ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৬ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৬ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকার বায়ুদূষণ : উপেক্ষিত নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা

  • মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঞা
শেয়ার
ঢাকার বায়ুদূষণ : উপেক্ষিত নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা
ছবি : কালের কণ্ঠ

ঢাকার বাতাস দূষিত তা আমরা প্রতিদিন জানছি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান নির্ণয়কারী সংস্থা আইকিউএয়ার এর প্রতিবেদন থেকে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে— এই ডিসেম্বরের বেশ কয়েকদিন বায়ু দূষণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব পায় ঢাকা! আইকিউএয়ারের সূচক অনুযায়ী প্রায় দিনই ঢাকার বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ কিংবা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পর্যায়ে থাকছে।  আইকিউএয়ারের মতে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব ২০১-৩০০ হলে (ওব্লিউএইচও কর্তৃক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫)  তা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ এর বেশি হলে তা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে গণ্য করা হয়। এই মাত্রার বায়ু দূষণে ঘরের বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে এবং ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

কোন স্থানে বিপজ্জনক মাত্রার দূষণ টানা তিন ঘণ্টা অব্যাহত থাকলে ওই স্থানে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারিসহ শিশুদের স্কুল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনটা যে এবারই ঘটছে তা কিন্তু নয়। বছরের পর বছর ধরে এই অবস্থা চললেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। 

পিএম ২.৫ কী, কীভাবে ক্ষতি করে?

পিএম ২.৫ হলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতি সূক্ষ্ম কণা যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২.৫ মাইক্রোমিটার  (১ মাইক্রোমিটার = ০.০০১ মিলিমিটার)।

বাতাসে ভাসমান ধুলা, ধোঁয়া, রাবার, প্লাস্টিক, অন্যান্য কঠিন পদার্থ, ছাই, মাইট, পানির কণা, ফুলের রেণু ইত্যাদি যার দৈর্ঘ্য ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার কম সেগুলো পিএম ২.৫ নামে পরিচিত। এই কণাগুলো এত সূক্ষ্ম যে, খালি চোখে এদের দেখা যায় না। ওজনে হালকা বলে এগুলো বাতাসে ভেসে থেকে শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে আন্ত:মহাদেশীয় দূষণ ঘটাতে পারে। এগুলো নি:শ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে যেতে পারে।
এর ফলে এ্যাজমা, হাঁচি-কাশি, চোখ দিয়ে পানি পড়া, ফুসফুসের নানা রোগ, হৃদরোগ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। শিশু ও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী এই দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। 

ঢাকার বাতাসে এতো দূষণ কেন?

ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৩৩ হাজার মানুষ বাস করে। সাম্প্রতিককালে এই শহরের বস্তুগত সংস্কৃতির বিকাশ যে হারে হয়েছে অবস্তুগত সংস্কৃতি সে হারে বিকশিত হয়নি।

ফলে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে যে যার অবস্থানে থেকে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে।

ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান কারণ দুটি। যেমন— ধুলা ও ধোঁয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহরগুলোর একটির নাম ঢাকা। এই শহরের রাস্তা, ফুটপাত, খেলার মাঠ সারাবছরই ধুলাবালিতে ভরা থাকে। ফলে মানুষের চলাচল, খেলাধুলা, বাতাস ও যানবাহন চলাচলে ধুলা নিয়মিত বাতাসে মিশছে। ঢাকার রাস্তাঘাটে চলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ধূলি-দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া অন্যান্য নির্মাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও এ সংক্রান্ত মালামাল বিশেষ করে বালু পরিবহনের সময় ধূলি-দূষণ হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকার চারপাশে থাকা অসংখ্য ইট ভাটা, শহরে ফিটনেসবিহীন পুরনো লক্কড়-ঝক্কর গাড়ি চলাচল, যানজট, আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি কারণে ঢাকার বায়ু দূষিত হচ্ছে। 

এ ধরনের দূষণ রোধে আইন আছে, কিন্তু কেউ মানছে না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আছে, কিন্তু কেউ কাজ করছে না। কারণ দুর্নীতি। এই দেশে ঘুষ ছাড়া কোন ঠিকাদার কাজ পায় না। ঠিকাদারের কাজের মান দেখতে যারা যায় তারা ঘুষ নেয়। ঠিকাদারের কাজ যে বুঝে নেয় সে ঘুষ নেয়। ফলে বেচারা ঠিকাদার দুপয়সা লাভের আশায় কাজ ও পরিবেশ দুটোরই বারোটা বাজায়। তেমনি ইমারত নির্মাণের ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও একই কারণে কেউ তা মানছে না।

করণীয় কী?

বর্ণীত সকল ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগুলো প্রয়োগ করলেই শহরে ধুলা ও ধোঁয়া দূষণ কমে আসবে। এর বাইরে জনসচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। যানজট নিরসন করতে পারলে গাড়িগুলো অকারণে দাঁড়িয়ে থেকে অতিরিক্ত কার্বন নি:সরণ করবে না। গাড়ির ফিটনেস প্রদানে বিদ্যমান মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। ময়লা আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। 

শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সকালে কিছুক্ষণ দেখা গেলেও সারা দিন কোন খোঁজ থাকে না। প্রয়োজনের তুলনায় কম কর্মী কাজ করে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়াতে হবে। দুই শিফটে পালা করে কাজ করতে হবে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ডিউটিকালীন ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করবে। রাস্তার ধুলোবালি ও ময়লা আবর্জনা সারাদিন কালো পলিব্যাগে জমা করবে, নির্দিষ্ট সময় পরপর কর্পোরেশনের গাড়ি এসে সেগুলো তুলে নিয়ে যাবে। নিজ নিজ ওয়ার্ড পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব ওয়ার্ড কমিশনারকে নিতে হবে। এসব কাজ দৃশ্যমান হলে নাগরিকগণ প্রয়োজনে বাড়তি ট্যাক্স দিতে আপত্তি করবে না। 

নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঢাকার বাতাসের মান উন্নত করার চ্যালেঞ্জ সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্লোভ-নির্মোহ থেকে দেশ সেবায় ব্রতী হওয়ার কঠোর বয়ান পৌঁছে দিতে হবে। কেউ দুর্নীতিতে জড়ালে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ঘুস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তবেই ঢাকার মানুষ নি:শ্বাসে নির্মল বায়ু গ্রহণ করতে পারবে। 

লেখক : মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঞা, শিক্ষক ও লেখক।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া

    অদিতি করিম
শেয়ার
শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া
ফাইল ছবি

রাজনীতিতে এখন প্রতিহিংসা, আক্রমণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসহিষ্ণু প্রবণতা বেড়েছে ভীষণ। পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ যেন লোপ পেয়েছে। রাজনীতির মাঠে এখন কুৎসিত নোংরামি এবং কাদা ছোড়াছুড়ির জয়জয়কার। সহনশীলতা শব্দটি যেন আজ বিলুপ্ত।

এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা, এমনকি প্রয়াত ব্যক্তিদের অসম্মান করার একটি রীতি আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু এটি প্রকৃত রাজনীতি নয়। এটি রাজনীতির শিক্ষাও নয়। রাজনীতি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল।

রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা সমাজের আদর্শ। তাঁরা সমাজকে পথ দেখান। একটি রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশ নির্মাণ করেন। কাজেই রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দেশের জনগণ শিখবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনীতি এখন যেন প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা, ভিন্নমতকে খতম করাই যেন আজকের রাজনীতির প্রধান কৌশল। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে মতের অমিল থাকবে, বিরোধ থাকবে, কিন্তু এই বিরোধ সহিংসতার পথে পা বাড়াবে না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করা বরেণ্য রাজনীতিবিদরা এই বৈশিষ্ট্যগুলোর চর্চা করেছেন তাঁদের জীবনে। এই বৈশিষ্ট্য একজন রাজনীতিবিদকে পরিণত করে, বড় করে এবং আদর্শবান করে তোলে।

এই রাজনৈতিক শিষ্টাচারের জন্যই তাঁকে জনগণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। তাঁরা অনুকরণীয় হন। কিন্তু কিছুদিন ধরে রাজনীতিতে যেমন বিভক্তি দেখা দিচ্ছে, বিভক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিহিংসা। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নির্মমভাবে আক্রমণ, সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেওয়া এবং যেকোনো ভিন্নমত হলেই তাকে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ভাষায় দমন করা, কখনো কখনো পাশবিক শক্তি প্রয়োগের একটা হিংস্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতিতে হিংস্রতা এবং ভাষাজ্ঞানহীন কথাবার্তার প্রবণতা বাড়ছে। একজন প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদকে কী ভাষায় কথা বলতে হবে, ভিন্নমতের ব্যাপারে কী ধরনের শিষ্টাচার দেখাতে হবে, সেই বোধগুলো আমাদের রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এ রকম একটি অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম খালেদা জিয়া। তিনি রাজনীতিতে শিষ্টাচারের এক প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি যখন প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিলাভ করেন, এর পর থেকে তাঁর প্রতিটি আচরণ এ দেশের মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই তাঁর প্রাজ্ঞ উদারতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতায় মুগ্ধ। এই মুহূর্তে রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি খালেদা জিয়া। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তিনি। তাঁর পরিমিতিবোধ, ব্যবহার, আচার-আচরণ এবং সংযত কথাবার্তা এ দেশের শান্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। খালেদা জিয়া সেই বিরল রাজনীতিবিদদের একজন, যিনি জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসেছিলেন। তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে বারবার নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েও তিনি তাঁর নীতি এবং আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনা কখনো শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়নি। অশালীন নোংরামির পর্যায়ে যায়নি। তিনি কোনো সময় প্রয়াত রাজনীতিবিদদের অসম্মানসূচক, অসত্য, কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেননি, আক্রমণ করেননি। এই ধারাটি তিনি অব্যাহত রেখেছেন গোটা রাজনৈতিক জীবনে। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আদর্শ থেকে এতটুকু চ্যুত না হয়েও যে একজন রাজনীতিবিদ শিষ্টাচার মেনে চলতে পারেন, নম্র ভদ্রোচিত ভাষায় তীব্র সমালোচনা করতে পারেন, সেই নজির তিনি রেখেছেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। জনগণের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে কার্পণ্য করেননি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যক্তির চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়। সে শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়াসময় খালেদা জিয়াকে ড. ফখরুদ্দীন সরকার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর দুই পুত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চলে চরিত্র হননের চেষ্টা। এই সময় খালেদা জিয়া আপস করেননি। কারাগার থেকে বেরিয়ে যখন তিনি আবার রাজনীতিতে এসেছেন, তখন এক-এগারোর কুশীলবদের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনাটা শালীনতার সীমা কখনো অতিক্রম করেনি। বেগম জিয়া সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অশালীন শব্দ প্রয়োগ ছাড়াই বিরোধী পক্ষের কঠোর সমালোচনা করেন। এক-এগারোর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে একটি অসত্য, ভিত্তিহীন মিথ্যা মামলায় তাঁকে প্রহসনের বিচারে নজিরবিহীনভাবে আটকে রাখা হয় কারাগারে। দিনের পর দিন কারা প্রকোষ্ঠে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এই অবস্থায় তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই মনে করেছিলেন যে খালেদা জিয়া যদি কখনো সুযোগ পান, তাহলে হয়তো ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যেন তাঁর ওপর সব নিপীড়নের বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর ওপর নিপীড়নের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। ৫ আগস্ট মুক্ত হয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একটি কটূক্তিও করেননি। এমনকি তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। নোংরা ভাষায় কথা বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘আল্লাহ বাংলাদেশের জনগণকে এই দিনটি দেখালেন, আলহামদুলিল্লাহ।’ এর বেশি তিনি কোনো কথা বলেননি। অথচ বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত ব্যক্তির নাম হলো খালেদা জিয়া। সাবেক সরকারের পাতি নেতারাও বেগম জিয়া সম্পর্কে যে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন, তা চিন্তা করাও কুরুচির পরিচয় বহন করে। কিন্তু এসব অমার্জনীয় নোংরামির জবাব না দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নীরবতাই তাঁর শক্তি। তাঁর প্রতিবাদহীনতাই যেন মানুষের ভালোবাসা। তাঁর তো সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর পারিবারিক ও রাজনৈতিক এই শিক্ষা তাঁকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তিনি তাদের শুধু নীতির সমালোচনা করেছেন। তাদের ভোট চুরির সমালোচনা করেছেন। তাদের লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি আক্রমণ করেননি। খালেদা জিয়ার এই ধরনের রাজনৈতিক শিষ্টাচার আজকের দিনে সবার জন্য অনুকরণীয়।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, যে বাড়িতে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টে শহীদ মইনুল হোসেন সড়কের বাড়িটি কেবল একটি বাড়ি ছিল না, এটি ছিল ইতিহাসের একটি অংশ। সেই বাড়ি থেকে যখন তাঁকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়, তখনো খালেদা জিয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে যাননি। নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি কথা বলেননি। এমনকি বাড়ি নিয়ে নজিরবিহীন অপপ্রচারে তিনি জবাব দেননি। খালেদা জিয়া মূলত এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি একজন আদর্শবান, জাতির অভিভাবকের মতোই আচরণ করেন। সবার ঐক্য, দেশের ভালো, দেশের মঙ্গল—এই বিষয়গুলো তাঁর সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে উৎসারিত। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য যান লন্ডনে, সেখানে ঈদ করেন তাঁর পুত্রের সঙ্গে। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। সেখানেও তিনি বিভক্তির কথা বলেননি। অনৈক্যের কথা বলেননি, ধ্বংসাত্মক কথাবার্তা বলেননি, উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি। এটিই একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের বৈশিষ্ট্য। একজন রাজনীতিবিদ যে পরিশীলিত ভাষায় কথা বলেই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাঁর আদর্শের অবস্থানটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করার জন্য তাঁকে কোনো নোংরা বা অরুচিকর কথাবার্তা বলতে হয় না, তার প্রমাণ খালেদা জিয়া। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র বেগম জিয়া। ৮০ বছর হতে চলল তাঁর। কিন্তু এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে এই সময় যখন রাজনীতিতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিঃশেষ করে দিতে চায়, এক পক্ষ অন্য পক্ষের চরিত্র হননের জন্য অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে, সেই সময় খালেদা জিয়া যেন জাতির এক আলোকবর্তিকা। তিনি সব রাজনীতিবিদের জন্য একজন শিক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কিভাবে রাজনীতিবিদদের কথা বলতে হয়, সমালোচনা করেও কিভাবে মানুষকে সম্মান জানাতে হয়, সেটির উদাহরণ হলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া প্রতিশোধপ্রবণ নন। তিনি এক উদার গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক-বাহক। এ কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অন্যায়-অবিচারগুলো করা হয়েছে, সেই অন্যায়-অবিচারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণকে। তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে এ পর্যন্ত কিছু কথা বলেছেন জনগণের উদ্দেশে, কিন্তু একটিবারও নিজের কথা বলেননি। জনগণের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছেন, নতুন করে দেশ বিনির্মাণের কথা বলেছেন। এটি তাঁর মহত্ত্ব। আমাদের রাজনীতিতে এখন উদারতার বড় অভাব, মহত্ত্বের বড় অভাব। এ রকম অবস্থায় বেগম জিয়ার মতো একজন অনুকরণীয় উদাহরণ বড় প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, কুৎসিত আক্রমণ, গালাগালি ইত্যাদি পছন্দ করে না। আর পছন্দ করে না বলেই খালেদা জিয়া এখন অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে। সব মানুষ মনে করে যে এ রকম একজন রাজনীতিবিদই যেন দেশের জন্য প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ দেশের হাল ধরার মতো সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলেন তিনি। তিনিই যেন বাংলাদেশের অভিভাবক। একজন মানুষের জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম এবং পারিবারিক শিক্ষা যে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, বেগম জিয়া তার প্রমাণ। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, যিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন না, বরং জনগণের হাতে তার বিচারের ভার ছেড়ে দেন। জনগণের বিপুল জনপ্রিয়তায় তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। পেশিশক্তি প্রয়োগ বা কটূক্তি করে নয়, বরং জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন।

 লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

E-mail : auditekarim@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়
প্রতীকী ছবি

আজকের ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার, সমাজের রুচির দর্পণ, এমনকি নৈতিকতার মাপকাঠি। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা যখন কেবল অশালীনতা, ভাঁড়ামি আর সস্তা সেন্সেশনের উপর নির্ভর করে, তখন তা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সংকটের ইঙ্গিত দেয়। একজন নারী যখন টাওয়েল বা নাইটি পরে নাচলে লাখো ভিউ পায়, আর একজন গুণী কবি বা জ্ঞানী ব্যক্তির কথায় মানুষ নাক সিঁটকায়, তখন বুঝতে হবে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ কোথায় হোঁচট খাচ্ছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আজ মনিটাইজেশনের লোভে মানুষের নৈতিকতা ও লজ্জাকে পণ্যে পরিণত করেছে।

দেবরকে আজ যা দিলাম!—এমন ক্যাপশনে কৌতূহল জাগিয়ে ভিডিও তৈরি করলে তা ভাইরাল হয়, কিন্তু সমাজসংস্কার, শিক্ষা বা শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। এখানে কবিতার চেয়ে বক্ষ প্রদর্শন বেশি মূল্য পায়, জ্ঞানের চেয়ে খিস্তির কদর বেশি। যেন মানুষ এখন শুধু চায় উত্তেজনা, চায় অশ্লীলতার মাঝে হারিয়ে যেতে। এমনকি মাঝবয়সী নারীরাও আজ প্রেমের কবিতা পড়ার চেয়ে শারীরিক প্রদর্শনেই বেশি সাড়া পাচ্ছেন।

কমেডির নামে আজ যা চলছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীলতা ও খিস্তির মিশেল। পাবলিক হাসছে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদেরই রুচির দৈন্য। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, সমাজের উন্নতি ঘটে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে, নাইটি বা শারীরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়। যখন একজন মা-বোন স্কুলের পড়া ছেড়ে রিলস বানাতে উৎসাহিত হন শুধু টাকার লোভে, তখন আমাদের ভাবতে হবে—আমরা আসলে কোন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছি?

মনিটাইজেশনের এই উন্মত্ততা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিচ্ছে? তারা শিখছে যে, পড়াশোনা বা সততার চেয়ে সস্তা সেলিব্রিটি হওয়াটাই বড় সাফল্য।

তারা দেখছে, সমাজে সম্মান পেতে হলে বুকের খাঁজ দেখাতে হবে, দেবর-ভাসুর নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কন্টেন্ট বানাতে হবে। এভাবে কি আমরা একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব? নাকি আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দেব শুধু বিকৃত রুচি আর নৈতিক অধঃপতনের উত্তরাধিকার?

সময় এসেছে জেগে ওঠার। সোশ্যাল মিডিয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। প্যারেন্টস, টিচার্স ও ইনফ্লুয়েন্সারদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পেট চালানোর জন্য নৈতিকতা বিক্রি করা কখনই সমাধান নয়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ফিরে যেতে হবে। নইলে একদিন আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করবে—আপনারা আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন? নাইটি নাচ, নাকি জ্ঞানের আলো? উত্তর দিতে পারব কি?

মন্তব্য

মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

মাহফুজ জুয়েল
মাহফুজ জুয়েল
শেয়ার
মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কামনায় রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে সামনে আসে। সংস্কারের বাসনায় একে একে গঠন করা হয় সাতটি কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

এর মধ্যে ১৮ নভেম্বর ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

কমিশনের প্রধান করা হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে। ২২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যদের অনেকেই নিজ নিজ কর্মগুণে স্বনামখ্যাত সুশীল এবং নিঃসন্দেহে জ্ঞানীগুণী। তাঁরা তুলনামূলক দ্রুততম সময়ে তথ্যসমুদ্র মন্থন করে ১৮০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
আমরা আশা করি, দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গল বা ইতিবাচক পরিবর্তনের বাসনা থেকেই তাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। কষ্ট করে পড়তে গেলেই তা ধরতে পারা যায়।

কমিশনের সুপারিশমালার শুরুতেই গণমাধ্যমের মালিকানার কথা বলা হয়েছে। একই কোম্পানি, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, পরিবার বা উদ্যোক্তা যাতে একই সঙ্গে একাধিক মাধ্যমের মালিক হতে না পারে, সেজন্য বিশ্বের বহু দেশে ‘ক্রস-ওনার শিপ’ (টেলিভিশনের মালিক সংবাদপত্রের মালিক হতে পারেন না বা সংবাদপত্রের মালিক টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না) নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে কমিশন ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’র সুপারিশ করেছে।

কমিশন মনে করে, বাংলাদেশেও অচিরেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ক্রস-ওনার শিপ নিষিদ্ধ করে অধ্যাদেশ করা যায়। যেসব ক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান সেগুলোয় পরিবর্তন আনার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজন। এগুলো নানা পদ্ধতিতে হতে পারে।

যেসব কোম্পানি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, পরিবার একই সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিক, তারা যে কোনো একটি গণমাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিতে পারে। অথবা দুটি গণমাধ্যমের (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একত্র করে আরও শক্তিশালী ও বড় আকারে একটি গণমাধ্যম (টেলিভিশন অথবা পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজস্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এ ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিদ্যমান এ ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করায় যেমন বাজারের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, একই মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এজন্য ‘এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া)’ নীতি কার্যকর করাই গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন।

আর এ কথাগুলো পড়ার পরই অধমের চোখে খটকা লাগে। প্রতিবেদনটিও অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা ও পবিত্রতা হারায়। মুহূর্তেই ‘অনেক দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গোমূত্র পড়ার’ চিত্রকল্পটাও ভেসে ওঠে। প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট এক উদ্ভট যাচ্ছেতাই বালখিল্য বিষয়ে পরিণত হয়। বোঝা যায়, নেহাত দেশ ও জনগণ, গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের মঙ্গলাকাক্সক্ষা নয়, এখানেও গতানুগতিক অপরাজনীতি ও ঘৃণ্য গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করেছে। সেই ‘গোষ্ঠীস্বার্থ’ও আবার স্রেফ ‘ব্যবসায়িক বিদ্বেষতাড়িত’। হ্যাঁ, স্রেফ বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা থেকেই কমিশন এ আজগুবি ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়ার সুপারিশ করেছে এবং ক্রস-ওনার শিপের প্রসঙ্গ টেনেছে।

বিদ্বেষের তাড়নায় কখনোই সর্বজনীন ভালো কিছু হয় না। ফলে কমিশনের এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে ইতিবাচক নতুন কিছু দেওয়া থাক দূরে, বরং আরও অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলবে। অদৃশ্য অব্যক্ত অসংখ্য ক্ষত বয়ে চলা নাজুক গণমাধ্যমকর্মীদের জীবনে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়েছে গণমাধ্যম কমিশন।

কোন প্রতিষ্ঠান কয়টা পত্রিকা বা টেলিভিশন চালু করতে পারবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বৈধ যুক্তি নেই। যার বৈধ টাকা আছে সে কেন পারবে না? কোনো একটি শিল্পগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে এ সুপারিশ সামনে আনা হলে মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

কেননা এর বিপরীত চিত্রটাই পৃথিবীতে সবল সচল। চোখের সামনেই এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের কথা ধরুন। তাদের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার কি এ ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে?

রয়েছেন মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডক, তাঁর কোম্পানি নিউজ করপোরেশন। তিনি বিশ্বজুড়ে শত শত স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বহুমুখী প্রকাশনা ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের মালিক। এ একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে যুক্তরাজ্যে রয়েছে দ্য সান এবং দ্য টাইমস, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান এবং দি অস্ট্রেলিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং নিউইয়র্ক পোস্ট। এ ছাড়া তিনি টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়া এবং ফক্স নিউজ (ফক্স করপোরেশনের মাধ্যমে), টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিস ফক্স এবং নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের (বর্তমানে বিলুপ্ত) মালিকও ছিলেন।

আছেন জন কার্ল মেলোন। এ আমেরিকান মিডিয়া মুঘল, যিনি লিবার্টি মিডিয়ার চেয়ারম্যান। তিনি ‘কেবল কাউবয়’ নামেও পরিচিত। তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া, টেলিযোগাযোগ এবং বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিক।

জন কার্ল মেলোন ১৯৯২ সালে ‘ফাইভ হানড্রেড চ্যানেল ইউনিভার্স’ ধারণাটি ব্যবহার করেন ভবিষ্যতের মিডিয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য, যেখানে বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি ইঙ্গিত করেন। তাঁর ডিসকভারি কমিউনিকেশনস, যা এখন ডিসকভারি ইনকরপোরেটেড, এই এক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে ডিসকভারি চ্যানেল, টিএলসি (দ্য লার্নিং চ্যানেল), অ্যানিমেল প্ল্যানেট, এইচজিটিভি (হোম অ্যান্ড গার্ডেন টেলিভিশন), ফুড নেটওয়ার্ক, ওডব্লিউএন (অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক), ইউরোস্পোর্ট (ইউরোপীয় স্পোর্টস চ্যানেল নেটওয়ার্ক), কিউভিসি (গুণমান, মূল্য, সুবিধা; যা একটি হোম শপিং নেটওয়ার্ক যা সৌন্দর্য, ইলেকট্রনিক, ফ্যাশন এবং আরও অনেক কিছু বিপণন ও পণ্য সরবরাহ করে লাইভ শো সম্প্রচার করে। কিউভিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ একাধিক অঞ্চলে কাজ করে।)

লিবার্টি গ্লোবালের অধীনে রয়েছে ভার্জিন মিডিয়া, যা যুক্তরাজ্যের একটি প্রধান টেলিযোগাযোগ এবং মিডিয়া কোম্পানি, কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং মোবাইল যোগাযোগ প্রদান করে। ইউপিসি, ইউনাইটেড প্যান-ইউরোপ কমিউনিকেশনস, রয়েছে টেলিনেট, যা বেলজিয়ামের একটি শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী, প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং টেলিফোন পরিষেবা প্রদানকারী।

লিবার্টি ল্যাটিন আমেরিকা, সিরিয়াসএক্সএম, ফর্মুলা ওয়ান, লাইভ নেশান, জিসিআই (জেনারেল কমিউনিকেশন, ইনকরপোরেটেড), লায়ন্সগেটসহ আরও অনেক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।

শুধু রুপার্ট মার্ডক বা জন কার্ল মেলোন নন, এ রকম এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক মিডিয়া থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের নাম আমরা উল্লেখ করছি, যাদের সব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করলে এ লেখাটা প্রবন্ধ না হয়ে মহাভারত হয়ে যাবে। সে কারণে আমরা শুধু ব্যক্তি বা তার মূল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সুবিধা নিয়ে এ মুহূর্তেই সেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ধরুন, সামনার রেডস্টোন, ভায়াকমসিবিএস, যা বর্তমানে প্যারামাউন্ট গ্লোবাল; টেড টার্নার, টার্নার ব্রডকাস্টিং সিস্টেম, টিবিএস ও সিএনএন; জেফ বেজোস, অ্যামাজন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক; ওয়াল্ট ডিজনি, দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি, ডিজনি মিডিয়া নেটওয়ার্ক; ডেভিড গেফেন, গেফেন রেকর্ডস, ড্রিমওয়ার্কস এসকেজি; মাইকেল ব্লুমবার্গ, ব্লুমবার্গ এলপি, ব্লুমবার্গ নিউজ; ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন, গুগল, বর্তমানে যা অ্যালফাবেট, ইউটিউব এবং গুগল নিউজসহ।

প্রতিবেশী দেশে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র, জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস, জিটিভি; কালানিথি মরন, সান গ্রুপ, সান টিভি নেটওয়ার্ক, রেডিও এবং চলচ্চিত্র; রাঘব বাহল, নেটওয়ার্ক১৮ গ্রুপ, সিএনবিসি-টিভি১৮, সিএনএন-নিউজ১৮-এর মতো মিডিয়া আউটলেট এবং অন্যান্য বিভিন্ন ডিজিটাল ও টেলিভিশন সম্পত্তির মালিক; ম. কে. আলাগিরি, দ্য হিন্দু গ্রুপ, ভারতের অন্যতম সম্মানিত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র দ্য হিন্দু এবং অন্যান্য প্রকাশনার মালিকানার সঙ্গে জড়িত। সম্বিত পাত্র, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোং, আগরওয়াল পরিবারের নেতৃত্বে টাইমস গ্রুপ ভারতের বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি, যারা টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো প্রধান সংবাদপত্র প্রকাশ করে এবং জুমের মতো টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক। রজত শর্মা, ইন্ডিয়া টিভি, হিন্দি ভাষার সংবাদ চ্যানেল ইন্ডিয়া টিভির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মিডিয়া শিল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এন. আর. নারায়ণ মূর্তি, ইনফোসিস, যদিও প্রাথমিকভাবে একজন প্রযুক্তিসম্রাট, মূর্তির বিনিয়োগ মিডিয়া এবং বিনোদনেও বিস্তৃত। বিজয় মালিয়া, কিংফিশার, ইউবি গ্রুপ এবং মিডিয়া ভেঞ্চারস। কিংফিশার এয়ারলাইনসের জন্য পরিচিত, মালিয়ার কিংফিশার টিভি এবং অন্যান্য বিনোদন উদ্যোগসহ মিডিয়া কোম্পানিগুলোতেও অংশীদারি ছিল। শিব নাদার, এইচসিএল এবং মিডিয়া ইনভেস্টমেন্টস, এইচসিএলের প্রতিষ্ঠাতা। নীতা আম্বানি, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, নেটওয়ার্ক১৮, টিভি১৮, জিও প্ল্যাটফর্মের মালিক।

ডিজিটাল যুগে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক স্বনামখ্যাত বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনোটি বন্ধ হওয়ার পথে, কোনোটি রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

তাই ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া চিন্তার পেছনে জনহিতকর, গঠনমূলক বা ইতিবাচক কিছু নয়, বরং রয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ কুচিন্তা ও কূটকৌশল। যাতে লাথি মারা হবে অসংখ্য মিডিয়াকর্মীর পেটে। তাতে বরং বেকারত্বের পাহাড় আরও উঁচু হবে, নানামুখী অসন্তোষ, সীমাহীন হতাশার আকাশ আরও মেঘকালো বা ভারী হবে।

মাহফুজ জুয়েল : কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য
ঐকমত্য কমিশন

জনপ্রশাসনের ১৮ সুপারিশ বাস্তবায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা : প্রেক্ষিত আইসিটি সার্ভিস

মো. মনিরুজ্জামান
মো. মনিরুজ্জামান
শেয়ার
জনপ্রশাসনের ১৮ সুপারিশ বাস্তবায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা : প্রেক্ষিত আইসিটি সার্ভিস

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ফলে দেশের জনগণের মধ্যে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুদৃঢ় প্রত্যয় ও আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করে। যার মধ্যে গত ৩ অক্টোবরে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও আছে। একটি ‘জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, নিরপেক্ষ ও দক্ষ জনপ্রশাসন’ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে দুই শতাধিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

যা আমাদের সবার জানা। 

পত্রপত্রিকার বরাতে আমরা ইতোমধ্যে একথাও জেনেছি, গত ২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের আগেই নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে ১১১ দফা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংস্কার প্রস্তাবের অন্য সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে বলেও আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি। 

২. একটি জাতীয় দৈনিকের গত ২০ মার্চের খবরে আমরা দেখলাম, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সুপারিশ এখনই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

এর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় রাজস্ব  বোর্ড পুনর্গঠন, ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালু, ভূমি রেজিস্ট্রেশন সংস্কার, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করা, পদোন্নতি না দেওয়া সরকারি কর্মচারীর বেতন সুবিধা চালু, দুর্নীতি তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন এবং চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন সীমিতকরণসহ আরো কিছু সুপারিশ। আমরা এখন দেখি ডিজিটাল রুপান্তর ও ই-সেবা নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবে আসলে কি বলা ছিল? গত ৫ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীসহ কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের যে প্রতিবেদন জমা দেন সে প্রস্তাবের ‘নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নে জনপ্রশাসন’ শিরোনামে পঞ্চম অধ্যায়ের ৫.১ এ নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিক সম্পৃক্ততা, নাগরিকদের তথ্য অধিকার ও নাগরিক পরিষেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে স্বল্প মেয়াদী (ছয় মাসে বাস্তবায়ন যোগ্য ) যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতে ডিজিটাল রুপান্তর ও ই-সেবায় বলা আছে, ‘৫.১ ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-সেবা: জনসেবা ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। একটি মূল কৌশল হতে পারে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তর। সরকার একাধিক ই-গভর্নমেনট সেবা শক্তিশালী করতে পারে, যেমন- অনলাইন ট্যাক্স দাখিল, ডিজিটাল জমির রেকর্ড এবং ইলেকট্রনিক জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট ইত্যাদি।
ই-সেবা সরকারি বা জনসেবার সময় ও খরচ হ্রাস করে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া এটি দূরবর্তী বা অনগ্রসর এলাকায় নাগরিকদের জন্য সেবার অভিগম্যতা (Access) বাড়াতে পারে। ই-সেবা স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে এবং নাগরিকদের সাথে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারে। একইসঙ্গে এটি খরচ সাশ্রয়ী এবং তথ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি করতে পারে। ই-সেবার উন্নতির লক্ষ্যে ন্যাশনাল ই-সাভিস সিস্টেম (NESS) এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে (Mobile Applications) শক্তিশালী করে আমলাতান্ত্রিক পক্রিয়া সহজতর করতে পারে।


অর্থাৎ, কমিশন সংস্কারের অংশ হিসেবে জনবান্ধব, নৈতিক, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ এবং কার্যকরি জনপ্রশাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রযুক্তি নির্ভর একটি নতুন দেশ গড়ার জন্য যেটুক দরকার সে বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করেছে। 


৩. সরকার ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছেন বোধকরি সরকারের এই উদ্যোগ যেন আলোর মুখ দেখে সেজন্য সংস্কার কমিশন প্রকৃত ডিজিটাল রূপান্তর ও টেকসই ই-সেবা বাস্তবায়ন এবং জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সংস্কার প্রতিবেদনেই তার রুপরেখা বাতলে দিয়েছেন।  ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’ এর প্রতিবেদনের সপ্তম অধ্যায়ের ৭.১ ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার’-এ ১৩ তম সার্ভিস হিসেবে কমিশন ‘বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস (Bangladesh ICT Service) বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ,রেমিট্যান্স আহরণ, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন ও ব্যবস্থাপনা এবং জনভোগান্তি হ্রাসে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন বোধকরি সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কমিশনের সুপারিশে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন একটি স্বল্প মেয়াদী অর্থাৎ ছয় মাসে বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করে ৭.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এমতাবস্থায় সরকারি দপ্তরের আইসিটি কর্মকর্তাদেরকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হলো” অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত পিএসসি’র সুপারিশপ্রাপ্ত আইসিটি কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিশন আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে সুপারিশ করেছে।

কিন্তু, গত ২০ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যে কাজগুলো রাজনৈতিক  দলের মতামত ছাড়াই অল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে যতদূর জেনেছি, আইসিটি ডিভিশনে প্রেরিত সুপারিশে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। আমরা  জানিনা সরকার আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন কীনা? যদি পাঠিয়ে থাকেন তো সেটা সরকারের কথা ও কাজের মিলের প্রতিফলন হিসেবে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই কিন্তু যদি না পাঠিয়ে থাকেন তাহলে বিষয়টা সরকারকে দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে। কেননা ঐকমত্য কমিশন যেখানে জনমুখী জনপ্রশাসন,  স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন এবং কার্যকর জনপ্রশাসনের স্বপ্ন দেখছে সঙ্গে সঙ্গে সরকার যেখানে নাগরিকরা যাতে সহজে ও অবাধে চাহিদামতো সরকারি সেবা পেত পারে, সকল সেবায় সকল নাগরিকের যেন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যায়, দুর্নীতি ও ভোগান্তিমুক্ত সেবা প্রদান যেখানে অঙ্গীকার, স্বচ্ছতা বাড়ানোর মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের যেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্ন সেখানে প্রযুক্তির প্রয়োগ না ঘটিয়ে সেবা প্রদান অসম্ভব। আর প্রযুক্তি যেখানে সেবা গ্রহণ ও সেবা প্রদানের মূল হাতিয়ার সেখানে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন না হওয়া আত্মঘাতির শামিল। 

৪. জনপ্রশাসন কমিশন কাজ শুরু করার পর থেকে প্রায় ৪৯টি সভায় মিলিত হয়ে কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়ন করে। জনপ্রশাসন সংষ্কারের বিষয়ে লিখিত পরামর্শ আহ্বান করে ১৩টি রাজনৈতিক দলের সম্মানিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ অন্যান্য দলের লিখিত পরামর্শ গ্রহণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এমনকি ইতোমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর  শুরু হওয়া সংলাপেও  প্রথম দল হিসেবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) থেকে শুরু করে বিএনপি, এনসিপি কিংবা অন্য কোনো দল আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানা যায়নি। কোনো রাজনৈতিক দল নাগরিক সেবা প্রদানের সাথে জড়িত আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে দ্বিমত করবে বলেও আশঙ্কা নেই  সুতরাং, আমরা মনে করি সরকার তার নির্বাহী আদেশেই আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন করতে পারে। কেননা এতে যেমন সরকারের কোনো আর্থিক সংশ্লেষ নেই তেমনই বিষয়টি চাকরি আইন দ্বারাও স্বতঃসিদ্ধ। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ ( ২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন )
প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ সৃজন ও পুনর্গঠন, একীকরণ, সংযুক্তকরণ এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীগণের নিয়োগ ও তাহাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এতৎসংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানাবলি সংহতকরণকল্পে প্রণীত আইন এর দ্বিতীয় অধ্যায় প্রজাতন্ত্রের কর্ম এবং কর্মবিভাগ সৃজন ও পুনর্গঠন- এ বলা আছে, (১) সরকার, সরকারি গেজেটে আদেশ দ্বারা, প্রজাতন্ত্রের যে কোনো কর্ম বা কর্মবিভাগ সৃজন, সংযুক্তকরণ, একীকরণ বা বিলুপ্তকরণসহ অন্য যে কোনোভাবে পুনর্গঠন করিতে পারিবে।   

অর্থাৎ সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বল্প মেয়াদী সুপারিশ “বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস (Bangladesh ICT Service) বাস্তবায়ন নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে পারে। 

৫. প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করে নাগরিক সেবা প্রদান করাকে লক্ষ্য ধরে জনপ্রশাসনের প্রধান কাজই যে নাগরিকদের সেবা প্রদান করা। সে কথা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন নাগরিক সেবা প্রদানের বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করে ই-গভর্ন্যান্স কার্যকরভাবে প্রবর্তনের  পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-সেবা কিংবা কমিশনের সুপারিশ ই-গভর্ন্যান্স কোনোটাই সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হবে না যদি না আমরা কমিশনের সুপারিশ বাংলাদেশ আইসিটি সার্ভিস দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে পারি। কেননা প্রযুক্তি নির্ভর যেকোনো সেবা প্রদানের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পরবর্তী প্রতিটা পদক্ষেপে আইসিটি জনবল সম্পৃক্ত থাকে ফলে সেই আইসিটি জনবলের দীর্ঘদিনের দাবী, তাদের অস্তিত্ব-ই যদি আমরা আগে নিশ্চিত করতে না পারি সঙ্গত কারণেই গৃহীত সব পদক্ষেপ অতীতের পতিত সরকারের ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়বে এবং সরকারের আইসিটি সেক্টর যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। তাই  আমরা মনে করি, শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া এই মাটি ও মানুষের অধিকার নিশ্চিতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের স্বল্প মেয়াদী সুপারিশ বাংলাদেশ আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার তার ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালুর সকল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে। তাতে একদিকে জনগণের ভোগান্তিমুক্ত আইসিটি ভিত্তিক সেবা পাওয়ার অধিকার যেমন সুনিশ্চিত হবে অন্যদিকে শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষনা করা কাঠামোগত সংস্কারের অঙ্গীকারও পূরণ হবে আর তা যদি না করতে পারি আমরা তবে একথা নিশ্চিত যে আমরা যেভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থন করিনা কেন সাঈদ-মুগ্ধরা আমাদের কখনো কোনোদিন ক্ষমা করবে না।        

যুগ্মসচিব, গভর্নমেন্ট আইসিটি অফিসার্স ফোরাম 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ