খাদিজা আরসালান খাতুন

অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন যে রাজকন্যা

আলেমা হাবিবা আক্তার
আলেমা হাবিবা আক্তার
শেয়ার
অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন যে রাজকন্যা

সেলজুক রাজকন্যা খাদিজা আরসালান খাতুন ছিলেন একজন অতি দানশীল নারী। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে বহু কল্যাণমূলক কাজ করিয়েছেন। তিনি বাগদাদ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক মাদরাসা, মসজিদ, খানকা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সারা বছর মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।

মাহে রমজানে তাঁর দানের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।

তাঁর পুরো নাম খাদিজা বিনতে দাউদ বিন মিকাইল বিন সেলজুক। তিনি আরসালান খাতুন নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সেলজুক সালতানাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জুগরি বেগের কন্যা এবং সুলতান উলুপ আরসালানের বোন।

সুলতান মালিক শাহের ফুফি। সেলজুক রাজবংশে তাঁর অনন্য মর্যাদা ও প্রভাব ছিল।

১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের মহর ছিল এক লাখ দিনার।

এই বিয়ের মাধ্যমে উভয় রাজবংশের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সে সময় দুর্বল আব্বাসীয় খেলাফতের অবস্থা ছিল নিভুনিভু। তাই এই বিয়ের মাধ্যমে আব্বাসীয় খলিফা মূলত সেলজুকদের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। সেটা বাস্তবেও রূপ নিয়েছিল। ৪৫০ হিজরিতে ফাতেমিরা বাগদাদ দখল করে নেয় এবং খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহকে নির্বাসনে পাঠায়।
তখন সুলতান তুগরল বেগ তাঁকে ও তাঁর রাজত্ব উদ্ধার করেন। খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহ ৪২২ থেকে ৪৬৭ হিজরি পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ৪৬৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। খাদিজা আরসালান খাতুনের ছেলে মুহাম্মদ জাখিরাতুদ্দিন এবং নাতি আবদুল্লাহ আল মুক্তাদি বিআমরিল্লাহও পরবর্তী সময়ে খলিফা হন। অবশ্য প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেছিলেন।

খালিফা কায়িম বিআমরিল্লাহ ছিলেন একজন দ্বিনদার গুণী শাসক। আল্লামা ইবনুল আসির তাঁর সম্পর্কে লেখেন, তিনি ছিলেন সুন্দর চেহারা ও অবয়বের অধিকারী। তিনি একজন আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ, দ্বিনদার, ইবাদতগুজার শাসক ছিলেন। তিনি সারা বছর নিয়মিত রোজা রাখতেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। তিনি অধিক পরিমাণ দান করতেন। তিনি শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুন্দর হস্তলিপির অধিকারী ছিলেন। তাঁর কাছে চেয়ে কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। ৪৫১ হিজরিতে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর তিনি কখনো রাতে ঘুমাননি। সারা রাত তিনি নামাজ ও সিজদায় কাটাতেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, খাদিজা আরসালান খাতুন স্বামীর এসব গুণ নিজের ভেতর ধারণ করেছিলেন। স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতা তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল।

খাদিজা আরসালান খাতুন বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও হাসপাতালের বাইরে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য কূপ খনন করে মানুষের পানির কষ্ট দূর করেন। আধুনিক ইরানের ইয়াজদ অঞ্চলের দারায় এখনো তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ ও মিনার টিকে আছে।

তাঁর একটি জনকল্যাণমূলক কাজ ছিল মানুষকে নিয়মিত খাবার খাওয়ানো। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে আলেম-ওলামা ও জ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। পাশাপাশি দরিদ্র অসহায় মানুষের ভেতরও খাবার পরিবেশন করতেন, বিশেষত রমজানে খাদিজা আরসালানের দানশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। তিনি রমজান মাসে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন, আলেমদের সম্মানে বিশেষ মেহমানদারির আয়োজন করতেন। অসহায় ও দুস্থ মানুষকে দুই হাতে দান করতেন। ঈদুল ফিতরের দিন তিনি শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষকে নগদ অর্থ, খাবার ও পোশাক বিতরণ করতেন।

এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায়, আধুনিক ইরানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁর কবরকে শীতল করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র : আল বিদায়া ওয়ান

নিহায়া : ১৫/৭৩৪; আল কামিল ফিত

তারিখ : ৮/১৩৪; তারিখে ইবনে

খালদুন : ৩/৫৬৯; আল ওয়াফি বিলওয়াফিয়্যাত : ১৩/১৮৩।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব : ৭২২
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই নিষ্কৃতি পেত না এবং আল্লাহ দয়ালু ও পরম দয়ালু। হে মুমিনরা! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।

...  

(সুরা : নুর, আয়াত : ১৯-২১)

আয়াতগুলোতে অশ্লীলতা প্রসারের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।

 

শিক্ষা ও বিধান

১.  অশ্লীলতা যৌনতায় সীমাবদ্ধতা নয়, যেকোনো অন্যায় ও অনৈতিক কাজই অশ্লীল এবং তা বর্জনীয়।

২.  পাপ, পাপাচারের বিস্তার এবং পাপাচারবিষয়ক চর্চাসবই নিন্দনীয়। বিনা প্রয়োজনে পাপের সংবাদ প্রচার করাও অনুচিত।

এতে মানুষ পাপের উৎসাহ পায়।

৩.  আয়াতে মুমিনদের কথা বলা হয়েছে, তারা ঈমানের বিচারে শ্রেষ্ঠ বলে। নতুবা যেকোনো সমাজে পাপ ও অশ্লীলতার বিস্তার নিন্দনীয়।

৪.  যারা সমাজে অন্যায়, পাপাচার ও অশ্লীলতা ছড়ায় তাদের জাগতিক শাস্তি শরয়ি হদ।

আর পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন।

৫.  পবিত্র জীবন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ। তাই আল্লাহর কাছে পূতঃপবিত্র জীবনের প্রার্থনা করা আবশ্যক।

    (তাফসিরে আবু সাউদ : ৬/১৬৩)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

    পর্ব : ১৫
শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা তাহা

এই সুরায় মানুষের ওপর কোরআনের প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে কোরআন তাদের জন্য উপদেশ, যারা আসমান ও জমিনের রবকে ভয় করে। এরপর আল্লাহর সঙ্গে মুসা (আ.)-এর কথোপকথন বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। তাঁর লাঠি ও সাদা হাতের মুজেজা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাঁর ভাই হারুন (আ.)-কে তাঁর সহযোগী হিসেবে মনোনীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মুসা (আ.)-এর বাল্যকাল সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ফেরাউনের কাছে নম্র ভাষায় দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সুরায় কোরআনবিমুখদের বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
বলা হয়েছে যে যারা কোরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, মহান আল্লাহ তাদের পার্থিব জীবন সংকীর্ণ করে দেন। আর পরকালে তারা অন্ধ হয়ে উঠবে। এই সুরার শেষের দিকে বলা হয়েছে, দুনিয়ার জীবনকে সুশোভিত করা হয়েছে পরকালের পরীক্ষাস্বরূপ। কাফিররা দ্রুত আজাব চায়।
তাদের আজাবের অপেক্ষায় থাকার ধমকি দিয়ে এই সুরা শেষ করা হয়েছে।

 

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ ঐশী জ্ঞানের ধারকদের ক্ষমা করে দেবেন।

(আয়াত : ২-৩)

২. আল্লাহ ও তাঁর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তা কেমন, কিসের মতো ও কিসের সদৃশ জাতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াই নিরাপদ।

(আয়াত : ৫)

৩. শালীনতা নবীদের বৈশিষ্ট্য। এ জন্য মুসা (আ.) লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন।

(আয়াত : ১০)

৪. স্ত্রীর সুখ-স্বস্তির ব্যবস্থা করা স্বামীর দায়িত্ব। বিশেষত যখন সে গর্ভে সন্তান ধারণ করে।

(আয়াত : ১০)

৫. জুতায় নাপাকি থাকার ভয় থাকলে মসজিদে প্রবেশ ও নামাজের সময় তা খুলে রাখা ওয়াজিব।

(আয়াত : ১২)

৬. হাতে লাঠি রাখা নবী-রাসুলদের সুন্নত। মহানবী (সা.)-ও লাঠি ব্যবহার করতেন।

(আয়াত : ১৮)

৭. কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ভয় থাকলে বক্তার দায়িত্ব তা স্পষ্ট করা। (আয়াত : ২২)

৮. দ্বিনি কাজ সহজতার সঙ্গে করাই উত্তম।

(আয়াত : ২৬)

৯. সুযোগ থাকলে অধিকসংখ্যক মানুষকে দ্বিনি কাজে সঙ্গী করা উত্তম।

(আয়াত : ৩২)

১০. জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নবী-রাসুলদের পুরো জীবন আল্লাহর নিরাপত্তায় আবৃত থাকে।

(আয়াত : ৩৯)

১১. আল্লাহর জিকির ইবাদতের প্রাণ। তাই জিকিরে শিথিলতা নিন্দনীয়।

(আয়াত : ৪২)

১২. নাম লিপিবদ্ধ করার সময় মর্যাদায় অগ্রগামীদের নাম প্রথমে আনা উত্তম।

(আয়াত : ৪২)

১৩. সত্যের ধারক হয়েও বাতিলপন্থীদের কথা শোনা এবং আক্রমণ না করা নবীদের বৈশিষ্ট্য।

(আয়াত : ৫২-৫৩)

১৪. রাসুলুল্লাহ (সা.) লেখার মাধ্যমে জ্ঞান সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন।

(আয়াত : ৫২)

১৫. সমাবেশের জন্য এমন স্থান ও সময় নির্ধারণ করা উচিত যেন সহজে বেশি মানুষ সমবেত হতে পারে।

(আয়াত : ৫৯)

১৬. সম্মিলিত চিন্তা-ভাবনা ও প্রচেষ্টা লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। (আয়াত : ৬০)

১৭. শত্রুর প্রতিও কল্যাণকামিতা নবী-রাসুলদের বৈশিষ্ট্য।

(আয়াত : ৬১)

১৮. জীবন-জীবিকার ভয় দেখিয়ে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করা শাসকদের পুরাতন কৌশল।

(আয়াত : ৬৩)

১৯. জাদুবিদ্যা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা খেয়াল বা মনের বিভ্রম মাত্র। (আয়াত : ৬৬)

২০. খাঁটি ঈমানে পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হয়।

(আয়াত : ৭৩)

২১. মানুষের দ্বিনি অধঃপতনে আলেমরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হন।

(আয়াত : ৯৪)

২২. গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে সামাজিকভাবে বয়কট করার অবকাশ আছে।

(আয়াত : ৯৭)

২৩. কোরআন শেখার শিষ্টাচার হলো তাড়াহুড়া না করে প্রথমে পূর্ণ মনোযোগসহ শোনা। অতঃপর তা আত্মস্থ করা। (আয়াত : ১১৪)

২৪. পৃথিবীতে মানুষের জীবিকা পরিশ্রম ও কষ্টের ভিত্তিতে অর্জিত হয়। (আয়াত : ১১৮)

২৫. যে কোরআন মুখস্থ করে তা ভুলে যায়, কিয়ামতের দিন সে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। (আয়াত : ১২৬)

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

মন্তব্য
রমজান ঐতিহ্য

ইস্তাম্বুলে রোজা ও রমজান

আলেমা হাবিবা আক্তার
আলেমা হাবিবা আক্তার
শেয়ার
ইস্তাম্বুলে রোজা ও রমজান

রমজান হলো রোজা, ইবাদত ও কোরআনচর্চার মাস। রমজান এমন একটি পবিত্র মাস, যখন মুসলমানরা খাদ্য ও পানীয় এবং শরিয়ত নির্ধারিত বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করে এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়। রমজানে পাল্টে যায় মুসলিম জীবনের চিরায়ত ধারা। ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল নগরেও এই আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহপ্রেম ও পরিবর্তিত জীবনধারা চোখে পড়ে।

রমজান মাসে তুর্কি মুসলিমরা সাধারণত উসমানীয় সাম্রাজ্যের সময় গড়ে ওঠা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মেনে চলে। তাদের কাজে পুনরুজ্জীবিত হয় হারিয়ে যাওয়া মুসলিম ঐতিহ্য।

যারা ইস্তাম্বুলে রমজান উপভোগ করার সুযোগ পায় তারা প্রায়ই গণ-ইফতারের বড় বড় আয়োজন করে, রমজানের রাতে নাগরিক জীবনের কোলাহল এবং শহরের আলোকিত মসজিদগুলো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর বাইরে ইস্তাম্বুলের একটি লুকানো ঐতিহ্য রয়েছে, যা শুধু তারাই দেখতে পায় যারা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে।

ধর্মীয় বিধি-বিধানের বাইরে রমজানের যে একটি সামাজিক দিকও রয়েছে ইস্তাম্বুলে গেলে আপনি তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। বিশেষ করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের ভিড়ে জনসমাগম স্থান, পার্ক ও মসজিদের প্রাঙ্গণ পূর্ণ হয়ে যায়। শহরের কিছু বিখ্যাত স্থাপত্য যেমনআইয়ুপ সুলতান মসজিদ, সুলাইমানিয়া মসজিদ ও ব্লু মসজিদে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। অনেকেই শহরের সরবরাহকৃত গণ-ইফতারে যোগদান করে।

এই ইফতার আয়োজনগুলো থাকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। আপনি শুধু একটি আসন খুঁজে নিন এবং চালের সঙ্গে ছোলা, মাংসের একটি অংশ, আয়রান (বেশির ভাগ খাবারের সঙ্গে পরিবেশিত সতেজ দই পানীয়) এবং রমজান পিদের (মাসজুড়ে তৈরি একটি বিশেষ রুটি) মতো একটি সাধারণ তুর্কি খাবার উপভোগ করুন। প্রায় প্রতিটি আবাসিক এলাকা ও আশপাশে গণ-ইফতারের ব্যবস্থা থাকে, যাতে স্থানীয় লোকজন ইফতারি সরবরাহ করে। গণ-ইফতার তুর্কি আতিথেয়তা ও উদারতার দারুণ প্রমাণ।

এশার নামাজের সময় ঘনিয়ে আসতেই মসজিদে মুসল্লির ভিড় বাড়তে থাকে।

মানুষ দলবদ্ধভাবে তারাবির নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজ আদায়ের বিশেষ আগ্রহও দেখা যায়। উসমানীয় ঐতিহ্য অনুসারে প্রায় সব মসজিদেই আলোকসজ্জা করা হয়। এই আলোকসজ্জা রমজান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট করে। তারাবির নামাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের পরিবেশে আধ্যাত্মিক আবহ সৃষ্টি হয়। তবে ইস্তাম্বুলের সব মসজিদে খতম তারাবি হয় না। রমজান মাসের শুরুতে সরকার যেসব মসজিদে খতম তারাবি হবে সেই তালিকা প্রকাশ করে। অন্য মসজিদগুলোয় দ্রুত তারাবির নামাজ শেষ হয়ে যায়।

তারাবি শেষ হওয়ার পরে দোকান, রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেগুলো খাবার ও মিষ্টি সরবরাহ করে। প্রায় সারা রাত ইস্তাম্বুলের হোটেল ও ক্যাফেগুলো খোলা থাকে। ইস্তাম্বুলের কোনো এলাকায় একদল লোক ঢোল পিটিয়ে মানুষকে সাহরির জন্য ডেকে দেয়। তারা সুরে সুলে ঢোল পিটিয়ে মানুষ জাগিয়ে দেয়। এটা মূলত একটি উসমানীয় রীতি।

ইস্তাম্বুলের একটি অনন্য রমজান ঐতিহ্য মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি ও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িত। এই শহরে মাসজুড়ে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র চুল প্রদর্শন করা হয়, যা জনসাধারণের জন্য প্রিয় নবী (সা.)-এর ভালোবাসা ও বরকত লাভের একটি বিরল সুযোগ। ঐতিহাসিক এই নিদর্শন খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে বাগদাদ থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে এটি সুলতানদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধনভাণ্ডারের অংশ ছিল। পরবর্তী সময়ে তা জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়। অধিকসংখ্যক লোককে পবিত্র চুল স্পর্শ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য নিদর্শনগুলো এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে স্থানান্তরিত হয়।

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে যুক্ত আরেকটি ঐতিহ্য হলো তাঁর খিরকা বা আলখাল্লা দেখা। বিখ্যাত মুসলিম মনীষী উয়াইস আল কারনির (রহ.) বংশধররা যখন জনসাধারণের জন্য এই ধন উন্মুক্ত করেন, তখন থেকে এটি মাসজুড়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়।

তুরস্ক এখনো একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র। তাই দিনের বেলায় রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে খোলা থাকে। বিশেষ করে ইস্তাম্বুলে আসা অমুসলিম পর্যটকদের বিবেচনা করেই তা করা হয়। তবে যারা রমজানে ইস্তাম্বুলের প্রকৃত ও অন্তর আত্মাকে দেখতে চায় তাদের জন্য উত্তম হলো রাতের ইস্তাম্বুলকে প্রত্যক্ষ করা।

সিক্রেট ফুটস্টেপস অবলম্বনে

মন্তব্য

আবুধাবির গ্র্যান্ড মসজিদে বৃহত্তম ইফতার

মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
শেয়ার
আবুধাবির গ্র্যান্ড মসজিদে বৃহত্তম ইফতার
ছবি : দ্য ন্যাশনাল নিউজ

সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক মসজিদটি দেখতে যায়। পবিত্র রমজান মাসজুড়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে থাকে মুসল্লির উপচে পড়া ভিড়। প্রতিদিন হাজার হাজার মুসল্লির ইফতারের ব্যবস্থা থাকে এখানে।

শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ সেন্টারের তত্ত্বাবধানে আওয়ার ফাস্টিং ইনিশিয়েটিভ-এর আওতায় রমজান মাসজুড়ে ২১ লাখ প্যাকেটের বেশি ইফতারি বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে মসজিদ প্রাঙ্গণে সাড়ে ছয় লাখ এবং আবুধাবির বিভিন্ন স্থানে সাড়ে ১০ লাখ প্যাকেট ইফতারি বিতরণ করা হয়। তা ছাড়া রমজানের শেষ ১০ রাতে ৩০ হাজার জনকে সাহরি বিতরণ করা হয়।

গ্র্যান্ড মসজিদ আয়োজিত সুবিশাল ইফতার আয়োজনে অংশ নেন মিসরীয় নাগরিক মোহাম্মদ আবদুল হামিদ।

বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, এখানে এসে নিজ দেশে থাকার অনুভূতি তৈরি হয়; যেন আমরা নিজ পরিবার ও মানুষের মধ্যে রয়েছি। এমন উন্মুক্ত স্থানে ইফতার আমাদের মধ্যে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি তৈরি করে। বিশেষত বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে ইফতার উপভোগ করার অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ।

শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ সেন্টার জানিয়েছে, ২০২৪ সালে মসজিদটিতে ৬৫ লাখ ৮২ হাজার ৯৯৩ জন মুসল্লি ও পর্যটকের আগমন ঘটেছে।

এর মধ্যে ৮১ শতাংশই ছিল বিদেশি পর্যটক এবং বাকি ১৯ শতাংশ ছিল আমিরাতের। আর ৫২ শতাংশ পর্যটক ছিল এশিয়ার বিভিন্ন দেশের।

১৯৯৬ সালে  মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০০৭ সালে ঈদুল আজহায় মসজিদটি উন্মুক্ত করা হয়। প্রায় ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি মসজিদটির আয়তন পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার বর্গমিটার। এখানে একসঙ্গে ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ নামাজ পড়তে পারে।

এর ভেতরে রয়েছে ৮২টি সাদা মার্বেলের গম্বুজ, বাইরের এক হাজার ৯৬টি কলাম, ভেতরের ৯৬টি মণি খচিত কলাম এবং সাতটি ২৪ ক্যারেট স্বর্ণখচিত ঝাড়বাতি। বিশ্বমানের ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কর্মী মসজিদটি নির্মাণে কাজ করেছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের নামানুসারে মসজিদটির নাম রাখা হয়েছে। তিনিই এই মসজিদ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের স্থাপত্যবিষয়ক নির্দেশনা তাঁরই ছিল। ২০০৪ সালে তিনি মারা গেলে মসজিদ চত্বরে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র : গালফ নিউজ

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ