উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ

  • ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
শেয়ার
উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ

জাতিসংঘের রেটিং অনুসারে বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথামিক তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ কোনো দুর্বিপাক না ঘটলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক একটি সংবাদ। কারণ কোনো দেশই দরিদ্র বা স্বল্পোন্নত দেশ হয়ে থাকতে চায় না।

এটি মর্যাদাহানিকর। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কিভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল এবং পরবর্তী সময়ে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় স্থান লাভ করার জন্য যে তিনটি আবশ্যিক শর্ত পালন করতে হয়, বাংলাদেশ তার প্রতিটিতেই ভালো করেছে। কাজেই উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উন্নীত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু বাংলাদেশ যে তথ্য ও পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এই অর্জন করতে চলেছে, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য? অন্তর্বর্তী সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা বলেছেন, বিগত সরকার অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শনের জন্য যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তার বেশির ভাগই অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিকর।

উল্লেখ্য, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং এ ধরনের আরো কিছু ইস্যুতে যে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছে, তা উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) প্রক্ষেপিত তথ্যের সঙ্গে মেলে না। প্রতিবছর বাংলাদেশ জিডিপি অর্জনের যে হার প্রদর্শন করে, উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গে তার অন্তত এক থেকে দেড় শতাংশ পার্থক্য থাকে। বছরান্তে কোনো পক্ষই তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে সরে আসে না।

এটি কী করে সম্ভব? নির্দিষ্ট বছরে একটি দেশের অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তো দুই রকম হতে পারে না। তাহলে আমরা কার দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্বাস করব? ভঙ্গুর ফাউন্ডেশনের ওপর ভবন নির্মাণ করলে যেমন তা টেকসই হয় না, তেমনি বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে, তা কখনোই বাস্তবে পরিণত হতে পারে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যদি আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হতে চায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। কারণ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধাসহ নানা রকম সুবিধ হারাতে হবে।

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জদেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন কিছুদিন আগে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময়সীমা ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

তারা বলেছে, বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার মতো উপযুক্ততা অর্জন করেনি। এই অবস্থায় যদি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয়, তাহলে যে অভিঘাত সৃষ্টি হবে অর্থনীতির ওপর, তা সামাল দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনের এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকেই অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পেয়ে থাকেন। জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আরো তিন বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখবে। তারপর তা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি+ নামে নতুন এক ধরনের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে, তা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪৮ শতাংশেরও বেশি আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। ২০০০-০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মোট ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল। ২০ বছরের ব্যবধানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি উৎপাদন সক্ষমতা ও পরিমাণ এবং গুণগত মান বাড়াতে পারে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ আরো ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীর একক বৃহত্তম গন্তব্য হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক সামগ্রী থেকে। এর বেশির ভাগই রপ্তানি করা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। কোনো কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো রপ্তানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

বিগত সরকারের আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে নানা কল্পকাহিনি প্রচার করা হলেও রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানি গন্তব্যে ভিন্নতা আনয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সীমিতসংখ্যক দেশ ও সামান্য কিছু পণ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আমরা যেসব দেশ বা অঞ্চলে বেশি হারে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করি, সেসব এলাকা থেকে আমাদের পণ্য আমদানির পরিমাণ খুবই কম। আবার যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করি, সেসব দেশে আমাদের রপ্তানির হার খুবই কম। যেমনবাংলাদেশ চীন ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য ও সেবা আমদানি করে থাকে। কিন্তু এই দেশ দুটি বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়, বরং নানা ধরনের অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের পণ্য তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হলেও এই দুটি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ খুবই সামান্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রয়োজন। আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ না হয়ে বরং এর সময়সীমা অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে যে সময় পাওয়া যাবে, তাকে বাণিজ্য বিনিয়োগ উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে রপ্তানি পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন এবং উৎপাদিত পণ্য বহুমুখী করতে হবে। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে রপ্তানি পণ্যের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবে।

বাণিজ্য-বিনিয়োগ আহরণের জন্য আমাদের ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি বা অর্থনৈতিক কূটনীতি গ্রহণ করা জরুরি। অর্থনৈতিক কূটনীতি এখন বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত এবং সমাদৃত একটি উন্নয়ন কৌশল। অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল বিষয় হচ্ছে কোনো দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বার্থ বা ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। অর্থাৎ যেকোনো দেশের সঙ্গেই আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টি এবং উন্নয়ন হতে পারে, যদি সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অর্জিত হয়। বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে আমি অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। অনেক দেশের কূটনীতিকরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব প্রদান করেন দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থকে। অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছেএটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন দেশে যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা অর্থনৈতিক কূটনীতির ব্যাপারে খুব একটা সচেতন নন। তাঁরা অনেকটাই রুটিন দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। প্রতিটি দূতাবাসে ইকোনমিক উইং আছে বটে, কিন্তু তাদের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তাঁরা দেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারেই বেশি তৎপর থাকেন। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা খুব একটা বেশি নেই, সেসব দেশে অর্থনৈতিক কূটনীতি চালানো যেতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। বিশেষ করে অর্থনীতি সম্পর্কিত অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতাম। এতে প্রতীয়মান হতো যে চেষ্টা করলে একজন রাষ্ট্রদূত তাঁর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারেন।

অর্থনীতি আবেগ দিয়ে চলে না। তাই আমাদের উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে বারবার চিন্তা করতে হবে, এটি আমাদের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে। এই পর্যায়ে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলেও পরবর্তী সময়ে যদি কোনো কারণে আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তাহলে আবারও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেমে আসতে হতে পারে। কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। তাই উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমাদের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেগ নয়, যুক্তিই হতে হবে উপজীব্য। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে যেসব উন্নয়ন কার্য সম্পাদিত হয়েছে, তার বেশির ভাগই টেকসই নয়। এই অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ সাফল্য অর্জনের চেয়ে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।   

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

পানির টেকসই ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা

    সাবাব আহমেদ চৌধুরী
শেয়ার
পানির টেকসই ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা

এবারের বিশ্ব পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য গ্লেসিয়ার সংরক্ষণ, যেখানে বিশ্বব্যাপী পানির টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু বিপর্যয়প্রবণ দেশে যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, চরমভাবাপন্ন তাপমাত্রা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি। এর পাশাপাশি ক্রমেই বাড়তে থাকা নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ভূগর্ভস্থ পানিদূষণের ফলে লাখো মানুষ নিরাপদ পানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব পানি দিবস সামনে রেখে কিভাবে আমরা দেশে নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি এবং একই সঙ্গে এই উদ্যোগে অন্যতম অংশীদার হিসেবে কিভাবে বেসরকারি খাত ভূমিকা রাখতে পারে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

এসডিজি ট্র্যাকার বাংলাদেশের ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা সেবার আওতায় জনসংখ্যার ৭১.২২ শতাংশ মানুষ রয়েছে।

বাকিরা কেবল এমন পানি সরবরাহের আওতায় রয়েছে, যেখানে নিরাপদ ও গুণমানসম্পন্ন পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। দেশের ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র ১৫৯টিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি যেখানে পাইপলাইনের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেও সব ঘরে এ সুযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেখা যাচ্ছে, নিরাপদ ও গুণমানসম্পন্ন পানি পাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে ব্যবধান রয়ে গেছে; শহর ও গ্রামের অনেক বাড়িতেই বাধ্য হয়ে দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে নিরাপদ পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে দূষণ সবচেয়ে বড় হুমকি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন আমাদের জানায় যে দেশের বিভিন্ন স্থানের বেসরকারি পাইপলাইনের পানি পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, এসবের ৮০ শতাংশ পানিতেই ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। পুকুরের পানি থেকে পাওয়া সংখ্যাটিও একই রকম। ফলে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুপযোগী।

অনিরাপদ পানি পান করার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসহ অন্য সব ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, কলেরা ও টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগ জাতীয় জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দূষিত পানির উৎস ও অপ্রতুল স্যানিটেশন এসব রোগের প্রকোপ আরো বিস্তৃত করছে। দেশে অসুস্থতা ও মৃত্যুর পেছনে এসব পানিবাহিত রোগ একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের রোগাক্রান্ত হওয়ার পেছনে এর ভূমিকা বেশ উদ্বেগজনক। আর এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যসেবার পেছনে খরচ বেড়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার অর্থনৈতিক প্রভাবও ব্যাপক।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে অনিরাপদ পানি।

ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক  ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাপানি সরবরাহ ও গুণমান উন্নত করতে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন (এনএসডব্লিউএসএস)। বাংলাদেশ রুরাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্টের মতো কর্মসূচিগুলো গ্রামীণ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে। এ কথাও ঠিক যে কাজের বাস্তবায়ন ও সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। আর এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের এগিয়ে আসা আরো বেশি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে আমাদের একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন; যেন অবকাঠামো উন্নয়ন, আচরণগত পরিবর্তন ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধান নিশ্চিত করার মাধ্যমে পানির মান ও পরিমাণ উভয় দিকেই মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়।

অবকাঠামো ও অর্থায়নের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) পরিচালনা করছে। যেমন২০০৯ সাল থেকে নিরাপদ খাওয়ার পানি সরবরাহের উদ্যোগ প্রবাহ। আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রবাহ নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় দেশজুড়ে ২৫টি জেলায় ১২৬টি পানি শোধনাগার স্থাপনার মাধ্যমে প্রতিদিন তিন লাখেরও বেশি সুবিধাভোগী মানুষ গড়ে প্রায় দুই লিটার করে নিরাপদ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে পারছে। 

কমিউনিটির স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপনসহ টিউবওয়েল ও আর্সেনিক পরিষ্কারক ফিল্টার বসিয়েছে। ওয়াটারএইডের সহায়তায় এইচএসবিসি বাংলাদেশ হাজারো পরিবারের মাঝে হাইজিন প্যাক বিতরণ করেছে, যাতে পানি সংরক্ষণ ও জীবাণুমুক্ত করার উপকরণ ছিল। একই প্রকল্পে টিউবওয়েল জীবাণুমুক্তকরণ, পুনর্নির্মাণ ও নতুন স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে এসব উদ্যোগ।

তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে সরকারকে বেসরকারি খাত, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে একযোগে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পানি শোধনাগার অবকাঠামো ও পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় যৌথ বিনিয়োগ বাড়াতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) আরো জোরদার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই পানি সম্পর্কিত করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য কর সুবিধা ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা বেসরকারি উদ্যোগকে আরো উৎসাহিত করবে। উল্লেখ্য, এসব ক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক খাতভেদে কোনোরূপ বৈষম্য করাটা সামগ্রিকভাবে সুফল বয়ে আনবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপদ ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুধীসমাজ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলার একটি অন্যতম উপায় হিসেবে পানির টেকসই ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, তেমনি অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত কেবল করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম হিসেবে নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হিসেবে এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা।

 

লেখক : হেড অব করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স, বিএটি বাংলাদেশ

মন্তব্য

ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

    সাইমন মহসিন
শেয়ার
ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক  ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ও চীন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে। এই সফর এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন উভয় দেশ জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চাশা থাকলেও এই সফরের মূল্যায়ন করতে হবে একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বর্তমান ধারা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। 

২০২৫ সাল বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

কারণ এ বছর দুই দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। গত পাঁচ দশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং একাধিক বড় অবকাঠামো প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী। 

যদিও চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, কিছু ক্ষেত্রে ঋণনির্ভরতা ও নির্দিষ্ট প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি একদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও মূল্যায়ন করবে। 

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও নতুন কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই সফরের মূল লক্ষ্য হবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

 

তবে বিআরআইয়ের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ ও সম্ভাব্য ঋণের ফাঁদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিলেও সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা কম। ড. ইউনূস এই বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করবেন, তবে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ধরনের ছাড় পাওয়া কঠিন হতে পারে। 

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। যদিও একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, বাস্তব আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

এই সফরে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও উভয় পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হবে। এ ছাড়া চীন যে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে, সেটিও আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। 

চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ প্রচারের ওপর জোর দিচ্ছে, যা একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, তবে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল শুধু বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা করা হবে। এটি শুধু স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ইঙ্গিত দেয়। 

বাংলাদেশের জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনের সমর্থনে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছে, অন্যদিকে চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশেও উদ্বেগ রয়েছে। ড. ইউনূস এই বিষয়গুলো উত্থাপন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে চীন সম্ভবত এ ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাইবে না। 

বাংলাদেশ ও চীন উভয়ই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে, তবে কার্যকর অগ্রগতি এখনো আশানুরূপ হয়নি। এই সফরে মানবিক তহবিল বাড়ানো ও মায়ানমারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা প্রসঙ্গে চীনের আরো সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যু এই সফরেও আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখলেও বাস্তব অগ্রগতি এখনো অধরাই রয়েছে। ফলে এই সফরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

তাত্ক্ষণিক সমাধানের আশা করা বাস্তবসম্মত নয়, তবে মানবিক তহবিল সংকট মোকাবেলায় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা তহবিলের সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমানভাবে চাপের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক সফরেও এটি অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল।

এই সফরে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা মানবিক তহবিল সংকট মোকাবেলা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে, যা নতুন উদ্যোগ বা প্রতিশ্রুতির দিকে এগোতে পারে। এ ধরনের অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরো শক্তিশালী সমর্থনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

ড. ইউনূসের চীন সফর মূলত বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরো সুসংহত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। তবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা কম।

সফরের মাধ্যমে মূলত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতাকে আরো শক্তিশালী করার দিকেই জোর দেওয়া হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ তার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যও বজায় রাখবে, যাতে দেশটি কেবল একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুমুখী কূটনীতি অনুসরণ করতে পারে।

চীন এই সফরকে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সর্বাধিক কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব আরো দৃঢ় করার কৌশল হিসেবে বেইজিং সফরটিকে ব্যবহার করবে; অন্যদিকে বাংলাদেশও তার কৌশলগত স্বার্থকে বাস্তবতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে ধরে রেখে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। ঢাকা তার ভূ-রাজনৈতিক চাহিদাগুলোকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করবে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাবে।

চীন ভালোভাবেই জানে যে বর্তমান সরকার জনপ্রিয় হলেও অভ্যন্তরীণ ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এই পরিস্থিতি বেইজিংকে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি, চুক্তি বা সমঝোতায় এখনই সম্পৃক্ত হতে কিছুটা সংযত রাখবে।

বাংলাদেশের জন্য এই সফর তার মূল অগ্রাধিকারগুলোকে সামনে তুলে ধরার একটি বড় সুযোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তঃসীমান্ত ইস্যুতে জোর দেওয়া হবে, একই সঙ্গে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে যে বাংলাদেশ কোনো একক অংশীদারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হবে না।

যদিও আলোচনাগুলো মূলত আকাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ অংশীদারির কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করবে, বাস্তব ও তাত্ক্ষণিক অগ্রগতি সীমিত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চেয়ে সতর্ক কূটনৈতিক পন্থাকে অগ্রাধিকার দেবে। ফলে এই সফর পরিবর্তনমূলক ফলাফল প্রদানের চেয়ে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। এটি মূলত কূটনৈতিক প্রটোকল অনুসারে পরিচালিত একটি সফর, যা বিশেষভাবে ড. ইউনূসের জন্য আয়োজন করা হয়নি। এই সফর বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের জন্য অনেক আগেই নির্ধারিত ছিল এবং যিনিই সরকারপ্রধান থাকতেন না কেন, সফরটি অনুষ্ঠিত হতো। তাই যদিও এই সফর নিয়ে উচ্চাশা থাকতে পারে, বাস্তবিক অর্জন সীমিতই থাকবে।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক

বিষয়ক বিশ্লেষক

মন্তব্য

আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টি

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টি

ক্রিকেটের মধ্যে যে কত বেশি বিনোদন, আনন্দ আর উত্তেজনার উৎস, কত বেশি উদ্ভাবনী শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস, নিজকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য, চরম পেশাদারি, বিজ্ঞান, অঙ্কপাশাপাশি ভীষণ অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মাঠে গড়ানোর আগ পর্যন্ত এই সম্পর্কে ধারণা ছিল না। প্রতিদিনই এই ক্রিকেট সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে চলেছে। সময়ের প্রয়োজনে মাঠে এসে খেলাকে দিয়েছে নতুন প্রাণের স্পন্দন। সার্বিকভাবে ক্রিকেট নামক খেলাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

মাঠমুখী করেছে ক্রিকেট রসিকদের। বিশ্বজুড়ে খেলাটির জনপ্রিয়তা, প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট সংস্করণ টি-টোয়েন্টি। সবার পরে মাঠে এসেছে।

মাঠে এসেই তার জাদুর মাধ্যমে বুঁদ করে ফেলেছে। দেশে দেশে মানুষ এই খেলা উপভোগের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে টি-টোয়েন্টি তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বদৌলতে টেস্ট ও ওয়ানডেকে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার দৌড়ে অনেক আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, টি-টোয়েন্টির প্রভাব এখন টেস্ট ও ওয়ানডেতে ভর করেছে।

ক্রিকেট খেলাটিকে বিপ্লব ঘটিয়েছে টি-টোয়েন্টি সংস্করণ। সম্ভব হয়েছে খেলাটির অ্যাপ্রচ ও দর্শনের বদৌলতে। খেলাটি পেরেছে সব বয়সের ক্রিকেটপ্রেমীদের আকৃষ্ট করতে, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে। মানুষ যা প্রত্যাশা করে, সেটি যে দিতে পারছে টি-টোয়েন্টি! এই ক্রিকেট এখন তাই সবার ভালোবাসা। সবার দুর্বলতা।

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বুঝতে পেরেছে টি-টোয়েন্টি তারুণ্যের খেলা, যৌবনের খেলা। এটি আগামী দিনের খেলা। তাই আগামী অলিম্পিকে টি-টোয়েন্টি সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে এই ক্রিকেট বিশ্বের দেশে দেশে আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে।

আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টিক্রিকেট খেলাটিকে বাঁচানোর জন্য একটি সময় টি-টোয়েন্টি সংস্করণকে মাঠে আনা হয়েছে। মাঠের ক্রিকেটকে তো বাঁচিয়েছে, পাশাপাশি ক্রিকেট ঘিরে বাণিজ্যকে মোটাতাজা করেছে। ক্রিকেটারদের দিয়েছে অকল্পনীয় আর্থিক নিরাপত্তা। প্রতিটি ক্রিকেট বোর্ডকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি আইসিসি ফান্ডের গ্রাফ যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে, তাতে দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেট কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে চিন্তার আর কারণ নেই। অতএব আনন্দদায়ী, স্নায়ুক্ষয়ী ক্রিকেট জিন্দাবাদ। ক্রিকেটের জগতে নতুন সূর্যোদয়চটকদার টি-টোয়েন্টি সংস্করণ। ক্রিকেট রোমান্টিক মাত্রই টি-টোয়েন্টির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। তিন ঘণ্টার চলচ্চিত্র উপভোগের জন্য সে কী ব্যাকুলতা!

একটা সময় ছিল অনেক ক্রিকেট গ্রেট এবং ক্রিকেট বিশুদ্ধচারিরা টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বেশি সমালোচক ছিলেন। তাঁদের কথা হলো ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট ক্রিকেটের সেই আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য, দর্শন ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে ফেলবেঅতএব এই ক্রিকেট চাই না। কিন্তু কিছু সময় যেতেই এই মানুষগুলোই আবার টি-টোয়েন্টির ভক্ত হয়ে গেছেন, প্রেমে পড়েছেনতাঁরা বুঝতে পেরেছেন এটি সময়ের দাবির ক্রিকেট। যুগের ক্রিকেট। তাই তাঁরা টি-টোয়েন্টির মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ঘড়ির খেলা, কড়ির খেলার আবেদন। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটাররা তো মাঠে নামছেন বিনোদ-মাধুর্য বিতরণের জন্য, যেটি নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীরা বেশি উদগ্রীব!

ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে আলোচিত ভারতের আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগের ১৮তম আসর মাঠে গড়াতে যাচ্ছে ২২ মার্চ। দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রতীক্ষার অবসান হবে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে মুখোমুখি হবে গতবারের চ্যাম্পিয়ন (২০২৪) কলকাতা নাইট রাইডার্স ও রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। কলকাতা নাইট রাইডার্স এর আগে দুইবার (২০১২ ও ২০১৪) শিরোপা জিতেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নাইট রাইডার্সকে চলতি বছর শিরোপা ধরে রাখার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

পুুরো বিশ্বের সেরা ও ভালো ক্রিকেটাররা আইপিএলে খেলেন। আইপিএলে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ৭৪ ম্যাচের টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে ২৫ মে আবার কলকাতার ইডেনে। ইডেনে ক্রিকেট উপভোগের অন্য এক ধরনের আবেগ এবং আবেদন আছে। ইডেনে খেলা মানেই স্টেডিয়ামে মানুষের সমুদ্র। ১০টি ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশগ্রহণে খেলা হবে কলকাতা ছাড়া আরো ১২টি শহরে। সব ভেন্যুই থাকবে দশর্কে ঠাসা। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আইপিএলে হোম ভেন্যুর আবেদন ও গুরুত্ব যাঁরা মাঠে গিয়ে খেলা না দেখেছেন, তাঁরা ঠিক সেভাবে অনুভব করতে পারবেন না।

গত বছর নভেম্বরে সৌদি আরবের জেদ্দায় বসেছিল আইপিএলের মেগানিলাম। ৬৩৯ কোটি ১৫ লাখ রুপিতে মোট ১৮২ জন খেলোয়াড় কিনেছে ১০ ফ্র্যাঞ্চাইজি। ধরে রেখেছে ৪৬ জন খেলোয়াড়। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছি, সৌদি আরব ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আয়োজনের কথা গভীরভাবে ভাবছে। এতে এই লীগ ঘিরে আকাশে টাকা উড়ে বেড়াবে। ক্রিকেটাররা ঝুঁকবেন সেই লীগে। তখন আইপিএলের অবস্থা কী হতে পারে? সৌদি পেশাদারি ফুটবলে তো এখন আন্তর্জাতিক গ্রেট তারকাদের মেলা। কথায় আছে, অর্থ কথা বলে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রিকেটের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, একমাত্র টি-টোয়েন্টি সংস্করণের মাধ্যমেই বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের সম্প্রসারণ সবচেয়ে বেশি সম্ভব। ২০ ওভারের ক্রিকেট এখন বাজার মাতাচ্ছে। সময় এটিকে দারুণভাবে লুফে নিয়েছে। সবাই ইতিবাচক টি-টোয়েন্টি নিয়ে।

ভারতে ১৮তম আইপিএলে এবার বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের স্থান হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের চাহিদা কার্যকর ক্রিকেটার, যাঁরা দলকে সঠিকভাবে সার্ভ করতে পারবেন। বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারকে ফ্র্যাঞ্চাইজি না কিনলেও অগণিত মানুষ কিন্তু প্রতিদিন প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক আইপিএল উপভোগ করবে। এখানেই খেলার রাজার আবেদনের জয়।

ভারত সম্প্রতি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। দুটি ট্রফি রোহিত শর্মার নেতৃত্বে। ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের খেলা গতবারের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। ভারতের খেলোয়াড়রা বিদেশিদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবেন। তাঁরা চাইবেন মানুষকে বহুগুণে সুখী করতে।

পরিসরে ছোট ক্রিকেট টি-টোয়েন্টিআবার সূত্র ধরে ক্রিকেটীয় কারিগরি বা কৌশলগত দিকে সমৃদ্ধতার পরশ সব সময় লক্ষণীয় হয়। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং ও রণকৌশলে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নিত্যনতুন সংযোজন, তার সবই প্রায় সীমিত ওভারের প্রয়োজন। খেলাটি সত্যি ব্যাটসম্যান, না বোলারের? না উভয়ের? এই বিতর্কটি এখন চলছে। বোলাররাও তো ম্যাচ জেতাচ্ছেন। আর শারীরিক ফিটনেস ছাড়া প্রাণবন্ত ক্রিকেট হবে কিভাবে? মাঠে ভুল শোধরানোর সুযোগ খুব কম। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিন ঘণ্টায় দুই দলের খেলা শেষ। কিন্তু অনুশীলন অনেক বেশি। মাথা ঘামাতে হয় অনেক বেশি।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

 

মন্তব্য

গ্রাম বদলে গেছে বদলে যাচ্ছে

    আব্দুল বায়েস
শেয়ার
গ্রাম বদলে গেছে বদলে যাচ্ছে

২০২৫ সালে গ্রামবাংলায় পা ফেলেই যেন ধাঁধায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কৈশোরে পাঠ্যপুস্তকে পড়া কিংবা দু-তিন যুগের আগের দেখা গ্রাম আর বর্তমান গ্রামের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য। এই গ্রাম তো ঠিক সেই গ্রাম নয়। পানির কলকল ধ্বনি, বর্ষার জলে টইটম্বুর নদী ও পুকুর, পাখির কলরব, সারি সারি ছনের ঘর, কুপির টিমটিমে আলো ইত্যাদি তেমন আর চোখ পড়ল না।

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে এখন ভরাট হয়ে সোজাসুজি চলছে। মাঠের ধূলাবালিতে গড়াগড়ি, গাছের ডাল থেকে দুঃসাহসিক লাফ, পুকুরে দাপাদাপি ও পানির খেলায় মেতে ওঠার মহোৎসব আগের মতো মূর্তিমান নেই; ঐতিহ্যবাহী হাডুডু, গোল্লাছুট, এমনকি এক্কা-দোক্কা খেলা আধুনিকতার ধাক্কায় যেন কুপোকাত। পতিত জমিতে পাজামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরা মাদরাসার ছাত্র কিংবা খালি গায়ে একদল শিশু ক্রিকেট খেলছে। গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে যাত্রা, পালা, জারিগান ও পুথিপাঠ।
আর নেবেই না কেন, আজকাল টিভি ও মোবাইল ফোন উপহার দিচ্ছে ডিসকো গান ও ধুমধাড়াক্কা সিনেমা এবং সম্ভবত সেই আফসোস থেকে এই গান গাওয়া : আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।/গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া জারিগান আর মুর্শিদি গাইতাম।

দুই.

সুতরাং সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য বলি, প্রথাগত গ্রামের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেখা গ্রামগুলো যে অনেকটা বেখাপ্পা ও বেমানান, সে কথা বলা বাহুল্য। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এই ব্যবধান আরো একটু পরিষ্কার করে বোঝানো যেতে পারে।

দুই দশক আগে কষ্টেসৃষ্টে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে বড়জোর উপজেলা সদর পর্যন্ত যাওয়া যেত; এখন পিচঢালা মসৃণ পথে মোটরগাড়িতে বেশ কিছু গ্রামে সরাসরি যাওয়া যায়চাই কি বাড়ির আঙিনায়। আজকাল গ্রামে ছনের ঘরের সংখ্যা ব্যাপক কমে আসছে আর কুপিবাতি বিদায়ের প্রহর গুনছে। এমনকি অতীতের মতো নাকে-মুখে রুমাল গুঁজে গ্রামে ঢুকতে হয় নাপ্রতিটি গ্রামের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং প্রায় প্রতিটি ঘরের জন্য সুপেয় পানির বন্দোবস্ত আছে। বসতবাটি যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার একটা তাগিদ আমাদের চোখ এড়াল না। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’—এমন পরিবেশ যেন সবার কাম্য।
অনেক খানায় বিদ্যুত্সংযোগ এসে গেছে এবং সেই সূত্রে টিভি ও ফ্রিজ; অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের ঘরে রঙিন টিভি ও দামি ফার্নিচার। যেখানে বিদ্যুত্ পৌঁছাতে পারেনি (যেমনচরাঞ্চল ও দুর্গম গ্রাম), সেখানে সোলার প্যানেল লাগিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। তবে টিভি ও ডিশ উন্নত জীবনমানের বাহক হলেও অভিযোগ আছে যে সিনেমা, নাটক ও সিরিয়াল কিশোর-কিশোরীদের খোলা মাঠের খেলা কেড়ে নিচ্ছে। টিভির দোষ দিয়েই বা লাভ কী? গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলার জায়গাগুলোতে গড়ে উঠেছে বসতি, নার্সারি কিংবা ফসলের আবাদ। এক শ বিঘার মাঠটাই এই গ্রামের একমাত্র সম্বল’—শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেখা সেই গ্রাম আজকাল কেউ দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। ইদানীং গ্রামে নাটক খুব একটা হয় না, তবে গ্রামের জীবন নানা নাটকীয়তায় ভরা। চলুন তাহলে এমন কয়েকটা নাটকীয় ঘটনার কথা শুনি।

তিন.

দু-তিন দশক আগেও দোকান বলতে গ্রামের কোনো ছোট একটি ঘরে চাল-ডাল, নুন আর তেলের পসরা। অথচ ২০২৪-২৫ সালে এসে আমাদের দেখা গ্রামগুলোতে গড়পড়তা চার-পাঁঁচটি দোকান এবং সেই সঙ্গে কোথাও টিভি ও ফ্রিজ। চা, চানাচুর, চিপস, সাবান ও প্রসাধনী, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, এমনকি প্রক্রিয়াজাত মসলা দেদার বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় হাটবাজারের অবস্থা আরো উন্নত এবং শহরের প্রায় সব দ্রব্য ওই সব দোকানে পাওয়া যায়। নাটকীয়তা এসে গেছে দরিদ্রের জীবনেও। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর একদা যে দিনমজুর সন্ধ্যার গ্রাম বদলে গেছে বদলে যাচ্ছেপরপরই বিছানায় গা এলিয়ে দিত, সে এখন চা, পান ও সিগারেট সঙ্গে করে মধ্যরাত পর্যন্ত গ্রামের বা হাটের দোকানে টিভির সামনে বসে থাকে। কোথাও আবার দোকানের এক কোণে ক্যারম বোর্ড পাতা আছেমাঝে মাঝে দিনমজুর, যুবক শ্রেণি ও বেকার লোক পয়সার বিনিময়ে খেলে কিংবা অন্যের খেলা প্রাণভরে উপভোগ করে। রোনালডো, নেইমার, মেসি, শচীন টেন্ডুলকার এখন গ্রামে খুব পরিচিত নাম; খুব দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েও তরতর করে নাম বলে, যেন তাঁরা ওদেরই সহপাঠী। এভাবে দুই দশক আগের অচেনা-অজানা পুরো বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ এখন গ্রামে থাকা ওই ছোট দোকান ঘরটিতে এক নিমেষে উপস্থিত হয়। সুতরাং কে বলবে এই গ্রাম, সেই গ্রাম? স্বভাবতই রবীন্দ্র, শরত্ যুগ, এমনকি সত্তরের দশকের গ্রাম-ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে শহরভিত্তিক উন্নয়নের ছিটেফোঁটা রাস্তাঘাট ও বাজারের বদৌলতে গ্রাম-গ্রামান্তর উপচে পড়ছে (ট্রিকল ডাউন); এক কালের বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত গ্রাম শহরের কিঞ্চিত্ রূপ ধারণ করে চলেছে। এই সংযুক্তির সুযোগে খোলা জানালা দিয়ে যেমন নির্মল বায়ু প্রবেশ করছে, তেমনি ঢুকছে মশা-মাছি। 

সাধারণত সিনেমা, টিভি বা নাটকের শুরুতে একটি ডিসক্লেমার বা সতর্কীকরণ নোটিশ দেওয়া থাকে। গ্রাম বিবর্তন উপাখ্যানের মূল পর্বে যাওয়ার আগে একটি ডিসক্লেমার দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও মনে হতে পারে যে গ্রামগুলো যেন এক ও অভিন্ন। আসলে কিন্তু তা নয়, বিশেষত ভূ-প্রকৃতি ও জীবিকা কৌশলের দিক থেকে এরা একে অপর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বেশির ভাগ গ্রামে দুই সন্তানই যথেষ্ট এমন একটি চেতনা বেশ ভালোভাবে গ্রোথিত বলে মনে হয়েছে। ফলে ওই সব গ্রামে খানার সদস্যসংখ্যা বড়জোর ৩-৪; মোট জনসংখ্যায় শিশুর অনুপাত ১০-১২ শতাংশ; কর্মবয়সী জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ন্ত এবং প্রজননহার পড়ন্ত। এর ঠিক উল্টো পরিস্থিতি দেখা যায় কিছু গ্রামে। আল্লাহর আদম আল্লাহ খাওয়াবেন’—এমন রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে সেখানে খানাপ্রতি সদস্যসংখ্যা ৬-৭, প্রজননহার বেশ উঁচুতে এবং উপার্জনকারীর ওপর ভোক্তার নির্ভরশীলতার অনুপাত অপেক্ষাকৃত বেশি। কোথাও খানার আয়ের বেশির ভাগ আসে বৈদেশিক রেমিট্যান্স থেকে (যেমনমধুরখোলা); কোথাও আবার অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স আয়ের প্রধান চাবিকাঠি (যেমনকবিরকাঠি গ্রাম)। রাজশাহীর তেঘর গ্রামে বর্ষা মৌসুমে ৮০ শতাংশ জমিতে পানি জমে না অথচ সুনামগঞ্জের পশ্চিম কাশিপুর ছয় মাস প্রায় পানির নিচে থাকে। সাতক্ষীরার পরানদহ তথা বেশির ভাগ গ্রামে উফশী ধান কৃষকের প্রাণ, যেখানে খুলনার মাইলমারা গ্রামে উফশীর উচ্ছিষ্টও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; তাই বলে মাইলমারার মানুষ না খেয়ে মরছে না। সীমান্ত ঘেঁষে গ্রামগুলোতে ভারত থেকে আসা ধানের বীজ (যেমনজামাইবাবু, স্বর্ণা, মিনিকেট) ও সেখানকার কৃষিজ্ঞান চোরাই পথে এসে চাষির মন কাড়ায় ব্যস্ত অথচ বাংলাদেশের অন্য কোথাও তেমনটি দেখা যায় না। কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস! কী বিচিত্র এই গ্রাম! তবে নানান বরন গাভিরে তার একই বরন দুধ অর্থাত্ নানা ধরনের গ্রাম হলেও তাদের উন্নয়নের সিঁড়ি অনেকটা একই রকম : সবুজ বিপ্লব এবং/অথবা উন্নত অবকাঠামো, যা মাইকেল লিপটনের ফার্টিলিটি, ফুড ও ফার্মিংপরিবর্তন ব্যাখ্যায় প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি।

চার.

ওর্যাল হিস্ট্রি থেকে মনে হলো যে গ্রামের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর গল্পের নায়কের নাম নয়া ধান, যা সচরাচর সুধীসমাজে সবুজ বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। বিশেষত সেচের সুবিধা আছে এমন অঞ্চলের গ্রামগুলোতে জমি, লিঙ্গ ও শিক্ষা ভেদে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা উফশী (উচ্চ ফলনশীল) বা নয়া ধানের জয়গান ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এর পেছনে একটিমাত্র কারণ হলো শুষ্ক মৌসুমে এই নয়া ধান গ্রামবাংলায় নবদিগন্তের সূচনা করেছে বলে তারা মনে করে থাকে। সবুজ বিপ্লবের চাদরে ঢাকা সেচ ও সার নির্ভর উচ্চ ফলনশীল ধান আসার আগে এসব গ্রামের কৃষিজমি ছিল প্রধানত একফসলি; খাদ্য জোগানের একমাত্র উপায় ছিল সনাতন জাতের ধান। সবুজ বিপ্লব তথা উফশীর ঢেউয়ে এখন সেই ধান ভেসে গেছে। দু-একটি গ্রাম ছাড়া একসময়ের প্রভাবশালী আউশ ধানের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না; যদি থেকেও থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে জাদুঘরে। তাই বলে কিন্তু সনাতন ধানের মৃত্যু ঘটেছে অমন কথা বলা যাবে না, আমন মৌসুমে কিছুটা অস্তিত্ব এখনো আছে। বেশ কিছু গ্রামে কৃষক এ ধরনের ধান করেন মূলত মুড়ি, চিড়া ও পোলাওয়ের চালের জন্য। তা ছাড়া এগুলোর বেশির ভাগ বেশি পানিতে কিংবা প্লাবনের পরও কিছু ফসল দেয় এবং রোগবালাইয়ের অক্রমণও অপেক্ষাকৃত কম। ফলে অবস্থাপন্ন কৃষক প্রয়োজনের সময় বীজ পাওয়ার জন্য অল্প জমিতে এসব ধানের চাষ বহাল রেখেছেন। আর একটি কথা। জমিখণ্ডগুলো এমন আলাদা যে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সব খণ্ডে উফশী করা যায় না বলে সনাতন ধানই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়।

পাঁচ.

কিন্তু এই ভরসার দিন শেষপ্রায়। মাটি, পানি ও প্রকৃতির ওপর চাপ দিয়ে নয়া ধান দীর্ঘমেয়াদি দুঃখ ডেকে এনেছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা। সুতরাং সনাতন জাতের ধান উৎপাদনে উৎসাহিত করার দিন এসে গেছে। পরিকল্পিতভাবে উপরিস্তরের পানি ব্যবহার করে, কম কীটনাশক ব্যবহার করে ধান উৎপাদনে ব্রতী হওয়া দরকার। নয়া ও সনাতন মিলে দেবে সমাধানএকটি সমস্যা ডেকে আনবে আরো তীব্রভাবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ