তিনি বলেন, এই শিশুদের আচরণের অস্বাভাবিকতা এবং সামাজিক মেলামেশায় অক্ষমতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাদের হয়?
ধর্ম-বর্ণ-আর্থ-সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে যেকোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চার গুণ বেশি।
লক্ষণ
১৮ থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই অটিজমের লক্ষণগুলো শিশুদের মধ্যে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে আছে—
► দুই বছর বয়সের মধ্যে অর্থপূর্ণ কথা বলতে না পারা।
► শিশু চোখে চোখ রাখে না।
► নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না।
► অন্যের সঙ্গে মিশতে, আদর নিতে বা দিতে সমস্যা হয়।
► পরিবেশ অনুযায়ী মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন না করা।
► অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মুখে মুখে কথা বলা এবং ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না।
এর পাশাপাশি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে কখনো কখনো কিছু আনুষঙ্গিক অসুবিধা থাকতে পারে। যেমন—
► খিঁচুনি
► অতিমাত্রায় চঞ্চলতা
► ঘুমের সমস্যা
► খাদ্য হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য
► বুদ্ধি বা জ্ঞানের স্বল্পতা
► দাঁত কিরমিরি দেওয়া ইত্যাদি।
অটিজম নিরূপণের জন্য চিহ্ন
শিশুর আচরণে যদি নিচের তালিকার একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই অটিজম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
► ছয় মাস বয়সের মধ্যে শিশু যদি পরিপূর্ণ হাসি না হাসে।
► ৯ মাস বয়সের মধ্যে হাসির উত্তরে হাসি বা ভাব প্রকাশ না করে।
► ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল না বলা, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা না করে।
► ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে না পারে।
► ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারে।
► ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যায়।
► বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করতে না পারে।
সম্ভাব্য কারণ
অটিজম কেন হয় সে বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা সুস্পষ্টভাবে অবগত নন। সারা বিশ্বেই এর মূল কারণ জানার জন্য গবেষণা অব্যাহত রয়েছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কিছু বিষয়ের সমন্বয়ে শিশুদের অটিজম হতে পারে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। এর মধ্যে জিনগত কারণ সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও কিছু পরিবেশগত কারণও আছে। ধারণা করা হয়, অটিজমের জন্য দায়ী ১০০টিরও বেশি জেনেটিক ত্রুটি।
পরিবেশগত কারণ বিদ্যমান থাকলে রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। যেমন—প্রতিনিয়ত রং ও সংরক্ষণের কেমিক্যালযুক্ত ফাস্ট ফুড খেলে, কিছু ওষুধের প্রভাবে বা ভারী ধাতুর সংস্পর্শেও অটিজমের প্রকোপ বাড়তে পারে। কারণ এসব শরীরে প্রবেশ করে কিছু জিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কথা বলতে শেখার সময় একাধিক ভাষার সম্মুখীন হলে, শিশুর বিকাশের উপযুক্ত সময়ে স্মার্টফোন বা ট্যাব নিয়ে খেলা করলে বা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য উপযুক্ত উদ্দীপনা না পেলেও অটিজমের লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে।
পরিসংখ্যান
অটিজম নিয়ে বাংলাদেশে তেমন পরিসংখ্যান নেই। তবে এ নিয়ে কর্মরত চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে অটিজম রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চালানো ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় শতকরা তিনজন শিশু অটিস্টিক। সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই সংখ্যাাটি কম, ৭০০ জনে একজন। গবেষণাটি পরিচালনা করেন প্রখ্যাত শিশু নিউরোলজিস্ট ও বর্তমানে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন সদস্য অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান। এক থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
সারা দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিস-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) পরিচালনা করে এক গবেষণা। এতে জানা যায়, শহরের ছেলে শিশুরা অটিজমে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৩০ মাসের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজমের হার মাত্র এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ জন।
অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে আরো কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় বেশি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে তারা। কিছু জেনেটিক সিনড্রোম, যেমন—ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গেও অটিজমের প্রকোপ বাড়ে। এ ছাড়াও স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে অটিজমের তীব্রতা—এমনও বলছে কোনো কোনো গবেষণার ফলাফল।
অটিজম নিয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অটিজম নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে যেমন বেড়েছে অটিজম নিয়ে কাজে আগ্রহীর সংখ্যা, তেমনি হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ও অন্যদের প্রশিক্ষণের ফলে এই শিশুরা আর প্রয়োজনীয় সেবা ও রোগের সঠিক নির্ণয় সেবার বাইরে থাকছে না। এ বিষয়ে কাজের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে নিউরোডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট ও অটিজম এবং এনডিডি সমস্যা বিষয়ক সেল। এর ফলে ইপনা (বিএমইউ) এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কাজ করছে বেশ কিছু সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।
ব্যবস্থাপনা
অটিজমকে নির্মূল করার ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে এর মাত্রা তথা মূল লক্ষণ কমিয়ে আনা ও এ শিশুদের জীবনযাপনের মান উন্নত করতে পারে এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে। এই রোগের সঙ্গে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, যেমন এডিএইচডি, লার্নিং ডিস-অ্যাবিলিটি, খিঁচুনির সমস্যা, হজমের সমস্যা, যা অটিজমের মাত্রাকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এসব রোগের চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজমেরও প্রকোপ অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। তাই এর চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত দলের প্রয়োজন। অটিজম ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে—
► ব্যাবহারিক শিক্ষা।
► স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি।
► পড়ালেখার জন্য বিশেষ স্কুল।
অটিজম ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে—
► ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিস-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।
► ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’, ঢাকা।
► জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।
► জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট।
► প্রয়াস, বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-এর শিশু বিকাশ কেন্দ্র।
► সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল।
► জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।
অটিস্টিক শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় বিশেষ চাহিদাকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান
শিশু নিউরোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।