কবিতা থেকে গান করার প্রচলন ঠিক কবে শুরু হয়েছে, তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে সফল গান হিসেবে ধরতে গেলে ভাষা আন্দোলনের কথাই আগে সামনে আসে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমে শহীদ হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন তরুণ। তাঁদের স্মরণে কবিতা লিখলেন সে সময়ের ঢাকা কলেজের ছাত্র কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটিতে সুর দেন আবদুল লতিফ। এরপর গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতে শুরু করেন শিল্পীরা। অবশ্য ১৯৫৪ সালে এই গানে নতুনভাবে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। এটিই পরে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সেই থেকে কবিতা আর গান বিভিন্ন সময়ে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। ছুঁয়েছে মানুষের হৃদয়, ছড়িয়ে গেছে শহর থেকে গ্রামে। কখনো কবিতার এক-দুটি লাইন হয়ে উঠেছে গানের মূল আকর্ষণ, আবার কখনো পুরো কবিতাকে গানে রূপ দিয়েছেন শিল্পীরা। নগর বাউল জেমসের গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘তারায় তারায়’।
এটি মূলত কবি শামসুর রাহমানের ‘উত্তর’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত। প্রতিবাদের গান হিসেবে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ সবার প্রিয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। প্রথমে কবির ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এটিতে সুর দেন কবি নিজেই। কালের পরিক্রমায় এটি অনেক শিল্পীর কণ্ঠে প্রবাহিত হয়েছে।
একবিংশ শতকের অনেক শিল্পী কবিতা থেকে গান করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা সিরিজ ‘খুঁটিনাটি খুনশুটি’। এর ১৭তম কবিতাকে গানে রূপান্তর করেছেন মেহেদী হাসান নীল। ২০১৫ সালে নিজের ইউটিউব চ্যানেল থেকে গানটি প্রকাশ করেন তিনি। ‘এখনো আলো আসে, জানালা খোলা রাখি/পেছনে গান গায় খাঁচায় পোষা পাখি/’-গানটি শ্রোতামহলে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কবিতা থেকে গানের দুঃসাহসিক কাজ করেছেন আহমেদ হাসান সানি। ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যালবাম থেকেই কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে আসছেন তিনি। ২০১৬ সালে আসে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘মুক্তাঞ্চল’। সেখানে তিনি জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও আহমদ ছফার মতো গুণীদের কবিতায় সুর দিয়েছেন। এর মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ছফার লেখা ‘কে আর বাজাতে পারে’ ও শক্তির ‘আনন্দ ভৈরবী’। পরবর্তী সময়েও কবিতা নিয়ে গান করেছেন সানি। ২০২২-এ ‘হাতিরপুল সেশনস’ থেকে প্রকাশিত হয় সানির ‘শহরের দুইটা গান’। এগুলোর কথা নেওয়া হয়েছে আল মাহমুদের ‘আর আসব না বলে’ ও মুয়ীয মাহফুজের ‘ঝরুক সন্ধ্যা কদম্বতলে’ কবিতা থেকে। বর্তমানে কবি হাসান রোবায়েতের একটি কবিতাকে গানে রূপান্তরের কাজ করছেন এ শিল্পী।
কবি হেলাল হাফিজের কালজয়ী কবিতা ‘প্রস্থান’ একাধিক শিল্পীর সুরে প্রকাশ্যে এসেছে। ২০১৯-এ কবিতাটি গানে রূপান্তর করেছিলেন জাহিদ তানসেন। তবে জনপ্রিয়তা পায় তানজীর তুহিনের কণ্ঠে, ইমন চৌধুরীর সুরে। এটি প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘ফুল নেয়া ভালো নয় মেয়ে’ কবিতা থেকেও গান করেছেন ইমন। এটি গেয়েছেন তিনি নিজেই।
সংগীতশিল্পী লুৎফর হাসান নিজেও সাহিত্যিক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবেতেই তাঁর বিচরণ। অন্যের কবিতা থেকে তিনিও গান করেছেন। নির্মলেন্দু গুণের ‘সংসার’, কবি আল মাহমুদের ‘পাখি’, আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘বালিকা আশ্রম’, সোমেশ্বর অলির ‘ঘুড়ি’ আলফ্রেড খোকনের ‘মেঘরাষ্ট্র’, টোকন ঠাকুরের ‘মানুষ’, মারজুক রাসেলের ‘ঠিকানা’ কবিতাগুলো থেকে গান করেছেন লুত্ফর।
এ সময়ের সংগীতশিল্পী নাহিদ হাসানও কবিতাপ্রিয় মানুষ। ২০২২-এ কামরুল ইসলামের কবিতা ‘বিনায়ক’কে গানে রূপ দিয়ে প্রকাশ করেছেন তিনি। পরের বছর কবি রাকিবুল হায়দারের ‘শুনতে পাই’ কবিতাকে নিয়ে আসেন গানের উদ্যানে। একই কবির আরেকটি কবিতা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন শিল্পী।
এ ছাড়া আরো অনেকেই কবিতা থেকে গান করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘পুরো মানুষের গান’ কবিতায় সুরারোপ করেছেন বেলাল খান। গেয়েছেনও তিনি। গানটি ব্যবহৃত হয়েছে সোহেল রানা বয়াতির ‘নয়া মানুষ’ ছবিতে। অভিনেতা, লেখক আফজাল হোসেনের কবিতা ‘কবে ও কীভাবে’ থেকে গান করেছেন তানভীর তারেক। এটি প্রকাশিত হয়েছে গত বছর। ব্যান্ড ‘মেট্রোলাইফ’ গত বছর প্রকাশ করেছে ‘খতিয়ান’। গানটি একই শিরোনামে লেখা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা থেকে তৈরি করেছেন তাঁরা।