কালান্তরের কড়চা

সাইমন ড্রিং এবং সাহসী সাংবাদিকতা

  • আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
সাইমন ড্রিং এবং সাহসী সাংবাদিকতা

সাইমন ড্রিং চলে গেলেন। কিংবদন্তি কথাটা আর ব্যবহার করতে চাই না। এটা বহু ব্যবহারে অর্থহীন হয়ে গেছে। তাই কিংবদন্তি কথাটা ব্যবহার না করে লিখছি সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার রূপকথার রাজপুরুষ।

তাঁর জীবনে যত নাটকীয়তা ও বৈচিত্র্য তা রূপকথার রাজপুত্রদেরও ছিল না। কিন্তু রাজপুত্র ও সাইমন ড্রিংয়ের চরিত্রে একটা মিল ছিল। রাক্ষস বধের জন্য রাজপুত্র যেমন রাক্ষসদের প্রাণভোমরার খোঁজে অসম্ভব বিপদ পাড়ি দিয়ে সমুদ্রতলে পৌঁছেছিলেন, সাইমন তেমনি খাঁটি খবরের খোঁজে অসুর শাসকদের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করেছেন। কখনো বশ মানেননি।
এমনকি বাংলাদেশে পাকিস্তানের বর্বর হানাদারদের কাছেও মাথা নত করেননি। তাঁর একটিই কথা ছিল, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা।’ তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার আনত শিরের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাইমন মারা গেছেন ১৬ জুলাই রোমানিয়ায়।

হার্নিয়া অপারেশন করতে গিয়ে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে তিনি মারা গেলেন। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু প্রতিভায় অনেক বড়।
তাঁকে নিয়ে ঢাকার কাগজে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ঢাকার অনেক সাংবাদিক তাঁকে জানতেন। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য তাঁদের হয়েছে। তাঁরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্তও প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার সব কাগজেই। তাই সেসব কথা আবার নতুন করে লিখতে গেলাম না। তাঁর সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল সামান্যই। কিন্তু গড়ে উঠেছিল গভীর অন্তরঙ্গতা। তাই এখানে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু কথা লিখব।

সাইমনের সঙ্গে আমার আলাপ ঢাকায় একাত্তরের সেই  ঝোড়ো দিনগুলোতে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক পিটার হেজেলহার্স্ট ঢাকায় এসেছিলেন একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসেই। ঢাকায় অবস্থানের ৯ দিনের মাথায় তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফে রিপোর্ট পাঠালেন—‘নাইন ডে’জ জাঙ্গল-রুল ইন ইস্ট পাকিস্তান’। তিনি অবজারভার হাউসে এসেছিলেন। আমি তখন অবজারভার হাউসের বাংলা দৈনিক পূর্বদেশে (এখন নেই) কাজ করি। হেজেলহার্স্টের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি আমার পরিচয় জেনে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন।

আমি তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হেজেলহার্স্টই জানালেন, তাঁর আরেকজন সহকর্মী সাইমন ড্রিং আগেই ঢাকায় এসে গেছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আপনারা অনেক বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় আসছেন। ব্যাপার কী? আপনারা কি ঢাকাকে নেক্সট ট্রাবল স্পট মনে করেন?’ হেজেলহার্স্ট বললেন, ‘আমার তা-ই ধারণা। নইলে সাইমন ড্রিং ঢাকায় আসতেন না। তিনি ভিয়েতনামে একবার, আরেকবার সাইপ্রাসে রণাঙ্গনের রিপোর্ট করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি আশা করছি, এবার ঢাকায় তেমন কিছু হবে না, আমরা একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে পারব। নইলে পরিস্থিতি ভিয়েতনামের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।’

মার্চ মাসের শুরুতেই বিদেশি সাংবাদিকরা দলে দলে ঢাকায় এসে পৌঁছান। তাঁদের আবাসস্থল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। সাইমন ড্রিংও এসে এখানেই উঠেছিলেন। তিনি রয়টার, বিবিসি থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশির ভাগ সংবাদ সরবরাহ সংস্থা ও সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। তখন সম্ভবত টাইমসে কাজ করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় হতেই দুজন দুজনের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক যখন শেষ পর্যায়ে, অত্যন্ত ক্রুসিয়াল পর্যায়ে, আওয়ামী লীগ নেতারা তখনো আশা করছেন একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হবে, তখন সাইমন একদিন অবজারভারের মূসা ও আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা সমঝোতা হবে না। আমি করাচি হয়ে ঢাকায় এসেছি, পিন্ডির এক ক্লাবে মদ খেয়ে অর্ধমাতাল জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বলতে শুনেছি, মুজিবকে এবার আমি ছেড়ে দেব না। নির্বাচনে জিতলে কী হবে, এবার ব্যালট নয়, বুলেট দিয়ে কথা বলা হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালট যে শক্তিশালী, এবার প্রাণ দিয়ে হলেও আমি তা প্রমাণ করব।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কার কথা সত্য হয়েছিল।

সাইমন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন ১৮ বছর বয়সে। আমিও তাই। তাঁর পটভূমি ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আমার ছিল পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ। তিনি ঢাকায় এসে ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে পেলে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ ও ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা রায়ট সম্পর্কে জানতে চাইতেন। সাইমন ব্রিটিশ সাংবাদিক। কিন্তু অকপটে স্বীকার করতেন, ব্রিটিশ শাসিত বাংলাদেশে বাংলা পঞ্চাশ সনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি। এই দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ নর-নারীর মৃত্যুর জন্য চার্চিল দায়ী। সাইমনের অভিমত, ছয় লাখ থেকে ১০ লাখ ইহুদি হত্যার জন্য হিটলারের যদি বিচার হতে পারে, তাহলে ৫০ লাখ বাঙালি হত্যার জন্য চার্চিলের বিচার হবে না কেন?

জিজ্ঞেস করেছি, আপনার এই অভিমত কখনো প্রকাশ করেছেন? সাইমন বলেছেন, ‘করেছি। সে জন্য নিজের দেশেই নিন্দিত হয়েছি এবং প্রশংসিতও হয়েছি।’ এটা পরবর্তীকালের কথা। ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর রেজা শাহ দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা আল্লামা  খোমেনি ১৪ বছর প্যারিসে নির্বাসনে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তরুণ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং একই প্লেনে তাঁর সঙ্গে প্যারিস থেকে তেহরানে পৌঁছেছিলেন। আমার এই আল্লামা খোমেনি সম্পর্কে লন্ডনে বসে জানতে প্রচণ্ড ইচ্ছা হয়েছিল। এই খোমেনির এক ফতোয়ার জন্য একসময় বিশ্ব বিখ্যাত লেখক সালমান রুশদিকে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলো সালমানকে রক্ষার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে বাধ্য হয়েছিল। আমার কাছে দাড়িওয়ালা এক মোল্লার ক্রূর কঠিন চরিত্রের যে ভাবমূর্তি, সেই ভাবমূর্তিই খোমেনি সম্পর্কে মনে স্থায়ী হয়েছিল। বাংলাদেশে বিএনপির রাজত্বকালে সাইমনকে যখন বের করে দেওয়া হয়, তখন তিনি দুই দিনের জন্য লন্ডনে এসেছিলেন। সানডে টাইমস অফিসে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ-টাইম বৈঠক। তখনই খোমেনির কথাটা কথা প্রসঙ্গে উঠেছিল।

সাইমন বললেন, ‘চৌধুরী, আপনার ধারণা ভুল। বাইরের জগতে তাঁকে যে কট্টর চেহারার দেখানো হয়েছে তিনি তা নন। কট্টর মোল্লা মোটেই ছিলেন না। আমার হাতে ড্রিংসের গেলাস দেখে তা সরিয়ে ফেলতে বলেননি। বিমানে পাশের সিটে বসিয়ে ইসলামী বিপ্লবের আদর্শ ও উদ্দেশ্য আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।’

তিনি বলেছেন, মানুষ এবং মানুষের সমাজ যেমন পরিবর্তনশীল, তাদের ধর্মও তাই। পনেরো শ বছর আগের ইসলামী সমাজের বিধিব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রাখলে চলবে না, তাকে যুগোপযোগী হতেই হবে। তবে ধর্মের যে বেসিক মন্ত্র তা থেকে সরলে চলবে না। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, হাউস অব সৌদ বেশিদিন টিকবে না। পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাবে।

সাইমন ড্রিং বাংলাদেশ থেকে দুইবার বহিষ্কৃত হয়েছেন। একবার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদারদের দ্বারা। দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিএনপি সরকারের আমলে এবং তাদের হুকুমে। সাইমনের ভাষায়, ‘তাঁকে প্রথমবার বহিষ্কার করেছিল পাকিস্তানিরা, পরে তাঁকে বহিষ্কার করেছিল পাকিস্তানের তাঁবেদাররা।’ একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে ধরে নিয়ে প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে। সাইমন হোটেল থেকে পালিয়ে যান। ২৭ মার্চ ভোরে কারফিউ শিথিল করা হলে তিনি সেই সুযোগে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢাকা শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। সেখান থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানি বর্বরতার রিপোর্ট প্রথম বহির্বিশ্বে প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টের হেডিং ছিল, ‘T

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়া

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়া

নজিরবিহীন এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ডেকে নিয়ে এভাবে অপমান করার ঘটনা অতীতে আর ঘটেনি। একেই বলে জোর যার, মুল্লুক তার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেস সচিবের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন এবং মধ্যাহ্ন ভোজের কথা থাকলেও দুই নেতার বিতণ্ডার পর জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।

বিষয়টি পরবর্তীতে পরিষ্কার করেছেন ট্রাম্প নিজেই। জানিয়েছেন, জেলেনস্কি যখন শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন আবার ফিরে আসতে পারেন। বিষয়টি এককথায় কূটনৈতিক এমনকি সাধারণ শিষ্টাচারবিবর্জিত হলেও এটি নিয়ে দুই নেতার পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই কথা বলছেন। নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক এর পক্ষে কথা বললেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রাম্পের পক্ষে কথা বলেছে একমাত্র রাশিয়া, সেটাও আবার কূটনৈতিক এবং রাষ্ট্রাচারের বাইরে গিয়ে জঘন্য বাজেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, রাশিয়া এটা দেখে অবাক হয়েছে যে ট্রাম্প এবং তাঁর ডেপুটি জেডি ভ্যান্স কিভাবে এই জঘন্য লোকটার গায়ে আঘাত না করে থাকলেন! মাত্র দেড় মাস সময়ের ব্যবধান! রাশিয়ার মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশংসাবাণী আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মুখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউক্রেনের লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলার জন্য জেলেনস্কিকে অভিযুক্ত করা! অথচ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ এবং অস্ত্রের জোরেই এই যুদ্ধের সূচনা, যার নিশ্চয়তা না থাকলে ইউক্রেনকে হয়তো বিকল্প পথে হাঁটতে হতো, হয়তো রাশিয়াকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হতো যে সে (ইউক্রেন) ন্যাটোতে যোগ দেবে না, পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের নামে এমন কিছু করবে না, যা রাশিয়ার স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।

ওভাল অফিস থেকে যখন জেলেনস্কি বের হয়ে যাচ্ছিলেন, দৃশ্যটা বলে দেয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। পুরো বিষয়টিই বলে দিচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন ট্রাম্প-ভ্যান্স। ইউরোপীয় দেশগুলো কোনো ধরনের রাখঢাক না করে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছে।

জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি চলে যান যুক্তরাজ্যে। কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে। তাত্ক্ষণিকভাবে ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পেয়েছেন সে দেশ থেকে। এই অর্থ দিয়ে নতুন করে অস্ত্র ক্রয় করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ইউক্রেন আর রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ দিয়ে ইউরোপের দায় মেটানো হবে। কতটুকু পারবেন জেলেনস্কি? শুধু ইউরোপের সহায়তায় রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে কত দিনই বা টিকে থাকতে পারবেন? এদিকে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে ইউরোপই বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কিভাবে নেবে সেটাও একটা ভাবনার বিষয়।
পুরো পরিস্থিতি থেকে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে রাশিয়া। বাইডেন প্রশাসনের প্ররোচনায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেখানে রাশিয়ার হাত থেকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বাইরেও ইউরোপের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তার দিকটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তাও কি শঙ্কায় ফেললেন না ট্রাম্প?

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়াপরিস্থিতি থেকে এটাও বোঝা যায় যে জেলেনস্কির ওপর অনেকটা পুরনো ক্ষোভ ঝাড়ার সুযোগ পেয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৯ সালে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের একটি ফোনালাপ নিয়ে সে সময় ট্রাম্পের অভিশংসনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে বিরোধী পক্ষগুলো। এই ফোনালাপে জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে ব্যবসা পরিচালনায় দুর্নীতির বিষয় তদন্ত করার অনুরোধের বিনিময়ে ইউক্রেনকে বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা জেলেনস্কি মানেননি। ট্রাম্প চাচ্ছিলেন এর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর অবস্থানকে পোক্ত করবেন। পরবর্তী সময়ে বাইডেনের কাছেই পরাজয় বরণ করে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয়। ওভাল অফিসে দুই নেতার কথোপকথনে উঠে আসে হান্টার বাইডেনের প্রসঙ্গও। এই বিষয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তা বা জাতীয় স্বার্থ নয়, ট্রাম্পের কাছে তার ব্যক্তিস্বার্থই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আর একটি বিষয় রয়েছে, আর তা হলো একতরফাভাবে ইউক্রেনের খনিজ ভাগাভাগির বিনিময়ে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের একটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিয়েছেন। ধারণা করা যায়, এর পেছনে ইলন মাস্কের বড় ভূমিকা রয়েছে। মাস্কের স্পেসএক্সের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাফাইট জোগানের নিশ্চিত করতে ইউক্রেনকে টার্গেট করা হয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ছাড়াও মাস্ক মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। এবার সেটার প্রতিদান দেওয়ার পালা। আর এ জন্য বলি করার চেষ্টা করা হচ্ছে ইউক্রেনকে।

তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে যাচ্ছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন জেলেনস্কি। এত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সমন্বিত প্রক্সি যুদ্ধের ভয়ে রাশিয়ার তরফে একের পর এক ইউক্রেনের ভূমি দখল করা হলেও জেলেনস্কির জীবননাশের মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি রাশিয়া। পুতিনের ব্যক্তি চরিত্র বিশ্লেষণ করে যা জানা যায়, তিনি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে পছন্দ করেন না এবং সুযোগ পেলে তাদের বিনাশ করে দেন। এর উদাহরণ হিসেবে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোসিন এবং রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। রাশিয়া কি এবার এই সুযোগটি নেবে, নাকি অপেক্ষা করবে ট্রাম্প বাস্তবে ইউক্রেনের বিপক্ষে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তার ওপর? 

ট্রাম্প যেমনভাবে ভাবছেন সব কিছু সেভাবেই করতে পারবেন এবং আখেরে তিনি তাঁর দেশের জন্য সর্বোচ্চটা অর্জন করতে পারবেন, তেমনটা ভাবারও কারণ নেই। ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। লন্ডনে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে গত ২ মার্চ  এক সম্মেলনের আয়োজন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। যোগ দিয়েছে ইউরোপের কমপক্ষে এক ডজন দেশের সরকারপ্রধান ছাড়াও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ কানাডাও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত অভিন্ন চাপে রয়েছে। এই সম্মেলন থেকে ঘোষণা এসেছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা ইউক্রেনের পাশে থাকবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় ইউক্রেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। এ যেন যুক্তরাষ্ট্রকে একধরনের চপেটাঘাত! এ ছাড়া রাশিয়ার দিক থেকে অভিন্ন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় তারা নতুন জোট প্রতিষ্ঠার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছে। এত দিন ধরে ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প অনেক বেফাঁস কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিতএমন কথা বলতেও ছাড়েননি তিনি। ইউরোপের দেশগুলো ট্রাম্পের এ ধরনের সম্ভাব্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে সচেতন রয়েছে। তারা সম্ভবত এটা এখন উপলব্ধি করছে যে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তারা বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, সঙ্গে পাচ্ছে কানাডাকেও। এ ক্ষেত্রে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটুকু সফল হতে পারবেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেই, রাশিয়া এই স্পষ্ট বার্তা পেয়েছে। এদিক দিয়ে তারা নতুন করে লাভবান হতেই পারে।

ইউক্রেনের ওপর তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার উসকানির জন্য দোষারোপ করেছেন। ইউক্রেনের আত্মরক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি তবে কোথায় থাকল! তা ছাড়া ইউক্রেনকে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার জন্য বাইডেনকে তিনি স্টুপিড প্রেসিডেন্ট বলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দায় ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে মনোভাব দেখিয়েছেন, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।  নিজ ঘরে অতিথিকে ডেকে নিয়ে এমন অপমান, এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রাচারের সঙ্গে যায় না। তবে জেলেনস্কির সাহসের প্রশংসা করতে হয়। রীতিমতো ট্রাম্প-ভ্যান্সের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। একসময় ইউক্রেনকে নিয়ে খেলেছেন বাইডেন, এখন খেলতে চাচ্ছেন ট্রাম্প। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের  ঝুঁকি তিনিই অনেক বাড়িয়ে তুলেছেন। ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একতরফাভাবে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা করার মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপের সমন্বিত উদ্বেগকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছেন। লন্ডন সম্মেলন ট্রাম্পের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্ত তারা মানছে না। সিদ্ধান্ত এটাই যে ইউক্রেন তার আত্মরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবে, পাশে থাকবে ইউরোপ। বিষয়টি কঠিন, যা স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং ইউরোপের কিছু নেতাও। যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া এই লড়াইয়ে শুধু ইউরোপের সহায়তা, সেটা যতটা বর্ধিতই হোক না কেন ইউক্রেনের পক্ষে রশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়, তার মানে লাভবান হচ্ছে রাশিয়াই, মাঝে ইউরোপের সঙ্গে যে দূরত্ব ট্রাম্প সৃষ্টি করলেন, এটা মেরামতের সুযোগ তিনি কতটা পাবেন সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।    

   

 লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

তৈরি পোশাক খাতে প্রয়োজন বিশেষ সহযোগিতা

    নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
তৈরি পোশাক খাতে প্রয়োজন বিশেষ সহযোগিতা

গত সোমবার একটি ইংরেজি দৈনিকে ক্রমাগত কারখানা বন্ধ হতে থাকায় ব্যবসায় আস্থা কমছে শিরোনামে উদ্বেগজনক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বিগত সাত মাসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ভয়ংকর অবস্থা, তা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে এবং উদ্যোক্তারা যে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে আছে সে বিষয়গুলো আলোচ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষ, অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ এবং ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়কেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাবসায়িক নেতা।

সেই সঙ্গে উচ্চ সুদের হার, খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়াকড়ি এবং ব্যাংকের অসহযোগিতার মতো বিষয়গুলো উক্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের খারাপ অবস্থা নিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এটাই যে প্রথম প্রতিবেদন তেমন নয়। এর আগে কালের কণ্ঠসহ বেশ কয়কটি জাতীয় দৈনিকে দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অবস্থার দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই, উল্টো ক্রমাগত খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

গত আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকের ধারণা ছিল যে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সরকার পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা খুব সহসাই কেটে যাবে এবং সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি, বরং ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে দেশের সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শোচনীয় অবস্থার কথাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

বেশ কয়েকটি বৃহত্ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পোশাক তৈরির কারখানাসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছোট-বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক শ্রমিক। অনেক তৈরি পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রয় আদেশ প্রত্যাহার করে অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বিদেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। বিদেশি ক্রেতারা এমনিতেই বাংলাদেশে গিয়ে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় অবস্থিত তাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে বসে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বর্তমান অস্থিরতার কারণে একেবারেই কোনো ক্রেতা যেতে আগ্রহী নয়। এ রকম অবস্থায় আমাদের রপ্তানিকারকরা যে ক্রেতাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে আলোচনা করে ক্রয় আদেশ সংগ্রহ করবে, সেই সুযোগও সীমিত। কেননা অনেকেই নানা কারণে দেশের বাইরে যেতে পারছে না।

তৈরি পোশাক খাতে প্রয়োজন বিশেষ সহযোগিতাএ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের যেকোনো ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব হবে মারাত্মক। প্রথমত, তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে অত্যন্ত শ্রমঘন একটি খাত। এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। একটি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক হচ্ছে দেশের প্রধানতম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যম। এই খাত যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে, যা দেশের রিজার্ভের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তৃতীয়ত, তৈরি পোশাক খাত হচ্ছে ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি একটি ব্যাবসায়িক সম্পর্কের ফল। দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে মানসম্পন্ন পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যে সুনাম অর্জন করেছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে, তা মূলত বিগত তিন দশকের ফল। এখন যদি ক্রেতাদের সঙ্গে এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তাহলে সেটি আর খুব সহজে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না এবং সে ক্ষেত্রে বেশ সময় লাগবে। তত দিনে অন্য কোনো দেশের রপ্তানিকারকরা সেই স্থান নিয়ে নেবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানির আরো একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে এক বছর আগে থেকে রপ্তানি আদেশ নিশ্চিত করতে হয়। রপ্তানির জন্য সময়, যাকে লিড টাইম বলা হয়, সেটা হয়তো থাকে দুই থেকে তিন মাস। অর্থাত্ রপ্তানির আদেশ বা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) পাওয়ার পর দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু রপ্তানি প্রক্রিয়া, অর্থাত্ ক্রয় আদেশ, মূল্য, রপ্তানির শর্ত, পোশাকের ধরন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে থেকে। যেমনআগামী গ্রীষ্মকালের জন্য যেসব পোশাক উন্নত বিশ্বে বিক্রি হবে, তার রপ্তানি প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়। তেমনি আগামী শীতকালে বিক্রির জন্য যে পোশাক, তার রপ্তানি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এখনো যদি দেশের তৈরি পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করা না যায় এবং রপ্তানিকারকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে যদি তাদের আশ্বস্ত করা সম্ভব না  হয়, তাহলে তারা আগামী এক বছরের রপ্তানি আদেশ হাতছাড়া করে ফেলবে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়বে পুরো তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর।

সবচেয়ে বড় কথা ধারাবাহিক ক্রয় আদেশের বিপরীতে রপ্তানির মাধ্যমে তৈরি পোশাক কারখানা টিকে থাকে। যদি ক্রয় আদেশ না থাকে, তাহলে কারখানা একবার বন্ধ হলে এমন বেহাল হয় যে পরবর্তীতে রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেলেও সে কারখানা আর খুব সহজে সচল করা সম্ভব হয় না। এসব কারণেই তৈরি পোশাক সম্পূর্ণ একটি ভিন্নধর্মী রপ্তানি খাত, যার জন্য সব সময়ই বিশেষ সুবিধা এবং নীতি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এমনকি এই খাতকে একটি অত্যাবশ্যক বাণিজ্য খাত হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব এবং অস্থিরতা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমরা যদি চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং এমনকি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে সেসব দেশে এ ধরনের রপ্তানি খাত বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কহার আরোপের কারণে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। এর প্রভাবে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এক নতুন সংকটে পড়তে বসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব রাজনীতিতে কিছু নতুন চমক, বিশেষ করে ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক প্রথমে আমেরিকার মিত্র উন্নত দেশগুলোর ওপর প্রয়োগ করা এবং আমেরিকা-ইউক্রেন সম্পর্ক আকস্মিক এক নতুন দিকে মোড় নেওয়ায় এই সংকট কিছুটা কেটে গেছে বা স্তিমিত হয়ে পড়তে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে রপ্তানির ওপর উচ্চ শুল্কের খড়্গ হয়তো আপাতত নামছে না। আমেরিকার ব্যবসায়ীদের আরো কিছুদিন বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা তৈরি পোশাক আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে অত্যাবশ্যক পণ্য। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই সুযোগ নিশ্চয়ই আপনাআপনি আসবে না। এই সুযোগ কষ্ট করে ধরতে হবে। আমরা যদি এই সুযোগ ধরতে না পারি, তাহলে সেটি আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না, বরং অন্য কোনো দেশে চলে যাবে। অনেক দেশই এসব সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অতিসত্বর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত থেকে অস্থিরতা দূর করে এখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ খুব দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ১. প্রথমেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে বা কারখানা এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২. ব্যবসায়ীদের, বিশেষভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের সমস্যাগুলো জানা এবং সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া। ৩. রপ্তানিকারকদের বিদেশে গিয়ে, বিশেষ করে ক্রেতাদের আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া। ৪. রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ বা আধুনিক করা, যেমনএলসির পরিবর্তে স্ট্যান্ডবাই এলসির মাধ্যমে রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়া। ৫. ব্যাংকঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করা। এবং ৬. খেলাপি ঋণ কঠোর করার বিষয়টি আপাতত সরিয়ে রাখা। কেননা এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জটিল সমস্যা, যা সময় নিয়ে বিশেষভাবে সমাধান করতে হবে। এর বাইরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে আমেরিকা বা লাতিন আমেরিকায় সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খুলে সেখান থেকে ফিনিশড প্রডাক্ট রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। বিষয়টি ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিধায় এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। 

মোটকথা, অতিসত্বর দেশের তৈরি পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সেই সঙ্গে রপ্তানিকারকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এমনটা করতে পারলে খুব সহজেই এই খাতের সংকট কাটানো সম্ভব হবে। আর এই বিশেষ খাতের সংকট দূর করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে এর প্রভাব দেশের অন্যান্য ব্যাবসায়িক খাতেও পড়বে এবং সেখানেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। আমাদের প্রত্যাশা, দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকার এবং নীতিনির্ধারক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

 

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

nironjankumar_roy@yahoo.com

 

মন্তব্য

নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে এনসিপির যাত্রা শুরু

    মাহবুব আলম
শেয়ার
নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে এনসিপির যাত্রা শুরু

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইংরেজিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি, সংক্ষেপে এনসিপির যাত্রা শুরু হয়েছে। বিতর্কের কারণ সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন ও ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান। এ ছাড়া দলটি কিংস পার্টি হচ্ছে কি না, এ নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক বা প্রশ্ন আছে। এই বিতর্ক আরো উসকে দিয়েছে নবগঠিত দলের প্রতি উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের আবেগ ও উচ্ছ্বাস।

তা ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রদের তিন প্রতিনিধির একজন পদত্যাগ করলেও দুজন উপদেষ্টা পরিষদে রয়েই গেছেন। অবশ্য তাঁরা বলেছেন, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন না।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শেরেবাংলানগরে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের প্রশস্ত সড়কে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে এনসিপি গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা করা হবে।

এই বক্তব্য ও ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক শুরু হয়।

বিতর্কের সূত্রপাত করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ নির্বাচন কেন হবে? আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে? সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্যে অন্য উদ্দেশ্য আছে। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অকার্যকর ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এটি বলেই সালাহউদ্দিন ক্ষান্ত হননি।
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এক মাসের আলটিমেটাম দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের দাবিতে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দেবে। রীতিমতো হুমকি।

শুধু সালাহউদ্দিনই নন, অন্যান্য দলের নেতারাও ছাত্রদের দল গঠনকে স্বাগত জানালেও তাদের ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ছাত্রনেতাদের গভীর চিন্তার মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে এরা অ্যাংরি ইয়াংম্যান। রীতিমতো কটাক্ষ।

গণ অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরও সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

দেশের সব রাজনৈতিক দল বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। এমনকি খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে আর একটু বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সংশোধিত বক্তব্য দিয়ে বলেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী মার্চের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন হবেএটি ধরে নিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঠিক এই সময় বর্তমান সংবিধান বাতিল করে গণপরিষদ নির্বাচন ও সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের দাবি ও প্রতিষ্ঠা রাজনীতির অঙ্গনকে অস্থির করে একেবারে সব কিছু ওলটপালট করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে এনসিপির যাত্রা শুরুওলটপালট এই কারণে যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য তিনি সব দলের সঙ্গে এরই মধ্যে এক দফা সংলাপ করেছেন। শিগগিরই আরো সংলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবেন। কিন্তু এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিকের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জাতীয় ঐকমত্যে রীতিমতো জল ঢেলে দিল। অবশ্য ছাত্রদের এই দাবি নতুন কিছু নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই ছাত্ররা বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি করে আসছে। এই লক্ষ্য নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার ঘোষণা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু বিএনপির আপত্তির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রদের ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত রেখে সরকার নিজেই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা দেবে বলে জানায়। কিন্তু আজও সেই ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

এই অবস্থার মধ্যে ছাত্রদের নবগঠিত দল এনসিপি সুস্পষ্ট করে বলেছে, কেবল একটি সরকারের পতন ঘটিয়ে আরেকটি সরকার বসানোর জন্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। বরং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে অগ্রাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে সাড়া দিয়েছে জনগণ। সেই আকাঙ্ক্ষার রূপ দেওয়ার কথা আমরা বলছি ছয় মাস ধরে। সে লক্ষ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্রের কথা বলছি।

এনসিপির নেতারা এ বিষয়ে আরো বলেছেন, ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে ঘোষণা দেওয়া হয় মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা হয়েছে। তাই নতুন সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন জরুরি ও অবশ্য কর্তব্য। জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে ধরে রাখা ও জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যও এটি হবে অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

এই অবস্থায় নিশ্চিতভাবে ডিসেম্বরের প্রস্তাবিত নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে ঐকমত্যের সম্ভাবনা কার্যত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছা করলেও জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে নতুন করে নতুন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংলাপ করতে হবে। এবং সেই সংলাপ থেকে রাতারাতি কোনো ফলাফল বেরিয়ে আসবে এমন কোনো লক্ষণ এখনো স্পষ্ট নয়।

বরং পরিস্থিতি আরো জটিল ও কঠিন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এনসিপির উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে নাহিদ ইসলামের সেকেন্ড রিপাবলিক কোনো অধরা স্বপ্ন নয় বক্তব্যে। এই অবস্থায় নতুন সংবিধান ও দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রশ্নের সমাধান এখন অনেকটাই জরুরি ও আবশ্যিক বিষয়ে পরিণত হতে পারে। কারণ এই ছাত্রদের নেতৃত্বেই জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে। এই অভ্যুত্থান দেশব্যাপী যে নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটিয়েছে, তা অনস্বীকার্য। সর্বোপরি চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের রাজনীতিবিমুখ অবস্থার অবসান হয়েছে। ছাত্ররা এখন রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। নিঃসন্দেহে এটি জুলাই অভ্যুত্থানের একটি বড় সাফল্য। এই অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন বন্দোবস্তের দাবি উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সে ক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নবগঠিত দলের সংঘাতও অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর তা যদি হয়, তাহলে ডিসেম্বর বা মার্চের প্রস্তাবিত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত হবে।

সেকেন্ড রিপাবলিক অর্থাত্ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ছাড়াও ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ মূলত কমিউনিস্টদের স্লোগান। ভারত ও পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা এই স্লোগান দেয়। ইনকিলাব অর্থ বিপ্লব। আর জিন্দাবাদ মানে দীর্ঘজীবী হোক।

১৯২১ সালে একজন মুসলিম পণ্ডিত মাওলানা হাসরাত সোহানি এই স্লোগানের জন্ম দেন। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা ও ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর আবিষ্কৃত এই স্লোগান ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এনসিপির শেরেবাংলানগরের সমাবেশে এই স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। এই স্লোগানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পিনাকি ভট্টাচার্যের যথেষ্ট অবদান আছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এটি তো কমিউনিস্টদের স্লোগান। অবশ্য এ কথাও সত্য, ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান, কংগ্রেস, অকংগ্রেসসহ সব স্বাধীনতাসংগ্রামীর স্লোগান ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ। তা ছাড়া এনসিপিকে কোনো কোনো মহল ডানপন্থী, দক্ষিণপন্থী দল বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেও কার্যত এটি একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। এই দলে ডান, বাম, ইসলামপন্থী সব মত ও পথের ছাত্রদের সম্মিলন ঘটেছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনসিপির ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে মধ্য, ডান, বাম, শিবির, কওমি, আদিবাসী ও ১৫ নারী স্থান পেয়েছেন। অর্থাত্ নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি বিশেষভাবে বিবেচিত হয়েছে ছাত্রদের নবগঠিত দলে, যে দলের লক্ষ্য বিপ্লব। তাইতো স্লোগান হিসেবে নিয়েছে ইনকিলাব জিন্দাবাদবিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

তরুণদের নিয়ে তারুণ্যনির্ভর এই দল শেষ পর্যন্ত কী করে, তা দেখার বিষয়। অতীতে তারুণ্যনির্ভর দল জাসদের পরিণতি দেশবাসী দেখেছে। এ ক্ষেত্রে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

মন্তব্য

একাত্তরকে ভুলি কী করে

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
একাত্তরকে ভুলি কী করে

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু এরই মধ্যে লেখা হয়েছে, আরো লেখা হবে, লেখার দরকার পড়বে। এই রকমের ঘটনা আমাদের জীবনে আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি, হয়তো আর ঘটবেও না। এর ইতিহাস লেখা দরকার, নিজেদের জানার ও বোঝার জন্য এবং অগ্রগতির পথে পাথেয় সংগ্রহের জন্যও।

মুক্তিযুদ্ধে ভুক্তভোগী, ত্যাগী একজন নন, অনেকজন।

তাঁরা অসাধারণ কেউ নন, সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তাঁদের যে অভিজ্ঞতা, তা ছিল মর্মান্তিক। এ নিয়ে তাঁরা বড়াই করেননি। করুণা আকর্ষণের চেষ্টা করেননি, বেদনার সঙ্গে সেই অতিদুঃসহ দিনগুলোকে স্মরণ করেছেন, যেগুলো তাঁরা ভুলতে পারলে খুশি হতেন, কিন্তু সেগুলো এমনই গভীরভাবে স্মৃতিতে প্রোথিত যে ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
তাঁরা দেখেছেন, জেনেছেন, বুঝেছেন এবং সহ্য করেছেন। তাঁদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতিকথনে অনাড়ম্বর নেই, অতিকথন নেই, আভরণ নেই, বক্তব্য একেবারে সাদামাটা এবং সে জন্যই সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য।

পাকিস্তানি হানাদাররা যা করেছে, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু সেটি ঘটেছে।

বাস্তবতা ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার ধারণক্ষমতাকে। হানাদারদের বংশধররাও কল্পনা করতে পারবে না তাদের পরমাত্মীয় নরাধমরা কী করেছে। তারা বিস্মিত হবে কেবল বর্বরতা দেখে নয়, মূর্খতা দেখেও। ওই মূর্খরা কী করে ভাবল যে হাজার মাইলের ব্যবধান থেকে উড়ে গিয়ে একটি জনগোষ্ঠীকে তারা অধীনে রাখবে, যাদের সংখ্যা তাদের তুলনায় বেশি এবং দুই অঞ্চলের মাঝখানে শত্রুভাবাপন্ন একটি বিশাল রাষ্ট্র বিদ্যমান। বংশধরদের লজ্জা পাওয়ার কথা।
মূর্খ বর্বররা ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন ও হতাশাগ্রস্ত। তারা কেবল মারবেই ভেবেছিল, কিন্তু যখন দেখল মার খাচ্ছে, তখন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ করেছে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সম্ভব অসম্ভব সব কিছু করেছে। সর্বাধিক বর্বরতা ঘটেছে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে। অন্য কিছুর বিবরণ না দিয়ে কেবল যদি ধর্ষণের কাহিনিগুলো স্মরণ করা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে কেমন অধঃপতিত ছিল এই দুর্বৃত্তরা। মার খাওয়া হানাদাররা ধর্ষণকে তাদের বিনোদন ও প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণের সবচেয়ে সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। জবাবদিহির দায় ছিল না। পালের গোদা শার্দূলবেশী মেষ জেনারেল নিয়াজী থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি হানাদারই ছিল একেকটি ধর্ষণলোলুপ নারকীয় কীট। জবাব দেওয়া দূরের কথা, তারা পরস্পরকে উৎসাহিত করেছে ওই কাজে।

একাত্তরকে ভুলি কী করেযুদ্ধের দিনগুলোতে মেয়েরাই ছিল সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। তাদের দুর্ভোগই ছিল সর্বাধিক। একে তারা বাঙালি, তদুপরি নারী। পুরুষদের অনেকে পালিয়ে যেতে পেরেছে। প্রাণভয়ে তারা মেয়েদের ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যারা যুদ্ধে গেছে, তাদের বাড়ির মেয়েরা বিপদে পড়েছে, অন্তঃসত্ত্বারা সন্তান প্রসব করেছে বনে-জঙ্গলে। কারণ মেয়েদের পক্ষে পলায়ন ছিল দুঃসাধ্য। দেহের গঠন, জামাকাপড় ও নারীত্ব সবই ছিল তাদের বিপক্ষে। সর্বোপরি হানাদাররা ওত পেতে থাকত তাদের অপহরণের জন্য। পুরুষদের তবু কখনো ছেড়ে দিয়েছে, মেয়েদের ছাড় দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। মেয়েরা কেউ কেউ ছিল অন্তঃসত্ত্বা, সে অবস্থায়ই তারা ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণের পর তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে আত্মহত্যা করেছে, কেউ কেউ কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। লজ্জায় অনেকে স্বীকার করেনি যে তাদের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মেয়েদের এই যন্ত্রণার কথা আসবেই। এসেছেও। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সর্বাধিক মর্মন্তুদ কাহিনিটি পাওয়া গেছে বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগমের জবানিতে। তাঁর ওপর যে নির্যাতন ঘটেছে, সেটি আমাদের সবার জন্য লজ্জার। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে আখক্ষেত থেকে উদ্ধার করে আনা হয়। তাঁর স্বামী জমিজিরাত বিক্রি করে তাঁর চিকিৎসা করেন। মমতাজ বেগমকে বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। নির্যাতিত মেয়েদের ওই উপাধি যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁরা জানতেন না যে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো মলিন হওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে তাদের ওই পুরুষমন্য সম্মানপ্রদর্শন অসহায় মেয়েদের জন্য দুঃসহ বোঝায় পরিণত হবে। মমতাজ বেগম তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। কারণ তাঁর যন্ত্রণাগুলো ছিল অসম্মানের চেয়েও কঠিন। তাঁর দুটি মেয়ে। মেয়েদের তিনি ভালো বিয়ে দিতে পারেননি। বলেছেন, বীরাঙ্গনার মেয়েকে কে বিয়ে করতে চায়? তাঁর শারীরিক ক্ষত সারেনি। তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। বলেছেন, দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে এই নির্মম কষ্ট ভোগ করে আসছি এবং বীরাঙ্গনা নাম নিয়ে জীবনের শেষ দিনটির প্রহর গুনছি। এটিই তো প্রাপ্তি; তাঁর এবং তাঁদের মতো অসংখ্য নারীর, যাঁরা তাঁদের কথা বলতে পারেন না লোকলজ্জায়।

সব কাহিনিতেই একটি ধ্বনি আছে, সেটি আর্তনাদের। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা নানা বিশেষণে ভূষিত করে থাকি। বলি, এই যুদ্ধ ছিল মহান। তা ছিল বৈকি। অত্যন্ত বড়মাপের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সাহস ও উদ্ভাবনশক্তির প্রকাশ ঘটেছে যুদ্ধে। সেসবের পরিচয় নিশ্চয় রয়েছে। তবে আর্তনাদ ছিল মস্ত বড় সত্য। প্রাণভয়ে মানুষ পালিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, আপনজন, বিষয়-সম্পত্তি, সব কিছু ফেলে পালাতে বাধ্য হয়েছে। তবে আর্তনাদের পাশাপাশি নীরব একটি ধিক্কার ধ্বনিও রয়েছে। ধিক্কার কেবল পাকিস্তানিদের নয়, ধিক্কার আমাদের নিজেদেরও। ওরা ছিল অল্প কিছু দস্যু, লাখখানেক হবে সব মিলিয়ে, আমরা ছিলাম সাড়ে সাত কোটি। আমরা কেন এভাবে মার খেলাম ওদের হাতে? হ্যাঁ, ওরা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। কিন্তু সুসজ্জিত হওয়ার সুযোগ তো আমরাই করে দিয়েছি। ওদের হাতে বোমারু বিমান পর্যন্ত ছিল, কিন্তু বিমানগুলো তো ছিল আমাদের ভূমিতে, সেগুলোকে বিকল করে দেওয়ার সুযোগ তো আমাদের ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মরক্ষা; আমরা আক্রমণ করতে পারিনি। আমাদের দিক থেকে কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছিল না। যোগাযোগ ছিল না পারস্পরিক। জনমত সৃষ্টি করা হয়নি আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে। যুদ্ধের প্রস্তুতি যুদ্ধে যাওয়ার আগে নয়, পরে নেওয়া হয়েছে। পলিটিক্যাল মটিভেশন তৈরির দায়িত্বে ছিলেন বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, তাঁরা ওই দায়িত্ব আগে পাননি, পেয়েছেন যখন শত্রু তাদের গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে, তারপর। গণহত্যা যে শুরু হয়েছে, সে খবরটি পর্যন্ত পাওয়া গেছে বিদেশি রেডিও থেকে এবং তার প্রকোপ টের পাওয়া গেছে হানাদাররা যখন একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন। এসব কথা প্রায় সবাই স্মরণ করে থাকেন। বস্তুত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো প্রস্তুতিহীন, অসংগঠিত এবং রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি আধুনিক ইতিহাসে কমই পাওয়া যাবে।

লজ্জা আমাদেরই। কিন্তু সে লজ্জা ব্যক্তির নয়, সমষ্টির এবং সমষ্টি যেহেতু চলে নেতৃত্বের পরিচালনায়, লজ্জাটি তাই শেষ বিচারে নেতৃত্বের। একাত্তরে নীরব ধিক্কার ধ্বনিটি ছিল আসলে ওই নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই। প্রধান নেতাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাকিস্তানে, অন্য নেতারা চলে গেছেন ভারতে। অনেকেই যুদ্ধ করতে যাননি, গেছেন আশ্রয়ের খোঁজে। এবং সবাইকে নির্ভর করতে হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। শুরুতে আন্দোলন ছিল স্বায়ত্তশাসনের জন্য, পরে দাবি উঠেছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের; তার পরে স্বাধীনতার। এই রূপান্তর নেতৃত্বের পরিকল্পনায় ঘটেনি, ঘটেছে ঘটনাপ্রবাহে। ওই প্রবাহে দুটি বিপরীত স্রোত ছিল। একটি হলো ক্ষমতা হস্তান্তরে পাঞ্জাবি সেনাপতিদের অসম্মতি, অপরটি হলো আপসের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গবাসীর অনড় অবস্থান। দুই স্রোতের সংঘাতে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছিল, যার ভুক্তভোগী হয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকেকোনো না কোনোভাবে। কেউই নিরাপদে ছিল না। মীরজাফররা ছিল, ভালোভাবেই ছিল, কিন্তু তারাও যে নিশ্চিত ছিল, তা নয়।

ব্যর্থতা নেতৃত্বেরই। যদি কর্তব্য ও প্রস্তুতির নির্দেশ পাওয়া যেত, তাহলে যুদ্ধের প্রকৃতিটা দাঁড়াত সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। শুরুতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত। কারণ হানাদাররা ক্যান্টনমেন্টগুলোতে আটকা পড়ে যেত। তারা ভাতে মরত, পানিতে মরত, মরত অস্ত্রাঘাতেও। কেন্দ্রীয় নির্দেশ ছাড়াও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহ ঘটেছে। ঘটেছে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে এবং প্রস্তুতিহীন অবস্থায়ই প্রাথমিকভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাঙালি সেনারা অবাঙালিদের কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। সংঘবদ্ধ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সেটি ঘটলে হানাদারদের পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যেত।

ঐতিহাসিক সত্যগুলো ক্রমাগত উন্মোচিত হচ্ছে। সে উন্মোচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের জন্য তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইতিহাস তো কেবল ঘটনা নয়, ঘটনা কেন ঘটল, ঘটনার কী তাৎপর্যএসবও ইতিহাস খোঁজ করে। ওই ব্যাখ্যা ছাড়া ইতিহাস নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আমাদেরও ওই ব্যাখ্যার খোঁজ করতে হবে। এবং যুদ্ধের ভেতরকার মানুষগুলোর আর্তনাদ আমাদের সবার আর্তনাদেরই অংশ, ধিক্কারও আমাদের সবারই। আর্তনাদ শোনাই কিন্তু যথেষ্ট নয়, সঙ্গে ধিক্কারও শোনা চাই।

সমষ্টিগতভাবে আমাদের বড় ব্যর্থতার একটি হলো পাকিস্তানি হানাদারদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারা। তাদের স্থানীয় দোসরদের কয়েকজনের বিচার হয়েছে, কিন্তু হানাদার পাকিস্তানিদের বিচারও অত্যাবশ্যক। তাদের ভেতর যে ১৯৫ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এ ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা সেই নেতৃত্বেরই। দুর্ভোগ যা পোহাতে হয়েছে, সেটি জনগণকেই, নেতারা মোটামুটি নিরাপদেই ছিলেন। বিচারের দাবি ভুক্তভোগী জনগণের, কিন্তু ইতিহাস দাবি করছে যে পাকিস্তানি অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো চাই। সেই সঙ্গে যুদ্ধে কার কি ভূমিকা ছিল, তারও মূল্যায়ন ইতিহাসই করে দেবে।

 

 লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ