<p style="text-align:justify">ঢাকার বাতাস দূষিত তা আমরা প্রতিদিন জানছি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান নির্ণয়কারী সংস্থা আইকিউএয়ার এর প্রতিবেদন থেকে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে— এই ডিসেম্বরের বেশ কয়েকদিন বায়ু দূষণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব পায় ঢাকা! আইকিউএয়ারের সূচক অনুযায়ী প্রায় দিনই ঢাকার বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ কিংবা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পর্যায়ে থাকছে।  আইকিউএয়ারের মতে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব ২০১-৩০০ হলে (ওব্লিউএইচও কর্তৃক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫)  তা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ এর বেশি হলে তা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে গণ্য করা হয়। এই মাত্রার বায়ু দূষণে ঘরের বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে এবং ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কোন স্থানে বিপজ্জনক মাত্রার দূষণ টানা তিন ঘণ্টা অব্যাহত থাকলে ওই স্থানে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারিসহ শিশুদের স্কুল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনটা যে এবারই ঘটছে তা কিন্তু নয়। বছরের পর বছর ধরে এই অবস্থা চললেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। </p> <p style="text-align:justify"><strong>পিএম ২.৫ কী, কীভাবে ক্ষতি করে?</strong></p> <p style="text-align:justify">পিএম ২.৫ হলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতি সূক্ষ্ম কণা যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২.৫ মাইক্রোমিটার  (১ মাইক্রোমিটার = ০.০০১ মিলিমিটার)। বাতাসে ভাসমান ধুলা, ধোঁয়া, রাবার, প্লাস্টিক, অন্যান্য কঠিন পদার্থ, ছাই, মাইট, পানির কণা, ফুলের রেণু ইত্যাদি যার দৈর্ঘ্য ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার কম সেগুলো পিএম ২.৫ নামে পরিচিত। এই কণাগুলো এত সূক্ষ্ম যে, খালি চোখে এদের দেখা যায় না। ওজনে হালকা বলে এগুলো বাতাসে ভেসে থেকে শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে আন্ত:মহাদেশীয় দূষণ ঘটাতে পারে। এগুলো নি:শ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে যেতে পারে। এর ফলে এ্যাজমা, হাঁচি-কাশি, চোখ দিয়ে পানি পড়া, ফুসফুসের নানা রোগ, হৃদরোগ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। শিশু ও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী এই দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। </p> <p style="text-align:justify"><strong>ঢাকার বাতাসে এতো দূষণ কেন?</strong></p> <p style="text-align:justify">ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৩৩ হাজার মানুষ বাস করে। সাম্প্রতিককালে এই শহরের বস্তুগত সংস্কৃতির বিকাশ যে হারে হয়েছে অবস্তুগত সংস্কৃতি সে হারে বিকশিত হয়নি। ফলে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে যে যার অবস্থানে থেকে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান কারণ দুটি। যেমন— ধুলা ও ধোঁয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহরগুলোর একটির নাম ঢাকা। এই শহরের রাস্তা, ফুটপাত, খেলার মাঠ সারাবছরই ধুলাবালিতে ভরা থাকে। ফলে মানুষের চলাচল, খেলাধুলা, বাতাস ও যানবাহন চলাচলে ধুলা নিয়মিত বাতাসে মিশছে। ঢাকার রাস্তাঘাটে চলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ধূলি-দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া অন্যান্য নির্মাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও এ সংক্রান্ত মালামাল বিশেষ করে বালু পরিবহনের সময় ধূলি-দূষণ হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকার চারপাশে থাকা অসংখ্য ইট ভাটা, শহরে ফিটনেসবিহীন পুরনো লক্কড়-ঝক্কর গাড়ি চলাচল, যানজট, আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি কারণে ঢাকার বায়ু দূষিত হচ্ছে। </p> <p style="text-align:justify">এ ধরনের দূষণ রোধে আইন আছে, কিন্তু কেউ মানছে না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আছে, কিন্তু কেউ কাজ করছে না। কারণ দুর্নীতি। এই দেশে ঘুষ ছাড়া কোন ঠিকাদার কাজ পায় না। ঠিকাদারের কাজের মান দেখতে যারা যায় তারা ঘুষ নেয়। ঠিকাদারের কাজ যে বুঝে নেয় সে ঘুষ নেয়। ফলে বেচারা ঠিকাদার দুপয়সা লাভের আশায় কাজ ও পরিবেশ দুটোরই বারোটা বাজায়। তেমনি ইমারত নির্মাণের ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও একই কারণে কেউ তা মানছে না।</p> <p style="text-align:justify"><strong>করণীয় কী?</strong></p> <p style="text-align:justify">বর্ণীত সকল ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগুলো প্রয়োগ করলেই শহরে ধুলা ও ধোঁয়া দূষণ কমে আসবে। এর বাইরে জনসচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। যানজট নিরসন করতে পারলে গাড়িগুলো অকারণে দাঁড়িয়ে থেকে অতিরিক্ত কার্বন নি:সরণ করবে না। গাড়ির ফিটনেস প্রদানে বিদ্যমান মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। ময়লা আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। </p> <p style="text-align:justify">শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সকালে কিছুক্ষণ দেখা গেলেও সারা দিন কোন খোঁজ থাকে না। প্রয়োজনের তুলনায় কম কর্মী কাজ করে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়াতে হবে। দুই শিফটে পালা করে কাজ করতে হবে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ডিউটিকালীন ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করবে। রাস্তার ধুলোবালি ও ময়লা আবর্জনা সারাদিন কালো পলিব্যাগে জমা করবে, নির্দিষ্ট সময় পরপর কর্পোরেশনের গাড়ি এসে সেগুলো তুলে নিয়ে যাবে। নিজ নিজ ওয়ার্ড পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব ওয়ার্ড কমিশনারকে নিতে হবে। এসব কাজ দৃশ্যমান হলে নাগরিকগণ প্রয়োজনে বাড়তি ট্যাক্স দিতে আপত্তি করবে না। </p> <p style="text-align:justify">নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঢাকার বাতাসের মান উন্নত করার চ্যালেঞ্জ সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্লোভ-নির্মোহ থেকে দেশ সেবায় ব্রতী হওয়ার কঠোর বয়ান পৌঁছে দিতে হবে। কেউ দুর্নীতিতে জড়ালে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ঘুস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তবেই ঢাকার মানুষ নি:শ্বাসে নির্মল বায়ু গ্রহণ করতে পারবে। </p> <p style="text-align:justify">লেখক : মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঞা, শিক্ষক ও লেখক।</p>