<p>মানবতাবোধ দ্বারা তাড়িত গতিশীল জীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে ছিল বহুমুখী মানবীয় গুণ। তিনি আজীবন নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখা ও সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মোহনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত এই মহানুভব মানুষটি মানবতার মহান উচ্চ আদর্শের প্রতি ছিলেন আজীবন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিবেদিতচিত্ত। তিনি সেবার উচ্চ আদর্শ তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। অদম্য প্রাণশক্তি, ইস্পাতকঠিন সংকল্প এবং সাংগঠনিক বিচক্ষণতার সঙ্গে শ্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যোগ্যতার মহামিলন ঘটেছিল এই বহুমুখী প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের বলয়ে। ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের মৃত্যু দিবসকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে।</p> <p>রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে অনেক দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সবারই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স চল্লিশের ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করে না; গাড়িতে চড়ে এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং বেশি ওজন এ রোগ বাড়তে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের—ক. ইনসুলিন নির্ভরশীল ও খ. ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।</p> <p>ডায়াবেটিক সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসা মানব সম্পদ তৈরির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বারডেম একাডেমি এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, আরভিটিসি ও বারটান গড়ে তোলেন। এরই সূত্র ধরে বা ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সমিতির ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ, নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি মেডিক্যাল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস), বারডেম নার্সিং কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চিকিৎসা ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিনি মনে করতেন, মানবিক গুণ ও সামাজিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান না থাকলে বা গড়ে না উঠলে কার্যকর ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিৎসা কার্যক্রমের শুরু থেকেই পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। তিনি মনে করতেন ডায়াবেটিক রোগী তার লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অর্ধেক চিকিৎসা শেষ। উপযুক্ত পরামর্শ পেলে খাদ্যমান বজায় রাখা এবং শৃঙ্খলা সহজসাধ্য হয়। ওষুধপত্র দেওয়ার সঙ্গে রোগীকে খাদ্যের তালিকা—কোন খাদ্যে কী পরিমাণ শর্করা ও ক্যালরি/প্রোটিন আছে তার একটা সচিত্র স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। গাইড বইয়ে প্রত্যেক রোগীর কী ধরনের খাবার কী পরিমাণ খেতে হবে তার নির্দেশনা চার্ট দেওয়া আছে। সমিতির প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হেলথ এডুকেটরের পদ রয়েছে এবং রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।</p> <p>ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সঙ্গে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মানে দুঃখীর অন্তর্নিহিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবাদানে মনোনিবেশ করতে হবে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সে সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে ।</p> <p>লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিল সদস্য</p>