জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে সাবেক সরকার শেখ হাসিনার পতন হয়। পালিয়ে যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেইসঙ্গে পালিয়ে যায় তার সরকারের এমপি, মন্ত্রী, উপজেলা চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌর মেয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীল ও স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরাও।
যার ফলে সকল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গভর্নিং কমিটি ও ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করা হয়।
এদিকে, কুমিল্লার বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার গভর্নিং, ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে বিপাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বুড়িচং উপজেলাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৭৩টি, বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৯টি, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৫টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ৩১ টি, দাখিল মাদরাসা ১৭ টি, আলিম মাদরাসা ৮ টি, ফাজিল মাদরাসা ৫ টি, কামিল মাদরাসা ১টি, কলেজ (সহপাঠ) ৭টি।
অপরদিকে, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৫৩টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৭টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় (বালিকা) ১টি, উচ্চ বিদ্যালয় (সহশিক্ষা) ২৬টি, উচ্চ বিদ্যালয় (বালিকা) ২টি, দাখিল মাদরাসা ১৩টি, আলিম মাদরাসা ৫টি, ফাজিল মাদরাসা ৩টি, কলেজ (সহপাঠ) ৯টি।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ বেসরকারি মাধ্যমিক-১ শাখা হতে গত ২৪ আগস্ট সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পরিচালনা করার জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে কমিশনার, জেলা পর্যায়ে ডিসি, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং তাদের মনোনীত প্রতিনিধিকে সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
তারপর গত ১৮ নভেম্বর একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইয়েদ এ, জেড মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডকে অনুরোধ করা হয় কলেজ পর্যায়ে এডহক কমিটির সভাপতি স্নাতকোত্তর এবং স্কুল পর্যায়ের সভাপতি স্নাতক পাস ব্যক্তিকে সভাপতি করে এডহক কমিটি গঠন করতে এবং এই কমিটি ৬ মাসের মধ্যে নিয়মিত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
এরপর ২৪ নভেম্বর একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইয়েদ এ, জেড মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ৯ম গ্রেডে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য হতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মনোনীত ব্যক্তিকে সভাপতি করে এডহক কমিটি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর একই মন্ত্রণালয়ের একই বিভাগ থেকে উপসচিব সাইয়েদ এ, জেড মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গত ২৪ নভেম্বর জারিকৃত প্রজ্ঞাপন রহিত করে এবং গত ১৮ নভেম্বর জারিকৃত প্রজ্ঞাপন প্রতিস্থাপন করে কার্যকরের নির্দেশ প্রদান করা হয়। একই বিষয়ে একই মন্ত্রণালয় থেকে পরপর ৪টি প্রজ্ঞাপন জারি করে ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করায় কমিটি গঠন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়দের মাঝে শুরু হয়েছে সভাপতি পদ নিয়ে নিয়ে টানাটানি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন দলীয় গ্রুপিং, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের। প্রত্যেকটি গ্রুপ কিংবা রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা চাচ্ছে তাদের পছন্দ অথবা মনোনীত ব্যক্তিকে এডহক কমিটির প্রধান ও অন্যান্য সদস্যের পদে বসাতে। এতে চাপের মুখে রয়েছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সুপার, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা।
তাছাড়া উপজেলা পর্যায় থেকে কমিটির নামের তালিকা প্রেরণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ইউএনওরা।
বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশ, দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের তদবির ও লবিং এবং এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না উপজেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল ইউএনওরা।
এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আদেশে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় রেষারেষির সৃষ্টি হচ্ছে। ঝগড়া ঝাটির সূত্রপাত ঘটছে এবং এই সুযোগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। দিনদিন দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে ধাপিত হচ্ছে।
ফলে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার প্রধানরা স্কুলের নিয়মিত কাজ বাদ দিয়ে এডহক কমিটি নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে আবার কখনো সামাজিক পরিবেশে মিটিং সেটিং নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও লাঞ্চিতের শিকার হচ্ছেন প্রধানরা। তাছাড়া হুমকি ধামকি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুড়িচংয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দল ও গ্রুপের লোকজনও নিয়মিত আনাগোনা এবং তদবির, লবিং,সুপারিশসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চাপের মুখে রাখছেন ইউএনও এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের। প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন নিয়মিত অন্তর্যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যার ফলে জয় পরাজয় ইস্যু এবং কারো কারো ক্ষেত্রে ইগোতে লাগার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল, গ্রুপ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক বলেন, এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গরা এডহক কমিটির বিষয় নিয়ে একে অপরের কুৎসা রটাচ্ছে। অন্যদিকে আমাকেও বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এই কমিটি নিয়ে মহাবিপদের মধ্যে আছি।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ইউএনও) সাহিদা আক্তার কলের কণ্ঠকে বলেন, এডহক কমিটির বিষয়ে আমি অনেক তদবির ও সুপারিশ পাচ্ছি। তারপরেও আমি চেষ্টা করছি, যাচাইবাছাই করে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করতে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা অফিসার (ইউএনও) মাহমুদা জাহান কালের কণ্ঠকে জানান, আমি নতুন যোগদান করেছি। শুনেছি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এডহক কমিটি হয়ে গেছে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক ও অন্যান্য নেতারা আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে।