<p style="text-align:justify">রেহেনা চা-বাগান, পূর্ব পাহাড় টি কম্পানি লি.—টিলার ওপরে এই সাইনবোর্ডের সামনে থামল আমাদের সিএনজিচালিত অটোরিকশা। চারপাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তা থেকে নেমে দক্ষিণমুখী পথ ধরে এগোতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল একজনের।</p> <p style="text-align:justify">জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, বিনোতার বাড়িটা কোন দিকে?’</p> <p style="text-align:justify"><img alt="চা-বাগানের ‘বিনোতা মা’" height="73" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/07-09-2024/67890.jpg" style="float:left" width="277" />‘আপনারা মায়ের বাড়ি যাবেন?’ পাল্টা প্রশ্নে ভাবলাম তিনি বোধ হয় বিনোতার সন্তান।</p> <p style="text-align:justify">‘উনি আপনার মা?’</p> <p style="text-align:justify">তিনি হেসে বললেন, ‘শুধু আমার না, বাগানের সব শ্রমিকের মা তিনি! আসেন আমার সঙ্গে।’</p> <p style="text-align:justify">বাড়িতে ঢুকতেই খালি পায়ে বেরিয়ে এলেন এক নারী। তামাটে চেহারা। পরনে প্রিন্টের মলিন সাদা শাড়ি। হাসিমুখে বললেন, ‘আসেন বাবু, ঘরে আসেন।’</p> <p style="text-align:justify">টিলার ওপর ছোট্ট মাটির ঘর। ঘরে জিনিস বলতে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার, একটি বিছানা আর থালাবাসন। মেঝেতে প্লাষ্টিকের বোতল নিয়ে খেলছে ১০-১১ বছরের এক শিশু। বললেন, ‘ওর নাম সৌরভ। আমার ছোট ছেলে।’</p> <p style="text-align:justify">পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারীর পুরো নাম বিনোতা ভূমিজ। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রেহেনা চা-বাগানের শ্রমিকজীবনের প্রাণ তিনি। তাঁর বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘দেশের মোট ২২৮টি চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির প্রথম ও একমাত্র নারী সভাপতি বিনোতা।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশে চা-বাগানের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে এই পদে তিনিই প্রথম নারী। সাধারণত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে পঞ্চায়েতপ্রধানের বিরুদ্ধে অনেক সময় নানা অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। কিন্তু এ পর্যন্ত বিনোতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। মানে তাঁর নেতৃত্বে সন্তুষ্ট শ্রমিকরা।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি</strong></p> <p style="text-align:justify">রেহেনা চা-বাগানের শ্রমিকরা বিনোতাকে ‘মা’ বলে ডাকেন। এই মায়ের জন্ম দেওরাছড়া চা-বাগানে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ। মা-বাবা ছিলেন চা শ্রমিক। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। স্বামী বুধুয়া ভূমিজও চা শ্রমিক ছিলেন। আট বছর আগে মারা গেছেন। অভাবের সংসার বলে বিয়ের পর শ্রমিকের খাতায় নাম লেখান বিনোতা। স্বামী বেঁচে থাকতেই নানা পেশার শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সরব ছিলেন। এতে বাগানে তাঁর একটা বিশেষ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।</p> <p style="text-align:justify">২০১৪ সালে পঞ্চায়েত কমিটির নির্বাচনে শ্রমিকরা বিনোতাকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। প্রথমবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হলেন। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ</strong></p> <p style="text-align:justify">শৈশবে দৈনিক ১২ টাকা মজুরিতে মায়ের সঙ্গে কাজে যেতেন। বাগানের নারী শ্রমিকদের কষ্ট ও বঞ্চনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই সভাপতি হয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে মনোযোগ দেন।</p> <p style="text-align:justify">রেহেনা চা-বাগানের শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। বিনোতা প্রথমেই বিদ্যালয় চালুর উদ্যোগ নেন। মালিকপক্ষ বাগানে স্কুল চালু করেছে। এখন সেখানে ২০ জন শিক্ষার্থী পড়ছে।</p> <p style="text-align:justify">বিনোতা শ্রমিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং গর্ভবতী নারীদের সেবায় একজন করে সেবিকা এবং মিডওয়াইফ আনার ব্যবস্থা করেছেন। একটি উপাসনালয় হয়েছে। বিনোতা সভাপতি হওয়ার পর শ্রমিকদের পাওনা নিয়ে নানা সমস্যা মিটেছে।</p> <p style="text-align:justify">আগে বাগানে টুকরিতে করে কাঁচা চা-পাতা মাপা হতো। একজন শ্রমিক ২৫ কেজি পাতা তুললে ২০ কেজির টাকা পেতেন। কিন্তু বিনোতার উদ্যোগে এখন গামছা বা কাপড়ে করে চা-পাতা মাপা হয়। পাঁচ কেজির বদলে ওজনে এক কেজি করে বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিনোতার উদ্যোগে চা-বাগানে বিশুদ্ধ পানির সমস্যাও দূর হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>শ্রমিক নেতা হিসেবে ব্যতিক্রম</strong></p> <p style="text-align:justify">বিনোতার বিষয়ে বাগানের চা শ্রমিক পার্বতী বলেন, ‘চা শ্রমিক হিসেবে নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে একজন নারী প্রতিনিধির মাধ্যমে আমাদের সমস্যার সমাধান সহজ।’</p> <p style="text-align:justify">বাগানের ম্যানেজার এ কে আজাদ বললেন, ‘বিনোতা ভালো মানুষ। শ্রমিকদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন। আমরাও সাধ্যমতো তাঁকে সহযোগিতার চেষ্টা করি।’</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘চা-বাগানের ভেতরের রাজনীতিটা জটিল। নানা বিষয়ে পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতিকে বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে হয়। তাই সভাপতি পদে সাধারণত নারীরা প্রতিযোগিতার সাহস করেন না। কিন্তু বিনোতা ব্যতিক্রম। তিনি পুরুষ সভাপতিদের চেয়েও অনেক বিষয়ে ভালো করছেন।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>বিনোতার দিনগুলো</strong></p> <p style="text-align:justify">ব্যক্তিজীবনে বিনোতা তিন মেয়ে আর দুই ছেলের মা। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে বউ নিয়ে আলাদা থাকেন। ছোট ছেলেকে নিয়ে এখন তাঁর সংসার। খুব ভোরে চা-রুটি খেয়ে বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের কাজের দেখভাল করেন, নিজে পাতা তোলেন। চা-পাতা মাপার সময় উপস্থিত থাকেন। ৩টার দিকে বাসায় ফেরেন। দুপুরে কোনো দিন দুটি রুটি, কোনো দিন পাতিছানা দিয়ে মুড়ি খান। রাতে ভাতের সঙ্গে থাকে আলুভর্তা, নয়তো কচুর লতি। পাতে মাছ-মাংস জোটে কালেভদ্রে। বললেন, ‘মাস চারেক আগে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছি।’</p> <p style="text-align:justify">দুর্গাপূজার সময় বোনাস পান। তখন নতুন কাপড় কেনেন। মাছ-মাংস খান। বললেন, ‘আমি ভালা পাই ভাত। রুটি তো চাবাতে পারি না। দাঁত ব্যথা করে। তবু ঠেকায় পড়ে খাওয়া লাগে। চাউলের কেজি ৬০ টাকা। তিন বেলা ভাত কিভাবে খাব?’</p> <p style="text-align:justify">এত অভাবের মধ্যেও তাঁর হাসি মিলেয়ে যায়নি। বললেন, ‘তা-ও যে এক বেলা ভাত খাইতে পারি—এটাই বা কম কী?’</p> <p style="text-align:justify">দায়িত্বে থাকা অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়টির স্থায়ী ভবন দেখে যেতে চান তিনি। যত দিন বেঁচে আছেন, শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করে যাবেন বলে জানালেন অদম্য এই নারী।</p>