যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই করপোরেট করহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে সংকটের মধ্যে থাকা পোশাক খাতের রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট করহার ১২ শতাংশ। সবুজ কারখানার জন্য এই হার ১০ শতাংশ।
তবে দেশের বিভিন্ন খাতের জন্য করপোরেট করহার ২৭.৫০ শতাংশ। তাই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাক খাতে করহার বাড়িয়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বর্তমানে অর্থ আইন ও এসআরওর মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের জন্য বিভিন্ন রকমের করপোরেট করহার নির্ধারণ করেছে এনবিআর। ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কম্পানির ক্ষেত্রে ২২.৫০ শতাংশ, ১০ শতাংশের কম শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ, কম্পানি আইনের অধীন এক ব্যক্তি কম্পানির ক্ষেত্রে ২২.৫০ শতাংশ, প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানির ক্ষেত্রে ২৭.৫০ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বীমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩৭.৫০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বীমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৩৭.৫০ শতাংশ, সিগারেট-বিড়ি-জর্দা-গুলসহ তামাকজাত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, ট্রাস্টের ক্ষেত্রে ২৭.৫০ শতাংশ, স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলের ক্ষেত্রে ২৭.৫০ শতাংশ, ব্যাক্তিসংঘের ক্ষেত্রে ২৭.৫০ শতাংশ, সমবায়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, পাটজাত শিল্পের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ, শাখা-লিয়াজোঁ অফিস ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার ক্ষেত্রে এই হার ২৭.৫০ শতাংশ।
তবে শর্ত পূরণ করলে কিছু ক্ষেত্রে করহার ২.৫০ পর্যন্ত কমতে পারে।
এনবিআরের সদস্য (করনীতি) এ কে এম বদিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পোশাক খাত দীর্ঘদিন ধরেই একটা কর সুবিধা ভোগ করে আসছে। আইএমএফের চাপ, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপ এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে করপোরেট করহারে বৈষম্য দূর করতে এনবিআর এ বিষয়ে ভাবছে। তবে এখনই কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রস্তাব অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া হবে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত পেলে তা কার্যকর হবে।’
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে এককভাবে ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৮.১৭ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৬.১৩ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রপ্তানি বিশ্বব্যাপী ১০.৬৪ শতাংশ বেড়ে ২৬.৭৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
এই খাতের রপ্তানি আয় যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর এখন করপোরেট করহার বৃদ্ধি করা অযৌক্তিক হবে বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, এতে ব্যবসায়ের খরচ বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থানে জটিলতা তৈরি হবে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে যে শক্ত অবস্থান তা নষ্ট হতে পারে।
নিট পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত এমনিতেই আছে নানা সংকটে। এখন করপোরেট করহার বাড়ানো এই খাতের জন্য অবিচার হবে। এ ছাড়া ১২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে করপোরেট করহার আরো অনেক বেশি। সরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম কর আদায় করে। সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। পাঁচ বছরের জন্য সংসদ এই করহার নির্ধারণ করে দিয়েছে। ফলে নতুন সংসদ ছাড়া করপোরেট করহার বাড়ানো সম্ভব নয়। আর এই মুহূর্তে করহার বাড়ানোও হবে অযৌক্তিক।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত সব সরকার দেশের রপ্তানি বাড়াতে অনেক চেষ্টা করেছে। অন্যান্য খাতকেও অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতই রপ্তানি বাড়াতে পেরেছে এবং ধরে রেখেছে। এই খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরি করেছে। সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনিতেই আমাদের ব্যবসায়ের খরচ বেড়ে গেছে। ফলে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি থাকায় ব্যবসা সহজীকরণও হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার বৃদ্ধির উদ্যোগ বড় একটা সমস্যা। আজকে আবার ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সময় বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি জাহাজীকরণের খরচও বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানে জটিলতা ও রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করবে।’
উদ্যোক্তারা করপোরেট করহার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা দিয়েছেন ভিন্ন মত। তাঁরা বলছেন, করনীতির সংস্কার করার এখনই উপযুক্ত সময়। এই সংস্কার উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এ ছাড়া করপোরেট করহার কম হলেই দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বৈশ্বিক এই সংকটের মধ্যে এই খাতের ওপর আরেকটা ধাক্কা দেওয়া ঠিক হবে না বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়করের হিসাবটা মুনাফার ওপর নির্ভর করে। এটা (করপোরেট করহার বৃদ্ধি) থেকে এনবিআরের সরে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ আমাদের কর খাতের সংস্কার লাগবে। সামনের দিনে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বিভিন্ন ধরনের নগদ সহায়তা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সব দেশের ওপরই ট্যারিফ বসিয়েছে, শুধু বাংলাদেশের ওপর না। এর আপেক্ষিক প্রভাব এখনো নিশ্চিত নয়। এখন চলমান সংস্কার থেকে পিছিয়ে গেলে তো হবে না। সংস্কারে না গেলে উনাদের জন্যই যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি লাগবে, সেই জায়গায় সাপোর্ট করার ক্ষমতা সরকারের থাকবে না।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করপোরেট করহার কম থাকলেই যে দেশে বিনিয়োগ আসবে, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, সরকারি দপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার সহজলভ্যতা বিনিয়োগ বাড়ার প্রধান শর্ত। শুধু করপোরেট করহার কম থাকলেই দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না।’
জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) ড. সৈয়দ আমিনুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চেয়ে বেশি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিলে ক্রয়াদেশ বেড়ে যেতে পারে। চীনের যে বিনিয়োগ এ দুই দেশে গিয়েছিল, সেটা আমাদের দেশে চলে আসতে পারে। অর্ডার বাড়লে আমাদের লোকসান কমে আসবে। আইএমএফের চাপ, রাজস্ব আদায়ের চাপসহ যেকোনো ধরনের চাপই থাকুক না কেন, বৈশ্বিক এই সংকটের মধ্যে এই খাতের ওপর আরেকটা ধাক্কা দেওয়া ঠিক হবে না।’