বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হলেও এটি এখন বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনি ও ক্ষমতামুখী সাংবাদিকতা সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বড্ড অন্তরায় সৃষ্টি করছে। সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।’
শনিবার (৮ মার্চ) বিকেলে সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
আরো পড়ুন
আগামীকাল বিএনপির ইফতার মাহফিল স্থগিত
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই। এই যখন অবস্থা, তখন সাংবাদিকদের একটি অংশ সেলফ সেন্সরশিপে চলে গিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকতা কি অপরাধ? জনস্বার্থে তথ্য অনুসন্ধান এবং তা প্রকাশ করতে গিয়ে কেন সাংবাদিকেরা ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন? সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ খুবই জরুরি।”
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সামনে যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এ পেশার স্বাধীনতা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে সত্য তুলে ধরা যায় না। আর সত্য লেখা না গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে পাঠক বা দর্শক প্রত্যাখ্যান করেন।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিবেকের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে।
অপসাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা ,তথ্য সন্ত্রাস পরিহার করে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হবে। সঠিক তথ্য জেনে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, সংবাদমাধ্যমের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা। আজকের তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ভুয়া খবর বা প্রপাগান্ডা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকেই প্রকৃত সাংবাদিকতা এবং ভুয়া সংবাদ বিভ্রান্তিতে পড়েন। গুজব, মিথ্যা আর চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য সমাজ তথা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে। তাই সাংবাদিকদের আরো সচেতন হতে হবে।’
বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, ‘সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তির কারণে ভয়ভীতি মাথায় রেখে সাংবাদিকদের কাজ করতে হচ্ছে। বিভাজনের কারণে সাংবাদিকরা এই ভয়-ভীতি থেকে নিজেদের বের করতে পারেন না। আগে ইউনিয়ন যখন একটা ছিল। চাকরি গেলে বা কোনো চাপের মুখে পড়লে বা প্রতিষ্ঠান পাওনাদি না দিলে মালিকদের সঙ্গে দেন-দরবারের জন্য বা অধিকার নিশ্চিত করতে গেলে তার পাশে নেতারা আছেন, এই ভরসাটুকু পেলে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে যেত। এখন অনৈক্যের কারণে ইউনিয়ন সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই সংকট উত্তরণের জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।’
আরো পড়ুন
আরব প্রস্তাবে সমর্থন মুসলিম ও ইউরোপীয় নেতাদের
সাংবাদিকদের এই নেতা বলেন, “‘আমরা-ওরা’, এসব বিভাজন আগের সাংবাদিকতায় ছিল না। ইদানীং এটা বড্ড বেড়ে গেছে। এক বলয়ের সাংবাদিকরা অন্য বলয়ের সঙ্গে এক টেবিলে বসেনও না। ইদানীং সাংবাদিকদের প্রথমেই একটি জার্সি গায়ে দিতে হয়। অর্থাৎ তুমি সরকারি দলের কিংবা বিরোধী দলের এ রকম কিছু একটা হতে হবে। খুব কম সাংবাদিকই আজকের সাহস করে বলতে পারছেন ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষক নই, আমার গায়ে কোনো জার্সি নেই, আমি কেবল দেশের সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধি’। আগেও সাংবাদিকরা রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করতেন, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে থাকতেন পুরো নিরপেক্ষ। এখন সাংবাদিকদের কেউ কেউ দলদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ।”
তিনি বলেন, ‘নিজেদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা মর্যাদা হারাচ্ছেন। যখন কোনো একজন ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তিনি তখন তিনি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। কিন্তু যখন কোনো সাংবাদিক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নন। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে মিডিয়ার প্রতিনিধি। আমরা যেন সাংবাদিক থাকি, কর্মচারী হয়ে না যাই। ক্ষমতাশালীদের অপকর্মগুলো সাংবাদিকরা তুলে না ধরলে এসব অপকর্মের লাগাম পরানোর কাজটি করবেন কী করে। তাহলে তো অপকর্ম বাড়তেই থাকবে। সমাজ ভেঙে পড়বে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সাংবাদিকরা দমে যেতে পারেন না। সাংবাদিকদের মোটা বেতন নেই; ঈদ-পূজায় বোনাসের নিশ্চয়তা নেই, অবসরের পর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের মতো পেনশন নেই; ক্যালেন্ডারে লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া ছুটি তো নেই-ই। কটা দিন ছুটি নিয়ে পরিবারকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। উৎসবের দিনেও সংবাদ সংগ্রহে কিংবা প্রচার-প্রকাশে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার পরও নিরলসভাবে কাজ করে যান সাংবাদিকরা।’
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে যেখানেই রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন কিংবা অত্যাচার হয়েছে, সেখানেই চিন্তাশীল মানুষদের প্রতিরোধ এসেছে। সাংবাদিকরা এ চিন্তাশীলদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সমাজের বুকে। তাই তাদের কাজে থাকে সুন্দর আর সত্য সৃষ্টির গভীর উন্মাদনা। পাশাপাশি প্রতিদিন নতুন কিছু জানার, জানাবার, নতুন কিছু শেখার এবং অন্য কিছু করার ভীষণ রকম তাগিদও আছে সাংবাদিকতায়। সে তাগিদেই সব ঝুঁকি, সব কষ্ট এড়িয়ে দুঃসাহস দেখাতে পারেন সাংবাদিকরা। সত্য অনুসন্ধানে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের অদম্য মানসিকতার সব চাহিদা। এ জন্য সাংবাদিকদের বলা হয়, সমাজের ওয়াচডগ। ভারত এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ফেক সাংবাদিকতা হয়েছে।
বিগত ফ্যসিস্ট সৈরাচার সরকার তার প্রমাণ। অসত্য লেখা বর্জন করতে না পারলে সাংবাদিকতা সংকটের মুখে পড়বে।
সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সভাপতি গণেশ দাসের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের সহকারী মহাসচিব ড. সাদিকুল ইসলাম স্বপন, বিএফইউজে নির্বাহী পরিষদ সদস্য মির্জা সেলিম রেজা, বগুড়া প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক ওয়াসিকুর রহমান বেচাল, সদস্যসচিব সবুর শাহ লোটাস, মমিনুর রশিদ শাইন, মতিউল ইসলাম সাদিসহ অন্যরা।