আমরা যারা অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছি, তারা ভালো করেই জানি যে অর্থনীতির কোনো তত্ত্ব তখনই কাজ করে, যখন অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। এ কারণেই অর্থনীতির যেকোনো সূত্র লেখার আগে একটি কথা প্রথমেই উল্লেখ করা হয় তা হচ্ছে, ‘অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে (ceteris paribus, meaning other things will ermain unchanged) ।’ এমনকি যেসব দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা বিদ্যমান; যেমন—কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ, সেখানেও এই নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় সম্ভব হয় না। এ কারণেই সেসব দেশে একাধিক মূল্যস্ফীতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; যেমন—মৌলিক মূল্যস্ফীতি যেখানে অতি মূল্য পরিবর্তনশীল পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় না; অমৌলিক মূল্যস্ফীতি, যেখানে সব রকম পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং গড় মূল্যস্ফীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মৌলিক মূল্যস্ফীতিই বিবেচনা করে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে আমাদের দেশে না আছে মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, না আছে বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা। সর্বক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এর ওপর এখন তো বিরাজ করছে একেবারেই অস্বাভবিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ রকম অবস্থায় উচ্চ সুদহার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি মোটেই সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। মাঝখান থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দুই ধরনের উপাদানের প্রভাব। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক উপাদান; যেমন—মুদ্রা সরবরাহ, চাহিদা, জোগান। আরেকটি হচ্ছে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান; যেমন—বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা, আধুনিক গুদামজাত ব্যবস্থার অভাব, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, অনিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি। নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদানের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই করার সুযোগ থাকে না। এ কারণেই দেখা যায়, যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান খুবই কম; যেমন—আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, সেসব দেশে নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি অনেকটা সহজ হয়। পক্ষান্তরে যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান অনেক বেশি; যেমন—বাংলাদেশ, সেসব দেশে শুধু নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ খুবই কম। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে।
উচ্চ সুদহারের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে উচ্চ সুদহারের নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। কেননা এখানে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সংগ্রহের একমাত্র উৎস হচ্ছে ব্যাংকঋণ। উচ্চ সুদহার বহাল থাকলে ব্যাংক যেমন নতুন ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না, তেমনি উদ্যোক্তারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না। কেননা উচ্চ সুদহারের সময় ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিং করতে না পারার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯৮০-এর দশকে অসংখ্য ঋণগ্রহীতা ব্যাপকহারে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ঋণখেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই দেশে ঋণখেলাপি সংস্কৃতির শুরু। সেই সময়ের অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের জন্য দেশের ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করা হয়। এটিই স্বাভাবিক। কেননা ঋণ নিলে, সেই ঋণ পরিশোধের সব ধরনের দায়দায়িত্ব ঋণগ্রহীতার ওপরই বর্তায়, তাতে বাস্তব অবস্থা যেমনই হোক না কেন।
বাস্তবতা হচ্ছে সে সময়ের পর্যাপ্ত ঋণখেলাপির পেছনের আসল কারণ কখনোই অনুসন্ধান করা হয়নি এবং এ নিয়ে কোনো কথাও বলা হয় না। অথচ সে সময়ের মাত্রাতিরিক্ত ঋণপখেলাপির পেছনে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত সুদের হার, যা তখন ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। এই উচ্চ সুদহারে এক কোটি ঋণ নিয়ে থাকলে চার বছরে তা সুদে-আসলে বেড়ে দুই কোটি টাকা হয়েছিল। কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে চার বছরের মধ্যে ব্যবসা করে গৃহীত এক কোটি টাকা ঋণ সুদে-আসলে দুই কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বেড়ে গেছে। এখনো যদি সুদের হার হ্রাস না করে উচ্চ সুদহার বহাল রাখা হয়, তাহলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অর্থাত্ দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা এরই মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায়ই আছে।
এ কারণেই শুধু অর্থনীতির নিয়মের মধ্যে বা আইএমএফের সুপারিশের মধ্যে আটকে না থেকে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে এবং সেসব দৃষ্টান্ত অসংখ্য আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের সে রকম একটি দৃষ্টান্ত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি। কানাডায় ব্যাংক অব কানাডা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) আগে বেশ কয়েকবার নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে এবং এখন কোনো অবস্থায়ই এই সুদের হার আরো কমানোর অবস্থানে নেই। কেননা মূল্যস্ফীতি এখনো সেভাবে হ্রাস পায়নি। তদুপুরি কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করলে কানাডিয়ান ডলারের আরো অবমূল্যায়ন হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব একটা ভালো হবে না। এর পরও ব্যাংক অব কানাডা পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করে ২.৭৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে জনগণের, বিশেষ করে ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা। কেননা এখানকার অর্থনীতি হচ্ছে ঋণনির্ভর। ফলে ঋণের ওপর উচ্চ সুদহারের কারণে কানাডার মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। এ কারণেই সরকার ডলারের অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিয়ে এবং বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা উপেক্ষা করে নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে।
বাস্তবতা যখন দাবি করে, তখন বইয়ের সূত্র বা আইএমএফের সুপারিশের বাইরে গিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে, তাই আমাদের দেশকেও নিতে হবে। আগে ব্যবসায় গতি আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হবে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর এগুলো নিশ্চিত করতে হলে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে, যার মধ্যে সুদের হার হ্রাস করা অন্যতম এবং সবার আগে এটি করা প্রয়োজন। আশা করব, অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
nironjankumar_roy@yahoo.com