<p>সূর্য ও মহাজাগতিক উৎস থেকে পৃথিবীর দিকে ধাবিত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিসহ অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রায় সব রশ্মির বেশির ভাগ আটকে দেয় ভূপৃষ্ঠের ওপরে থাকা ওজোনস্তর। ফলে মানুষ তথা জীবজগৎ সেই সব শক্তিশালী ও ভয়ানক ক্ষতিকর রশ্মির সরাসরি সম্পাতজনিত অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়। ওজোনস্তর আছে বলেই আমাদের ত্বক, চোখ, সামুদ্রিক জীব, গাছপালা, ফসলসহ অন্য অনেক জিনিস রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলে একসময় ওজোনস্তরে ওজোনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল।</p> <p>গত শতকের শেষের দিকে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে ওজোনস্তরে বিশাল এক গহ্বর তৈরির প্রথম দুঃসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬ মে ১৯৮৫ সালে প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল নেচার সেই দুঃসংবাদ প্রকাশ করার পর টনক নড়ে বিশ্বের সংশ্লিষ্ট মহলের। ত্বরান্বিত হয়েছিল ওজোনস্তর রক্ষার জন্য ঐতিহাসিক মন্ট্রিয়ল চুক্তি। ওজোনস্তর রক্ষার জন্য ১৯৮৭ সালে হওয়া মন্ট্রিয়ল চুক্তি (কার্যকর ১৯৮৯) ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।</p> <p>মূলত এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ তথা জীবজগতের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওজোনস্তর রক্ষার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। চুক্তির পরে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও এগিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এই চুক্তিতে কিছু সংশোধনী (লন্ডন সংশোধনী ১৯৯১, কার্যকর ১৯৯২; বেইজিং সংশোধনী ১৯৯৯, কার্যকর ২০০২; কিগালি সংশোধনী ২০১৬, কার্যকর ২০১৯) এনে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পৃথিবীতে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী পদার্থগুলোর (ওজোন ডিপ্লেটিং সাবস্ট্যান্স—ওডিএস) উৎপাদন লক্ষণীয়ভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ (২০২২) প্রতিবেদনে ক্ষয় হওয়া ওজোনস্তর পূরণ ঠিকমতোই হচ্ছে বলে বলা হয়েছে।</p> <p>মন্ট্রিয়ল চুক্তির এই সাফল্যের জন্য এ বছর আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবসের (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩) প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘মন্ট্রিয়ল প্রটোকল : ওজোনস্তর ঠিক করা ও জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসের সফল দলিল।’ আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০৬৬ সালের মধ্যে ওজোনস্তর গত শতকের আশির দশকে থাকা ওজোনস্তরের সমান পুরুত্ব লাভ করবে। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে ভবিষ্যতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, মন্ট্রিয়ল চুক্তি ও পরবর্তী সংশোধনীর সব কাজ এখনো শেষ করা সম্ভব হয়নি।</p> <p>মন্ট্রিয়ল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনীর লক্ষ্য হলো হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (এইচএফসি) উৎপাদন ও ব্যবহার কমিয়ে আনা।</p> <p>কারণ সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) ও এইচসিএফসির বিকল্প হিসেবে শীতলীকরণ (এসি) কাজে বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয় এইচএফসি। এটি ওজোনস্তরের জন্য ক্ষতিকারক না হলেও তা কার্বন ডাই-অক্সাইডের থেকে প্রায় হাজার গুণ শক্তিশালী এবং অনেক বেশি বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এইচএফসি কমাতে পারলে বিশ্বের তাপমাত্রা ০.৫ ডিসে হ্রাস পাবে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের জন্যও বিষয়টি জরুরি।</p> <p>এটা ঠিক যে বর্তমান বাস্তবতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসি ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে খাদ্য ও ভ্যাকসিন সংরক্ষণ; গবেষণাগার ও হাসপাতাল; বিশেষ ধরনের শিল্প-কলকারখানাসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাহের জন্য এখন এসি ব্যবহার করতে হচ্ছে। কাজেই কিগালি প্রস্তাব অনুযায়ী এইচএফসির বিকল্প (আইসোবিউটেন, প্রোপেন ইত্যাদি) উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ব্যবহার করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আরো নতুন নতুন বিকল্প অনুসন্ধান এবং তা কার্যকর করা।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে ওজোনস্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী একটি বিষয় নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গত ২০ এপ্রিল ২০২৩ নেচার জানাচ্ছে যে ক্ষুদ্র কৃত্রিম উপগ্রহ (কিউবস্যাট বা ন্যানোস্যাটেলাইটস) ওজোনস্তরের ক্ষতি করছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন (মার্চ ২০২৩) অনুযায়ী বর্তমানে হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ঘুরছে। এগুলো সাধারণত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা ওজোনস্তরের ওপরের দিকে অবস্থান করানো হয়। ভূপৃষ্ঠের ১০-১৫ কিলোমিটার (ট্রোপোস্ফিয়ার) ওপর থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা ওজোনস্তর বলা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম উপগ্রহ সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার আয়তনও বৃদ্ধি করে চলেছে। বর্তমানে ২৫০ গ্রাম থেকে শুরু করে দুই হাজার কিলোগ্রাম ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থান করছে।</p> <p>কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বেশির ভাগই তৈরি করা হয় অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। এগুলোর মধ্যে থাকে অসংখ্য ইলেকট্রনিক পার্টস, ব্যাটারি, কার্বনতন্তু, সিনথেটিক আঠা, বিভিন্ন ধরনের ধাতু (টাইটানিয়াম, ক্যাডমিয়াম, লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি)। এসব দ্রব্য ক্রমাগতভাবে মহাকাশে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং সেসব স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা ওজোনস্তরে নেমে আসে। গবেষকরা বলছেন যে এগুলো শেষ পর্যন্ত ওজোনস্তরের জন্য ক্ষতি ডেকে আনছে। মহাকাশে এরই মধ্যে কৃত্রিম উপগ্রহকেন্দ্রিক অনেক আবর্জনা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো কৃত্রিম উপগ্রহে ব্যবহৃত আয়োডিন ওজোনস্তরের ক্ষতি করে বলে জানা গেছে।</p> <p>কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষপণের জন্য ব্যবহৃত রকেটগুলোতে বেশির ভাগ সময় জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। এই কেরোসিন ব্ল্যাক কার্বন (অসম্পূর্ণ দহনপ্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ২.৫ মাইক্রোমিটার কিংবা তার চেয়েও কম কালো কণা) তৈরি করে। সেই ব্ল্যাক কার্বন সৌর বিকিরণ শোষণ করে এবং স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে ওজোনস্তরের ক্ষতি করে থাকে। উড়োজাহাজে ব্যবহৃত কেরোসিন থেকে ব্ল্যাক কার্বন তৈরি হলেও আকাশে তার স্থায়িত্ব কয়েক সপ্তাহের বেশি থাকে না। কিন্তু রকেট থেকে তৈরি ব্ল্যাক কার্বন বছরের পর বছর থাকতে পারে। রকেট থেকে নির্গত ব্ল্যাক কার্বন সরাসরি ওজোনস্তরে পৌঁছায়। কিন্তু উড়োজাহাজ থেকে নির্গত ব্ল্যাক কার্বন ওজোনস্তরের নিচে চলে যায়। তা ছাড়া রকেট ইঞ্জিনগুলো বিমানের তুলনায় প্রতি লিটার জ্বালানিতে অনেক বেশি মাত্রায় ব্ল্যাক কার্বন তৈরি করে। এসব ইঞ্জিন থেকে বর্তমানে বছরে এক হাজার টন ব্ল্যাক কার্বন তৈরি হচ্ছে। ২০৪০ সালে এর পরিমাণ বছরে ১০ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে বলা হচ্ছে।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকরা ওজোনস্তর ক্ষয়ের জন্য দাবানলকেও দায়ী করেছেন। নেচারে প্রকাশিত এসংক্রান্ত এক গবেষণা প্রবন্ধে (৮ মার্চ ২০২৩) বলা হয়েছে যে ঘন ঘন ও বিশাল এলাকাজুড়ে তীব্র দাবানল ওজোনস্তর পুনরুদ্ধার বিলম্বিত করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবানল থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা ওজোনস্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং সেখানে ধোঁয়ার ক্ষতিকর কণাগুলো এক বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে। গত ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় সংঘটিত দাবানলের ওপর গবেষণায় এই ফল উঠে এসেছে। কাজেই ওজোনস্তর রক্ষায় দাবানল প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, ক্যাম্পফায়ারে সতর্কতা অবলম্বন, শুকনো তৃণ থেকে যানবাহন দূরে রাখা, বাইরে ব্যবহৃত ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ, আতশবাজি নিয়ন্ত্রণ, বাইরে রান্নার সময় সতর্কতা অবলম্বন, জ্বলন্ত কোনো কিছু যেখানে-সেখানে না ফেলা, সাবধানতার সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি বিষয় মেনে চললে দাবানল সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়।</p> <p>বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে মন্ট্রিয়ল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সংশোধনীগুলোতেও (১৯৯৪, ২০০০, ২০০১, ২০১০ ও ২০২০) বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ ওজোন সেলের ওয়েবসাইটে ‘প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ২০১০ সালের মধ্যে সিএফসি, হ্যালন ও কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, ২০১৫ সালের মধ্যে মিথাইল ক্লোরোফর্ম, ২০৩০ সালের মধ্যে এইচসিএফসি এবং ২০৪০ সালের মধ্যে এইচএফসির আমদানি ও ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বহুপক্ষীয় তহবিল বাংলাদেশকে ১৭ লাখ ৫৭৪ হাজার ৫৮২ ডলার মঞ্জুর করেছে এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত মোট ১২ লাখ ৫৬০ হাজার ৫৬৮ ডলার ছাড় করেছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই সব কাজের বিস্তারিত হালনাগাদ বিবরণ বাংলাদেশের ‘ওজোন সেল’ ওয়েবসাইটের ‘প্রকল্প’ সাবমেন্যুতে নেই। তবে প্রকাশনা সাবমেন্যুতে জুন ২০২২ পর্যন্ত কিগালি সংশোধনীভিত্তিক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ও কার্যক্রমসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। প্রকল্প সাবমেন্যুতে তথ্য যুক্ত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া অন্যান্য সাবমেন্যুতেও (যেমন : ওজোন হ্রাস সম্পর্কে প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি, চলমান ও আসন্ন ঘটনাপ্রবাহ) তথ্য থাকা দরকার। ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যগুলো ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা (সঠিক এসি ব্যবহার করা, ওজোন ক্ষয়কারী প্রসাধনী ব্যবহার না করা ইত্যাদি) বৃদ্ধির জন্যও কাজ করা প্রয়োজন।</p> <p>আসলে ওজোনস্তর রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। এগুলো মোকাবেলা করার কৌশলও ভিন্ন ভিন্ন। এই কৌশলগুলোকে সমন্বিত করেই ওজোনস্তর রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।</p> <p>লেখক : উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি</p>