কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বন্দুকধারীদের হামলায় ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের তালিকায় কাশ্মীর থেকে কেরালা, গুজরাট থেকে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম—বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের নাম রয়েছে। এই হামলায় কেবল দেশজুড়ে নয়, কাশ্মীরের মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ ছড়িয়েছে। কারণ, পর্যটকরা কাশ্মীরের মানুষের জীবিকা নির্বাহের বড় উৎস।
হামলার পর সামাজিক মাধ্যমে দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এই হামলার সময় নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল? দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২০ মিনিট হামলা চলার পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
‘কেউ সাহায্য করতে আসেনি’
পুণের বাসিন্দা আশাবরী জানান, তিনি তার বাবা-মা ও আত্মীয়দের সঙ্গে পেহেলগাম ছিলেন। হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হন।
তিনি জানান, ‘হামলার সময় আমাদের পাশে কেউ ছিল না। কেবল খচ্চরচালকরাই আমাদের সাহায্য করেছেন।’
তিনি দাবি করেন, ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী এলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
‘নিরাপত্তা আরো কড়া হওয়া উচিত ছিল’
সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক ১৫ কোরের সাবেক কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে জে এস ধিলোঁ বলেন, ‘বৈসরন উপত্যকার মতো পর্যটক-ভরা জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি থাকা উচিত ছিল।
নিরাপত্তাব্যবস্থা গতিশীল হলেও এটি নিয়মিত পর্যালোচনা দরকার।’
অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার যশোবর্ধন আজাদ বলেন, ‘এই হামলার পেছনে স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। পেহেলগাম দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ ছিল, পর্যটকনির্ভর এই এলাকায় সাধারণ মানুষ এমন হামলার বিরুদ্ধে। হামলাকারীরা কৌশলে এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পারছি হামলাকারীদের সম্পর্কে আগে থেকেই গোয়েন্দা তথ্য ছিল।
তবুও তারা সফল হয়েছে। এর বিশ্লেষণ দরকার, এবং এটিকে বড়সড় শিক্ষা হিসেবেও নেওয়া উচিত।’
সহিংসতা কি কমেছে?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কাশ্মীরে ৩৪ লাখ পর্যটক গিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ১১ লাখে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তা এক কোটি আট লাখ ছাড়ায়। পর্যটনের ওপর নির্ভর করে কাশ্মীরের অর্থনীতি—২০১৯-২০ সালে পর্যটনের অবদান ছিল জিডিপির ৭.৮৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৪৭ শতাংশে। তবে সহিংসতা পুরোপুরি থেমে যায়নি।
সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল বলছে, ২০২৩ সালে ১২ জন বেসামরিক, ৩৩ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ৮৭ জন চরমপন্থী নিহত হয়। আর ২০২৪ সালে (এখন পর্যন্ত) ৩১ জন বেসামরিক, ২৬ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ৬৯ জন চরমপন্থী নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বলছেন, বড় ঘোষণা দেওয়ার আগে আরও ভালো করে পরিস্থিতি সামলানো উচিত ছিল।
‘পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে’
এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘পর্যটকরা সফট টার্গেট, তাই তাদের ওপর হামলা অনেক সহজ। অমরনাথ যাত্রার মতো বড় আয়োজনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা থাকে। তেমনভাবেই পর্যটনকেও সামলাতে হবে। পর্যটকদের নির্দিষ্ট নিরাপদ এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।’
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ধিলোঁ বলেন, ‘পর্যটকদের সংখ্যা এত বেশি, যে প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। স্থানীয় গাইড, হকার, চালকসহ অনেকেই ভিড়ে থাকেন। এর মধ্যেই চরমপন্থীরা লুকিয়ে থাকতে পারে।’
ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট-এর পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, ‘এই ধরনের হামলার ফলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সরকারের উচিত সাময়িক হলেও কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া, না হলে কাশ্মীরের পর্যটন ধ্বংস হয়ে যাবে।’ ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সরকার পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ ঘটনার পর কি সেই নীতি বদলাবে?
এরপর কী হবে?
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, হামলার জবাব শিগগিরই দেওয়া হবে। তবে কবে এবং কিভাবে, তা জানা যায়নি।
যশোবর্ধন আজাদের মতে, ‘এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। তারা চায় আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে। হামলাকারীদের জীবিত ধরে পাকিস্তানের ভূমিকা প্রমাণ করতে হবে এবং তারপর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সংলাপের পক্ষে, কিন্তু এখন যুদ্ধবিরতির বাস্তবতা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। পাকিস্তান এতে বেশি লাভবান হচ্ছে।’
অজয় সাহনি মনে করেন, ‘কাশ্মীরে দীর্ঘ ৩০ বছরের সন্ত্রাসবাদ এখন শেষ পর্যায়ে। ভারত সফল হয়েছে অনেকটা। তবে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা না গড়ে তুললে সন্ত্রাসের মূল টেনে তোলা সম্ভব নয়।’ তার কথায়, ‘রাজনীতিবিদদের উসকানিমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে। গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় ও পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে হবে। স্থানীয়দের পাশে না থাকলে কোনো অভিযান সফল হবে না।’
সূত্র : বিবিসি