<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা-ই পরবর্তীকালে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের প্রতি রয়েছে দেশের সব স্তরের মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনাকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলো সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কিন্তু পিএসসিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের অগোচরে জন-আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতে আমলাতন্ত্রের উপসচিব (ডিএস) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যকর একটি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগের জন্য একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) নামের একটি বোর্ডকে। এই বোর্ড ভয়ংকর বৈষম্যমূলক এক কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে। বর্তমানে উপসচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ পদ কেবল প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশে মোট ২৬টি ক্যাডার আছে। বাকি ২৫টি ক্যাডার থেকে মাত্র ২৫ শতাংশ পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকে। উপসচিব-পরবর্তী পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এই বোর্ডের স্বেচ্ছাচারিতা নজিরবিহীন। বিভিন্ন স্বশাসিত সংস্থার সার্বক্ষণিক প্রধান পদে এবং পরিচালনা পরিষদের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাদের রয়েছে বৈষম্যমূলক একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি। এই নিবর্তনমূলক কোটা পদ্ধতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং সামগ্রিক আমলাতন্ত্রে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উপসচিব পদে বিদ্যমান এই কোটা পদ্ধতি কেবল অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্যই নয়, তা বর্তমান সরকারের মূলনীতি এবং চেতনার পরিপন্থীও। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উপসচিব পদে কোটা ভিত্তিক এই নিয়োগপ্রথার কুফল অনেক। একটি ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। ফলে জনগণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের একচ্ছত্র আধিপত্য ও দখলদারির ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। আন্ত ক্যাডার সম্প্রীতির পরিবর্তে আন্ত ক্যাডার বিভাজন তৈরি হয়েছে। অন্য ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে। একটি ক্যাডারের সদস্যদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়োগলাভের মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ থাকায় স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও দুর্নীতি, দলীয়করণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দেশে একটি ভারসাম্যহীন গণবিরোধী আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়। প্রায় প্রতিটি কমিশনই এই অন্যায় প্রথা বিলুপ্তির সুপারিশ করে। যেমন এ টি এম শামসুল হকের নেতৃত্বে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ডিএস নিয়োগে কোটা প্রথা বিলুপ্তির সুপারিশ করে। তারা বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক পরিচালিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে উপসচিব পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। তারা বলে, সব ক্যাডারের সিনিয়র স্কেলভুক্ত এবং ন্যূনতম আট বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা এই পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার যোগ্য হবেন। তারা মনে করে, এর ফলে সচিবালয়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নিশ্চিত হবে এবং প্রতিভাবান কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। শামসুল হক কমিশন সচিব পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ডিএস পর্যায়ে ১০ শতাংশ পার্শ্বপ্রবেশের ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করে। এই কমিটি ২০০০ সালে তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে প্রদান করে। এর আগে ১৯৭৭ সালে গঠিত পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশনের প্রতিবেদনেও মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই নিয়োগের জন্য একটি সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠনের সুপারিশ করা হয়। এই পুল গঠনের লক্ষ্য ছিল সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং এক শ্রেণির ওপর অন্য শ্রেণির প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি শ্রেণিহীন আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কেবল প্রশাসন ক্যাডারের প্রবল বিরোধিতার কারণে কমিশনগুলোর এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এখন সময় এসেছে এই অন্যায় প্রথা বিলুপ্ত করার। এই লক্ষ্যে অতি দ্রুত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বাতিল করা দরকার। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের পরিবর্তে পিএসসির মাধ্যমে উপসচিব এবং তদূর্ধ্ব পর্যায়ের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। পিএসসি সব ক্যাডারের সদস্যদের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এই নিয়োগের ব্যবস্থা করবে। বর্তমান পদ্ধতিতে কেউ একবার সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ হারালে পরবর্তী সময়ে তার আর রাষ্ট্রকে সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ডিএস এবং তদূর্ধ্ব পর্যায়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রবেশের (ল্যাটারাল এন্ট্রির) সুযোগ রাখতে হবে। মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে মেধাবী ও যোগ্যরা সুযোগ পাবে, রাষ্ট্রের কাজে ছন্দ ও গতিশীলতা ফিরে আসবে; আন্ত ক্যাডার বৈষম্যের পরিবর্তে আন্ত ক্যাডার সম্প্রীতি ফিরে আসবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত হওয়া বর্তমান সরকার বৈষম্যমূলক এই অগণতান্ত্রিক এসএসবি বাতিল করবে এবং মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব নিয়োগের ব্যবস্থা চালু করবে, এমনটাই প্রত্যাশা। </span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : শিক্ষক</span></span></span></span></p>