তারা ওই বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এক দিকে পানির অভাবে ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল, আবার অন্যদিকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিচ্ছে, এতে ভেসে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ। কৃষকের আবাদি ফসল ভাসিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে নদীভাঙন তো আছেই, প্রতিবছর লাখ কোটি টাকার ফসলের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’
ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, “গত ৫ আগস্ট একটি খুনি স্বৈরাচারী এই দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। এই স্বৈরাচার একটি কথা বলেছিল, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তা তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ এই ভারত শুধু স্বৈরাচার ও পলাতককেই মনে রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণকে তারা মনে রাখেনি। সে জন্য তিস্তাপারের বিক্ষুব্ধ মানুষের প্রশ্ন, পলাতক স্বৈরাচারকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া ভারত কি বাংলাদেশকে কিছু দিয়েছে? ৫ আগস্ট যে স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে, জোর করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে সে নিজেকে ভারতের সেবা দাসে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশন সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রেখেছিল। এখনো ফারাক্কা সমস্যার সমাধান হয়নি, তিস্তার চুক্তিও হয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে ওই পলাতক স্বৈরাচার আমাদের বন্দরগুলো ভারতকে ব্যবহারের একতরফা সুবিধা দিয়ে গেছে। ওই সব চুক্তিতে মিনিমাম ন্যায্যতা রক্ষা করা হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রয়োজনে অসম, অন্যায্য ও একতরফা যেসব চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এটি মূলনীতি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই নীতি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। বর্তমান বিশ্বে স্থায়ী শত্রু, স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই। বরং একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা, হবে ন্যায্যতা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সুতরাং সম্পর্ক রক্ষা করার ক্ষেত্রে নিজ দেশের ও জনগণের স্বার্থ রক্ষাই হতে হবে প্রথম এবং প্রধান অগ্রাধিকার।’
তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সীমান্তে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ আর দেখতে চায় না। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত মরদেহ মানুষ আর দেখতে চায় না। প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না দেয় বা দিতে যদি দেরি করে, অনীহা দেখায় তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে, কৃষককে বাঁচাতে, নদী বাঁচাতে আমাদেরই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে। দেশি ও অন্তর্জাতিকভাবে সব সম্ভাব্য বিকল্পকে কাজে লাগাতে হবে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের এই দাবি তুলে ধরতে হবে। একই ভাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কূটনৈতিকভাবে আলোচনা শুরু করতে হবে আবার। আর সময়ক্ষেপণ না করে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব পেলে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করব।’
পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের মানুষের সব ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে পলাতক স্বৈরাচার দেশে মাফিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এই পলাতক স্বৈরাচার সরকারের আমলে জাতীয় নির্বাচনকে খেল-তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। ভোট দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এই মাফিয়া পালিয়া যাওয়ার পর আবার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরকারের হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার ও তার দোসররা যেন পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কথা শুনলেই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা বিচলিত হয়ে পড়েন। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একেক উপদেষ্টার একেক বক্তব্য মাফিয়া পলাতকদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ সুগম করে দেয়। এ জন্যই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ বারবার জানতে চেয়েছে।’
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ স্থানীয় লাখো মানুষ।
এর আগে দিনভর তিস্তা নদীর পানিতে নেমে সাধারণ মানুষ ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাও’, ‘সিকিম না তিস্তা, তিস্তা তিস্তা’, ‘তিস্তা মেগাপ্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে। এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় ভারতের কাছ থেকে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তা মহা প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে মশাল প্রজ্বালন করা হয়। এরপর আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিল্পী দেশীয় গান পরিবেশন করেন।

এর পরও ভারত পানি না দিলে কঠোর আন্দোলন : তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর নদীভাঙন এলাকার মানুষজন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিস্তার লালমনিরহাট অংশ থেকে পদযাত্রায় অংশ নেয় অন্তত অর্ধলাখ মানুষ। তাতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে দুপুরে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লালমনিরহাটের তিস্তা রেল সেতুসংলগ্ন নদীতে নেমে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানায় ৫৩ বছরের ক্ষোভে দুঃখে থাকা বাস্তুহারা মানুষ।
রংপুর বিভাগ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘তিস্তায় দুই কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। বহমান তিস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু পানি নেই। তিস্তা মরুভূমি হয়ে গেছে। সোমবার বিভিন্ন কর্মসূচি এবং আজ (গতকাল) সকালের পদযাত্রায় আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করেছি। এখন আমরা তিস্তার পানিতে নেমে বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাই, আসলে তিস্তায় কোনো পানি নেই। আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়া হোক।’
বিএনপি জনগণের সমর্থন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে—আমির খসরু : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে সবার বাংলাদেশ, একটি দল বা গোষ্ঠীর বাংলাদেশ নয়। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই পাকার মাথায় তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আজকের এই দাবি আমাদের প্রাণের দাবি। আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়নীতির ন্যায্য দাবি। প্রতিটি দেশে এই ধরনের নদী যখন বিভিন্ন দেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানে এগুলো পরিচালনার জন্য সব কটি দেশের সমন্বয় হয় ও ব্যবস্থাপনা থাকে। তিস্তার সেই ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে। আজ আমাদের দাবি হচ্ছে সব ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে আনার দাবি। তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবি। এই দাবি পূরণ করতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার আজীবন চলতে পারে না—গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আজীবন চলতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা, চোখের ভাষা ও মনের ভাষা বুঝতে হবে। তাদের কত দিন থাকতে দেবে কি দেবে না, তাদের ডিসাইড করতে হবে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আগে একটা নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করার।’
গতকাল বিকেলে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে নদীর চরে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচির সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
পরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নীলফামারী জেলা বিএনপি আয়োজিত ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ হেলিপ্যাডের সমাবেশে বক্তব্য দেন। বিএনপির সভাপতি আলমগীর সরকারের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল আলম, সহসভাপতি মীর সেলিম ফারুক, মোস্তফা হক প্রধান, আহমেদ সাঈদ চৌধুরী, ডোমার উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেয়াজুল ইসলাম, ডোমার পৌর বিএনপির সভাপতি মো. আনিছুর রহমানসহ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী।
তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ভারত—মেজর হাফিজ : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম বলেছেন, ‘তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ভারত। এই পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। এই কথাটি অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকার বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে পারেনি। পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র সঠিক ভূমিকা নিয়েছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালে গঙ্গা নদীর পানি যখন তারা একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছিল, তখন তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি বাংলাদেশের দাবির কথা বলিষ্ঠভাবে উত্থাপন করেছিলেন। এ কারণে ভারত বাধ্য হয়েছে ১৯৭৭ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনে একটি চুক্তি করার জন্য।’
গতকাল মঙ্গলবার তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির দুই দিনের কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহিপুর তিস্তা সেতুর নিচে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
গাইবান্ধায় মশাল প্রজ্বালন করে তিস্তা বাঁচানোর দাবি : তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে উত্তরের পাঁচ জেলায় চলমান লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে উজ্জীবিত হয়ে দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্লোগানমুখর হয়ে ওঠে।
গতকাল মঙ্গলবার অবস্থান কর্মসূচির দিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর তিস্তা ব্রিজ পয়েন্টে রংপুরের তিস্তাপারের ১১টি পয়েন্টের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একযোগে মশাল প্রজ্বালন করা হয়। এ সময় ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবুল আহমেদ বলেন, ‘তিস্তা রক্ষা করা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আজকের এই মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচি সরকারের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া উত্তরবঙ্গের মানুষ চুপ করে থাকবে না। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে আমরা আরো কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছে রংপুর অফিস, আঞ্চলিক প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি, গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি ও গাইবান্ধা প্রতিনিধি)