সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি’র প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিস্তার চরে মঞ্চ তৈরি, খাবার ব্যবস্থা, তাঁবু টানিয়ে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন শিক্ষার্থী, কৃষক, মৎস্যজীবী, পরিবেশকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যরা।
‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে গতকাল একই সঙ্গে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ১১টি স্থানে সমাবেশ করে বিএনপি।
এতে তিস্তাপারের মানুষের বাঁচার আহাজারি বেরিয়ে এসেছে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার এলো। সবাই ভাবল, ভারতের বন্ধু আওয়ামী লীগ। সুতরাং তিস্তার পানি মনে হয় এবার পেয়েই যাবে। লবডংকা। ১৫ বছরে বাংলাদেশের অনেক কিছু বেচে দিয়েছে, কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানি আনতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টা নদী, সব নদীর উজানে তারা বাঁধ দিয়েছে। তারা পানি নিয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ জীবন-জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। একদিকে ভারত আমাদের পানি দেয় না, অন্যদিকে আমাদের শত্রুকে (শেখ হাসিনা) তাদের দেশে বসিয়ে রেখেছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এখানে নিরপেক্ষ থাকলে চলবে না। মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে, পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। আর খুব তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেন।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘শুকনা মৌসুমে ভারত উজানের পানি আটকে রাখে, আর বর্ষা মৌসুমে ছেড়ে দেয়। ফলে আমাদের এখানে বন্যায় সব ভেসে যায়। এটা কি কোনো বন্ধুর পরিচয় হতে পারে?’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, এখন সময় এসেছে ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলার। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের সরকারকে যেতে হবে।’
জাতীয় পার্টির (জাফর অংশ) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, “আজকের এই কর্মসূচি ৬০ দিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল, এরপর কয়েক দিন আগে ভারত পানি ছাড়া শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে চাই, যদি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না দাও তাহলে আমরা এককভাবে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করব।”
সভাপতির বক্তব্যে ‘তিস্তা নদী রক্ষা কমিটি’র প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘এই রংপুর ছিল রঙ্গে রসে ভরপুর। তাকে আজ বিরান ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। ছিন্নমূল মানুষ বাড়ি-ঘর হারিয়ে দেশান্তরি হয়ে কোথায় চলে গেছে আমরা বলতে পারি না।’
তিস্তা নিয়ে অন্যান্য জেলার সমাবেশে ১০টি স্থানে পৃথকভাবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহিপুর তিস্তা সেতুর নিচে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘এক-তৃতীয়াংশ পানি নদীর জন্য হবে, বাকি পানি কৃষিকাজে ব্যয় করার জন্য যথাযথভাবে বণ্টন করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন আছে। একটা নদীর পারে যেসব দেশ আছে সেই নদীর ওপর সব দেশেরই অধিকার সমান। ফলে ভারত উজানে আছে বলে তিস্তার ওপর তাদের অধিকার বেশি, এটা মোটেও সত্য না।’
কুড়িগ্রামের দুটি পয়েন্টে সমাবেশ : তিস্তাপারে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল কুড়িগ্রামের দুটি পয়েন্টে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজারহাটের বুড়িরহাট এলাকায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম বেবু, হাসিবুর রহমান হাসিব প্রমুখ।
উলিপুরের থেতরাইয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি হায়দার আলী। বক্তব্য দেন পৌর বিএনপির সভাপতি আপন আলমগীর, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও আন্দোলন উলিপুর উপজেলা শাখার নেতা নজরুল ইসলাম, উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল রহমান বুলবুল প্রমুখ।
লাখো মানুষের অবস্থান : কারো হাতে ঢাক-ঢোল, কারো হাতে ঘুড়ি, কারো কারো হাতে পানির দাবিতে তৈরি করা ব্যানার-ফেস্টুন। সবার গন্তব্য তিস্তাতীর। গতকাল সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসে। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এই আয়োজন। গতকাল দুপুরে তিস্তার কাউনিয়া অংশ পরিদর্শন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুসহ শীর্ষ নেতারা।
একই দাবিতে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারের দুই পাশে ২৩০ কিলোমিটার অংশের ১১টি স্পটে একযোগে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসছে তিস্তা তীরে বসবাসরত মানুষ।
আয়োজকরা বলছেন, রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলা ও ১২টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত। শাখা-প্রশাখা ও উপনদী মিলে তিস্তায় সংযুক্ত নদীর সংখ্যা ২২টি। ৩১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা অববাহিকাটিকে একটি ইউনিট ধরে সারা বছরের পানির প্রবাহকে হিসাবে এনে অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে সই করে। এর সঙ্গে খরাকালে তিস্তার পানি চুক্তিটিও চূড়ান্ত হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পেত ৩৭.০৫ শতাংশ, ভারত পেত ৪২.০৫ শতাংশ পানি। শেষ মুহূর্তে মমতার আপত্তির মুখে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি।
যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন ছিল তিস্তার উজানে পাহাড়ি অঞ্চলে যৌথভাবে একটি বড় জলাধার নির্মাণ করা। এই জলাধার থেকে নিয়ন্ত্রিত পানি ছেড়ে দিতে হতো, যাতে করে ভাটিতে বর্ষাকালে পানি প্রবাহ কমে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়ে। এতে দুই দেশের সেচ সংকটের সমাধান এবং বিপুল পরিমাণ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক নিয়মে আছে- আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে স্থাপনা তৈরি করতে হলে ভাটির দেশকে জানাতে হবে। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবেশী এর সমাধান আটকে রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিম সরকার বাংলাদেশকে না জানিয়ে একতরফাভাবে তিস্তা নদীতে নির্মাণ করেছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, ব্যারাজ, বাঁধসহ নানা স্থাপনা।
(প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাদের রংপুর অফিস এবং গঙ্গাচড়া ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি)