আরবের বাণিজ্যিক অবস্থা তাওরাতের পৃষ্ঠাগুলো থেকে যতটা স্পষ্ট হয় তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয় গ্রিক ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলো থেকে। এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে আরব বণিকরা খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকে এসব বাণিজ্যিক সেবা আঞ্জাম দিয়ে আসছে। প্রাচ্য ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বা সাঁকো ছিল এরাই। আফ্রিকা ও ভারত থেকে বাণিজ্যিক পণ্য সামুদ্রিক পথে নিয়ে যাওয়া হতো এবং ইয়ামান ও হারামাউতের উপকূলে জাহাজগুলো নোঙর করত। বাণিজ্যিক পণ্য স্থলপথে লোহিত সাগরের তীর ধরে হিজাজ, মাদয়ান ও ওয়াদিউল কুরা পেরিয়ে শামে পৌঁছত। শাম থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে চলে যেত ইউরোপে অথবা শামের সীমান্ত হয়ে পৌঁছে যেত মিসরে। মিসর থেকে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর হয়ে রওনা হতো ইউরোপের দিকে।
আরবের প্রধান বাণিজ্যিক পথ বা আল-ইমামুম মুবিন
যে বাণিজ্যিক পথ হিজাজ হয়ে ইয়েমেন থেকে শাম অঞ্চল পর্যন্ত চলে গেছে তাকে পবিত্র কোরআন আল-ইমামুম মুবিন (প্রকাশ্য পথ) নামে আখ্যায়িত করেছে।
আসহাবুল আইকাহ ওয়াল মুতাফিকা অর্থাৎ লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের বসতি লোহিত সাগরের কাছে এই পথের ওপরই অবস্থিত ছিল। পবিত্র কোরআন বলছে—‘আর আইকাবাসীরাও তো ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী। সুতরাং আমি তাদের শাস্তি দিয়েছি। অবশ্য উভয়টি প্রকাশ্য পথের পাশে।’
(সুরা : হিজর, আয়াত : ৭৮-৭৯)
ইসলামপূর্ব আরবের ব্যাবসায়িক কাফেলা সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে—‘তাদের এবং যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম; ওই সব জনপদে যাতায়াতের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং (তাদের বলেছিলাম,) তোমরা এই সব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিবস ও রজনীতে।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১৮)
ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনায় একটি বণিক কাফেলা যে পথ ধরে চলে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা এই পথ। তাওরাতে তা বর্ণিত হয়েছে এভাবে—‘ইউসুফের ভাইয়েরা চোখ তুলে দেখতে পেল যে একটি ইসমাইলি কাফেলা আসছে জালআদ থেকে... এবং মিসরের দিকে যাচ্ছে।’ (সাফর আত-তাকভিন : ২৫/৩৭)
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—‘এক যাত্রীদল এলো।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১৯)
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আরবদের বহির্বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ভারত, হাবাশা, পারস্য, বাবেল (ইরাক), শাম অঞ্চল, মিসর ও গ্রিসের সঙ্গে। এসব দেশ আরবের চারপাশে অবস্থিত, যেন আরব একটি বৃত্তের কেন্দ্র, তাকে ঘিরে ঘুরছে এসব দেশ।
দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক শহর
কারয়া অর্থাৎ বাহরাইন বা ইয়ামামা, হাজরামাউত, হাজরামাউতের রাজধানী শাবওয়াহ ও পোতাশ্রয় কানাহ, সাবার রাজধানী মাআরিব, মায়িন, আদন (এডেন), আজাল, আদফার, মাদয়ান ও আইলা (আকাবা) শহরগুলোর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন যে এগুলো পারস্য উপসাগর থেকে নিয়ে আকাবা উপসাগর পর্যন্ত আরবের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত।
বাণিজ্যিক পণ্য
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন এই যে আরব রাজ্য হলো ঊষর ভূমি, সেখানে পানি নেই, ফসল নেই, তাহলে সেখানে ব্যবসার কী পণ্য তাদের হাতে আসত, কী কী পণ্য তারা উৎপাদন করত, আরব বণিকদের বাণিজ্যিক পণ্য আসলে কী ছিল? স্বয়ং আরবদের কাছেও এসব তথ্যের কোনো সূত্র নেই। কিন্তু যেসব জাতি ও সম্প্রদায়ের কাছে আরব বণিকরা পণ্য সরবরাহ ও কারবার করত তারা তাদের উপহার-উপঢৌকনের একেকটি জিনিস মনে রেখেছে।
আরব বণিকদের ব্যাবসায়িক পণ্য ছিল মোটামুটি তিন ধরনের :
১. মসলা ও সুগন্ধি বস্তু।
২. স্বর্ণ, মূলবান পাথর ও লোহা।
৩. চামড়া, ঘোড়ার জিন এবং ছাগল ও ভেড়া।
খিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে যেসব আরব বণিক মিসরে যাতায়াত করত তাদের বাণিজ্যিক পণ্য ছিল বালাসান, পাইন, লোবান ও অন্যান্য সুগন্ধি।
সফর আল-তাকভিন : ২৫/৩৭)
দাউদ (আ.) খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দে সাবার স্বর্ণরাশি প্রার্থনা করেছিলেন। (জাবুর : ৭২)
তাওরাতের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সাবার সম্রাজ্ঞী সুলাইমান (আ.)-কে ৯৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যেসব উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন তা হলো সুগন্ধি বস্তু, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও রত্নরাশি।
গ্রিক ঐতিহাসিকদের বর্ণনা এর চেয়ে বেশি তথ্য পরিবেশন করেনি। তাঁরাও এসব পণ্যের কারবার ও বাণিজ্যের কথাই বেশি উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ সোনা, উত্কৃষ্ট খুশবুদার মসলা, সুগন্ধি বস্তু এবং জ্বালানোর জন্য সুগন্ধি লাকড়ি।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই যে এসব খুশবুদার মসলা, সোনা, লোহা, মূল্যবান পাথর, মণিমুক্তা ইত্যাদি জিনিস আরবে কোথা থেকে আসত?
গ্রিক ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে বেশির ভাগ সুগন্ধি বস্তু উৎপন্ন হতো ইয়েমেনে, তাদের এসব বস্তুর বাগান ছিল। গ্রিক ঐতিহাসিক আগাথারচিন্ডিস (Agath-archides) (মৃ. ১৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলেন,
‘সমুদ্রের সংলগ্ন ভূমিতে জন্মে বালাসান গাছ (Commiphora) এবং/সুন্দর সুন্দর আরো অনেক গাছ...। সাবার ভেতরের অংশে লোবান (অর্থাৎ জ্বালানোর সুগন্ধি), দারচিনি, খেজুর ও অন্য বড় বড় গাছের ঘন বন দেখতে পাওয়া যায়। ...পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেরা বসবাস করে সাবায়। চারদিকের এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা-রুপা সাবায় আমদানি করা হয়।’
ঐতিহাসিক আল-হামদানি লোবান ও জাফরান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তা এখান থেকেই গোটা দুনিয়ায় যায়। ইয়ামানে ও নাজদে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও উদ্ভিদ জন্মায়।’ কিন্তু খুব সম্ভবত মসলা অর্থাৎ লবঙ্গ, গোল মরিচ, এলাচি, মিছরি, দারচিনি, নারকেল, তেঁতুল ইত্যাদি বস্তু দক্ষিণ ভারতের ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের উপকূলীয় এলাকা থেকে আরবে আমদানি করা হতো।
আমাদের এই বক্তব্যের দলিল হলো—আরবি ভাষায় মসলা এবং বেশির ভাগ সুগন্ধি বস্তুর নাম সংস্কৃত থেকে এসেছে। যেমন—মিশক, ফুলফুল (মরিচ), কাফুর (কর্পূর), জানজাবিল (আদা), সানদাল (চন্দন), নারজিল (নারকেল), কারানফুল (লবঙ্গ), ইত্যাদি। কোনো কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে ‘হিন্দ’ শব্দটি নামের অংশ হয়ে গেছে। যেমন—আল-উদুল হিন্দি (আগর), আল-কিন্তুল হিন্দি (এক প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ) আত-তামরুল হিন্দি (তেঁতুল)। লোহার তরবারিও রপ্তানি করা হতো ভারতবর্ষ থেকে। এ কারণে আরবি ভাষায় ‘হিন্দি’ ও ‘মুহান্নাদ’ শব্দটি তরবারির বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। খুশবুদার মসলার মধ্যে লবঙ্গ, এলাচি, গোলমরিচ, দারচিনি, হলুদ—সব কিছু অন্তর্ভুক্ত। এগুলো দক্ষিণ ভারত ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে উৎপন্ন হতো।
আমদানি
আরব বণিকরা কী কী পণ্য নিজেদের দেশ থেকে বাইরের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেত তা আমরা জানলাম। কিন্তু তারা বাইরে থেকে কী কী পণ্য নিয়ে দেশে ফিরত? অর্থাৎ কী কী পণ্য আমদানি করত?
ইতিহাসের হাজার হাজার পৃষ্ঠা ওল্টানোর পর আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তা এই যে বিদেশ থেকে তারা কাপড়, খাদ্য, মদ, অস্ত্র, আয়না ও অন্যান্য বিলাসী পণ্য আমদানি করত।
ইয়েমেনেও কাপড় উৎপাদিত হতো। ইয়ামানি চাদর ছিল অনেক বিখ্যাত।
সাবার রাজধানী মাআরিবে তুলাশিল্প ও বস্ত্রশিল্প ইসলামের আগমন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাই মহানবী (সা.) এখানকার অধিবাসীদের জিজিয়া হিসেবে দিরহাম ও দিনারের বদলে কাপড় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মুআজ (রা.)-কে ইয়েমেনের উদ্দেশে (শাসক নিযুক্ত করে) পাঠালেন, তখন প্রত্যেক অমুসলিম বালেগ ব্যক্তি থেকে এক দিনার বা তার সমমূল্যের মুআফিরি কাপড়, যা ইয়েমেনে প্রস্তুত হয়, আদায় করার নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩৬)
ইয়েমেনের বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ভারতবর্ষের সঙ্গে। তাই নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে এসব কাপড়ের পুরোটাই ইয়েমেনে উৎপাদিত হতো নাকি ভারত থেকেও আমদানি করা হতো। মুসলিম ব্যবসায়ীরা শাম থেকে কাপড় আমদানি করত। আর সম্ভবত তারা খাদ্য আমদানি করত ইয়েমেন থেকে। তবে সাধারণভাবে বেশির ভাগ খাদ্য আমদানি করা হতো শাম অঞ্চল থেকে।
(সূত্র : আল কোরআনের ভৌগোলিক ইতিহাস)