আরব নেতারা শুক্রবার সৌদি আরবে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ও সেখানকার জনগণকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা মোকাবেলা করা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে কূটনৈতিক ও সরকারি সূত্র জানিয়েছে।
সৌদি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান উপসাগরীয় আরবদেশগুলোর নেতা, মিসর ও জর্দানের রাষ্ট্রপ্রধানদের রাজধানী রিয়াদে এই বৈঠকে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সৌদি পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ উমর করিম এই সম্মেলনকে আরববিশ্ব ও ফিলিস্তিন ইস্যুর জন্য ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং ‘নেতাদের একত্র করার ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কাঠামোর’ মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে এসপিএ জানিয়েছে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরবদেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলেও গাজা উপত্যকার প্রশাসন কার হাতে থাকবে এবং পুনর্গঠনের জন্য অর্থায়ন কিভাবে হবে, সে বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
এদিকে ট্রাম্প বৈশ্বিক সমালোচনার মুখে পড়েন, যখন তিনি প্রস্তাব দেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘গাজা উপত্যকা দখল করবে’ এবং এর ২৪ লাখ বাসিন্দাকে পার্শ্ববর্তী মিসর ও জর্দানে সরিয়ে দেওয়া হবে। এসপিএ জানিয়েছে, ‘যৌথ আরব পদক্ষেপ এবং এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত আসন্ন জরুরি আরব সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে থাকবে, যা মিসরে ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে।’
আরো পড়ুন
ফিলিস্তিনি বন্দির সঙ্গে বর্বরতা, ৫ ইসরায়েলি সেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
এর আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে বৈঠককালে জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ দ্বিতীয় বলেন, মিসর গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে।
একজন সৌদি নিরাপত্তা সূত্রর মতে, বৈঠকে ‘মিসরের পরিকল্পনার একটি সংস্করণ’ আলোচনা করা হবে, যার কথা জর্দানের বাদশাহ উল্লেখ করেছিলেন।
নতুন রাজনৈতিক পথ?
অন্যদিকে গাজার পুনর্গঠন হবে আলোচনার অন্যতম মূল বিষয়, যেখানে ট্রাম্প পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে জনগণের স্থানান্তরের পক্ষে একটি যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।
কায়রো এখনো তার পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে মিসরের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ হেগাজি তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘তিনটি কারিগরি পর্যায়ের’ একটি পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
প্রথম পর্যায়ে ছয় মাস ধরে ‘প্রাথমিক পুনরুদ্ধার’ প্রক্রিয়া চালানো হবে। কায়রোতে নীতি-নির্ধারণী মহলে ঘনিষ্ঠ থিংকট্যাংক মিসরীয় পররাষ্ট্র পরিষদের এই সদস্য জানিয়েছেন, ভারী যন্ত্রপাতি এনে ধ্বংসস্তূপ সরানো হবে এবং গাজায় সাময়িকভাবে নিরাপদ অঞ্চল চিহ্নিত করা হবে, যেখানে বাসিন্দাদের স্থানান্তর করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা হবে, যেখানে পুনর্গঠনের বিস্তারিত পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে এবং অবকাঠামো পুনরুদ্ধারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আরো পড়ুন
যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল
হেগাজি বলেন, ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে গাজার নগর পরিকল্পনা, আবাসন নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে।’
এদিকে জাতিসংঘ মঙ্গলবার জানিয়েছে, গাজা পুনর্গঠনে ৫৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি লাগবে, যার মধ্যে প্রথম তিন বছরের জন্য ২০ বিলিয়নের বেশি প্রয়োজন।
এ ছাড়া শেষ ধাপে ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের জন্য একটি রাজনৈতিক পথ উন্মোচন’ এবং ‘একটি টেকসই যুদ্ধবিরতির জন্য প্রণোদনা সৃষ্টি করা’ অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলেও হেগাজি জানিয়েছেন।
করিম বলেছেন, পরিকল্পনার সফলতার জন্য এমন ‘এক ধরনের আরব ঐক্য প্রয়োজন, যা বহু দশক ধরে দেখা যায়নি।’
আরো পড়ুন
নেতানিয়াহুর মন্তব্যের তীব্র নিন্দা আরববিশ্বের
আর্থিক চ্যালেঞ্জ
উপসাগরীয় অঞ্চলের বিষয়ে পরিচিত এক আরব কূটনীতিক বলেছেন, ‘মিসরের পরিকল্পনার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর অর্থায়ন কিভাবে হবে। কুয়েতের মতো কিছু দেশ হয়তো মানবিক কারণে অর্থায়ন করবে, তবে অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো যেকোনো ধরনের অর্থ হস্তান্তরের আগে নির্দিষ্ট শর্ত নির্ধারণ করবে।’
উমর করিম বলেন, ‘সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কোনো অর্থ ব্যয় করবে না, যদি না কাতার ও মিসর হামাস নিয়ে কিছু নিশ্চয়তা দেয়।’
মিসরের পরিকল্পনা গাজায় যুদ্ধ-পরবর্তী জটিল তদারকির বিষয়টি মোকাবেলা করতে চায়। ২০০৭ সাল থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের পরিবর্তে সেখানে ‘কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ফিলিস্তিনি প্রশাসন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রশাসন ‘বিশেষজ্ঞদের’ নিয়ে গঠিত হবে এবং এটি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবে না, বরং এটি রাজনৈতিক ও আইনিভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীন থাকবে বলে জানিয়েছেন হেগাজি।
আরো পড়ুন
বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের প্রস্তাব নিন্দিত
কায়রোর এই উদ্যোগে একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনীর পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা মিসর, আরবদেশসমূহ ও অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে পরিপূরক হবে। তবে এখানেও মতপার্থক্য রয়ে গেছে। হেগাজি বলেছেন, ‘আসন্ন সময়ে হামাস রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরে দাঁড়াবে।’ অন্যদিকে এক সৌদি সূত্র বলছে, রিয়াদ গাজার নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে দেখতে চায়। আবার যুদ্ধের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী কাতার জোর দিয়ে বলেছে, গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে ফিলিস্তিনিদেরই।
করিম বলেন, ‘আমার মনে হয়, সব আঞ্চলিক পক্ষই বুঝতে পারছে, তাদের প্রস্তাবিত যেকোনো বিকল্প পরিকল্পনায় কোনোভাবেই হামাস থাকতে পারবে না। কারণ হামাসের উপস্থিতি এটিকে মার্কিন প্রশাসন ও ইসরায়েলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে না। অতএব, সামগ্রিকভাবে এই পরিকল্পনার সফলতার কোনো সম্ভাবনা তৈরি করতে হলে গাজার ভেতরে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতেই হবে।’
সূত্র : আলজাজিরা, এএফপি