ্ছে এসব পরিবহনের ওপর যাদের যাতায়াত নির্ভরশীল, তাদের। রাতের বেলা কোথাও কোথাও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ফলে বিএনপির ডাকা এসব হরতাল-অবরোধে জনসম্পৃক্ততা ও সমর্থন সৃষ্টির পরিবর্তে জনদুর্ভোগ আর অসন্তোষ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অবরোধের সংজ্ঞাটিও বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা বোধ হয় পাল্টিয়ে দিয়েছে। অবরোধ ডেকে কোথায় তারা কী অবরোধ করবে, সেই ঘোষণার কথা কেউ শোনেনি, জানেও না। অথচ বলা হচ্ছে দেশব্যাপী অবরোধ। এর কী অর্থ দাঁড়ায়, সেটি বোঝা বড় মুশকিল।</p> <p style="text-align: justify;">বিএনপির নেতারা ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেন। এরপর মঙ্গলবার বিরতি রেখে রবি, সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবার কখনো ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ, কখনো বা হরতাল ও অবরোধ দুটিই বলা হচ্ছে। এ যেন বিতর্কের মতো আসন্ন নির্বাচন ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিরাজনীতিতে বারোয়ারি কর্মসূচির আমদানি। বিএনপির বেশ কিছু নেতা জেলে কিংবা আত্মগোপনে আছেন। ২৮ অক্টোবর পুলিশ-সাংবাদিক আক্রমণ, পুলিশ হত্যা, বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ এবং পরবর্তী সময়ে অগ্নিসংযোগে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক নেতাকর্মী আটক হয়েছেন। </p> <p style="text-align: justify;">ফলে এসব হরতাল-অবরোধ ডাকাডাকি করে বিএনপির নেতাকর্মীদের খুব একটা রাস্তায় বের হয়ে আসতে দেখা যায় না। যাঁরা আসেন, তাঁরা ফটো সেশন করতে প্রত্যুষে রাস্তায় এক-দুই মিনিটের ঝটিকা সফর দিয়ে কেটে পড়েন। বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী একেক দিন একেক জায়গায় কয়েক মিনিটের জন্য আবির্ভূত হন আবার লাপাত্তা হয়ে যান। এরপর অনলাইনে এসে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রায় একইভাবে ঝটিকা মিছিল করে চলে যান। মাঝেমধ্যে তাঁদের চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয় যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহনও। নেতাকর্মীরা রাস্তায় ফটো সেশন শেষে সবাই গাঢাকা দেন। </p> <p style="text-align: justify;">দেশের অন্যত্র বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে মাঝেমধ্যে ভাঙচুর ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে প্রেস ক্লাবের আশপাশে যুগপৎ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকা ‘বাম তারকাদের’ একটি সাত দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা রাস্তায় মার্চ করেন, সরকার উৎখাতের বক্তৃতা করেন। তাঁরাই মূলত ওই এলাকায় হরতাল-অবরোধের দিনগুলোতে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। কিন্তু তাঁদের আশপাশ দিয়েই যানবাহন যেমন চলাচল করে, অফিসগামী ও সাধারণ মানুষও আসা-যাওয়া করে।</p> <p style="text-align: justify;">অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ থেকে এ রকমই দেখতে হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততার কোনো লক্ষণ কেউ আবিষ্কার করতে পারছে না। অথচ ‘বাম তারকারা’ দাবি করছেন, জনগণ স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাবে, নির্বাচন হতে দেবে না ইত্যাদি। অথচ  দেশ নির্বাচনের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। দলের সংখ্যা হিসাব করলে এখন বেশির ভাগ দলই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেও কোনো কোনো দল আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। ৩০ তারিখ বোঝা যাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কারা কারা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী অনলাইনে জানিয়েছেন, কঠোর কর্মসূচি আসছে। সেই কঠোর কর্মসূচি কী, তা তিনি বলেননি। আন্দোলনে বারোয়ারি কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সফল করা সম্ভব নয়। জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়া আন্দোলন সফল হতে পারে না।</p> <p style="text-align: justify;">বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনটি করে আসছে, সেটির মূল লক্ষ্যই ছিল সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন। এতে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিতে হবে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। এসব দাবিই তো বারোয়ারি হয়ে যায়। যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একমাত্র দাবিতে আন্দোলন হতো, তাহলে জনগণের সমর্থন যেমন পাওয়া যেত, সরকারেরও মতামত বোঝার সুযোগ ঘটত। </p> <p style="text-align: justify;">সরকার নিশ্চয়ই বিএনপির সেই যৌক্তিক দাবিকে উপেক্ষা করে থাকতে পারত না। কোনো না কোনোভাবে আলোচনা-সমঝোতায় এসে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশন ও সরকার উদ্যোগ নিত। উদ্যোগ গ্রহণে আন্তরিকতার অভাব ঘটলে তবেই সরকারবিরোধী আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। কিন্তু শুরুতেই তো বিএনপি বারোয়ারি দাবি উত্থাপন করে বসেছে, যেগুলো সরকারে এখন বিএনপি থাকলেও নিতে সম্মত হতো না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা ক্ষমতায় সরকারপ্রধান কে থাকবেন কিংবা নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে গঠিত হবে, সেটি তো মুখ্য বিষয় নয়, সেগুলোতে হাত দিতে গেলে সংবিধান সংশোধনের আবশ্যকতা দেখা দেয়।</p> <p style="text-align: justify;">একটি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য বারবার সংবিধান সংশোধন করার কোনো অর্থই কেউ যুক্তির ওপর দাঁড় করাতে পারবে না, যতই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের উদাহরণ টানা হোক না কেন। </p> <p style="text-align: justify;">সেসব নিয়ে অর্থহীন বিতর্ক করা যাবে, কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন পণ্ড করার আন্দোলনের দায় কাদের? ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়েও যে বিতর্ক রয়েছে, তাতে বিরোধীদের ছিল শৈথিল্য, নেতৃত্বের অভাব আর সরকারি দলের প্রার্থীদের ছিল বাড়াবাড়ি। এ ছাড়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি একদিকে যেমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি দেওয়ার প্রমাণ ও অভিজ্ঞতা দিতে পারেনি; অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করার পর সেই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন সংবিধানে কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। </p> <p style="text-align: justify;">দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকলে সর্বোচ্চ আদালত থেকেই তা নিষ্পত্তি করতে হয়। সংবিধানে যেহেতু সেই রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, তাই নতুন করে সেই ব্যবস্থার প্রয়োগ করতে গেলে তা সাংঘর্ষিকতার কারণে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এসব বিষয়ে বিএনপির নেতারা জেনেও কেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিয়ে সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে গেলেন, তা-ই বোধগম্য নয়। কারণ এ ধরনের আন্দোলন করে যদি দেশে কোনো ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়।</p> <p style="text-align: justify;">বিএনপি ২৮ অক্টোবরের আগে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলেও তাদের দাবিনামা ছিল বারোয়ারি অর্থাৎ বেশ কিছু জটিল দাবি; যেগুলো সরকার, সংবিধান এবং সব বিষয়ে সমঝোতার ওপর  নির্ভরশীল।  তবে এই দাবিগুলো নিয়ে সংসদ এবং বাইরে আলোচনা করা যেত। একমত হলে সংবিধান সংশোধন করা যেত। যেমনটি ১৯৯১ সালে করা গিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তা না করে ২৮ অক্টোবর ‘মহাযাত্রার’ নামে সরকার উৎখাতের যেসব আলামত দেখিয়েছিল, এর পরেই পরিস্থিতি বিএনপির হাত থেকে চলে যায়। সরকার আইনানুগভাবেই অগ্রসর হয়। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের বারোয়ারি কর্মসূচি দিয়ে জনসমর্থন হারাতে বসেছে। অথচ নির্বাচনে গিয়ে দলটি অনেক কিছুই অর্জন করতে পারত। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জনসমর্থন নিয়ে আন্দোলন করতে পারত। এখন বিএনপি যে স্বপ্ন দেখছে তার কতটা ধরা দেবে, সেটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।  </p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক</strong> : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়</p>
