ডায়াবেটিক সেবা দিবস

  • ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
ডায়াবেটিক সেবা দিবস

মানবতাবোধ দ্বারা তাড়িত গতিশীল জীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে ছিল বহুমুখী মানবীয় গুণ। তিনি আজীবন নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখা ও সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মোহনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত এই মহানুভব মানুষটি মানবতার মহান উচ্চ আদর্শের প্রতি ছিলেন আজীবন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিবেদিতচিত্ত।

তিনি সেবার উচ্চ আদর্শ তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। অদম্য প্রাণশক্তি, ইস্পাতকঠিন সংকল্প এবং সাংগঠনিক বিচক্ষণতার সঙ্গে শ্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যোগ্যতার মহামিলন ঘটেছিল এই বহুমুখী প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের বলয়ে। ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের মৃত্যু দিবসকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে।

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে অনেক দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়।

সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সবারই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না।
এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স চল্লিশের ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করে না; গাড়িতে চড়ে এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং বেশি ওজন এ রোগ বাড়তে সাহায্য করে।
এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের—ক. ইনসুলিন নির্ভরশীল ও খ. ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।

ডায়াবেটিক সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসা মানব সম্পদ তৈরির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বারডেম একাডেমি এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, আরভিটিসি ও বারটান গড়ে তোলেন। এরই সূত্র ধরে বা ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সমিতির ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ, নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি মেডিক্যাল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস), বারডেম নার্সিং কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চিকিৎসা ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিনি মনে করতেন, মানবিক গুণ ও সামাজিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান না থাকলে বা গড়ে না উঠলে কার্যকর ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিৎসা কার্যক্রমের শুরু থেকেই পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। তিনি মনে করতেন ডায়াবেটিক রোগী তার লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অর্ধেক চিকিৎসা শেষ। উপযুক্ত পরামর্শ পেলে খাদ্যমান বজায় রাখা এবং শৃঙ্খলা সহজসাধ্য হয়। ওষুধপত্র দেওয়ার সঙ্গে রোগীকে খাদ্যের তালিকা—কোন খাদ্যে কী পরিমাণ শর্করা ও ক্যালরি/প্রোটিন আছে তার একটা সচিত্র স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। গাইড বইয়ে প্রত্যেক রোগীর কী ধরনের খাবার কী পরিমাণ খেতে হবে তার নির্দেশনা চার্ট দেওয়া আছে। সমিতির প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হেলথ এডুকেটরের পদ রয়েছে এবং রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সঙ্গে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মানে দুঃখীর অন্তর্নিহিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবাদানে মনোনিবেশ করতে হবে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সে সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে ।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিল সদস্য

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি

    ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল হয়ে উঠেছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থলও এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এই অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক কৌশলের ওপর উভয় দেশের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

এই অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা মূলত দক্ষিণ চীন সাগর সংকট, তাইওয়ান সংকট, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (IPS) -কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। চীন তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে চীনের সম্প্রসারণবাদ প্রতিহত করতে চায়। ফলে এই অঞ্চল একটি সম্ভাব্য সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

দক্ষিণ চীন সাগর কৌশলগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীন দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে স্প্রাটলি ও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে চীন, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর একদিকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বিদ্যমান। চীন দাবি করে যে প্রায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগর তাদের অঞ্চলভুক্ত, যা নাইন ড্যাশ লাইন নামক একটি ঐতিহাসিক দাবির ওপর ভিত্তি করে।
তবে এই দাবির বিরোধিতা করে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও ইন্দোনেশিয়া। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালত চীনের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করলেও চীন তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির মাধ্যমে তার শক্তি প্রদর্শন করছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ফ্রিডম অব নেভিগেশন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে চীনের আধিপত্য প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চীনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা দেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও মার্কিন সমর্থনের দিকে ঝুঁকছে, তবে তারা চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়েও সচেতন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতিতাইওয়ান ইস্যুটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনীতির অন্যতম প্রধান অগ্নিগর্ভ বিষয়। তাইওয়ান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর একটি। চীন তাইওয়ানকে তাদের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখে এবং একীভূত করার ঘোষণা দিয়েছে, যদিও তাইওয়ান কার্যত স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের মতো পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এক চীন নীতি মেনে চললেও তারা তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। সম্প্রতি চীনের সামরিক মহড়া ও তাইওয়ানের চারপাশে নৌ ও বিমান শক্তির প্রদর্শন দ্বীপটির নিরাপত্তার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে যে তারা তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। এর ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড বা অবর (OBOR)  উদ্যোগটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম প্রধান কৌশল। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনের প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ চীনের অবর প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেলেও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবরের মাধ্যমে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, বিশেষ করে বন্দর, সড়ক ও রেল প্রকল্পে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, লাওসসহ একাধিক দেশে চীনের প্রকল্প চলছে। তবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন করেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, অবর প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তাদের প্রতি দেশগুলোর নির্ভরশীলতা তৈরি করছে, যা কিছু ক্ষেত্রে ঋণের ফাঁদ সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কারণ তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি এটি সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (IPS)  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি চালু করেছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করা। যুক্তরাষ্ট্র জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াড (QUAD) নামে একটি কৌশলগত জোট গঠন করেছে, যা মূলত চীনবিরোধী একটি উদ্যোগ। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন—‘ব্লু ডট নেটওয়ার্ক নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে, যা ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে এবং কোনো এক পক্ষের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে না। এই কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা গভীর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে এবং চীনের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত ব্যূহ গঠনের চেষ্টা করছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের চেষ্টা করছে। আসিয়ান (ASEAN) জোট এ বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, তবে বাস্তবতা হলো প্রতিটি দেশ নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে তারা চীনের ওপর নির্ভরশীল আবার নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে ফিলিপিন্সের বিরোধ থাকলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। তবে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো পুনরায় সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত ফিলিপিন্সের যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতারই ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে, কিন্তু সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। আবার ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া চীনের অবর প্রকল্প থেকে লাভবান হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বজায় রাখছে।

চীন-মার্কিন সম্পর্কের অন্যতম প্রধান দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করেছে, যা চীনের অর্থনীতিকে কিছুটা চাপে ফেলেছে। তবে চীনের প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে দেশটি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে; যদিও ট্রাম্প চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তথাপি কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে চীনের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে। দক্ষিণ চীন সাগর সংকট, তাইওয়ান ইস্যু, ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলএসব বিষয়ই দুই পরাশক্তির মধ্যে ভবিষ্যতে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আসিয়ান ও অন্যান্য কৌশলগত সংলাপের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক

সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে

দারিদ্র্য যদি খুঁজি তা-ও আছে, অসাম্য খুঁজলে তা-ও। আমাদের সংস্কৃতিতে এই দুই উপাদানের কোনো অভাব নেই। এবং দারিদ্র্য ও অসাম্যকে এমনিতে যতটা পরস্পর নিকটবর্তী মনে হয়, আসলে তারা তার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ। বললে ভুল হবে না মোটেই যে অসাম্যই দারিদ্র্যের মূল কারণ।

অসাম্য যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে ধনীতে ও দরিদ্রে, শহরে ও গ্রামে, শিক্ষিতে ও অশিক্ষিতে, সেই বিভেদই দারিদ্র্য সৃষ্টির জন্য দায়ীকি অর্থনীতিতে, কি সংস্কৃতিতে, যেমন মূল কাঠামোতে, তেমনি ওপরকাঠামোতে। অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের পক্ষে সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের কারণ হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধক নেই। এ কথাও অবশ্যি সত্য, টাকা হাতে এলেই যে সংস্কৃতিতে উৎকর্ষ আসবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, মধ্যপ্রাচ্যের তেল-ধনী কোনো কোনো দেশ এ বিষয়ে সরলরৈখিক সমীকরণ টানার বিপক্ষে রায় দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেতে হবে কেন, আমাদের হাতের কাছেই হঠাত্-ধনী পরিবার খুঁজলে পাওয়া যাবে, যারা ওপরে যত বেড়েছে, হৃদয়ে তত বাড়েনি।
না, টাকা থাকলেই রুচিবান হওয়া যায় না, কিন্তু বিপরীত পক্ষে আবার টাকা না থাকলে রুচিও বেঁচে থাকে না, কিছুই থাকে না। কেবল খাওয়ার জন্য মানুষ বাঁচে না বটে, তবে বাঁচতে হলে খেতেই হয়।

কিন্তু এ আলোচনার প্রারম্ভেই বোধ করি বলে নেওয়া আবশ্যক যে সংস্কৃতি কোনো সংকীর্ণ অর্থে বিবেচনা করছি না আমরা। সংস্কৃতি বলতে সুকুমার শিল্পের চর্চাকেই শুধু বোঝানো হচ্ছে না, বরং চিন্তা-চেতনার প্রকাশগুলোকেই ধরা হচ্ছে, যাদের মধ্যে সুকুমার শিল্পগুলো থাকবে তো বটেই, কিন্তু কেবল তারাই থাকবে না, সঙ্গে আপন আপন দাবি নিয়ে থাকবে ভাষা ও সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান, থাকবে শিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলন।

আসলে সংস্কৃতি হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনে মানুষের যে প্রয়াস, তারই বহিঃপ্রকাশ। এই প্রয়াসে আনন্দ আছে, বেদনা আছে। এর অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে চিন্তাধারা। এই প্রয়াসে পরিবেশ ও প্রকৃতি যেমন বদলায়, তেমনি মানুষ নিজেও যায় বদলে।

সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নেযদি সংস্কৃতির বিভিন্ন এলাকায় আলাদাভাবে চোখ দিই, তবে দেখা যাবে দারিদ্র্য ও অসাম্য, তারা নানাভাবে নানারূপে কাজ করে যাচ্ছে।

আসলে আমাদের এই আলোচনা সেই দৃষ্টিপাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। সিদ্ধান্তটা যদি আগে থেকেই দিয়ে দেওয়া হয় সে শুধু এই কারণে যে এ কোনো গোপন ব্যাপার নয়, এর মধ্যে লুকোচুরি নেই। সত্যটা সামান্যই, অসামান্য সত্যের কার্যকারিতা, কর্মদক্ষতা ও সর্বত্র বিরাজমানতা।

২.

আমাদের এই অঞ্চলে ভাষা সব সময়েই একটি বড় সমস্যা। তার একটি প্রধান কারণ বেশির ভাগ মানুষই অশিক্ষিত এখানে। অশিক্ষিতজনের কোনো ভাষা নেই, এক আর্তনাদ এবং ক্বচিত্-কখনো হুংকার ছাড়া। কিন্তু শিক্ষিতজনের মধ্যেও ভাষার সমস্যা বারবার দেখা গেছে, অত্যন্ত কিম্ভূত, নিতান্ত কুৎসিত আকারে। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা আগে কখনোই ছিল না। শাসক ও শাসকের সহযোগী শ্রেণি সংস্কৃতের চর্চা করেছে কখনো, কখনো ফারসির, তারপর ইংরেজির, এমনকি সেবা করতে চেয়েছিল উর্দুরও। নিকট অতীতেও ইংরেজির প্রবল প্রাদুর্ভাব ছিল। দুইবার স্বাধীন হওয়ার পরও ইংরেজির চল কমেনি, বাড়ছেই বরং দিনকে দিন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে শপথ নিতে হয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের। সে শপথ পরের দিনই বিলীন হয় বিস্মৃতির গহ্বরে। বলা বাহুল্য, এর কারণটা খুবই স্পষ্ট। ইংরেজ গেছে, আমেরিকা এসেছে, সাম্রাজ্যবাদ ঘটা করে চলে গেল নতুন করে, আরো প্রবলভাবে ফিরে আসার জন্য।

আজ দুর্ভাগা বাংলাদেশের সর্বত্র বিদেশের উপস্থিতি, তার পুঁজি আসছে বিদেশ থেকে, আসছে ঋণ, দান, অনুদান সাহায্য। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পানির মাছ, হবে মনে হয় মাটির নিচের গ্যাস, ওপরের আকাশ। যুগ-যুগান্তরের জন্য বন্ধক রাখা হয়ে গেছে আমাদের ভবিষ্যত্। যার গায়ের জামায়, মুখের ভাষায়, মেধার রেখায় যত বেশি বিদেশের ছাপ, সে-ই তত বেশি মহত্ এ দেশে। তেমন অবস্থায় বাংলা কেন চলবে? না, চলে না। সমাজের অধিপতি শ্রেণি বাংলা চর্চা করে না। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা, না উর্দুএই মর্মান্তিক বিতর্ক একদিন উঠেছিল। আজও উঠতে পারে নতুন এক বিতর্কবাঙালির মাতৃভাষা বাংলা, নাকি ইংরেজি? উচ্চশিক্ষিত বাঙালির প্রধান অংশটাই বাংলাচর্চায় যেমন অনভ্যস্ত, তেমনি অনাগ্রহী। এমনকি যে বাঙালি বাংলা ব্যবহার করে, তারও বাক্যের মধ্যে ইংরেজির অনুপ্রবেশ ক্রমবর্ধমান। কারণ এই শ্রেণির মধ্যে উদগ্র লালসাটা হলো যেকোনো পথে হোক, যেকোনোভাবেই হোক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এরা উপগ্রহ, গ্রহের আলোকেই আলোকিত। এটা একদিক। অন্যদিকে এই শ্রেণি দেশের ব্যাপক জনসাধারণের সঙ্গে নিজের দূরত্বটাকে যেভাবে পারে, যতটা পারে বজায় রাখতে চায়। সে ক্ষেত্রেও ভাষা মানুষের সহায়ক বটে। ভাষা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভাষা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ইংরেজি আসছে বিচ্ছিন্নতার তথা আভিজাত্যের স্মারক চিহ্ন হিসেবে। যেমনএককালে ফারসি এসেছিল, তার আগে এসেছিল সংস্কৃত। আবির্ভাব হয়েছিল উর্দুরও। ফস করে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, বাংলা ভাষাটা তাহলে কোথায় আছে? বলা যাবে সে আছে সাধারণ মানুষের জীবনে। এ দেশের সাধারণ মানুষ অসাধারণরূপে বিপন্ন, কিন্তু সেই বিপন্ন মানুষই বিপন্ন ভাষাকে রক্ষা করছে, মা যেমন রক্ষা করেন আপন শিশুকে। বিদেশিরা বারবার এসেছে এ দেশে, এসে শাসন করেছে দেশ, তাদের তাঁবেদার শ্রেণি শাসকদের ভাষাকেই নিজেদের ভাষা হিসেবে সানন্দে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ওই অসিলাটা পায়নি, তারা থেকেছে নিজস্ব অন্ধকারে, যায়নি দালালির পথে, হয়নি বেনিয়া-ফড়িয়া কিংবা আমলা। তাদের ভাষা সব যুগেই স্বদেশি ভাষা। এমনকি বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও সফল হতো না (যতটা হয়েছে) যদি না সাধারণ মানুষ নিজেদের নতুনভাবে বিপন্ন করে এগিয়ে এসে যোগ দিত লড়াইয়ে।

মাতৃভাষা চর্চাই যদি দেশপ্রেমের সবচেয়ে অকৃত্রিম ও নির্ভরযোগ্য নিরিখ হয়, তাহলে এ দেশের শ্রমিক-কৃষকই যে সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, সেই বিষয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকে না; শ্রমিকের চেয়েও উচ্চস্থান কৃষকের। বিদেশ কৃষককে ছুঁয়েছে সবচেয়ে কম। যে শ্রেণি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি, সেই একই শ্রেণি যে সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, এ ঘটনা তাৎপর্যবিহীন নয়।

কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের সত্যি কোনো ভাষা আছে কি? সেও তো একটি মর্মান্তিক প্রশ্ন। শ্রমজীবী মানুষেয় জীবনটা ছোট শিশুর জীবনের চেয়েও সংকীর্ণ। কেননা তাতে শিশুর হ্রস্বত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু শিশুর কল্পনাটা নেই। যেন আজন্ম বৃদ্ধ সে, লোলচর্ম। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন-আতঙ্কে জড়সড়। না, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতো ভাষাহীন প্রাণী খুঁজে পাওয়া ভার। বিষয়ীর সঙ্গে বিষয় এখানে এমন গলাগলি, ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে যে সাধ্য কি সেখানে ভাষা প্রবেশ করে, অন্তঃপ্রবিষ্ট হয় বস্তুজ্ঞান অথবা তত্ত্বচিন্তা। বিশেষ্যকে সেখানে ছাপিয়ে ওঠে বিশেষণ। তাই যদি হয়, কেমন করে তাহলে বলব যে সাধারণ মানুষের অতিসংকীর্ণ জীবনে ভাষা আছে? না, এক অর্থে ভাষা নেই। আর এখানেই আরেকটি মর্মান্তিকতা, যাদের মুখে ভাষা নেই, ভাষা রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হচ্ছে। এ অবশ্যি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয় আমাদের দেশে। এখানে উৎপাদন যে করে, উৎপাদিত পণ্য সে ভোগ করে না, এখানে দরিদ্রই দরিদ্রকে সাহায্য করে এবং দরিদ্রই ধনীকে বাঁচায়।

উচ্চবিত্তদের জীবনে বাংলার চলনটা কম। বিত্তের উচ্চতা ও বাংলার ব্যবহার বিপরীত অনুপাতে চলে। এই বৈপরীত্য বাড়ছে বৈ কমছে না। আমাদের উচ্চবিত্তদের জগত্ এত বেশি উদার ও বৃহত্, সাহসী ও বিকাশপ্রিয় যে তারা ও বিত্তহীনরা যে একই দেশের মানুষ, তা ভাবলে যে ধাঁধা লাগে না তার কারণ আমরা এ বিষয়ে ভাবিই না। এদের জগত্ মোটামুটি আন্তর্জাতিক, আর আন্তর্জাতিক মানে বাংলার উচ্চমূল্য নির্ধারণ সহজ কাজ নয়।

মাঝখানে মধ্যবিত্ত, তার জীবনে বাংলার চল উচ্চবিত্তের চেয়ে বেশি, কিন্তু বিত্তহীনের তুলনায় কম। মধ্যবিত্ত চিরকালই অসন্তুষ্ট, এ ক্ষেত্রেও তার স্বাভাবিক অসন্তোষ বিদ্যমান। সে অসন্তুষ্ট উচ্চবিত্ত থেকে সে যথেষ্ট দূরের বলে, অর্থাত্ কিনা যদৃচ্ছা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারে না দেখে এবং অন্যদিকে আবার অসন্তুষ্ট নিম্নবর্তী শ্রেণির যথেষ্ট নিকটবর্তী বলে, অর্থাত্ কিনা বাংলা বহুল পরিমাণে ব্যবহার করতে হয় দেখে। ব্যাপারটা এমন স্পষ্ট নয়, কিন্তু অস্পষ্টভাবে হলেও ব্যাপারটা এই রকমই।

আমরা বলে থাকি, বাংলা চলছে না। কথাটির অর্থ কী? একটি অর্থ, অফিস-আদালতে চলছে না; শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় চলছে না। অফিস-আদালতে বাংলা চলবে, বাংলা ছাড়া আর কিছুই চলবে না, এই রকম হুকুম থেকে থেকে জারি হয়, কিন্তু এই ভীতির দেশেও অফিসের কলম দেখা যাচ্ছে বেশ নির্ভীক, ইংরেজিই লেখে সে নির্ভয়ে। এমনকি ভুল লিখলেও। কিন্তু না হয় ধরেই নিলাম আমরা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে সত্যি পৌঁছে গেলাম, বাংলা ছাড়া আর কোনো ফাইলই চলছে না, কিন্তু সেই চলমানতায় কি লিখিত বাংলা ভাষা সর্বত্র চলে যাবে, পৌঁছে যাবে দীনদরিদ্র, অশিক্ষিত, অখ্যাতজনের কুঁড়েঘরে। অক্ষরজ্ঞান কি সবার আছে, সবার কি সামর্থ্য আছে বই কিনবে, কিনে পড়বে?

কিন্তু অফিসে-আদালতে এবং উচ্চশিক্ষায় বাংলা চালু হয়ে যাবে এই কল্পনাটাও আপাতত আকাশকুসুম বটে। প্রথম সত্য এই যে আমাদের বিদেশনির্ভরতাকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে বাংলা ভাষাকে আমরা

যথোপযুক্তরূপে এমনকি অফিসে-আদালতেও চালু করতে পারব না, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো নয়ই। টাকা যেখান থেকে আসে, ভাষাও সেখান থেকেই আসবে। টাকাই আসলে কথা বলে, অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে ওঠে তার গলার স্বর। সামাজিক বীররা বাংলা বলেন না বা যত কম বলেন, ততই বেশি পরিমাণে বীরের মর্যাদা পানএই দৃশ্য আমরা অতীতে দেখেছি, ভবিষ্যতেও দেখতে থাকব, যদি না হঠাত্ করে সামাজিক বিপ্লব ঘটে যায়। দ্বিতীয়ত, অফিসে-আদালতে বাংলা চলছে, বাংলা ছাড়া আর কিছুই চলছে নাএই লোমহর্ষক ছবি দেশবাসীর জন্য বৈপ্লবিক কোনো মঙ্গল আপনা থেকেই বয়ে নিয়ে আসবে এমনও তো ভরসা হয় না। জেল-ফাঁসি তো মস্ত ব্যাপার, জরিমানার কথাটাই যদি ইংরেজিতে না এসে বাংলায় আসে, তাহলে আমরা যে আহ্লাদে একেবারে আটখানা হব এমন তো ভরসা রাখি না। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু সবই সমান তখন আমাদের কাছে। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেব কী করে? পাঠ্যপুস্তক কোথায়? কোথায় পরিভাষা? কে করবে অনুবাদ? এই সমস্ত উত্তেজিত প্রশ্নের অভ্যন্তরে আছে একটি শান্ত সিদ্ধান্ত, পাঠ্যপুস্তক দেশে লেখা হবে না, তাকে আনতে হবে বিদেশ থেকে, তার বিষয়বস্তু আপাদমস্তক বিদেশি, আবরণটাই শুধু স্বদেশি। ওইটুকুই। উচ্চশিক্ষা সব দিক দিয়েই বিদেশমুখো এবং বিদেশে তো বাংলার চল নেই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়নে দুই জিয়ার অবদান

    সাঈদ খান
শেয়ার
নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়নে দুই জিয়ার অবদান

অগণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে জনগণকেই করেছেন ক্ষমতার উৎস এবং জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি গ্রহণ করেছেন নানা গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, যেগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেনতিনিই হলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

দেশের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির সব দিককে একীভূত করে একটি ঐতিহ্যবাহী ও সংহত জাতীয় পরিচিতি হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মতে, ভাষা যদি একটি ফুল হয়, ধর্ম আরেকটি ফুল, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধের নানা ফুল নিয়ে যে তোড়া বেঁধেছিএটিই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তাঁর এই ধারণা ছিল জাতির সব স্তরের মানুষকে একত্র করার শক্তিশালী রসায়ন, যা আজও দেশবাসীকে একসঙ্গে থাকার প্রেরণা জোগায়।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ছিল সমানাধিকার ও উন্নয়নের দর্শন। দেশের মানুষের জন্য একটি আত্মনির্ভরশীল ভবিষ্যতের চিত্র এঁকেছিলেন তিনি।

তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয় যদি সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে। আমাদের দেশের প্রতিটি সেক্টরকে আত্মনির্ভরশীল করতে হবে, তবেই আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে পারব।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছেন। তিনি নারীদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। স্বাধীনতার পর নারী উন্নয়নে তেমন উদ্যোগ না থাকলেও তাঁর নেতৃত্বে তা নতুন মাত্রা পায়। তিনি নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, কিন্তু তারা শিক্ষা, অর্থনীতি ও সমাজে পিছিয়ে রয়েছে। জাতির অর্ধেক অংশ পিছিয়ে থাকলে তার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি থেকে তিনি নারী উন্নয়নে বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচিতে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়।

১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে নারী বিষয়ক দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৭৮ সালে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এ রূপান্তরিত হয়। নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন পাস হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়। নারী পুলিশ বাহিনী গঠন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়নে দুই জিয়ার অবদানঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেন। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৯০ শতাংশ নারী, যা তাঁর দূরদর্শিতার ফল।

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ১৯৭৮ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করা হয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। গ্রাম সরকার ব্যবস্থায় ১১ সদস্যের মধ্যে দুটি পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

শিক্ষাক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ব্যাপক সংস্কার করেন। ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়, যা ১৯৭৯ সালে অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ পেশ করে। কারিগরি, কৃষি ও চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার অধীনে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি বিদ্যালয় ছিল। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যা পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমবাজারের ভিত্তি গড়ে তোলে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ১৯৮০ সালে সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করা হয়। ১৯৭৬ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা পরিষদ গঠন এবং ১৯৮০ সালে গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়। স্কুল নির্মাণ ও সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো হয়।

কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষাকে কর্মমুখী করতে নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। কৃষি ও প্রকৌশল শিক্ষা আধুনিকায়ন করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রক্ষণশীল সমাজে নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর নেতৃত্বে নারী উন্নয়ন আইনি কাঠামোর বাইরে গিয়ে বাস্তবিক উন্নয়নে রূপ নেয়। নারীশিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।

খালেদা জিয়া বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন করেন এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি এবং শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু করে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চিত করেন।

তাঁর সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতায় তিনি প্রাইভেটাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়।

১৯৯৫ সালে তিনি বেগম রোকেয়া পদক প্রবর্তন করেন, যা নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান করে। মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেও তিনি নারীর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন।

নারীশিক্ষার জন্য তিনি উপবৃত্তি এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম চালু করেন, যা নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাঁর সময়েই স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ১৯৯১ সালে ৫৫ঃ৪৫ থেকে ১৯৯৬ সালে ৫২ঃ৪৮-এ উন্নীত হয় এবং প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েশিশুদের তালিকাভুক্তি প্রায় ৩০ লাখ বেড়ে যায়। ২০০১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়।

নারীর ক্ষমতায়নেও খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ২০০১ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ১৬টি দেশের ৫০১ জন ছাত্রী লেখাপড়া করছেন, বেশির ভাগই বিনা খরচে। তাঁর সময়ে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

এ ছাড়া তিনি নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি, নতুন ক্যাডেট কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনসহ অনেক কার্যক্রম চালু করেন। ২০০৪ সালে ফোর্বস সাময়িকী তাঁকে বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারী নেত্রীর মধ্যে ১৪তম স্থান দেয়।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর অবদান নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে।

বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচিতে নারীশিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের বিকাশের পথচলা অব্যাহত রেখেছে। দলটি নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে নারীশিক্ষার প্রসার, কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা এবং রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো উল্লেখযোগ্য। বিএনপির নীতি ও কর্মসূচিগুলো নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে আরো এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি যুক্ত করে সবার বাংলাদেশ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শন পৃথিবী ও মানবজাতির রক্ষায় একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ এটি শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো বা উন্নয়ন মডেল নয়, বরং একটি সামাজিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান প্রদান করে। বর্তমান পৃথিবীতে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, বৈষম্য, পরিবেশগত সংকট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা মোকাবেলা করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শন মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে ভূমিকা রাখবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শনের মূল বিষয় হলো Save world, serve humanity.

 

.

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

মন্তব্য

গাজার ফিলিস্তিনিদের কি শেষ রক্ষা হবে

    এ কে এম আতিকুর রহমান
শেয়ার
গাজার ফিলিস্তিনিদের কি শেষ রক্ষা হবে

আমরা জানি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্দানে পাঠিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে গাজাকেমধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা হিসেবে পুনর্গঠিত করার একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিয়ে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ওই ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের ওই ঘোষণায় শুধু আরব রাষ্ট্রগুলো বা মুসলিম দেশগুলোই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে। এমনকি গত মাসে ইসরায়েল সফরকালে মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ছয় সিনেটরের একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থাল এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আরব অঞ্চলের নেতাদের গাজা পুনর্গঠন সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা হাজির করার আহ্বান জানান, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসনে বাস্তবসম্মত হবে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকারের অধিকারকে সমুন্নত রাখবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গত মাসেই মিসরে আরব দেশগুলোর সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি স্থগিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আরব নেতাদের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বৈঠকে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনসহ ফিলিস্তিনিদের যাতে সেখান থেকে না সরিয়ে নেওয়া যায়, সেসব নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে নেতারা ৪ মার্চ কায়রোতে জরুরি আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনের ব্যাপারে একমত হন। সেই ধারাবাহিকতায় ৪ মার্চ কায়রোতে অনুষ্ঠিত হলো আরব লীগের জরুরি শীর্ষ সম্মেলন।

সম্মেলনে আরব লীগের সব সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতিও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনে ট্রাম্পের বিকল্প পরিকল্পনা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে আরব দেশগুলো। এ ছাড়া আরব নেতারা ৫৩ বিলিয়ন ডলারের একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেন, যা গাজার প্রায় ২০ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিকে তাদের ভূখণ্ডে থাকার সুযোগ করে দেবে। সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যেসত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রশংসা করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসনের অবদান ছাড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্ভব হতো না, যা আমরা আশা করি অব্যাহত থাকবে।

গাজার ফিলিস্তিনিদের কি শেষ রক্ষা হবেপরিকল্পনাটিতে লোকজন না সরিয়েই ২০৩০ সালের মধ্যে গাজা পুনর্নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ ও গোলাবর্ষণের ফলে পাঁচ কোটি টনেরও বেশি ধ্বংসাবশেষের স্তূপ পরিষ্কার করা এবং একই সঙ্গে অবিস্ফোরিত বোমা অপসারণ করা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই পরিকল্পনায় পরবর্তী বছরগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেকসই, সবুজ ও চলাচলের উপযোগী আবাসন এবং নগর এলাকা নির্মাণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃষিজমি সংস্কারসহ শিল্প অঞ্চল এবং বৃহত্ পার্ক এলাকা তৈরি করার কথাও তাতে রয়েছে।

তা ছাড়া একটি বিমানবন্দর, একটি মাছ ধরার বন্দর এবং একটি বাণিজ্যিক বন্দর স্থাপনের আহ্বান জানানো হয়েছে। 

এই পরিকল্পনা সম্পর্কে আরব লীগের মহাসচিব বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মিসরের দেওয়া প্রস্তাবটি সম্মেলনে অনুমোদন পাওয়ায় এটি একটি আরব পরিকল্পনায় পরিণত হয়েছে। তিনি জানান, শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানানো হয়েছে। তাঁর মতে, মিসরীয় পরিকল্পনা গাজায় একটি নতুন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পথ তৈরি করেছে।

পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত না করার এ ধরনের পরিকল্পনায় সমর্থন দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও পরিকল্পনাটিকে সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি তারা ফিলিস্তিনের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার পদক্ষেপকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে। কার্যত তারা গাজার শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। মিসরের পরিকল্পনাটি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সমর্থনও লাভ করেছে। 

অন্যদিকে হোয়াইট হাউস তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আরব দেশগুলোর মতামতকে স্বাগত জানালেও জোর দিয়ে বলেছে যে হামাস এই অঞ্চলে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। হোয়াইট হাউস জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজেস ইঙ্গিত দেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছেন যে হামাস গাজা শাসনের দায়িত্বে থাকতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে কায়রো পরিকল্পনায় হামাস একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, যতক্ষণ না একটি সংস্কারকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনাকেপরিস্থিতির বাস্তবতা উপেক্ষা করার শামিল বলে উল্লেখ করে এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রেসিডেন্ট সিসি বলেন, গাজায় প্রশাসন পরিচালনা করবে স্বতন্ত্র, পেশাদার টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য মানবিক সহায়তা তদারক এবং উপত্যকাটির বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করবে এই কমিটি। মিসরের দেওয়া প্রস্তাবে গাজার শাসনভার অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে হস্তান্তর করতে হামাসের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পুনর্গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত শাসনভার ওই অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে থাকবে।

কায়রো পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বিষয়টি হলো গাজা পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ। পুনর্গঠন তহবিলের জন্য তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র; যেমনসংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব থেকেই হয়তো বেশি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পুনর্গঠন তহবিল আন্তর্জাতিক অর্থায়ন এবং তদারকির পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অধীনে থাকবে। গাজা নিয়ে যাদের ঘুম নেই, সেই যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কি কোনো দায়িত্ব নেবে না?

যে বিষয়গুলো আগামী কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে১. যেহেতু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার ধারাবাহিকতায় কায়রো পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাই তাঁর কাছে এই পরিকল্পনাটি উত্থাপন করার কথা রয়েছে। উথাপনের পর কী ঘটে অর্থাত্ ট্রাম্প তাঁর প্রতিক্রিয়ায় কী বলেন, সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যদি ট্রাম্পের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়, তাহলে বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো ও পুনর্গঠন তহবিল নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা কী হবে। ২. যদিও ইসরায়েল পরিকল্পনাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো কিছু শর্ত সাপেক্ষে পরিকল্পনাটি মেনে নিতে পারে। ৩. কায়রো সম্মেলনে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব মনে করে, গাজায় হামাসের সশস্ত্র উপস্থিতি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কোনো পরিকল্পনায়ই সায় দেবে না, তারা আপত্তি জানাবেই। তাই হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্র একমত হয়ে অন্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে হামাসকে নিরস্ত্র করা হবে কি না এবং কিভাবে করা হবে সে ব্যাপারে মূল দায়িত্ব নিতে হবে আরব রাষ্ট্রগুলোকেই। ৪. মিসরীয় কাঠামোতে প্রাথমিকভাবে গাজার দায়িত্বে টেকনোক্র্যাট এবং হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের চিন্তা করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পরামর্শ দিলে তা গ্রহণ করা সম্ভব হবে কি না। এ ছাড়া পরিকল্পনায় গাজা এবং ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরকে সুরক্ষিত করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টিতে জাতিসংঘ কী ভূমিকা নিতে পারবে, তা নির্ভর করবে ভেটো ক্ষমতার সদস্য দেশগুলোর ওপর। ৫. সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা সম্মেলন এড়িয়ে গিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। এতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনাটির প্রতি ঐক্যবদ্ধ আরব সমর্থন নিয়ে। যেখানে পুনর্গঠন তহবিলের জন্য এই দুটি দেশ থেকেই বেশি পরিমাণ অর্থ পাওয়ার চিন্তা-ভাবনা, সে ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কি অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো সমীকরণ কাজ করছে? ৬. যদি ট্রাম্প এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেন, সে ক্ষেত্রে আরব লীগের পক্ষে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে কি, নাকি তাদের ঐক্যে ফাটল ধরার সম্ভাবনাই বেশি? ৭. এদিকে ১ মার্চ ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ জারি করেছে ইসরায়েল। ফলে সেখানে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। খাদ্য সরবরাহ স্থগিত করায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে। সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে যে এর মাধ্যমে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধবিরতির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না। 

কায়রো বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট সিসি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘এই পরিকল্পনার সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেকোনো প্রস্তাব বা ধারণাকে আমরা স্বাগত জানাই, যা শান্তির জন্য একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার পাশাপাশি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাঁর এই আহ্বান কতটুকু কার্যকর হবে জানি না। তবে যতটুকু মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবিক ভূমিকা নেয় এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করতে আগ্রহী হয়, তাহলেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ফিলিস্তিনি নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অটল থাকেন, তাহলে ইসরায়েলের মাধ্যমেই তিনি তাঁর সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম হবেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেটি ঘটলে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করা কেউ ঠেকাতে পারবে না। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশই ইসরায়েলের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে পারবে না।

 

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ