ঢাকার ৫০টি থানার বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম তিন বছর পর আবার শুরু করেছে পুলিশ। 'নিজে নিরাপদ থাকুন অন্যকে নিরাপদে রাখুন' - এই প্রতিপাদ্য নিয়ে 'নাগরিক তথ্য সংগ্রহ সপ্তাহ ২০১৯' কার্যক্রমটি চলছে ২১শে জুন পর্যন্ত। এবার পূর্বে দেওয়া তথ্য সংগ্রহ ও হালনাগাদ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ইতোমধ্যেই রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ফর্ম পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ।
যে কারণে এই তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাস, উগ্রবাদ ও অপরাধের হুমকি থেকে বাসিন্দাদের সুরক্ষিত রাখতে এই তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম। কিন্তু তিন বছর পরে কেন আবার জোরেশোরে এই তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করছে পুলিশ?
ঢাকা মহানগরীর উপ পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলছেন, ‘'নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাছে বাসিন্দাদের তথ্য থাকলে কোন অপরাধী যেমন সহজে অপরাধ করার সাহস করবে না, তেমনি কোন ঘটনা ঘটলে আমরা সহজেই অপরাধীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’
সম্প্রতি ঢাকার পুলিশের ওপর কয়েক দফা বোমা হামলার ঘটনা ঘটে, যেসব হামলার দায় স্বীকার করেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইএস মতাদর্শীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ফলে নগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরো জোর দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। 
এর আগে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর, যখন দেশজুড়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযান চলছিল, তখন প্রথমবার নাগরিকদের এ ধরণের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নিজের নাম পরিচয় লুকিয়ে জঙ্গি বা অপরাধীরা যাতে লুকিয়ে থাকতে না পারে, সেজন্যই এই তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম।
নাগরিকদের যেসব তথ্য পুলিশকে জানাতে হবে
রাজধানীর বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশের একটি ফর্ম রয়েছে। প্রতিটি থানার বিট অফিসাররা তাদের এলাকার বাসিন্দাদের এই ফর্মটি পূরণ করে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করবেন।
ফর্মে ভাড়াটিয়া/বাড়ীওয়ালার নাম, পিতার নাম, জন্ম তারিখ, বৈবাহিক অবস্থা, স্থায়ী ঠিকানা, পেশা ও কর্মস্থলের ঠিকানা, ধর্ম, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জরুরী যোগাযোগ নম্বর, পরিবারের সদস্যদের বিবরণ, গৃহকর্মী ও ড্রাইভারের বিবরণ, আগের বাসার বাড়িওয়ালার নাম, ফোন ও ঠিকানা (ভাড়াটিয়াদের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে। এছাড়া ফর্মে ভাড়াটিয়া বা মালিকদের এক কপি ছবি সংযুক্ত করতে হবে। ফর্মের একটি কপি বাড়ির মালিক সংরক্ষণ করবেন, অপর কপিটি স্থানীয় থানায় জমা দিতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস নামের একটি বিশেষ সফটওয়্যারে এসব তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি ইউনিক ইনডেক্স নম্বর থাকে। ফলে সেই নম্বর বা জাতীয় পরিচয়পত্র, অথবা মোবাইল নম্বর দিয়ে সার্চ দিলেই কাঙ্ক্ষিত নাগরিকের বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে কারো আগে জঙ্গি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস থাকলে তাকে নজরদারি করা সহজ হবে। আবার অপরাধীরাও নজরদারিতে থাকার কারণে সহজে কোন অপরাধ করার সাহস করবে না।
পুলিশ জানিয়েছে, ১৩ জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২২ লাখ পরিবারের ৬৩ লাখ নাগরিকের তথ্য ওই সফটওয়্যারে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা আছেন ২ লাখ ৪১ হাজার ৫০৭ জন, ভাড়াটিয়া ১৮ লাখ ২০ হাজার ৯৪ জন, মেস সদস্য ১ লাখ ২১ হাজার ৪০ জন, অন্যান্য ১, ১০০ জন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৮২১ জন ও ড্রাইভার বা গৃহকর্মী হিসাবে আছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮৪ জন।
নাগরিকদের তথ্য কতটা সুরক্ষিত?
পুলিশকে দেওয়া এ তথ্যের গোপনীয়তা কতক্ষানি রক্ষিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেক বাসিন্দার।
ঢাকার কলাবাগানের বাসিন্দা শাহনাজ পারভিন বলছেন, ‘পুলিশকে তথ্য দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু সেখানে আমার, আমার পরিবারের সকল সদস্যের গোপনীয় তথ্য, এনআইডি নম্বর বা ফোন নম্বর থাকছে। সেটা কি পুলিশ ঠিকভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে?’
মিরপুরের বাসিন্দা মুনমুন আক্তার বলছেন, ‘এর আগেও একবার আমাদের বাড়ি থেকে সব তথ্য দেয়া হয়েছে। সেগুলোর কি হয়েছে জানি না। এখন আবার পুলিশ তথ্য চাইছে। খানিকটা ভয় কাজ করে, এসব নিয়ে আবার তারা কি করে না করে?’
এ বিষয়ে পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলছেন, ‘২০১৬ সাল থেকে আমরা নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করছি। কিন্তু এই তিন বছরে কোন তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ভবিষ্যতেও যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি। শুধুমাত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই আমরা এসব তথ্য সংগ্রহ করছি।’
কোথায় তথ্য দিতে হবে
ঢাকার ৫০টি থানা বা পুলিশ স্টেশনে ওই এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এজন্য এসব থানার বিট অফিসাররা সংশ্লিষ্ট এলাকার রাজনৈতিক, সামাজিক বা পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলে প্রতিটি বাড়ি যাচাই করে দেখবেন যে, কেউ বাদ পড়েছে কিনা। বাদ পড়লে তাকে ফর্ম দিয়ে তথ্য পূরণ করে ফেরত নেবেন। এছাড়া বাসিন্দারা চাইলে ডিএমপি ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম নামিয়ে পূরণ করে স্থানীয় থানায় জমা দিতে পারবেন।
এসব ফর্ম পরে ডিএমপি হেডকোয়াটার্সে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে এসব তথ্য সিআইএমএস সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পরবর্তীতে পুলিশ দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই করে দেখবে সবার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা। সেখানে বাদ পাওয়া গেলে পুনরায় তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা