মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো অমলিন

  • ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
শেয়ার
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো অমলিন
ছবি : লুৎফর রহমান

আমি ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আমি সূর্য সেন হলের একটি ফ্লাটে অবস্থান করছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের শেষের দিকে ঢাকা থেকে নিজ শহর ফেনীতে চলে যাই। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

মা-বাবা আমাকে ঢাকা আসতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। ফলে আমাদের ফেনী শহরের বাড়িতে অবস্থান করতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো অমলিনথাকি। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযান শুরু করে। ফেনীতে বসেই খবর পেলাম, ঢাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
২৬ মার্চ সকালে ফেনী শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষ জটলা করে রেডিও শুনছে। সেখানে গিয়ে রেডিওতে শুনতে পাই, মেজর জিয়া (পরে লে. জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। তিনি বলছেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
’ তিনি দেশের জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানান।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করলে জাতি দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। তারা কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছিল না। মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা পুরো জাতিকে আলোর পথ দেখায়। তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে শুরু করে।

রেডিওতে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে আমার মনে যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে হত্যার খবর শুনে জাতি ভীষণভাবে মর্মাহত হয়। এই অবস্থায় আমার পক্ষে ঢাকা আসার কথা চিন্তা করাও দুষ্কর ছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে অভিযান শুরু করে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেনী শহরে সামরিক অভিযান শুরু করে। স্থল বাহিনীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে বিমানবাহিনী হামলা শুরু করে। প্রথম যেদিন ফেনীতে বিমান হামলা হয় সেদিন আমি পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ফেনী শহরের বাড়িতেই ছিলাম। প্রথমে দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে বুঝতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী একতরফা বিমান হামলা শুরু করেছে। আমরা বাসার সবাই ভয়ে খাটের নিচে আশ্রয়  গ্রহণ করি। বিমান হামলা থেমে গেলে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। পরদিন তুলনামূলক নিরাপদ বিবেচনায় আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহরের অদূরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। গ্রামে থেকেই আমরা ফেনী শহরের খবর পাচ্ছিলাম।

গ্রামে পৌঁছার কয়েক দিন পর এলাকার যুবকসমাজের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয় লক্ষ করি। আমাদের এলাকায় মকবুল হোসেন মকু মিয়া নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় তিনি গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। আমি মকু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণদানের জন্য অনুরোধ জানাই। মকু মিয়া আমার অনুরোধে সাড়া দেন। রক্ষণশীলদের অভিভাবকদের বাধা উপেক্ষা করে আমরা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সভা আহ্বান করি। সেই সভার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছুদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রাইফেলও জোগাড় হয়ে যায়। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ফেনী শহরে আসি। ফেনী রেলস্টেশনের কাচাকাছি এলে দুজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করেই বিমান হামলা শুরু হয়। আমরা দ্রুত পাশের একটি বাড়িতে প্রবেশ করে খাটের নিচে আশ্রয় নিই। এই সময় পাকিস্তানি বাহিনী অবিরাম বোমাবর্ষণ করতে থাকে। অনেকেই আহত হন। আমরা যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম বোমার আঘাতে সেই ঘর থরথর করে কাঁপছিল। আমরা যে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম তার আশপাশে বোমা পড়তে থাকে। আমি ভাবতে থাকি, আজই বোধ হয় আমার জীবনের শেষ দিন। আমার সঙ্গে যেসব লোক খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্তত দুজন ছিল আমার বেশ পরিচিত। তারা মৃত্যুভয়ে কান্না শুরু করে। তাদের একজন আমার নাম ধরে বলে, ‘মৃত্যুর পর আমার লাশটি মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেবেন।’ অন্য বন্ধুটিও কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই বুঝতে চাচ্ছিল না যে ঘরের ওপর বোমা পড়লে শুধু তারাই মারা যাবে না, আমারও মৃত্যু হবে। মৃত্যুচিন্তা মানুষকে কতটা বিপর্যস্ত করে তোলে তাদের অবস্থা দেখে আমি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। বোমা হামলার পর খুব দ্রুতই ফেনী শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে শহরে অবস্থান করা নিরাপদ নয় মনে করে আমি আবার গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা আমার চিন্তায় অস্থির ছিলেন। আমাকে পেয়ে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনোনীত করা হয়। এর আগে ৪ এপ্রিল কুমিল্লার তেলিয়াপাড়ায় আর্মি হেড কোয়ার্টার্সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে কর্নেল ওসমানী, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব বাঙালি সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সেই সময় বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সমন্বিত সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কর্নেল ওসমানী ছিলেন সবার সিনিয়র, তাই তাঁকে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।

এপ্রিল মাসেও আমরা গ্রামে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকি। পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ফেনীর দিকে আসতে থাকে। তারা ব্যাপক লুটপাট শুরু করে। গ্রামবাসীদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা আমাকে প্রশিক্ষণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানাতে থাকে। যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল তাদের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ দেখা দেয়। তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা প্রশিক্ষণ বন্ধ করিনি। মে মাসের দিকে আমাদের প্রতিরোধ বাহিনীর কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। তারা সেখান থেকে কিছু বিশেষ টার্গেট নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এতে আমাদের উৎসাহ অনেক গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টি হয় অন্য কারণে। মাঝে মঝেই খবর পেতাম, আজ আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করবে। গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আসছে—এমন খবর পেলে আমরা বাড়ি থেকে অন্যত্র গিয়ে লুকাতাম। সেই সময় যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। মাধ্যম ছিল কেবল বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা। গ্রামে কয়েকটি রেডিও ছিল। শ্রোতারা জটলা পাকিয়ে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরও তারা মনোযোগ দিয়ে শুনত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’।

সেই সময় ফেনীতে বেলাল খান নামের একজন এসডিও ছিলেন। ফেনী শহর মুক্ত থাকাকালে তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যান। পরে ফেনী শহর পাকিস্তানি সেনারা দখল করে নিলে সেই এসডিও ফেনীতে ফিরে আসেন। ফেনীতে এসেই তিনি লুটপাটের নীতি গ্রহণ করেন। লুণ্ঠনকার্যে তিনি স্থানীয় কিছু সহযোগীও পেয়ে যান। সেই সময় পাঞ্জাবি এসডিওর একটি উক্তি বেশ প্রচার পেয়েছিল। তিনি সহযোগী লুটেরাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হাম ভি খায়েগা, তুম ভি খায়েগা।’ অর্থাৎ আমিও খাই, তোমরাও খাও। কিছুদিনের মধ্যেই ফেনীতে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির উদ্যোগে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

অনেকেই শান্তি বাহিনীতে যোগদান করে। রাজাকার বাহিনীতেও নাম লেখায় অনেকেই। জুন-জুলাই মাসের দিকে ফেনীতে রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা বেশ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানি বাহিনী শহরাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আর শান্তিবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। রাজাকার বাহিনী ও শান্তিবাহিনীর কারণে প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনীর বেশ অসুবিধা হতো। অবশ্য পরে মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি সঞ্চয় করে এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করার জন্য পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী নিয়োগ দেওয়া হয়। মিলিশিয়া বাহিনী ছিল অত্যন্ত বর্বর ও জঘন্য চরিত্রের।

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফেনী শহরের পতন হলে অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা শুধু বাড়তেই থাকে। গ্রামে অবস্থান করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এমন এক সময় রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, ১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। এ অবস্থায় আমি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকি। আমি কি ঢাকায় ফিরে যাব, নাকি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাব? নাকি গ্রামেই অবস্থান করব? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নিই। ৩১ মে আমি ঢাকার পথে রওনা দিই। পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে বিকল্প পথে ঢাকা আসি। আমরা যখন মেঘনার নীলকমল ঘাটে উপনীত হই, তখন সূর্য অস্তগামী। আমরা লঞ্চে রওনা দিলাম। লঞ্চে অন্যান্য যাত্রীর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লুত্ফুল হক এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দিলীপ বড়ুয়াকে পেলাম। তাঁদের সঙ্গে সারা রাত গল্প করতে করতে কাকডাকা ভোরে ঢাকায় পৌঁছি। সদরঘাট থেকে আমি সরাসরি আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ে বন্ধু মনসুর মুসার বাসায় গিয়ে উঠি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে ফ্ল্যাট ছিল, সেখানে ওঠা নিরাপদ মনে হয়নি। পরদিন সকাল ১০টায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যাই। বিভাগীয় প্রধান তাঁর কক্ষে  আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ কেটে গেল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই আর বাসায় আসি। ক্লাস খোলা থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীদের তেমন কোনো উপস্থিতি ছিল না। আমি আর দু-তিনজন শিক্ষক আমার কক্ষে বসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতাম। একদিন বিভাগীয় প্রধান নাজমুল করিম স্যার আমাকে তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে বললেন, এভাবে দল র্বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করলে তোমরাও মরবে, আমাকেও মেরে ফেলবে। তোমরা নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করবে। একদিন সকালবেলা নাজমুল করিম স্যার আমাকে তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে এক নিষ্ঠুর ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সাবধানে চলাচল করার পরামর্শ দিলেন। একই সঙ্গে মাথায় টুপি পরার জন্য নির্দেশ দিলেন। স্যার নিজেও সঙ্গে একটি টুপি রাখতেন।

কিছুদিন পর আমি মনসুর মুসার বাসা ত্যাগ করে সূর্য সেন হলের ফ্ল্যাটে উঠি। কিন্তু এখানে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকি। বিশেষ করে রাতের বেলা  বেশি ভয় পেতাম। সামান্য শব্দ হলেই মনে হতো, এই বুঝি পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করছে। একসময় নিরাপত্তাজনিত কারণে হল ছেড়ে আমি ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক মুসলেহউদ্দিন আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় উঠি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ফিরোজ কবীর (মুকুল সরকার) মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় গিয়ে রাত কাটাতেন। এক রাতে মুকুল সরকার কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিই। সেই প্রথম আমি কোনো যুদ্ধরত গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাই। এ সময় একদিন আমি কলা ভবনে থাকা অবস্থায় মুসলেহউদ্দিন খবর দিলেন, আমাদের বাসায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করেছে। আমাদের না পেয়ে তারা বাবুর্চি ছেলেটিকে মারধর করে। আমরা এরপর দ্রুত বাসা ত্যাগ করে আরো ভেতরে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠি। জুলাই মাসে আমি ডাকযোগে জীবননাশের হুমকি সংবলিত একটি চিঠি পাই। যমদূত বাহিনীর চিঠি পাওয়ার পর আমি ঢাকা শহর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ ঢাকা শহর আমার জন্য তখন আর নিরাপদ ছিল না। এক পর্যায়ে সীমান্ত অতিক্রম করার পরিকল্পনার কথা মনসুর মুসার কাছে প্রকাশ করি। তিনি আমার পরিকল্পনায় সমর্থন জানান। আমি ৩১ মে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি।

প্রথমে গ্রামের বাড়ি যাই। বাড়ি পৌঁছানোর এক দিন পর সকালবেলা রাজাকার বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। বাড়ির সবাই খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বড় চাচা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গোপন পথে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে আমার ও পরিবারের সবার জীবন বাঁচানোর জন্য বিকল্প পথে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। তারা আমাকে না পেয়ে আমার ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পে তাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে পরে মুক্তি দেয়। রাজাকার বাহিনী আমাদের বাড়ি লুট করে। ঘটনার পর বাড়ি ফিরে দেখি, সাবাই কান্নাকাটি করছে। আমার ছোট ভাইকে রাজাকার বাহিনী মুক্তি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা করতে থাকি। আমি পরিবার ও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই রাতেই ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। তারা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমার পরিকল্পনা সমর্থন করল। আমি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পথে রওনা দিলাম। এর মাধ্যমে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অধ্যায় শুরু হলো।

আগস্ট মাসের ৪ অথবা ৫ তারিখে আমি সীমান্তের নিকটবর্তী জগন্নাথদীঘির অদূরে নওগাঁয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। সঙ্গে ছিলেন আমার বাবা এবং এক আত্মীয়। আমাদের বাড়ি থেকে নওগাঁর দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। কিন্তু এই রাস্তা পাড়ি দিতে আমাদের পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লেগে যায়। কারণ আমরা পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান এড়িয়ে বিকল্প পথে গন্তব্যে পৌঁছি। নওগাঁ পৌঁছে সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন আত্মীয়বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে সীমান্তবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ি। এই গ্রামগুলো পেরোলেই ভারতীয় সীমান্ত। ঢাকা-চট্টগ্রাম রাস্তা পেরোনোর আগেই বাবার কাছ থেকে বিদায় নিই। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য অত্যন্ত সাধারণ পোশাক পরে দুর্গম রাস্তা পার হয়ে চোত্তাখোলা এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে ফেনী এলাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি খাজা আহমেদের ক্যাম্পে গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে পরিচিত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। রাতে একসঙ্গে আহার করি। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা চলতে থাকল প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত। এমপি খাজা আহমেদ আমাকে দেখে বেশ খুশি হলেন। তবে যেকোনো কারণেই হোক তিনি আমাকে বললেন, পরদিনই যেন আগরতলা চলে যাই এবং সেখান থেকে কলকাতা বা অন্য কোনো স্থানে। আমি আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ক্যাম্প থেকে কিছুদূর এলেই বিলোনিয়া-আগরতলা সড়ক। সেখান থেকে বাসযোগে আগরতলা চলে যাই এবং একটি সাধারণ মানের হোটেলে রাত যাপন করি। আগরতলায় তখন বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। আমি একটি ক্যাম্পে থাকা শুরু করলাম। আমার পরিচয় জানতে পেরে ক্যাম্পের সবাই বেশ সমীহ করত। আমি স্থানীয় সিপিএম অফিসে যাতায়াত শুরু করি। সিপিএম কমরেডরা আমাকে যেভাবে সম্মান প্রদর্শন করতেন তাতে বেশ মুগ্ধ হই। মাঝে মাঝে স্থানীয় শরণার্থী ক্যাম্পে যেতাম। সেখানে অবস্থানরত তরুণদের দৃঢ় মনোবল দেখে আমার মনে হতে লাগল, বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করবে। এখানে কমল কর নামে আমার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। ১৯৬০ সালের পর এটাই কমলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। ক্যাম্পে অবস্থান করা সবাই আমাকে বেশ সম্মান করত। কিন্তু একই সঙ্গে তারা আমাকে কলকাতা যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে থাকে। আমার কলকাতা যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কারণ আগরতলা থাকাকালে আমি যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি অবস্থানের সুযোগ পেয়েছিলাম। দেশের খবরও পাওয়া যেত। তারপর মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর অবদান রাখার জন্য একসময় কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কলকাতা যাত্রার দিন আগরতলা বিমানবন্দর থেকে একটি ছোট ডাকোটা বিমানে উঠি। বৃষ্টি ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বিমান আকাশে উড্ডয়ন করে। কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় প্রচণ্ড বাম্পিং। সব যাত্রীই ভয় পেয়ে যায়। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আজই বুঝি জীবনের শেষ দিন। যা হোক, পাইলট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিমান চালাতে থাকলেন। তিনি গৌহাটি বিমানবন্দরে বিমানটি জরুরি অবতরণ করালেন। সেখানে ঘণ্টাখানেক থাকার পর আবার কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে ট্যাক্সিযোগে বউবাজারে অবস্থিত বন্ধু কমলদের পরিত্যক্ত একটি অফিস কাম আবাসিক রুমে উঠি। পরদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা ভবনে যাই। এখানে ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির অফিস। পাশেই ছিল বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অফিস। কলকাতা পৌঁছার পর আমি মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখার সুযোগ পাই। বাংলাদেশের যেসব শিক্ষক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছতেন তাঁদের মাসিক ৪০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো। এই টাকা দিয়ে আমাদের মাসিক খরচ মোটামুটি চলে যেত। আমি কলকাতা থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রচারণা চালাতে থাকি। আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু বেশ কিছু আলোচনাসভায় যোগ দিয়েছি। কলকাতার শরণার্থীজীবনে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল বাল্যবন্ধু কমল। কমলের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় মুক্তিযু্দ্ধ নিয়ে আলোচনা হলেও তার মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে জানতে পারি। কলকাতা অবস্থানকালে অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে দেখা হতো, আলোচনা হতো।

কলকাতার নাট্য আন্দোলন আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আদায়ের জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল তার কোনো প্রভাব কলকাতায় প্রত্যক্ষ করিনি। কলকাতায় অনেক বাংলাভাষীকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনেছি। সেই সময় কলকাতার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশির ভাগ মালিক ছিলেন অবাঙালি। কলকাতা ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির শহর। কিছু অভিজাত এলাকা বাদে পুরো শহরই কার্যত নোংরা ও দুর্গন্ধময়। কলকাতা থাকাকালে আমি সাধারণত ট্রামে চলাচল করেছি। কিন্তু ট্রামে যে ঘটনা ঘটেছিল তা এখনো আমার মানসপট থেকে বিদূরীত হয়নি। একদিন আমি বউবাজার থেকে ট্রামে চড়ে আসছিলাম এসপ্লানেডে। নামার সময় আমার পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমি নিজ চোখে অবলোকন করলেও করার কিছু ছিল না। আমি চিৎকার করে বলে উঠি, ‘ওই যে, ওই যে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে।’ কিন্তু কে বা কারা আমার গতিপথ রোধ করে দিল এবং রহস্যময় ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? কে নিয়েছে? এর মধ্যেই ছিনতাইকারী উধাও। আমি সেদিন হেঁটেই আস্তানায় পৌঁছি।

মুক্তিযুদ্ধকালে আগরতলা ও কলকাতা অবস্থান করাটা আমার জন্য স্মৃতিময় একটি ঘটনা। আমি সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। যেকোনো মানুষের তার জীবনে সবচয়ে স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারা। আমি সেই সৌভাগ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন একটি মানবিক সমাজ গঠন করা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। বিগত সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে গণতন্ত্রহীনতার দিকে ধাবিত হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেশে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি আনুকূল্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের মহোৎসব চলছিল সাড়ে ১৫ বছর ধরে। শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিগত সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ যদি গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হতো তাহলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হতো। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এই সুযোগ আমরা কি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব?

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ