<p>বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক সময় আদালতে মামলা চালানোর মতো ন্যূনতম অর্থ থাকে না। আবার দীর্ঘ মেয়াদে মামলা চালিয়ে যাওয়াটাও তাদের পক্ষে এক বড় সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের পক্ষে জেলা শহরে অবস্থিত আদালতে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে মামলা ও মামলার খরচ চালানো সমস্যা। আবার তারা অনেক ছোটখাটো মামলা সুযোগ না থাকার কারণে দায়রা জজ আদালতে দায়ের করতে পারে না। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনেক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে গ্রাম আদালত কার্যকর থাকলে তৃণমূল পর্যায়ে বিচারব্যবস্থায় এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। এতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠু বিচারপ্রাপ্তি অনেকাংশে নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে।</p> <p>দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কিছু বিরোধ ও বিবাদের সহজ এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। একজন চেয়ারম্যান এবং বিবদমান দুই পক্ষের দুজন করে (একজন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি) মোট পাঁচজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়, যা নির্দিষ্ট বিধির দ্বারা দেওয়ানি ও ফৌজদারি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে। সালিসি আদালত ১৯৬১-এর ২০ ধারার জায়গায় গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ (এলএক্সআই ১৯৭৬) ঘোষিত হয়, যা ছিল মূলত কিছু সংশোধনীসহ সালিসি আদালতের একটি পুনর্বিচারকৃত ভাষ্য। এটি দেশে প্রথমবারের মতো গ্রামাঞ্চলের জন্য একটি আইনসম্মত আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং এটিকে তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষতাসম্পন্ন, অপেক্ষাকৃত আনুষ্ঠানিক ও ক্ষমতাশীল বিচার বিভাগীয় ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।</p> <p>অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রাম আদালত সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি—এই দুই ধারায়ই বিচার করার কর্তৃত্ব রাখে, যাতে বিচারের ক্ষেত্রে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের মূল্যমান পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। ২০০৬ সালের মে মাসে ১৯ নম্বর আইনের অধীনে ১৯৭৬ সালের গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যে আইনটি প্রণীত হয়, সেটি কমবেশি আগের আইনটির মতোই। মূলত এখানে প্রধান পরিবর্তনটি এসেছে মামলার মূল্যমানের ক্ষেত্রে, যা আগের পাঁচ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়।</p> <p>এ কথা সত্য যে কিছু কিছু বিষয় গ্রাম আদালতের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। যেমন—দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধিমালার অধিভুক্ত আইনগুলো সম্পর্কে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জানা-বোঝার ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া উচ্চতর আদালত বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রম পর্যালোচনা বা পরিবীক্ষণ যথাযথ নয় এবং গ্রাম আদালতের রায় বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অত্যন্ত সীমিত। এ ছাড়া মামলা নিবন্ধনের জন্য দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে ফির পরিমাণ খুবই নগণ্য, যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক উপকরণের ব্যয়ের অংশবিশেষও মেটানো সম্ভব হয় না। গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। সর্বোপরি গ্রাম আদালত পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য কোনো সম্মানী বা বেতন-ভাতারও ব্যবস্থা নেই।</p> <p>কিন্তু গ্রাম আদালত কার্যকর হলে স্থানীয় বিচারব্যবস্থায় বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। যেমন—১. গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে দরিদ্র ও নারীরা কম সময়ে ও কম খরচে ন্যায্য বিচার পাবে। ২. এটি আনুষ্ঠানিক বিচার পদ্ধতি হলেও মীমাংসা বন্ধুসুলভ হয় বিধায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সামাজিক বন্ধন অটুট থাকবে। ৩. বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্থানীয় হওয়ায় রায় বাস্তবায়ন সহজ হবে। ৪. গ্রাম আদালতের আইনগত ভিত্তি থাকায় এর রায় উচ্চ আদালতে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ৫. নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ নিশ্চিত হলে বর্তমানে উচ্চতর আদালতে বিচারাধীন বহুসংখ্যক মামলা স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করা সম্ভব, যা উচ্চতর আদালতে মামলার ভার হ্রাস করবে।</p> <p>গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করতে দেশের নাগরিক সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন : গ্রাম আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া ও এর সুফল সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন কর্মসূচি পরিচালনা করে। প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা প্রদান করে। তা ছাড়া বিচারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং গ্রাম আদালতের কার্যক্রম নিয়মিত পরিবীক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এসবের পাশাপাশি এ বিচারপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সময়োপযোগী অ্যাডভোকেসি উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করে। দেশে সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের সাধারণ জনগণ, বিচারক, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের।</p> <p>স্বাধীন বিচার বিভাগের অংশ হিসেবে স্থানীয় বিচারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র গ্রাম আদালত কার্যকর করতে কিছু বিষয় বাস্তবায়নে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ১. সরকার কর্তৃক গঠিত ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটির সুপারিশের আলোকে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন, বিচারিক এখতিয়ার বৃদ্ধি, বিচারপ্রক্রিয়ায় নারীর প্রতিনিধিত্ব, বিচারিক ক্ষমতা ও রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার ব্যবস্থা করা। ২. গ্রাম আদালত আইন ইউনিয়ন পর্যায়ে যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৩. মামলা নিবন্ধনের জন্য ফির পরিমাণ বৃদ্ধি, অবকাঠামো স্থাপন, লোকবল ও উপকরণ সরবরাহ, আদালত পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্মানীসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার ব্যবস্থা করা। ৪. গ্রাম আদালতের রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা। ৫. সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিচার কার্যক্রম নিয়মিত পর্যালোচনা ও পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা।</p> <p>মামলাজট কমানো এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ দেশের অসংখ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিচারপ্রাপ্তি সহজে নিশ্চিত করতে এবং বিভিন্ন আদালতের মামলাজট কমাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে গ্রাম আদালত কার্যকর হলে এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অল্প সময়ে, কম খরচে এবং সহজে ন্যায্য বিচার পাবে বলে আশা করা যায়।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি</p> <p> kekbabu@yahoo.com</p>