ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনে বিকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করেছে আরব দেশগুলো। মিসরের রাজধানী কায়রোতে এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে আরব নেতারা গাজার জন্য ৫৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গাজা দখল’ এবং দুই মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে নেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে নিজেরাই বিকল্প প্রস্তাব হাজির করেছেন।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজা পুনর্গঠনে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে।
বিপুল এই অর্থ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গেও শিগগিরই একটি সম্মেলনে বসতে যাচ্ছে আরব দেশগুলো। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ কখন শুরু হবে তা জানা যায়নি।
আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ আবুল ঘেইত ঘণ্টাব্যাপী এই সমাবেশের শেষে ঘোষণা করেছেন, ‘মিসরের পরিকল্পনা এখন একটি আরব পরিকল্পনা।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিশেষ উল্লেখ না করেই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আরবদের অবস্থান হলো- যেকোনো স্থানচ্যুতি প্রত্যাখ্যান করা, তা স্বেচ্ছায় হোক বা জোরপূর্বক’।
আরো পড়ুন
বিস্ফোরকবোঝাই গাড়িসহ পাকিস্তানে আত্মঘাতী হামলা, ৭ শিশুসহ নিহত ১২
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত এবং হতবাক করে দেওয়া প্রস্তাব ‘মধ্যপ্রাচ্য রিভেরা’ তৈরির পাল্টা জবাব জানাতে মিসর ৯১ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত খসড়া তৈরি করেছে। যার প্রতি পৃষ্ঠায় রয়েছে বিশাল পাবলিক ভবনের ছবি।
মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি তার উদ্বোধনী ভাষণে দ্বী-রাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান জানান। ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
মিসরের নেতৃত্বে এই পরিকল্পনা শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার মিত্ররা এটিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পরিকল্পনাটিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, গাজা সাময়িকভাবে ‘গাজা ব্যবস্থাপনা কমিটি’ দ্বারা পরিচালিত হবে, যা ফিলিস্তিনি সরকারের অধীনে থাকবে এবং দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে গঠিত হবে। এ ছাড়া, নিরাপত্তা নিশ্চিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে এখানে যদি হামাসের কোনো ভূমিকা থাকে, তাহলে কী ভূমিকা পালন করবে, সেই বিষয়টি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
কিছু আরব রাষ্ট্র হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার আহ্বান জানাচ্ছে বলে জানা গেছে। অন্যরা বিশ্বাস করেন, এই সিদ্ধান্তগুলো ফিলিস্তিনিদের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে হামাস স্বীকার করেছে, গাজা পরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে, ‘নিরস্ত্রীকরণ একটি লাল রেখা’।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ‘দূরদর্শী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বারবার হামাসের জন্য, কিন্তু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্যও ভবিষ্যতের কোনো ভূমিকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
নিরাপত্তার আরেকটি সংবেদনশীল বিষয় হলো, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মোতায়েনের আহ্বান জানানো। পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের জন্য আগামী মাসে একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো বিশাল খরচের কিছু অংশ বহন করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেউই বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত নয়, যদি না তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হয় যে আরেকটি যুদ্ধে ভবনগুলো ভেঙে পড়বে না। কারণ, নাজুক যুদ্ধবিরতি এবং সম্ভাব্য সংঘর্ষের আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা এখনো দ্বিধায় রয়েছেন।
আরো পড়ুন
রোজায় প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া, নাইজেরিয়ায় আটক ২৫ মুসলিম
গাজা পুনর্নির্মাণের এই নতুন আরব পরিকল্পনাটি তিনটি পর্যায়ে প্রকাশিত হবে। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ছয় মাসের প্রাথমিক সময়কাল এবং একে প্রাথমিক পুনরুদ্ধার পর্যায় বলা হবে। ওই পর্যায়ে বিপুল পরিমাণে ধ্বংসস্তূপ অপসারণ শুরু করা হবে, পরবর্তী দুটি ধাপ কয়েক বছর স্থায়ী হবে। এই সময়ের মধ্যে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের (যাদের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন বলে জানা গেছে) অস্থায়ী স্থানে রাখা হবে।
পরিকল্পনায় চকচকে ছবিতে তাদের সুন্দর এলাকায় নকশা করা আবাসন ইউনিট হিসেবে দেখানো হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্কুল ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎলাইন পর্যন্ত জীবনযাত্রার সব মৌলিক বিষয়ই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার ভবিষ্যৎ চিত্র কেমন হবে তা নিয়ে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি।
ওই ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, গাজাকে ইউরোপের রিভেরার মতো এক বিলাসবহুল রিসোর্টে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভিডিওতে ট্রাম্পের একটি স্বর্ণের মূর্তি দেখা যায়। এ ছাড়া, মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ককে হুমুস (মধ্যপ্রাচ্যে পরিচিত এক বিশেষ ধরনের রুটি) খেতে দেখা যায়। ভিডিওতে আরো দেখানো হয়েছে, ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সমুদ্রসৈকতে বসে ককটেল পান করছেন। তাদের চারপাশে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বিলাসবহুল ইয়ট ও ঝলমলে শহরের দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
ভিডিওটি বর্তমান গাজার চিত্র দিয়ে শুরু হয়েছে। যেখানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর ও ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত এলাকাগুলো দেখানো হয়েছে। সেখানে খালি পায়ে শিশুদের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটতে দেখা যায়। এরপর একটি শিরোনাম দেখ যায় ভিডিওটিতে ‘এরপর কী?’
এরপর, খালি পায়ে হাঁটতে থাকা শিশুরা একটি অন্ধকার গুহাসদৃশ টানেলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়, আর তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় গাজা উপকূলে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, রাস্তায় বিলাসবহুল স্পোর্টস কার এবং সমুদ্রে সারি সারি ইয়ট।
পটভূমিতে একটি গান বাজতে থাকে, যেখানে শুনতে পাওয়া যায়, ‘ডোনাল্ড আসছে তোমাদের মুক্ত করতে। ট্রাম্প গাজা ঝলমলে আলোর মতো উজ্জ্বল। সোনালি ভবিষ্যৎ, নতুন দিগন্ত। নাচো-গাও, কাজ শেষ।’
এ সময় ভিডিওতে লম্বা দাড়িওয়ালা ও বিকিনি পরা নারী নৃত্যশিল্পীদের পাশাপাশি ট্রাম্পের মাথার আকৃতির একটি স্বর্ণের বেলুন হাতে ধরে রাখা একটি শিশুর দৃশ্য দেখানো হয়। ভিডিওতে ইলন মাস্ককে সমুদ্রসৈকতে নাচতে দেখা যায়, যেখানে তার ওপর দিয়ে মার্কিন ডলারের ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে এবং তিনি খাবার উপভোগ করছেন। গাজার কেন্দ্রে ‘ট্রাম্প গাজা’ লেখা সংবলিত বিশাল এক ভবন দেখা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে ভিডিও পোস্ট করে তীব্র ক্ষোভ এবং ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
কায়রোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিসরের পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিংয়ে অংশ নেওয়া একজন পশ্চিমা কূটনীতিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাদের মনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা ছিল।’ কায়রোর প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংকের টেকসই বিষয়ক পেশাদার থেকে শুরু করে হোটেলের দুবাই ডেভেলপার পর্যন্ত বিস্তৃত দক্ষতার বিবেচনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। হিরোশিমা, বৈরুত এবং বার্লিনসহ ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা অন্য বিধ্বস্ত শহরগুলো থেকেও শিক্ষা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত নকশাগুলো ‘নতুন কায়রো’ তৈরির ক্ষেত্রে মিসরের নিজস্ব অভিজ্ঞতা দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে।
এদিকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি তার ধারণাগুলো কারো ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না, তবুও তিনি তার পরিকল্পনাই ‘কার্যকর’ বলে মনে করেন। এখন আরব রাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের ওপর নির্ভর করছে বাকি বিষয়, প্রমাণ করতে হবে, তাদের পরিকল্পনাই একমাত্র পরিকল্পনা।
সূত্র : বিবিসি