পিরোজপুর জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ কে করেছেন, কার সহায়তায় করেছেন—এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছে সাধারণ মানুষ।
এলজিইডির তদন্তে দেখা গেছে, তাদের অন্তত ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একটি ঠিকাদার পরিবারের চারটি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে সব কাজ পেয়েছে, যার মূলে ছিলেন তিন ভাই।
তাঁরা হলেন মহিউদ্দিন মহারাজ, মিরাজুল ইসলাম ও শামছুদ্দিন হাওলাদার।
এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিন বছরের এই অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের ঘটনায় এলজিইডির পিরোজপুরের সম্প্রতি অবসরে যাওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদার জড়িত। নিয়ম অনুযায়ী, এই আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছাড়া কোনো টাকা ঠিকাদারের পাওয়ার সুযোগ নেই। তিনিই ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে এসব কাজ করেছেন।
সাবেক এই কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে অবসরের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পিরোজপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁকে তিনবার বদলির উদ্যোগ নিয়েছিল এলজিইডির প্রধান কার্যালয়, কিন্তু প্রতিবারই তা ঠেকাতে সমর্থ তিনি হন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা করেন ওই ঠিকাদার।
এলজিইডির কর্মকর্তারা বলছেন, আব্দুস সাত্তার কোনো নীতি বা অফিশিয়াল নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতেন না।
আদালতে মামলা করে বদলি স্থগিত করেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আব্দুস সাত্তার হাওলাদারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এলজিইডি পিরোজপুরের যেসব অনিয়ম পাওয়া গেছে, এর বেশির ভাগই ভাণ্ডারিয়া উপজেলায়। রাস্তা ও ব্রিজের অনিয়ম, ভ্যাট, আয়কর, ল্যাব টেস্ট ফি, রোলার ভাড়া ইত্যাদির অনিয়ম, ফাইল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় বেশি। ভাণ্ডারিয়ায় এই অনিয়মের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রকৌশলী বদরুল আলম জড়িত বলে স্থানীয় সরকার বিভাগে জানিয়েছে এলজিইডি।
এ ছাড়া এই উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী, নকশাকার ও সার্ভেয়ার এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বদরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একাধিক প্রকল্প থাকলে ওভারল্যাপিং হবেই। তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত চলছে। স্যাররা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে আমাকে নিষেধ করেছেন।’
আবুল কালাম আজাদ ২০০৬ সাল থেকে পিরোজপুর জেলায় উপসহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত ছিলেন। সহকারী প্রকৌশলী পদের চলতি দায়িত্ব পেয়েও তিনি ২০২৩ সালের ৯ মে থেকে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত পিরোজপুর জেলায় পোস্টিং নেন। মাঝে দুই বছর উপসহকারী হিসেবে কাউখালীতে বদলি হলেও নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে ওই পদে কাজ করেন। তিনিও এই অনিয়মে জড়িত ছিলেন বলে এলজিইডি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।
এর আগে ২০১১ সাল থেকে এ কার্যালয়ে থাকা আব্দুল হাই, ২০১৩ সালে দায়িত্বে থাকা রফিকুল হাসান পিরোজপুর জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানের আগে একই জেলার সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য রয়েছে অধিদপ্তরে।
প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত রঞ্জন রায়, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম এবং হিসাবরক্ষক এ কে এম মোজাম্মেল হক খান, বিজেপি প্রকল্পের হিসাবরক্ষক আনোয়ারুল ইসলামকেও দায়ী করছে এলজিইডি।
ঠিকাদার পরিবারের কাছে জিম্মি : একটি ঠিকাদার পরিবারের কাছে জিম্মি ছিল পিরোজপুরের এলজিইডি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এই পরিবারের ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্যের সুযোগ করে দিয়েছেন সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। প্রাথমিক তদন্তে সাবেক এই মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এক সংবাদ সম্মেলনে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘পিরোজপুর জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পের যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, সেখানে অর্থ লুটপাটের প্রাথমিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর সঙ্গে সাবেক মুখ্য সচিবের প্রাথমিক সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত এখনো চলছে।’
তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ২০১৮ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। এর পর থেকে তিনি ঠিকাদার পরিবারকে সব ধরনের প্রশাসনিক সহায়তা করেন। তাঁদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সঙ্গী হন। ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁর নিয়োগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন।
১৫ বছর ধরে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তিন ভাই মহিউদ্দিন মহারাজ, মিরাজুল ইসলাম ও শামছুদ্দিন হাওলাদারের হাতে। মহিউদ্দিন মহারাজ সর্বশেষ ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একসময় জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর একান্ত সচিবও ছিলেন তিনি। তাঁর ছোট ভাই মিরাজুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁদের অন্য ছোট ভাই শামসুদ্দিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা।
তাঁদের মালিকানাধীন ইফতি ইটিসিএল, মেসার্স তেলিখালি কনস্ট্রাকশন, মেসার্স ইষান এন্টারপ্রাইজ ও ঐশী কনস্ট্রাকশন—এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিরোজপুরের প্রায় সব কাজ করতেন। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় তাঁদের কথার বাইরে কিছুই হতো না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পেত না কেউ।
স্থানীয় লোকজন জানায়, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভাণ্ডারিয়ায় এই তিন ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ভূরিভোজ করতেন। এলজিইডির ঠিকাদারের বাড়িতে প্রধান প্রকৌশলীর এই ভোজ নিয়ে তীব্র সমালোচনাও হয়েছিল।
২০১১ সাল থেকে এই দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও তদন্ত আটকে যায়।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, মহিউদ্দিন মহারাজ ও মিরাজুল ইসলাম বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। অন্য ছোট ভাই শামসুদ্দিন হাওলাদার গ্রামের কোথাও আত্মগোপনে রয়েছেন।
ভাণ্ডারিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতিকুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘আমরা এই ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও কোনো ফল হয়নি। উল্টো আমাদের হয়রানি করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, “মহিউদ্দিন মহারাজ প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘নদীর পানি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের টাকা শেষ হবে না।’ তাঁর কথার প্রমাণ তাঁরা দেখিয়েছেন। কাজ না করেই যে তাঁরা টাকা আত্মসাৎ করছেন—এটা ওপেন সিক্রেট। আশা করছি, এবার প্রতিকার পাব।”