শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ—সম্পাদনা : বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এ জাফর ইকবাল। প্রকাশক : বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান আকন্দ। প্রচ্ছদ : মাহবুবুল আলম খান। দাম : ৭০০ টাকা
গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শেরপুর।
শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ—সম্পাদনা : বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এ জাফর ইকবাল। প্রকাশক : বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান আকন্দ। প্রচ্ছদ : মাহবুবুল আলম খান। দাম : ৭০০ টাকা
গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শেরপুর।
বাংলাদেশের মানচিত্রে শেরপুর প্রান্তিক জেলা হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এ জেলার ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেরপুরের তিনটি উপজেলা সীমান্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয়টি জেলার করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া বৃহত্তর ঢাকার তিনটি জেলা, রংপুর বিভাগের দুটি জেলা ও রাজশাহী বিভাগের দুটি জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়েছে শেরপুর দিয়ে।
ইতিহাসসমৃদ্ধ বইটির শুরুতেই তুলে ধরা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী শেরপুর জেলার পরিচিতি।
দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে শেরপুর মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। এ নিয়েও আলোচনা আছে বইটিতে। শেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা ছাপা হয়েছে বইটির বড় অংশজুড়ে। যুক্ত করা হয়েছে জেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও। এই ইতিহাস গ্রন্থ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইতিহাসপ্রেমী, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক তথা সর্বস্তরের পাঠককে নির্দেশিকা হিসেবে পথপ্রদর্শন করবে।
আরাফাত শাহরিয়ার
সম্পর্কিত খবর
— কি গো দাদা, জমির আলে কী করো? চলো যায়।
— কুনডে?
— তুমি দেখি দুনিয়ার খবর কিছুই রাখো না? ক্যান, মেলায়। নাগরদোলা এসেছে। তোমাকে নাগরদোলাতে চড়াব, চলো।
— ঐ দোলায় মেলা দুলিজি, এগন তুরাই দুলেক গা।
— তোমাদের কালের নাগরদোলা আর এখনকার নাগরদোলা এক নয়, দাদা। এখন কারেন্টে চলে। সুইচ দিলেই ঘুরে।
— ঘুরুক, তুমার উডিজে তুমিই মাইর্যা আইসো।
— কী উডিজে, দাদা?
— দ্যাখ মামুন, রাগাস না। তুর রং লাগিজে তুই যা।
— তুমি তো চিরকালই রঙের মানুষ ছিলা।
— হারায়নি তো। শুনেক, হামারে মুতন চাষার রং ঐ ধানে। দ্যাখ, কত সুন্দর রং ধরিজে ধানে। ধানের ঐ সোনারং হামারে বুকের মধ্যে খই হয়্যা ফুটে। তবে বাড়িতে না উডা পয্যন্ত শান্তি নাই।
— দাদা, তুমি মনটাই খারাপ করে দিলে। তবে চলো, মেলায় গেলে মন ভালো হবেনি। পান্তা ইলিশ খাওয়াবনি।
— ঐ পন্দা হামি দৈনিক খাই। আর ইলিশ মারওজেন, না? ইলিশ হামি খাই না।
— খাও না, নাকি পাও না?
— আবার কিন্তুক হামাক রাগ ধরাওজু মামুন। তুর মাস্টারির ট্যাকার গরম দ্যাগাওজু, তাই লয়?
— তুমিও কিন্তুক খোঁচা দিলে, দাদা। প্রাইমারির মাস্টারের আবার ইলিশ! শোনো, গেল চার বছর আমি কোনো ইলিশ কিনিনি। কয়েকবার কিনতে গিয়ে দামদর করে ফিরে এসেছি।
— বলিস কিরে। তুদের ইলিশ খাবার জন্য টাকা তো দেয় সরকার?
— তা তো দেয়। শুনো দাদা, দশ হাত শরীরের নয় হাত কাপড়ে খানতি থাকেই। সে জরি বসানো কাপড় হোক আর মণিমুক্তা বসানোই হোক। এক দিকে টানলে আরেক দিক খাটো পড়ে।
— তুর ছেলেমেয়ে বায়না ধরে না?
— ধরে তো। তবে তারা ছোট। সিলভরকার্প আর ইলিশের পার্থক্য এখনো বুঝতে শিখেনি।
— শিগেনি, না শিগাসনি?। তুই মাস্টার হয়্যা নিষ্পাপ বাচ্চাদের সঙ্গে প্রতারণা করিজু কিন্তুক। অন্যায় করিজু ভাই।
— তা জানি দাদা। ও পাপ আল্লা মাফ করবেন। এখন অনেক কিছুই এদিক-ওদিক করতে হয় দাদা। ছেলেদের জন্যে যে দুধ নিতাম, তাও দু’বছর হলো বাদ দিয়েছি। রাখো ওসব কথা। চলো, না হয় সিলভর দিয়েই পান্তা খাওয়াবনি।
— তুই এগনো মেলা লিয়াই পড়্যা আছিস ছোঁড়া। হামার বাড়িত এগনো দৈনিক পন্দাতে বলক উডে। তুর বলক উডে না তুই যা।
— তুমি শালা এখনো বজ্জাতই থেকে গেলা। রস এখনো কমেনি। আমি তো মনে করেছিলাম তোমার এখন সবই কড়কড়া। হাজার মাখালেও খটমটে। রস আসে না।
— ওরে শালা বজ্জাত। শুনেক মামুন, কড়কড়ার মজা তুরা বুঝবু না। কড়কড়া শুকনা মরিচ দিয়া মাগালে বেশ রং ধরে। জোয়ান মরদেরও লালা ঝরে। পন্দার মজা পন্দায় আর কড়কড়ার মজা কড়কড়ায়। ও তুই বুঝবু না। কিরে ছোঁড়া, এমুন হাঁ কর্যা তাকায়া আছিত ক্যান?
— দাদা, তুমি একটা মাল গো। সাহিত্যিকের মতো কথা বলো। কত সুন্দর করে কথা বলো! মনটা তোমার রং-সাগর। মনের বয়স আঠারো। আচ্ছা দাদা, তুমি তো একসময় ভালো লেঠেল ছিলা, লাঠি খেলাতে তোমাকে নাকি হায়ার করে নিয়ে যেত দূর দূর থেকে।
— সে তো যেতই। সেই দিনগুলোন বড় রঙিন ছিল রে ভাই। মুনে হলে বুকের মদ্যে গুড়কা বাধে।
— লাঠিখেলা কি পহেলা বৈশাখেই হতো?
— নারে ভাই। এগনকার মুতন বৈশাখের উৎসব হামারে সুময় হতো না। তগন এই এলাকাতে মেলা পার্বণ বুলতে ছিল কালীপূজার মেলা, মহরমের মেলা. দুর্গাপূজার মেলা, বাসন্তী মেলা, বারনই মেলা। তগনকার দিনে হেন্দু-মসুলমান এক হয়্যা মেলায় যাতুন। জামাই-বেটি, কুটুম-সাখ্যাত বাড়ি ভর্যা উটতো।
— লাঠিখেলা কখন হতো?
— সেটা হতো মহরমের সুময়। আশুরার দিন হাজার হাজার কাসিদে ভর্যা থাকত মাঠঘাট। লাল শালুকের পোশাক পরা দলে দলে কাসিদ দেগা মুনে হতো, চারদিগে আগুন আর আগুন। সেদিন কাসিদের আইন বড় আইন। খৈলানে খৈলানে মহরমের জারি হতো। বউ-বেটিরা বুক ভাসাত জারি শুনে।
— তাহলে কি আশুরার দিনই লাঠিখেলা হতো?
— আসলে খেলা শুরু হতো মহরম মাসের প্রথম দিন থাক্যা। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে হামরা লাঠি খেলে বেড়াতুন। আর লড়াই হতো মঞ্জিলের দিন, মানে আশুরার দিন। দশ পনেরো দলে খেলা। সোনাতন মুণ্ডলের দল, খিতাব মুণ্ডলের দল, নাদেরের দল আর এদিকে হামার দল। হামার বড় ফাইট হতো সোনাতনের দলের সঙ্গে। একবার তারা জিতলে পরেরবার হামরা। তবে মেডেল পতিবছর হামার বান্ধা। হামার লাঠির প্যাঁচ কেউ ধরতে পারতক না। আখড়াতে হামার গলা আর লাঠি সবার আগে।
— দাদা, তুমি একালের রূপাই। তুমি রূপাইকে চিনো? কী হলো, হাসছ কেন?
— তুর কি মুনে হয়? হামরা চাষাভুষারা পড়ি না। হামি বাষট্টি সালে মেট্টিক পাস। হামার বাড়িত যাস, এগনো জসীমউদ্দীনের কয়েকটা বই আজে।
— দাদা তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। তুমি নক্সী কাঁথার মাঠের রূপাইয়ের কথা জানো? তোমার আখড়া দেখতে ইচ্ছা করছে।
— ‘আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী/খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।’ জসীম সত্যিই গ্রামবাংলার হৃদয়ের কবি রে ভাই।
— বাহ, এখনো তোমার মনে আছে লাইনগুলো! তোমাকে আমি রূপাই বলেই ডাকব। ‘যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী/এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে দামী।’
— আর কাল! হামার সব কাল এগন এক কালে ঠেকিজে, ভাই। স্বপন আর দেগাস না।
— এমন ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা হঠাৎ বন্ধ হলো কেন, দাদা?
— হঠাৎ হয়নি, দাদু। দিনে দিনে হলো। হঠাৎ কিজু বুজদার মানুষ জুট্যা গেল। তারা বিরোধিতা করল লাঠিখেলার। হামারেও সেই জোশ আস্তে আস্তে হারায়া গেল।
— আচ্ছা দাদা, আবার যদি তোমার হাতে লাঠি তুলে দিই, তাহলে খেলতে পারবে?
— পারব না ক্যান? কিন্তুক হামার লাঠি ধরার মানুষ কই? তুরে মুতন দশজনকে এগনো হামি একলাই লিয়া লিমু।
— দাদা, তুমার লাঠির প্যাঁচ দেখতে খুব ইচ্ছা হয়। তুমি আবার দল গড়ো। আমি তোমার সঙ্গে আছি।
— নিবতে বসা আগুনে ফুঁ দিস না ভাই। সে আর হোবে না।
— অবশ্যই হবে, দাদা। তোমার মধ্যে সেই আগুন আছে। এই বৈশাখে হলো না, আগামী বৈশাখী মেলায় অবশ্যই তোমার লাঠিখেলা দেখব। সারা এলাকার মানুষ দেখবে। দুনিয়া দেখবে। দল গড়ো। ঢোল নতুন করে ছেয়ে নাও। ও দাদু, হঠাৎ কী হলো তোমার? আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার চোখে আগুন।
— না দাদু, হামার লয়। তুর ভিতরে কিসের যেন আগুন দেগতে পাওজি। ঐ আগুন হামার নিবে যাওয়া সলতেতে ঘষা দেয়। তুই চল্যা যা।
— হ্যাঁ দাদু, যাব। তবে তুমি কথা দাও, খেলবে। তোমার লাঠি তো আছেই, এবার আমিও লাঠি বানাব। তোমার সঙ্গে খেলব।
— না, হামার লাঠি নাই। তুর দাদি ফেলা দিজে।
— তবে বাঁশঝাড়ে যাও। নতুন করে লাঠি কাটো। খেলা হবেই।
— না, হোবে না। তুই মেলাত যা। হামার কাম আজে। আল থাক্যা ধানগুলান সরায়্যা দিই।
— দাদু গেলাম, তবে আগামী বছর এলাকা জুড়ে মাইকিং করে লাঠিখেলা হবে। আরো দল আসবে। তোমার গলায় আবার মেডেল উঠবে।
— আচ্ছা দেগা যাবে পরে, এগন যা।
— ঠিক আছে দাদু, গেলাম। তবে খেলা হবে।
— এই মামুন, অত জুরে হাঁটিস ক্যান? খাড়া। লাঠি কিন্তুক আজক্যাই কাটমু। তেল মালিশ শুরু হোবে আজক্যা থাক্যাই। লাঠির রং ফিরাতে সুময় লাগবে।
— ঠিক আছে দাদু, আমিও কাটব লাঠি।
— খেলা না হলে কিন্তু ঐ লাঠি দিয়াই তুদের মেলা ভাঙমু। কুনো সমুন্দি বাধা দিলে মাদা ফাটামু। তুই আইসলে তুরও।
— আগে লাঠি তো কাটো। হয় খেলা হবে, না হয় ভাঙা হবে। কিছু তো হবেই।
— মুনে থাকে যেন। খেলা মানে খেলাই। ঢোল কাঁসর সবই আজে। ঢোলে নতুন চামড়া দিলেই গগন ফাটপে।
— না দাদু, গগন নয়, মানুষের মন ফাটবে।
— ফাটপে তো বটেই...
সে এক পহেলা বৈশাখের ভোরবেলা। আমি আর আলমগির মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। বাষট্টি সালের কথা। আমার নানাবাড়ির দক্ষিণ দিককার বাড়িটা মিয়াবাড়ি।
ওই ঘরটা ধীরেন্দ্র চৌধুরীর। চৌধুরীর সঙ্গে মনীন্দ্র ঠাকুরের কোনো রক্ত সম্পর্ক নেই। সে ছিল একটু লোভী ধরনের লোক। স্ত্রী ছেলেমেয়ে কলকাতায়, সে পড়ে থাকত মনীন্দ্র ঠাকুরের বাড়িতে, হয়তো বা সম্পত্তির লোভে। ঠাকুরের কেউ নেই। বিয়ে করেছিলেন, স্ত্রী কী কারণে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার পর থেকে ঠাকুর একা। ব্রাহ্মণ মানুষ, তাঁর রান্নাবান্না করে চৌধুরী। মজিদ নামে হাজামবাড়ির এক যুবক তাঁর কম্পাউন্ডার। বর্ষাকালে ঠাকুরের ছইঅলা নৌকা বায় মজিদ। ঠাকুরকে নিয়ে এগ্রাম-ওগ্রামে যায়। নৌকার ভিতর ধপধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে চারদিক আলোকিত করে বসে থাকেন ঠাকুর।
আমি আর আলমগির যাচ্ছি সেই ঠাকুরের কাছে। আলমগির কার কাছে শুনেছে, পহেলা বৈশাখের দিন সকালবেলা আমাদের বয়সী কেউ ঠাকুরের কাছে গেলেই তাকে তিনি একটা কাঁচা টাকা ধরিয়ে দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, ‘বৈকালে এই টেকা লইয়া গলুইয়ায় যাইছ। রসোগোল্লা কিনা খাইচ।’
আমরা দুজন যাচ্ছি কাঁচা টাকার লোভে। যদি সত্যি সত্যি দুজনে দুটি টাকা পাই?
আমার পহেলা বৈশাখ মানে ছেলেবেলা, বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রাম, মনীন্দ্র ঠাকুর আর কালিরখিলের মেলা। পহেলা বৈশাখে এখনো আমার মন চলে যায় ফেলে আসা সেই দিনে, সেই গ্রামে। এখনো চোখ বুজে, চোখ খুলে দেখতে পাই বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রাম, বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত, উদাস মাঠখানির ওপাশে সূর্য ডুবে যায়। গৃহস্থবাড়ির গাছপালায় দিনমান হাওয়া বয়, পাখি ডাকে। হিন্দু-মুসলমান গলাগলি করে দিন কাটায়, আর গ্রাম আলোকিত করে থাকেন এক মানুষ, মনীন্দ্র ঠাকুর। রাজপুরুষের মতো দেখতে তিনি। পেশায় ডাক্তার। পাস করা ডাক্তার বলতে যা বোঝায় তা নন, কিন্তু অসাধারণ হাতযশ। তাঁকে দেখলেই অর্ধেক ভালো হয়ে যায় রোগী। দেশগ্রামের লোক তাঁকে মাথায় করে রাখে। এত আমুদে মানুষ, হাসি-আনন্দে ভরা, গ্রামের যুবকদের তিনি নয়নমণি। নাটক থিয়েটার করছেন, গান করছেন, ফুটবল খেলার আয়োজন করছেন, একাই যেন উৎসবমুখর করে রেখেছেন গ্রামখানি।
পহেলা বৈশাখের দিন মেলা বসে কালিরখিলের মাঠে। লোকে বলে ‘গলুইয়া’।
এক টাকা মানে বিশাল ব্যাপার। মনীন্দ্র ঠাকুর মানুষ ভালোবাসতেন, দেশ ভালোবাসতেন।
এই অসাধারণ দেশপ্রেমিক মানুষটি এক বর্ষার রাতে খুন হয়ে গেলেন। পঁয়ষট্টি সালের কথা। কারা খুন করল তাঁকে, কেন খুন করল, কেউ জানে না। লৌহজং থানা থেকে দারোগা পুলিশ এলো, মুন্সীগঞ্জ থেকে এলো। কয়েক দিন খুবই হৈচৈ, তারপর সব থেমে গেল। খুনিদের একজনও ধরা পড়ল না। এর কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে শুরু হলো ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ। মনীন্দ্র ঠাকুরের খুনের ঘটনা চিরতরে চাপা পড়ে গেল।
সেই বিশাল বাড়িটার পুব দিককার অংশে থাকতেন মনীন্দ্র ঠাকুর। পুবে-পশ্চিমে মুখোমুখি দুটি টিনের ঘর। পশ্চিম দিককার ঘরে ঠাকুর থাকেন, ঘরে একটা পালঙ্ক আর আলমারি ভর্তি ওষুধ, কিছু বইপত্র। একচিলতে নিকোনো উঠোনের পুব পাশের ঘরটায় রান্নাবান্নার ব্যবস্থা, আর কত রকমের যে ফলফলারি রাখা! বারো মাসে বারো ফলই ধরছে ঠাকুরের বাগানে। সেইসব ফলে রান্নাঘর ভর্তি।
বাড়িতে ওঠার মুখে পায়ে চলা পথের দুপাশ হলুদ হয়ে আছে গাঁদা ফুলে। ছোট্ট একটা পুজোর ঘর এক পাশে। বৈশাখ মাসের ভোরবেলার রোদে ঝকঝক করছে চারদিক। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। হাওয়ায় ভাসছে বুনো ফুলের গন্ধ। আমি আর আলমগির পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি ঠাকুরের উঠোনে। তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ঠাকুর। পরনে সাদা ধুতি আর কনুই পর্যন্ত হাতার কোড়াগেঞ্জি। গলায় পৈতে, পায়ে বইলাঅলা খড়ম। আমাদের দুজনকে দেখে এত মায়াবী এক হাসি ফুটল তাঁর মুখে! অতি স্নেহের গলায় ডাকলেন, ‘আয় আয়।’
তার পরই আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। মুঠোয় করে নিয়ে এলেন দুটি কাঁচা টাকা। আমার হাতে একটা, আলমগিরের হাতে একটা টাকা দিয়ে বললেন, ‘গলুইয়ায় যাইচ, খেলনাপাতি কিনিছ, রসোগোল্লা খাইচ। যা।’
আমরা দুজন কী যে খুশি! যা ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি তা-ই ঘটেছে! সত্যি সত্যি দুজনে দুটি টাকা পেয়েছি! তার পর থেকেই অপেক্ষা, কখন দুপুর হবে, কখন কোনো রকমে ভাতটা মুখে দিয়েই চলে যাব কালিরখিলের মাঠে। সেখানে দুপুরের পর থেকে জমবে মেলা।
কালিরখিলের মাঠ এখনো আছে। ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে, মাওয়ার বাজার ছাড়িয়ে ডান পাশে মাঠটি। আমার ছেলেবেলায় কী যে বিশাল সেই মাঠ!
দশ-বারো মিনিট লাগবে হেঁটে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে। মাঠের দক্ষিণে শুকনো একটা খাল, খালের ওপারে কয়েক ঘর বেলদার সম্প্রদায়ের বাস। তারপর আধমাইলখানেক দূরে পদ্মা। পদ্মা তখন সমুদ্রের মতো বিশাল। হা হা করা হাওয়া আর তুমুল ঢেউয়ে দিনরাত মেতে থাকে। মাওয়া বরাবর পদ্মার খোলা তীরে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব হতো পহেলা বৈশাখে। দুপুরের পর পর নানা রকম ঘুড়িতে ভরে যেত আকাশ। এক ঘুড়ি গোত্তা মেরে কাটছে আরেক ঘুড়ি। কিশোর ছেলেরা সরু বাঁশের মাথায় শুকনো ডালপালার ঝাঁকা লাগিয়ে ছুটছে কাটা ঘুড়ি ধরতে।
গরুর দৌড়ও হতো ওখানটায়। সেও এক বিরাট উৎসব। ঘোড়ার রেসের মতো ব্যাপার। গৃহস্থরা তাদের তাগড়া জোয়ান দৌড়বাজ গরু নিয়ে আসত প্রতিযোগিতায়। মাথায় লাল কাপড় বাঁধা গরুগুলো কোন মন্ত্রে যে অমন দৌড় লাগাত, কে জানে।
আলমগির আর আমি গরুর দৌড় দেখতে গেছি। একদল গরু জানপরান দিয়ে দৌড়াচ্ছে। দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে শয়ে শয়ে দর্শক। হঠাৎ একটা গরু নির্দিষ্ট দিকে না দৌড়ে জনতার দিকে তেড়ে এলো। আমি আর আলমগির ভয়ে এমন একটা দৌড় দিলাম, সেই দৌড়ের কোনো তুলনা হয় না। এক দৌড়ে সোজা কালিরখিলের মাঠ। মাঠে ততক্ষণে বিরাট জমা জমে গেছে ‘গলুইয়া’। প্যাঁ পোঁ শব্দে বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ, খেলনা ঢোল বাজাচ্ছে কোনো কিশোর। এক পাশে তোকমাদানার শরবত বিক্রি করছে একজন। মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুকে ভরে গেছে মাঠ। ময়না টিয়া কত রকমের খেলনা পাখি! মাটির তৈরি খেলনা হাঁড়িপাতিল, বিক্রমপুরের ভাষায় বলে ‘টোফা’। টোফা কিনতে ভিড় করেছে কিশোরী মেয়েরা, শিশুকন্যারা। বাঁশ বেতের ঝুড়ি ধামা কুলা, লোহার দা বঁটি। কাঠের বেলুন পিঁড়ি জলচৌকি, এসবের পাশাপাশি নানা রকমের মুখরোচক খাবার। নিমকি ভাজা, মুড়লি ভাজা। বিন্নির খই, কদমা, ফাঁপা নামের বাতাসা টাইপের গুড়ের তৈরি একটা জিনিস। অন্যদিকে রসগোল্লা লালমোহন বালুসাই চমচম আমৃতি। কত রকমের কত কী, বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। খেলনাপাতি কিনে, তোকমাদানার শরবত খেয়ে, মিষ্টি খেয়ে, বিন্নির খই বাতাসা আর কদমা কিনেও একটা টাকা শেষ হতে চায় না। বুকের কাছে দুহাতে সেইসব পোঁটলাপাটলি ধরে যখন বাড়ি ফিরছি, তখন বিলের ওপারে ডুবতে বসেছে সূর্য। পদ্মা থেকে আসছে মনোরম এক হাওয়া।
আহা, কোথায় হারিয়ে গেছে সেই সুখের দিন!
নানি বলতেন, বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, মিথ্যা বলতে হয় না, কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে হয় না, কারো মনে দুঃখ দিতে হয় না। যদি বছরের প্রথম দিন মিথ্যা বলো, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো, কারো মনে দুঃখ দাও, তাহলে সারা বছরই তুমি মিথ্যা বলবে, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, আর মানুষের মনে দুঃখ দেবে। সারা বছর ধরে তুমি হয়ে যাবে একজন খারাপ মানুষ। এ জন্য বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখের ভোরবেলা থেকে তুমি একটাও মিথ্যা বলবে না, কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না, কারো মনে দুঃখ দেবে না। শুধু ভালো কাজ করবে, ভালো কাজ। তাহলে সারাটা বছরই কাটবে তোমার ভালো কাজ করে। আর যারা ভালো কাজ করে, তারাই ভালো মানুষ। তাদেরই লোকে ভালোবাসে। তারাই হয় দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে এই কথাটা আমরা যেন সবাই মনে রাখি।
নারকেলগাছের ডানাগুলি যেন ক্যাবারে ডান্সার
একসাথে ফণা তুলে বামে হেলে গেল
সব ফুল ঝরে গেল নিমগাছটির
অপরাজিতার ঝাড় লোহার শিক ছেড়ে
নুয়ে পড়তে চাইল অন্ধকারে
আম কাঁঠালের ডালগুলো কে কার হাত ধরবে
খুঁজতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে গেল
কোত্থেকে উড়ে এসে একটা টিন বাজিয়ে গেল
একপশলা ব্লেডড্রাম
এমন তীব্র বৈশাখী ঝড়েও দূর্বাদের কিচ্ছু এলো না গেল না,
সামান্য বৃষ্টির জলে নেয়ে উঠে তারা
আরো সবুজ হয়ে উঠল
।
আমি এখন সমুদ্রতে আছি—সে কি আমার কেউ?
সাঁতরানো ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই;
আমি এখন অজগরের ফণার সামনে সাপুড়ে নাচ নাচি
মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই;
একটু আগে এক কালনাগিনীর ছোবল খেয়ে বুঝেছি—
জীবন তো বেদে ও বেদেনীর সম্পর্কই;
আমি এখন সমুদ্রতেই আছি—এইখানে ক্ষুরধার ঢেউ
সমুদ্র তো জানে চিরকাল সে সমুদ্রই...
।