<p>উম্মে খলিল ইসমাতুদ্দিন সাজারাতুদ্দুর ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের প্রথম নারী শাসক। যিনি একজন দাসী থেকে আইয়ুবীয় রাজবংশের সম্রাজ্ঞীতে পরিণত হন। তাঁর শাসনামল সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর বীরত্ব, সাহসিকতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনকল্যাণমূলক কাজ তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অম্লান করে রেখেছে। সুলতানা সাজারাতুদ্দুর ছিলেন আইয়ুবীয় শাসক মালিক সালিহ আইয়ুবের স্ত্রী এবং শাহজাদা খলিলের মা। সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধে স্বামী মালিক সালিহ মারা গেলে তিনি দেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২ মে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিসরের সম্রাজ্ঞী মনোনীত হন।</p> <p>সুলতানা সাজারাতুদ্দুর ছিলেন তুর্কি বা আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সুন্দরী, ধার্মিক ও বুদ্ধিমান নারী। মালিক সালিহ সুলতান হওয়ার আগেই তাঁকে একজন ক্রীতদাসী হিসেবে ক্রয় করেছিলেন। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুলতান হন এবং সাজারাতুদ্দুরের গর্ভে শাহজাদা মালিক মানসুর খলিলের জন্ম হয়। এর কিছুদিন পর সুলতান তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। এপ্রিল ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে মালিক সালিহ আইয়ুব সিরিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।</p> <p>ফলে তিনি মিসরে ফিরে আসেন এবং তিনি দামিয়েত্তা শহরের নিকটবর্তী আশমুম তানাহতে অবস্থান নেন। কেননা তিনি জানতে পেরেছিলেন ফ্রান্সের রাজা নবম লুইস সাইপ্রাসে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং তিনি মিসরে আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন। জুনে ক্রুসেডার বাহিনী দামিয়েত্তা শহরে অবতরণ করে। অন্যদিকে মালিক সালিহ সুরক্ষিত আল-মানসুরাহ শহরে অবস্থান করে ক্রুসেডার বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। ২২ নভেম্বর ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।</p> <p>সাজারাতুদ্দুর সভাসদদের সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ গোপন রাখার নির্দেশ দেন। কেননা তিনি ভেবেছিলেন, শত্রু আক্রান্ত দেশে সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সুলতানের লাশ অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে রুদাহ দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সুলতানের ছেলে আল মুয়াজ্জাম তুরানশাহকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে পরবর্তী সুলতান হিসেবে মনোনীত করেন। নিহত সুলতানের হাতের লেখা নকল করে রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি রাখেন। কিন্তু সুলতানের মৃত্যু খবর ক্রুসেডার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। ফলে তারা আশমুম খাল পার হয়ে মিসরের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ করে। সাজারাতুদ্দুর মানসুরায়ই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন এবং টোপ ফেলে আগ্রাসী বাহিনীকে শহরের ভেতরে নিয়ে আসেন। অতঃপর মিসরীয় বাহিনী ও শহরবাসী একযোগে আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করে। যুদ্ধে নবম লুইস আটক হন। তুরানশাহ মিসরে এলে সুলতানের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়।</p> <p>ক্ষমতায় বসে তুরানশাহ অনুভব করেন সাজারাতুদ্দুরের ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পথে বাধা। এ ছাড়া প্রভাবশালী মামলুক ও প্রাসাদের রক্ষী বাহিনীর ওপর তাঁর কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে তিনি প্রশাসনে নিজের পছন্দের লোক বসাতে শুরু করেন এবং জেরুজালেম সফররত সাজারাতুদ্দুরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তিনি যেন তাঁর পিতার সম্পদ ও অলংকারগুলো তাঁকে ফেরত দেন। তুরানশাহের এমন অকৃতজ্ঞ আচরণে সাজারাতুদ্দুর কষ্ট পান। তিনি তাঁর অনুগত মামলুক ও রক্ষী বাহিনীকে বিষয়টি জানালে তারাও ক্ষুব্ধ হয়। একদিন তুরানশাহ মদ্যপ অবস্থায় দাসীদের অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করছিলেন। তখন বাইবার্স ও মামলুক সেনাদের হাতে নিহত হন।</p> <p>তুরানশাহ নিহত হওয়ার পর সভাসদ, প্রশাসক ও মামলুকরা মিলে সাজারাতুদ্দুরকে সম্রাজ্ঞী এবং ইজ্জুদ্দিন আইবেককে সেনাপ্রধান মনোনীত করেন। তাঁর রাজকীয় নাম নির্ধারণ করা হয় ‘মালিকা ইসমাতুদ্দিন উম্মে খলিল সাজারাতুদ্দুর’। তিনি মুসলিম ইতিহাসের প্রথম নারী, যাঁর নামে জুমার দিন খুতবা পাঠ করা হতো এবং যাঁর মুদ্রা জারি করা হয়েছিল। সাজারাতুদ্দুর ক্ষমতায় আরোহণের পর রাজা নবম লুইয়ের সঙ্গে সমঝোতা করেন। ফলে লুই ও তাঁর ১২ হাজার যুদ্ধবন্দি মুক্তিপণ ও দামিয়েত্তাসহ দখলকৃত অঞ্চল অর্পণের বিনিময়ে মুক্তি লাভ করে।</p> <p>রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সাজারাতুদ্দুর সেনাপতি ইজ্জুদ্দিন আইবেক বিয়ে করেন। তাঁরা যৌথভাবে সাত বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। কিন্তু ইজ্জুদ্দিন একসময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন। এতে আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং ইজ্জুদ্দিন নিহত হন। এর জেরে ২৮ এপ্রিল ১২৫৭ সাজারাতুদ্দুরও নিহত হন। তাঁকে তুলুন মসজিদের কাছে দাফন করা হয়। সাজারাতুদ্দুর তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে জনকল্যাণমূলক বহু কাজ করেছেন। অসংখ্য মাদরাসা, মসজিদ, পানির কূপ ও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেন। মাদরাসা-মসজিদের সঙ্গে কবরস্থান নির্মাণ করা ছিল তাঁর উদ্ভাবন। এ ছাড়া তিনি ইসলামী স্থাপত্যে নতুন ধারার সূচনা করেন, যা ‘বাহরি মামলুক’ রীতি নামে পরিচিত।</p> <p><em>সূত্র : আলজাজিরা, মাআরিফ ডটকম ও উইকিপিডিয়া</em></p>