নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়ার নানা দিক

মুফতি মাহমুদ হাসান
মুফতি মাহমুদ হাসান
শেয়ার
নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়ার নানা দিক
ছবি : সংগৃহীত

সালাত বা নামাজ হলো ঈমানের পরে ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। এর মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে তার রবের বিশেষ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। তাই নামাজ অবস্থায় বান্দার শরীর, কাপড় ও স্থান পরিপূর্ণ পাক-পবিত্র থাকা অত্যাবশ্যক। পবিত্রতা নামাজ আদায়ের পূর্বশর্ত।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমার ঘর পাক-সাফ রাখ তাওয়াফকারী, রুকু-সিজদা ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীদের জন্য।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৬)
নামাজের স্থান পবিত্র করার নির্দেশসংবলিত বহু প্রমাণ আছে। নিম্নে নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়ার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো :
জমি শুকালে বা তাতে বৃষ্টি পড়লেও পবিত্র হয়
জমি ও ছাদ ইত্যাদিতে নাপাক পড়ার পরে তা রোদ্রে বা বাতাসে শুকিয়ে নাপাকির চিহ্ন দূর হয়ে গেলে তা পাক হয়ে যাবে। আয়েশা (রা.), ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়া (রহ.), ইমাম মুহাম্মাদ (বাকের রহ.) প্রমুখ থেকে বর্ণিত, ‌‘জমিনের পবিত্রতা হলো তা শুকিয়ে যাওয়া।
’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৬২৪, ফাতহুল কদির ১/১৯৯)
তদ্রুপ নাপাক জমি কুপিয়ে নেওয়ায় নাপাকির চিহ্ন দূর হয়ে গেলেও জমি পাক বলে গণ্য হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, জনৈক বেদুইন অজ্ঞতাবশত মসজিদে পেশাব করে দেওয়ায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই জায়গা খনন করে নিতে বলেছেন। (দেখুন : মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৬৫৯)
অনুরূপ নাপাক জমিতে বৃষ্টি পড়ে নাপাকির চিহ্ন দূর হয়ে গেলেও পাক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সর্বাবস্থায়ই নাপাকির চিহ্ন অবশিষ্ট থাকলে জমি পাক হবে না।
(ফাতাওয়া কাজিখান ১/২৩, আদ্দুররুল মুখতার ১/৩১১)
প্রস্রাবে ভেজা নাপাক জুতা নিয়ে শুকনা জমির ওপর চলার কারণে যদি জমি ভিজে যায়, তাহলে জমি নাপাক হবে, অন্যথায় নাপাক হবে না। (রদ্দুল মুহতার ৬/৭৩৩)
পাকা মেঝে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছলেই পবিত্র হয়ে যায়
পাকা বা টাইলস বিছানো মেঝেতে শিশুরা প্রস্রাব করলে জায়গাটি ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলার দ্বারা প্রস্রাবের চিহ্ন ও দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেলে পাক হয়ে যাবে, তাতে নামাজ পড়াও বৈধ হবে। পানি ঢেলে ধোয়া আবশ্যক নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ১/৩১১, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৫/২৮৪)
নাপাক মেঝে শুকিয়ে পাক হওয়ার পর তাতে পানি পড়লে পুনরায় নাপাক হবে না, বরং পাক-ই গণ্য হবে। তদ্রুপ অজুর পরে ভিজা পায়ে তাতে হেঁটে গেলেও পা নাপাক হবে না।
(হালবি কাবির, পৃষ্ঠা ১৫৪, আলবাহরুর রায়েক : ১/৩৯৪)
গোবর দ্বারা লেপনকৃত স্থানে নামাজ পড়া
মাটি মিশ্রিত করে গোবর দ্বারা জমি লেপা হলে এমতাবস্থায় জমি শুকিয়ে গোবরের চিহ্ন ও দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেলে তা পাক হয়ে যাবে বিধায় তাতে নামাজ পড়া যাবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৬২, কাসেমিয়া ৫/৫৭৭)
নাপাক স্থানে বিছানা বিছিয়ে নামাজ পড়া
নাপাক স্থানে বিছানা বিছিয়ে নামাজ পড়া অবস্থায় বিছানা এমন মোটা হলে যাতে এপাশ-ওপাশ দেখা না যায় এবং নাপাকির প্রভাব বিছানায় প্রকাশ না পায়- তাতে নামাজ শুদ্ধ হবে। আর বেশি পাতলা হলে যার কারণে নাপাকি অনুভূত হয়, তাহলে নামাজ শুদ্ধ হবে না।
(রদ্দুল মুহতার ২/৭৪, কাসেমিয়া ৫/৫৭৮)
সেপটিক ট্যাংক, নাপাক নালা ইত্যাদির ছাদে নামাজ পড়া
সেপটিক ট্যাংক, নাপাক নালা ইত্যাদির ছাদের ওপর নামাজ শুদ্ধ হবে। কেননা ছাদ বা তার উপরিভাগ পাক, যদিও তার নিচে নাপাকির অবস্থান আছে। কোনো কোনো মসজিদের নিচতলায় বা এক পাশে টয়লেট ইত্যাদি থাকে, সেগুলোর ওপরতলায় নামাজের ব্যবস্থা থাকলে তাতে নামাজ পড়তেও কোনো অসুবিধা নেই।
(রদ্দুল মুহতার ২/৭৪)
কোনো স্থানের পাক-নাপাক না জানলে করণীয়
কোনো স্থানের পাক-নাপাক জানা না থাকলে তাতে নাপাকির কোনো চিহ্ন স্পষ্ট না হলে জমিটি পবিত্র বলে গণ্য হবে। সন্দেহবশত কোনো জমিকে নাপাক বলা যাবে না। জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার জন্য গোটা জমিকে নামাজের স্থান এবং পবিত্রকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাই আমার উম্মতের যেখানেই নামাজের সময় হবে সেখানেই নামাজ পড়ে নেবে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৫)
তদ্রুপ নতুন-পুরনো বিছানা-পাটি ইত্যাদিতে নাপাকির চিহ্ন না থাকলেই তাতে নামাজ পড়া যাবে। অহেতুক সন্দেহের প্রয়োজন নেই।
(আজিজুল ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা ১৯৩)
রাস্তাঘাটের কাদামাটি ও পানির বিধান
কোনো স্থানকে শুধু সন্দেহবশত নাপাক বলা যাবে না। নাপাকির ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পাক হিসেবেই বিবেচিত হবে। রাস্তাঘাটের আবর্জনাযুক্ত পানি ও কাদায় নাপাকির আলামত পরিলক্ষিত না হলে তা নাপাক বলে গণ্য হবে না এবং উক্ত পানির ছিটা শরীর বা কাপড়ে লাগলেও নাপাক হবে না। তবে নাপাকির চিহ্ন, রং বা দুর্গন্ধ অনুভূত হলে নাপাক বলা হবে। (রদ্দুল মুহতার ১/৩২৪)
মোটা কার্পেট নাপাক হলে পবিত্র করার পদ্ধতি
কার্পেটের কোনো অংশে নাপাক লাগলে শুধু ওই অংশই নাপাক হবে, পুরো কার্পেট নাপাক হবে না। তাই পাক করার জন্য ওই অংশে পানি ঢেলে এমনভাবে রেখে দেবে যাতে পানি সম্পূর্ণ ঝরে যায়। এভাবে তিনবার করলে কার্পেটটি পাক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, যদি একবারও এমনভাবে পানি ঢালা হয়, যাতে ওই নাপাকি দূর হওয়ার বিষয়ে ধৌতকারীর প্রবল ধারণা হয়ে যায়, তাহলে একবার ভালোভাবে ধোয়ার দ্বারাও পবিত্র হবে। আর গাঢ় নাপাক যেমন পায়খানা ইত্যাদি লাগলে ওই নাপাকির চিহ্ন ও দুর্গন্ধ দূর করে ফেললেই পাক হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার ১/৩১০)
যদি কার্পেটের বিভিন্ন স্থানে ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে এবং শুকিয়ে যাওয়ার কারণে প্রস্রাব পড়ার স্থান চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়, তখন অনুমান করে কার্পেটের সন্দেহযুক্ত অংশগুলো ধুয়ে ফেললে পুরো কার্পেট পাক হয়ে যাবে। তবে সম্ভব হলে পূর্ণ কার্পেটই ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নেওয়া উত্তম।
(রদ্দুল মুহতার ১/৩২৮, আহসানুল ফাতাওয়া ২/৯২)

লেখক : শিক্ষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার
বসুন্ধরা, ঢাকা

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭৪২
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘রাসুলকে আহ্বান করাকে তোমরা তোমাদের পরস্পরের প্রতি আহ্বানের মতো গণ্য কোরো না; তোমাদের মধ্যে যারা অলক্ষ্যে সরে পড়ে আল্লাহ তাদেরকে জানেন। সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা সতর্ক হোক যে বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর মর্মন্তুদ শাস্তি। জেনে রাখো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই। তোমরা যাতে ব্যাপৃত তিনি তা জানেন।

...

(সুরা : নুর, আয়াত : ৬৩-৬৪)

আয়াতদ্বয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. এ বিষয়ে সর্বযুগের সব আলেম একমত যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। আর তাঁর সম্মান হানি করা হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

২. স্মরণ ও সম্বোধনে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক।

৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নাম ধরে সম্বোধন করা শিষ্টাচার পরিপন্থী। উত্তম হলো তাঁকে আল্লাহর নবী, আল্লাহর রাসুল বা তাঁর উপনাম আবুল কাসেম দ্বারা সম্বোধন করা।

৪. আল্লামা আলুসি (রহ.) বলেন, উম্মতের জন্য নবীরা যেমন, কোনো গোত্রের জন্য আলেমরাও তেমন। তাই তাঁদের সম্মান করা সাধারণ মানুষের জন্য আবশ্যক।

৫. একইভাবে সন্তান মা-বাবাকে, শিক্ষার্থী শিক্ষককে, ছোট বড়কে স্মরণ ও সম্বোধনে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে।

(আল কোরআন তাদাব্বুর ওয়াল আমল : ১৮/১৯)

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

আল্লাহর জন্য জান-মাল উৎসর্গের পুরস্কার

সাআদ তাশফিন
সাআদ তাশফিন
শেয়ার
আল্লাহর জন্য জান-মাল উৎসর্গের পুরস্কার

আল্লাহর জন্য যেকোনো কিছু ত্যাগ করার মানসিকতা ঈমানের পরিচায়ক। মুমিন তার জীবন, সময়, সম্পদ সব কিছু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিতে ভালোবাসে। মহান আল্লাহ তাঁর ত্যাগী বান্দাদের ভালোবাসেন। কখনো কখনো তিনি তাঁর বান্দাদের ওপর ত্যাগকে ফরজ করে দেন।

তন্মধ্যে অন্যতম হলো, আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের ওপর লড়াইয়ের বিধান দেওয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২১৬)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে কোরো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিজিক দেওয়া হয়।

(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৯)

সুবহানাল্লাহ, তবে এত বড় পুরস্কার পাওয়ার জন্য মানুষের নিয়তও বিশুদ্ধ হতে হবে। লড়াইটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, মনগড়া পদ্ধতি কিংবা নিজের প্রভাব বিস্তার, সুনাম, সুখ্যাতির জন্য নয়। আবু মূসা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে যুদ্ধ কোনটি, কেননা আমাদের কেউ লড়াই করে রাগের বশবর্তী হয়ে, আবার কেউ লড়াই করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তিনি তার দিকে মাথা তুলে তাকালেন।

বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর মাথা তোলার কারণ ছিল যে, সে ছিল দাঁড়ানো। অতঃপর তিনি বলেন, আল্লাহর বাণী বিজয়ী করার জন্য যে যুদ্ধ করে তার লড়াই আল্লাহর পথে হয়।

(বুখারি, হাদিস : ১২৩)

এমনিভাবে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ ব্যয় করে, মহান আল্লাহ তাদের বহুগুণে নিয়ামত বাড়িয়ে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না? অথচ আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকারতো আল্লাহরই? তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে।

তবে আল্লাহ প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত। এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি বহুগুণে এটাকে বৃদ্ধি করবেন তার জন্য। আর তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ১১)

উল্লেখ্য, কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা লড়াই ছাড়াও দ্বিনের অন্যান্য কাজে ব্যয় করা, অভাবীর পাশে দাঁড়ানো, মুসাফিরের সহযোগিতা করা, পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা ইত্যাদিকেও আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ উৎসর্গ হিসেবে গণনা করা হয়। তাই আমাদের উচিত আমাদের জান-মালকে বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা সৃষ্টি করা।

 

 

মন্তব্য

উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
শেয়ার
উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান

৬৫৬ হিজরি মোতাবেক ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আরতুগ্রুলের ছেলে উসমানের জন্ম হয়। তাঁর দিকেই উসমানি সাম্রাজ্যের সম্বোধন করা হয়। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন, সে বছরই মঙ্গোলীয়রা হালাকু খাঁর নেতৃত্বে আব্বাসি খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে আক্রমণ করে। এটি ছিল মর্মান্তিক একটি দুর্যোগ।

এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, তারা শহরে আক্রমণ করে সেখানকার সব পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা, বৃদ্ধ, যুবক যাদেরই নাগালে পেয়েছে হত্যা করেছে। অনেকে কূপ, বন্য জন্তুদের আবাস এবং ভাগাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এভাবে তারা অনেক দিন আত্মগোপন করে থাকে। তারা একমুহূর্তের জন্যও বাইরে বের হতো না।
একদল লোক সেখানকার সরাইখানাগুলোতে দরজা বন্ধ করে আত্মগোপন করে; কিন্তু তাতারিরা সেগুলো ভেঙে আগুন লাগিয়ে তাদের বের করে নিয়ে আসে। এরপর লোকজন দূর-দূরান্তে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা মঙ্গোলীয়দের হাতে ধরা পড়ে। মঙ্গোলীয়রা তাদের খোলা ময়দানে পেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। রক্তে শহরের অলিগলির নালাগুলো ভরে ওঠে।
মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই অবস্থা দেখা গিয়েছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান আর তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনাকারী কিছু মুসলিম ছাড়া আর কেউই রেহাই পায়নি। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১৯২-১৯৩)

উম্মাহর সেই কঠিন ও দুর্যোগময় সময়ে উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের জন্ম হয়।

প্রথম উসমানের নেতৃত্বসুলভ গুণ

প্রথম উসমানের জীবন নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের সামনে তার ব্যক্তিত্বের কয়েকটি গুণ ভেসে ওঠে। যেমনতিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

তার সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও উল্লেখযোগ্য গুণাবলি হচ্ছে

বীরত্ব : ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের বুরুসা, মাদানুস, আদ্রানুস, কাত্তাহ, কাস্তালাহ প্রভৃতি অঞ্চলের খ্রিস্টান রাজারা উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান বিন আরতুগ্রুলের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দেয়। খ্রিস্টানরা এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দেয় এবং এই উঠতি সালতানাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ গ্রহণ করে। উসমান তাঁর সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে যান। যুদ্ধের ময়দানে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে তিনি ক্রুসেড যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাঁর বীরত্ব উসমানিদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে যায়। (জাওয়ানিবুল মুক্তিনগ্রাহ ফি তারিখিল উসমানিধিনাল আতরাক, পৃষ্ঠা-১৯৭)

হিকমত বা প্রজ্ঞা : স্বীয় গোত্রের নেতৃত্ব হাতে নেওয়ার পর তিনি ভেবে দেখলেন, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অবস্থান করা বুদ্ধির কাজ হবে। তাই তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও দুর্গ জয়ে সুলতানকে সাহায্য করেন। এর ফলে তিনি রোমের সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিনের দরবারে আমির হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।

(কিয়ামুদ দাওলাতিল উসমানিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২৫)

ঈমানি জজবা : বুরুসার অধিপতি ইকরিনুসের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর এই গুণের কথা জানা যায়। যুদ্ধ শেষে ইকরিনুস ইসলাম গ্রহণ করেন। সুলতান উসমান তাঁকে বেক উপাধি প্রদান করেন। এরপর তিনি উসমানি সালতানাতের প্রথম সারির সেনাপতিদের কাতারে পৌঁছে যান। অনেক কনস্টান্টিনোপলিয়ান সেনাপতি উসমানের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁরা উসমানের দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুকরণ করে উসমানি সালতানাতকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তখন অনেক মুসলিম সৈন্যদল উসমানি সালতানাতের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ছিল গাজিয়ারোম অর্থাৎ রোমের একদল যোদ্ধা। তারা আব্বাসীয় খিলাফতের সময় থেকে রোম সীমান্তে একতাবদ্ধভাবে অবস্থান করত এবং মুসলিমদের ওপর রোমীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করত।

আরেক দল ছিল ইখওয়ান অর্থাৎ ভাইদের দল। তারা মুসলিমদের সাহায্য করত এবং যোদ্ধাদের সেবা করার জন্য সৈন্যদলের সঙ্গে অবস্থান করত।

আরেক দল ছিল হাজিয়াতে রোম অর্থাৎ রোমের হাজিদের কাফেলা। ইসলামী ফিকহ নিয়ে কাজ করত আরেকটি দল। তারা শরিয়তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা করত।

(আত তারাজুযুল হাজারি ফিল আলামিল ইসলামি, ড. আলি আবদুল হালিম, পৃষ্ঠা-৩৩১-৩৩২)

ন্যায়পরায়ণতা : তুর্কি ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ৬৮৩ হিজরি মোতাবেক ১২৮৫ হিজরিতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কুরুহজাহ দুর্গ জয় করার পর আরতুগ্রুল তাঁর ছেলে উসমানের হাতে সে অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন। তখন উসমান তুর্কি মুসলিমদের বিপরীতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের শাসন করেছিলেন। এতে অভিভূত হয়ে এক খ্রিস্টান উসমানকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিভাবে আপনি আমাদের কল্যাণ সাধন করেন, অথচ আমরা আপনার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী?

উসমান জবাব দিয়েছিলেন, আমি কেন তোমাদের কল্যাণ কামনা করব না! আমরা তো আল্লাহর ইবাদত করি। তিনি আমাদের বলেছেন—‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার হকদারের কাছে পৌঁছে দাও এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসন করো। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

তাঁর এই ন্যায়পরায়ণতার কারণে লোকটি তার গোত্রসহ ইসলাম গ্রহণ করে। (জাওয়ানির মুক্তিয্যাজ, পৃষ্ঠা-৩৩)

 

মন্তব্য

ইসলামে মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর গুরুত্ব

মাইমুনা আক্তার
মাইমুনা আক্তার
শেয়ার
ইসলামে মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর গুরুত্ব

মুসলমান মুসলমানের ভাই। নবীজি (সা.) তাদের উপমা দিয়েছেন এক দেহের সঙ্গে। অর্থাৎ দেহের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন সারা দেহ জ্বরে আক্রান্ত হয়, তেমনি গোটা মুসলিম উম্মাহও তাদের কোনো মুসলিম ভাইয়ের বিপদে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। ইসলামের প্রতি মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের কিছু হক আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হক হলো, তাকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করা।

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, বারাআ ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (সা.) আমাদের সাতটি কাজ করতে বলেছেন এবং সাতটি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদের রোগীর সেবা করার, জানাজায় অংশ গ্রহণ করার, হাঁচি দিলে তার জবাব দেওয়ার, কসম পুরা করায় সহযোগিতা করার, মজলুমকে সাহায্য করার, সালামের বিস্তার করার এবং কেউ দাওয়াত দিলে তা কবুল করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি আমাদের নিষেধ করেছেন স্বর্ণের আংটি পরতে, রুপার পাত্র ব্যবহার করতে, ঘোড়ার পিঠের ওপরে রেশমি গদি ব্যবহার করতে এবং কাসসিয়া বা পাতলা রেশমি কাপড় এবং দ্বিবাজ ব্যবহার করতে। আবু আওয়ানাহ ও শায়বানী আশআস সূত্রে সালামের বিস্তারের কথা সমর্থন করে বর্ণনা করেন।
(বুখারি, হাদিস : ৫১৭৫)

তাই কোনো মুসলিম যেমন তার অন্য কোনো মুসলিম ভাইয়ের ওপর জুলুম করতে পারে না, তেমনি তাকে কোনো শত্রুর হাতে জুলুমের শিকার হতে দেখে বসে থাকতে পারে না। ঈমানের দাবি হলো, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো। তাকে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। কেননা নবীজি (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমান একজন অন্যজনের ভাই।

সে তার ওপর কোনো রকম জুলুম-অত্যাচার করতে পারে না এবং শত্রুর কাছেও তাকে সমর্পণ করতে পারে না বা তাকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দিতে পারে না। কোনো লোক তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটানোর কাজে যে পর্যন্ত লেগে থাকে, আল্লাহ তাআলাও তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। কোনো মুসলমান ব্যক্তির কোনো অসুবিধা যে লোক অপসারণ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তার অসুবিধাগুলোর মধ্য থেকে একটি অসুবিধা দূর করে দেবেন। কোনো মুসলমান ব্যক্তির

দোষত্রুটি যে লোক গোপন করে রাখে আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তার দোষত্রুটি গোপন করে রাখবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৪২৬)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও আবু ত্বালহা ইবনু সাহল আল-আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের মান-ইজ্জত নষ্ট হওয়ার স্থানে তাকে ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা হতে বিমুখ থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে।

আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের মান-ইজ্জত নষ্ট হওয়ার স্থানে তাকে সাহায্য করে আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য প্রত্যাশা করে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৮৭)

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রয়োজনে মজলুমকে রক্ষায় জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭৫)

জুলুমের শিকার মজলুমরা যেমন মহান আল্লাহর কাছে ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়, তেমনি তখন তাদের অপর মুসলিম ভাইরাও পরীক্ষায় থাকে, তারা তাদের মুসলিম ভাইদের সহযোগিতায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে আল্লাহ তা দেখেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সব! তোমরা তো অবশ্যই এই আয়াত তিলাওয়াত করে থাকো : হে ঈমানদাররা! তোমাদের নিজেদেরই কর্তব্য তোমাদেরকে সংশোধন করা। যদি তোমরা সৎপথে থাকো তাহলে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা তোমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১০৫) অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, মানুষ যদি কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচারে লিপ্ত দেখেও তার দুহাত চেপে ধরে তাকে প্রতিহত না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা অতি শিগগিরই তাদের সবাইকে তাঁর ব্যাপক শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৮)

নাউজুবিল্লাহ, অতএব, প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব নিজের সবটুকু নিয়ে মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ