গত ১৬ ও ১৭ মার্চ রাতে দুই টিমে বিভক্ত হয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে নগদ অর্থসহ বেশ কিছু জিনিস উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন মনিরুজ্জামান ওরফে মনির, সলিমুল্লাহ, মোসা. আসমাউল হুসনা, মো. হাসান, আসমত উল্লাহ, মো. হাসান, মোসা. শাহিনা ও মোসা. সেনোয়ারা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে শিশুও ছিল।
এ ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের পাঁচ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলে তাঁদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহিনুর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, পাহাড় থেকে পড়ে আরসার প্রধান ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা পেয়েছিলেন। এরপর পরিচয় গোপন করে চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছিলেন বলে আরসাপ্রধান দাবি করেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ময়মনসিংহ নগরীর ব্যস্ত এলাকা নতুনবাজার মোড়। এই মোড়ে ১৫ তলা গার্ডেন সিটি ভবনের ১০ তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন আরসার চার সদস্য। ভবনটির মালিক নরসিংদীর পলাশ এলাকার মাজহারুল ইসলাম। বাসাটি ভাড়া দিয়েছিলেন ভবনের দারোয়ান নিজাম উদ্দিন।
পুলিশ জানতে পেরেছে, চার মাস আগে নিজেদের ঈশ্বরগঞ্জের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়ে দুই ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নিতে চান। এ সময় তাঁদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা নানা কৌশলে এড়িয়ে যান। পরে মনিরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেন। এটিতে বাড়ি উচাখিলা ইউনিয়নের চর আলগী লেখা, বাবার নাম মো. আতিকুল ইসলাম। ভবনটির ১১ তলার বাসিন্দা আনিসুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ওই ফ্ল্যাটে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না।
নতুন চাকরির কথা বলে বাড়ি ছাড়েন মনির : গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি মনির। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের প্রত্যন্ত চরাঞ্চল উচাখিলা ইউনিয়নের চর আলগী গ্রামে।
এ ঘটনা জেনে গতকাল দুপুরে সরেজমিনে ওই গ্রামে গেলে দেখা যায়, মনিরের বাড়িতে সুনসান নীরবতা। তবে বাড়িতে আছেন মা-বাবা ও কয়েকজন ভাই-বোন। পরিবারের লোকজন জানায়, চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় মনির। বাবা আতিকুল ইসলাম একই উপজেলার কোনাপাড়া গ্রামে একটি কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। কওমি মাদরাসা থেকে ২০১৬ সালে হেফজ শেষ করে মাওলানা হতে মনির নরসিংদীর একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। পরে ঢাকায় একটি মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। গাজীপুরের টঙ্গীতেও মাদরাসায় চাকরি করতেন।
মা চম্পা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে মনির সরল প্রকৃতির। না বুঝে হয়তো এ কাজ করেছে সে। হয়তো সে সঙ্গীদের ফাঁদে পড়ে এমন কাজে জড়িয়েছে। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না।’
তিনি জানান, প্রায় চার মাস আগে বাড়িতে এসে মনির বলেন মাদরাসায় আর চাকরি করবেন না। এটা ভালো লাগে না। এখন ১৩ হাজার টাকা বেতনে নতুন একটি চাকরি পেয়েছেন। তবে কী চাকরি, তা বলেননি। ওই সময় সালাম করে দোয়া নেন মনির।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর সম্পর্কে তদন্ত চলছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে আরসা সদস্যরা মায়ানমারের জান্তা সরকারের হয়ে লড়াই করছে। যদিও আরাকান আর্মির কাছে পরাস্ত হয়ে আরসা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে গাঢাকা দিতে শুরু করেছে। এর পর থেকে তারা মূলত নতুন আশ্রয় খুঁজছে। তাদের অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করছে। তাদের নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারাও আতঙ্কিত।
র্যাব জানায়, এর আগে গত এক বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যেভাবে আরসার নাম ছড়ায় : ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে গুলি করে হত্যার তথ্য পাওয়া যায়। এরপর আরসার নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আতাউল্লাহ। এ ছাড়া আরসা কমান্ডার আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক খুন ও নানা অপরাধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
র্যাব বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যত খুন হয়েছে, তার সঙ্গে আরসার সন্ত্রাসীদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তারা মাদকের টাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রের কারবার করত বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাব-১৫-এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা (এএসপি) এ এম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, আরসার সন্ত্রাসীরা মাদকের টাকায় অস্ত্র কিনছে। এর আগে র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা সদস্যরা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দেয়। তারা মাদকের টাকায় অস্ত্র সংগ্রহ করছে। এসব অস্ত্রে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কক্সবাজারে অপহরণ, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠের ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি]