গত সোমবার বিশ্বব্যাপী ডাকা ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ পালিত হয়। বিক্ষোভে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত লাখো জনতার সামনে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারি বলেন, ‘মার্চ করতে গিয়ে লাথি-গুঁতা সব খেয়েছি। তার পরও এই গণজমায়েত, গণসমুদ্রে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পেরেছি ফিলিস্তিন, আল-আকসার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরে হতে পারি, কিন্তু এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে আমাদের একেকজনের হৃদয়ে-বুকের ভেতর বাস করে একেকটা ফিলিস্তিন। আমাদের হৃদয়ে বাস করছে একেকটা গাজা।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই নির্দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের আগে থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অভিমুখে রওনা হয় সাধারণ মানুষ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিবাদী মানুষ শাহবাগের উদ্দেশে আসতে থাকে। দুপুর গড়াতেই পুরো গণজমায়েতস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। দুপুরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, জিরো পয়েন্ট, পুরানা পল্টনসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
এ সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পোস্টার ঘিরে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় অনেককে। ফিলিস্তিনি জনতা ও নিরীহ শিশু হত্যার প্রতিবাদে প্রতীকী লাশ ও কফিন নিয়েও মিছিল করতে দেখা যায়।
ইসরায়েলের পণ্য বর্জনের আহবান
ঘোষণাপত্রে সারা দেশের মানুষের প্রতি ইসরায়েলের পণ্য বর্জনের আহবান জানান মাহমুদুর রহমান। একই সঙ্গে চার স্তরে দাবি জানানো হয়, পড়া হয় অঙ্গীকারনামা।
প্রথম দাবিগুলো হলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি, যেখানে বলা হয়—জায়নবাদী ইজরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে; যুদ্ধবিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে; ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয় দাবিগুলো মুসলিম উম্মাহর নেতাদের প্রতি। এতে বলা হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে; জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে; গাজার মজলুম জনগণের পাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে; জায়নবাদীদের দোসর ভারতে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে। কারণ গাজার রক্তে লজ্জিত হওয়ার আগেই, গাজার পাশে দাঁড়ানোই উম্মাহর জন্য সম্মানের একমাত্র পথ। যে নেতৃত্ব আজ নীরব, কাল ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
তৃতীয় দাবিগুলো বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। এই দাবিগুলোতে বলা হয়েছে—বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ (ইসরায়েল ব্যতীত) শর্ত পুনর্বহাল করা, রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে; সরকারের সঙ্গে ইসরায়েলি যত প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে; রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানিনীতিতে জায়নবাদী কম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশ দিতে হবে; জায়নবাদীদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে; পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুসলিম আত্মপরিচয়ের সঙ্গে গড়ে ওঠে।
সর্বশেষ দাবিগুলো নিজেদের প্রতি বলে জানান মাহমুদুর রহমান, যা মূলত একটি অঙ্গীকারনামা হিসেবেও তিনি অভিহিত করেন। সেগুলো হলো—আমরা বয়কট করব প্রতিটি সেই পণ্য, কম্পানি ও শক্তিকে, যারা ইসরায়েলের দখলদারিকে টিকিয়ে রাখে; আমাদের সমাজকে প্রস্তুত করব এমন নুরউদ্দীন, এমন সালাহউদ্দিন তৈরি করার জন্য, যারা বায়তুল মুকাদ্দিসের মিম্বার পুনরুদ্ধার করবে। আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলব, যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে; আমরা বিভাজিত হব না, কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়। আমরা শুরু করব নিজেদের ঘর থেকে, ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ—সবখানে এই অঙ্গীকারের ছাপ রেখে।
শেষে বলা হয়, শান্তি বর্ষিত হোক গাজার সম্মানিত অধিবাসীদের ওপর, যারা সবুর করেছে, যারা ঈমানের প্রমাণ দিয়েছে, যারা ধ্বংসস্তূপের মাঝেও প্রতিরোধের আগুন জ্বেলেছে, বিশ্বের নীরবতা ও উদাসীনতার যন্ত্রণা হাসিমুখে বুকের মাঝে ধারণ করেছে।
সমাবেশে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের সব দল, মত, চিন্তা-দর্শনের মানুষ মজলুম ফিলিস্তিন ও মজলুম গাজার পাশে আছে, সহাবস্থান করছে। আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে আজ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমাদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা, মতগত পার্থক্য, ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু মজলুম ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, ভূমির অধিকারের দাবিতে আমরা প্রত্যেকটা বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।’
অশ্রুসিক্ত মোনাজাত
ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া চেয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা আবদুল মালেক। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনে যে নৃশংসতা চালাচ্ছে ইসরায়েল, তা মানবতার ওপর চরম আঘাত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করেন এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতার আলো দেখান।’ এ সময় মোনাজাতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে মানুষ প্রার্থনা করে শান্তির জন্য।
এর আগে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে বিখ্যাত ক্বারি আহমদ বিন ইউসুফের কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ প্রমুখ। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মঞ্চে এসে কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
আরো সংহিত জানিয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাহিদ রানা ও তাইজুল ইসলাম, বুয়েটের প্রভাষক ও জনপ্রিয় ইউটিউবার এনায়েত চৌধুরী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোক্তার আহমেদ, ডা. জাহাঙ্গীর কবির, ইসলামী বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, ঝালকাঠি নেছারাবাদ দরবার শরিফের পীর ছাহেব আল্লামা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী, টিভি উপস্থাপক, কনটেন্ট ক্রিয়েটর আরজে কিবরিয়া, উদ্যোক্তা মাহমুদুল হাসান সোহাগ, অভিনেতা তামিম মৃধা, টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।