<div> সাত বছর আগে খুলনার এক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে আত্মস্বীকৃত সিরিয়াল কিলার রসু খাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুণাভ চক্রবর্তী এ রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে মামলার তদন্তে অবহেলার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।</div> <div> রায়ের সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিল সাদা লুঙ্গি, প্রিন্টের শার্ট ও টুপি পরিহিত ক্লিন শেভড আসামি রসু খাঁ; যে মামলার বিচারকাজ চলাকালে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ১১ নারীকে হত্যার কথা স্বীকার করে।</div> <div> গতকাল সকাল ৯টার দিকে রসু খাঁকে কড়া পুলিশ প্রহরায় জেলখানা থেকে আদালতে আনা হয়। সকাল ১১টা ২৫ মিনিটে বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। দিনের অন্যান্য কাজ শেষ করে ১১টা ৪৯ মিনিটে তিনি রসু খাঁর বিরুদ্ধে খুলনার গার্মেন্টকর্মী শাহিদা আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেন। বিচারক তাঁর রায়ে হত্যার ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় আসামি রসু খাঁকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।</div> <div> বিচারক রায়ে রসু খাঁকে একজন বিকৃত যৌনাচারী ও পেশাদার খুনি হিসেবে উল্লেখ করে তার যথোপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে মামলা তদন্তে বিভিন্ন অসংগতির চিত্র তুলে ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন আদালত। রায়ের পরপরই রসু খাঁকে পুলিশ প্রহরায় জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।   </div> <div> মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর খুলনার দৌলতপুরের কলমচর গ্রামের গার্মেন্টকর্মী শাহিদা আক্তারকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চাঁদপুরে এনে ধর্ষণের পর হত্যা করে রসু খাঁ। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর সদর উপজেলার সোবহানপুর গ্রামের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে জনৈক আবিদ মালের বাড়ির পাশ থেকে শাহিদার হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময় চাঁদপুর মডেল থানার তৎকালীন এসআই নজরুল ইসলাম অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তদন্তে কোনো তথ্য না পেয়ে মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালের ২০ জুলাই টঙ্গীর নিরাশপুর মসজিদের ফ্যান চুরির একটি মামলায় রসু খাঁকে গ্রেপ্তার করে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। এরপর একের পর এক হত্যারহস্যের জট খোলার খবর দিতে শুরু করে পুলিশ। রসু খাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১১ নারীকে হত্যার অভিযোগ। সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট সাইয়েদুল ইসলাম বাবু। তিনি রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রসু খাঁর পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী নাঈমুল ইসলাম রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা দেন। </div> <div> খুনি রসু খাঁর উত্থান ও নির্মমতার ধরন : চাঁদপুর সদর উপজেলার মদনা গ্রামের খাঁ বাড়ির মৃত আবুল খাঁর ছেলে রসু খাঁ। ছোটবেলা থেকেই ছিঁচকে চোর হিসেবে তার পরিচিতি। একপর্যায়ে তার স্বভাব-চরিত্র খারাপ দেখে গ্রামবাসী তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে আশ্রয় নেয় গাজীপুরের টঙ্গীতে। সেই থেকে শুধু চুরি, ডাকাতি, গুণ্ডামি, ভাড়ায় মাস্তানি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই নয়, সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতেও রসু হয়ে ওঠে সিদ্ধহস্ত। টঙ্গীতে পেয়ারা বেগম নামের এক গার্মেন্টকর্মীর সঙ্গে পরকীয়া করতে গিয়ে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হওয়ার পর রসু শপথ নিয়েছিল, ১০১ জন নারীকে হত্যা করে তারপর মাজারে গিয়ে তওবা করে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই মসজিদের ফ্যান চুরির ঘটনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।</div> <div> পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রসু খাঁ স্বীকার করে, সে ১১ জন নারীকে প্রেমের অভিনয় করে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। সাধারণত গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা থেকে নারীদের চাঁদপুরে এনে ধর্ষণ শেষে হাত-পা বেঁধে শ্বাস রোধ করে হত্যার পর নদী বা খালে ফেলে যেত সে। হত্যার শিকার নারীদের মধ্যে শুধু পারভীন আক্তার নামের একজন ছিলেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ এলাকার পালতালুক গ্রামের।</div> <div> পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর রসু খাঁর বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলা বিচারের জন্য চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পর সেখানে একটি মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আদালত তাকে খালাস দেন। পরে বাকি সব মামলা বিচারের জন্য আবার চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেসব মামলার মধ্যে খুলনার গার্মেন্টকর্মী শাহিদা আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার মামলায় গতকাল রসু খাঁর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হলো। এ মামলায় মোট ১৩ জন সাক্ষ্য দেন।  </div>