তেমনি কুয়েতে সংসদ সদস্য পাপুলের গ্রেপ্তারে বিব্রত সরকার, বিব্রত সংসদ সদস্যরা, সমালোচনা সংসদে। কারণ অভিযোগ গুরুতর, মানবপাচার-মুদ্রাপাচার। এর আগে আমরা পাচারের বহুবিচিত্র ঘটনা নিয়ে লিখেছি, লিখতে গিয়ে অবাক হয়েছি ভেবে যে এতসব ভয়ংকর পাচার ঘটনা দিনের পর দিন ঘটছে কিভাবে? কোথায় আমাদের দক্ষ অনুসন্ধানী গোয়েন্দা বিভাগ?
ঘটনাগুলোর বিশদ বিবরণে গেলে সে এক অনৈতিক ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে, যা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠতে পারে। যেসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিত বিচার করতে গেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ শিরোনামের সঙ্গে একমত না হয়ে পারা যাবে না।
পাপিয়ার অনৈতিক পাঁচতারাকাণ্ডের এক খবরে প্রকাশ, সেখানে রমণীয় জলসায় এক ডজন রুশ তরুণীও নাকি আমদানি করা হয়েছিল। তাই নিয়ে বর্তমান রুশ পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে ভালো রকম ধোলাই দিয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় (এপ্রিল-জুন ২০২০)।
বাংলাদেশি সমাজে অনৈতিকতা ও আর্থ-সামাজিক দুর্নীতির শেষ নেই এবং তা নানা মাত্রায়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস এসে দ্বিমুখী কাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রথমত, করোনা উপলক্ষে নতুন করে দুর্নীতির বহুমুখী প্রকাশ, যার বিশাল অংশ স্বাস্থ্য খাত ঘিরে এবং তা নিয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে দিনের পর দিন খবর প্রকাশ ও নিবন্ধাদি লেখালেখি।
আমরা এর আগে পাপিয়া, পাপুল ইত্যাদি একাধিক কাণ্ডের কথা লিখেছি। করোনার অবদানে সম্প্রতি ঘটেছে ডা. সাবরিনা-আরিফকাণ্ড, যা নিয়ে কয়েক দিন ধরে পত্রিকাগুলোতে কী পরিমাণ লেখালেখি এবং পাঠককুলের স্বাদু ভূরিভোজ। কিন্তু ঘটনা তো আজকের নয়। ওই যে বলছিলাম, করোনার দ্বিতীয় সফলতা-পূর্ব দুর্নীতির সাতকাহন ফাঁস, যা এত দিন ধামাচাপা ছিল। সন্দেহ নেই ঘটনাগুলো চাঞ্চল্যকর। এত দিন যারা নিশ্চুপ ছিল, দুর্বোধ্য কারণে এখন তাদেরই অভিযানে সেই সব সামাজিক ক্ষত উদ্ঘাটিত হচ্ছে।
দুই.
এখন কয়েক দিন ধরে দৈনিক থেকে দৈনিকে সাবরিনা-আরিফকাণ্ড নিয়ে লেখালেখি। উদ্ঘাটিত হবে তাদের দুর্নীতির নানামাত্রিক কীর্তিকলাপ। গ্রেপ্তার হয়ে এরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে করোনা সনদ জালিয়াতির অভিযোগে তার রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালাবদ্ধ করা উপলক্ষে ক্রমান্বয়ে উদ্ঘাটিত সাহেদনামা।
রিজেন্ট হাসপাতালের দ্বিতীয় সারির কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হলেও এত দিন অধরা মূল গায়েন সাহেদ এখন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার, তাও বেশ নাটকীয় প্রেক্ষাপটে, বোরকা পরে সীমান্ত অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা সীমান্তে। এ ঘটনার তাৎপর্য হলো, আমাদের নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী প্রয়োজনে ঠিকই লক্ষ্যভেদে সক্ষম।
গত কয়েক দিনে এই সাহেদকে নিয়ে কত নাটক, কত ঘটনার প্রকাশ ফেসবুক থেকে টিভি ও সংবাদপত্রে। দিনকয় আগে ফেসবুকের খবর : সাহেদের বক্তব্য ‘আমি চার্টার প্লেনে বিদেশে পাড়ি জমালে কার সাধ্য আমাকে ধরে।’ প্রতারণা ও নাটক সৃষ্টিতে সিদ্ধ সাহেদ আত্মগোপনে থেকে চেষ্টা করেছে আইনি সংস্থার নজর ভিন্ন দিকে ফেরাতে।
এ পর্যন্ত উদ্ঘাটিত খবরদারিতে দেখা গেছে, এমন কোনো দুর্নীতিবাজ নেই, যার সঙ্গে সাহেদের সম্পর্ক ছিল না। পাচার, অনৈতিকতা, দুর্নীতি, রোগ-রোগী স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত সাহেদের সঙ্গে নাকি পাপিয়ারও সম্পর্ক ছিল। শুধু সিদ্ধহস্ত কথাটা তার জন্য যথেষ্ট নয়। সত্যি বলতে কী সাহেদ কুপথে চালিত একটি বিস্ময়কর প্রতিভা। সে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। লোক ভজাতে অসাধারণ পারঙ্গমতা তার।
কয়েক দিন আগে একটি দৈনিকের খবরে পড়েছিলাম : সাহেদের কুর্কীতি সত্ত্বেও কারো সাহস হতো না তার বিরুদ্ধে কিছু বলার। অনুরূপ একটি খবর এখন একটি দৈনিকে : ‘সাজা হলেও সাহেদকে জেলে যেতে হয়নি’। কারণ প্রথমত, তাকে ধরতে না পারা; দ্বিতীয়ত, তদন্ত বিভাগের গাফিলতি। ক্ষুব্ধ অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য : ‘এখন সময় এসেছে প্রসিকিউশন বিভাগকে ঢেলে সাজানোর’। অর্থাৎ একাধিকবার আমরা যা বলেছি তাই; সরষের মধ্যে ভূত।
তিন.
এবার আমরা মূল প্রশ্নটিতে যাচ্ছি : এত আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষবৃক্ষ জন্মায় ও বাড়ে কিভাবে? কেউ কেউ মহীরুহ হয়ে ওঠে কোন জাদুর খেলায়? এ প্রশ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সংবাদ শিরোনাম : ‘১৩ বছর কুকীর্তির পর অভিযানে ধরা সাহেদ’।
এ সংবাদের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য : ‘ভুয়া হাসপাতাল, ব্যাংকঋণ পেতে চাকরি দেওয়া, পণ্য সরবরাহ ও কেনার নামে জালিয়াতি, এমএলএম কম্পানি খুলে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া’ ইত্যাদি। সব শেষ কথা, তার নামে ছিল ৫৯টি মামলা। বেশির ভাগ মামলাই প্রতারণার। অর্থাৎ সাহেদ একজন ‘মাস্টার প্রতারক’।
প্রশ্ন : একজন চৌকস প্রতারক ১৩ বছর ধরে একের পর এক প্রতারণায় শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে, তার বিরুদ্ধে এত মামলা থাকার পরও তাকে হাসপাতাল খোলার অনুমতি দেওয়া হয় কিভাবে, তাও করোনা চিকিৎসা ও পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের হাসপাতাল। অন্য এক খবরে প্রকাশ—তাতে ছিল স্বাস্থ্য খাতের আশীর্বাদ।
যদি অনুমতি দেওয়াই হলো, সে ক্ষেত্রে দরকার ছিল কড়া নজরদারির। কিন্তু কোনো কিছুই করা হয়নি। আরেকটি ছোট্ট খবর : দুজন চিকিৎসক নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সতর্ক করে দিয়েছিল। তাতে কান দেওয়া হয়নি। দিনের পর দিন চলেছে জাল সনদ বিতরণ। কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো কিছুতেই কান দেয়নি বা ব্যবস্থা নেয়নি।
কেন নেয়নি? জবাব খুব সহজ ও সরল এবং সবারই বোধের আওতায়। আমি শুধু অ্যাটর্নি জেনারেলের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলব, শুধু প্রসিকিউশনই নয়, সংশ্লিষ্ট সব খাতই ঢেলে সাজানো দরকার। কারণ তাদের সবার চোখের সামনে এসব বিষবৃক্ষের জন্ম ও প্রবৃদ্ধি। পরিবর্তন সর্বত্র দরকার।
তার চেয়েও বড় একটি প্রশ্ন : এসব বিষৃবক্ষের উত্থানের সুবিধাভোগী নেপথ্য নায়ক, অনুরূপ ক্যাসিনোকাণ্ডের; তারা কি আড়ালেই থেকে যাবে? তাদের স্বরূপ উন্মোচিত না হলে অনুরূপ ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ভবিষ্যতে আরো পাপিয়া, পাপুল, সাবরিনা, সাহেদ জন্ম নেবে। তাই সময় থাকতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে সতর্ক হওয়ার ও ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই। এককথায় মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন ঢেলে সাজানো এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্বিক লাগাতার অভিযান।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী