বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ছিলেন তাদের ছত্রচ্ছায়ায়। ছিলেন দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুও। টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির সঙ্গেও ছিল বেশ সখ্য। নানাবাড়ি গোপালগঞ্জে হওয়ায় সব সময় আওয়ামী ভাব ধরতেন।
পরিচয় দিতেন শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে।
ওয়াসার বিতর্কিত এমডি তাকসিনও তার আত্মীয়। আর সেই ব্যক্তিই এবার হঠাৎ করে ভোল পাল্টে গত ৫ আগস্টের পর হয়ে গেছেন বড় ‘বিপ্লবী’। নাম তার আহসান আকবর।
গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সফট পাওয়ার, হার্ড অ্যাবিউজ : দ্য মিডিয়া মাফিয়া অব আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করেন এই আহসান আকবর। কথিত সেই সেমিনারের পরপরই সাংবাদিক মহলে কৌতূহল জাগে আহসান আকবর সম্পর্কে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য। ওই সেমিনারে অংশ নেওয়া একাধিক সাংবাদিকের দাবি, সেমিনারের শিরোনাম দেখে মনে হয়েছিল— গোটা মিডিয়ার অপব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
যদিও সেমিনারটি ছিল মূলত আহসান আকবরের ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে কুৎসা রটানোর একটি সংবাদ সম্মেলন।
সেমিনারটিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার।
সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা আহসান আকবরকে আ. লীগের শীর্ষ লোকজনের সঙ্গে তার সুবিধা নেওয়ার প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন।
মূলত সেসব প্রশ্নের মুখে টিউলিপ সিদ্দিক ও রাদওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেন কথিত এই ‘বিপ্লবী’।
আহসান আকবর জানান, তিনি টিউলিপের ক্যাম্পেইনে ছবি তুলেছিলেন।
আর তার কারণ- সেটা দেখিয়ে যাতে জেমকন গ্রুপের কর্ণধারদের কাবু করা যায়।
সূত্রের বরাতে জানা যায়, আহসান আকবর আসলে টিউলিপের বিভিন্ন নির্বাচনে নিয়মিত ও জোরাল ক্যাম্পেইন করেছিলেন। এমনকি টিউলিপের স্বামী ক্রিসকে বাংলা শেখানোর কাজটিও তিনিই করেছেন।
আহসান আকবর ঢাকা লিট ফেস্টে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অতিথি হিসেবে নিয়ে যান। আর সেখানে সিআরআই থেকে প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের ছোটবেলার জীবনী নিয়ে একাধিকবার বিশেষ আলোচনা ও স্টল রাখা হয়।
সূত্রের বরাতে প্রাপ্ত নথিতে পাওয়া যায়, ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজন করত যাত্রিক নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাদাফ সাযও লিট ফেস্টের অন্যতম একজন পরিচালক।
লিট ফেস্টের অপর পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান লিট ফেস্টে ব্যাপক স্পন্সর করে। কিন্তু আহসান আকবর ও সাদাফ সাযের ভূমিকা ছিল ভিন্ন– শুধুই টাকা তোলা।
আহসান আকবর ও সাদাফ সায যৌথভাবে লিট ফেস্ট পরিচালনার নামে বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আওয়ামী লীগ সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা স্পন্সর হিসেবে আদায় করতেন। তবে লিট ফেস্টের নামে তোলা টাকা, এমনকি সরকারি অনুদানও যেত যাত্রিক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লিট ফেস্টের ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের দাবি, এত টাকা তোলার পরও প্রতিবছরই ভেন্ডরদের পেমেন্ট বাকি থাকত। এ রকম কেন হয়েছে— বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে, যেহেতু এখানে সরকারের তথা জনগণের টাকাও অনুদান হিসেবে ছিল। এখানে আরো উল্লেখ্য যে আহসান আকবর ও সাদাফ সায দুজনই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের অনুবাদ সংক্রান্ত সাব-কমিটির কো-অপ্ট সদস্য ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা লিট ফেস্টে বিদেশ থেকে যেসব অতিথি আনা হতো, তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে আনা হয়েছিল। যাতে সরকারের কোষাগারে কর দিতে না হয়। কর ফাঁকি ছাড়াও অতিথিদের উচ্চ অঙ্কের সম্মানির খাত দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে আহসান আকবর। এমনটাই অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিট ফেস্টের একজন সাবেক কর্মী। এই সূত্র মতে- সেই টাকা আহসান আকবর লন্ডনেও পাচার করেছেন।
সূত্র আরো জানায়, আহসান আকবর দীর্ঘদিন লন্ডনের টিটুলিয়া টি ইউকের সিইও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আহসান আকবরের অদক্ষতা ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ নিয়ে নয়ছয় করার কারণে বছর দুয়েক আগে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এ সময় থেকে পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে জেমকন গ্রুপের কর্ণধারদের কাছে নানা অছিলায় টাকা চাইতে শুরু করেন আহসান আকবর।
একপর্যায়ে সাত লাখ ৩০ হাজার পাউন্ড ‘ক্ষতিপূরণ’ দাবি করে বসেন। লিখিত সেই দাবির ই-মেইল এই প্রতিবেদক দেখেছেন।
জেমকনের কর্ণধাররা এ রকম উদ্ভট দাবিতে সম্মতি না জানালে আহসান আকবর তাদের নানা ধরনের হুমকি দিতে শুরু করেন। আর সেই হুমকি দেওয়া ই-মেইলও এ প্রতিবেদক দেখেছেন। একপর্যায়ে জেমকনের মালিকরা বাধ্য হয়ে যুক্তরাজ্যে আদালতের দ্বারস্থ হন।
পরবর্তীকালে আদালত জরিমানাসহ আহসান আকবরের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। মূলত এর পর থেকেই আহসান আকবর বাংলাদেশে জেমকনের মালিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার ক্যাম্পেইনে নামেন।
সাহিত্য অঙ্গনের একজন জানান, সব জায়গায় নিজেকে কবি এবং লেখক হিসেবে দাবি করলেও বাজারে আহসান আকবরের একটি মাত্র কবিতার বই রয়েছে। আর তার সেই বইটিও জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল লাইটস থেকেই ছাপা। তা-ও আবার ২০১৩ সালে।
আহসান আকবরের সাম্প্রতিক ‘সেমিনার’ নিয়ে আরো সন্দেহ জাগে মিডিয়াকর্মীদের। কেননা সেখানে তিনি আ. লীগের সাফাই গাওয়ারও চেষ্টা করেন।
নিজের বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ঢাকা লিট ফেস্ট প্ল্যাটফরমেও অপব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ।
সেখানে তার দাবি ছিল, শেখ হাসিনার ভাগ্নের নেতৃত্বে প্রচার সংস্থা সিআরআই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমগুলোকে প্রভাবিত করেছে। যেমন— ঢাকা লিট ফেস্ট প্যানেলের অপব্যবহার, যথাযথ নির্বাচন ছাড়াই পেন বাংলাদেশ দখল এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করেছে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে নিজের বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সবাই খারাপ নয়। ওপরের লোকজন খারাপ হলেও মাঠের অনেকেই ভালো।
মূলত তার এই বক্তব্যে অনেকের ধারণা— আহসান আকবর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবী সেজে আওয়ামী লীগের বিষয়ে সফট ধারণা তৈরির জন্য মাঠে নেমেছেন।
এ ধরনের ব্যক্তিগত ও মিশ্র উদ্দেশ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আশরাফ কায়সারের মতো ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণে উপস্থিত অনেক সাংবাদিকও বিস্মিত হয়েছেন ।