উপন্যাস

শিমুলকাঁটা

  • ইমদাদুল হক মিলন
শেয়ার
শিমুলকাঁটা
অঙ্কন : ধ্রুব এষ

‘আপনি যাবেন কোথায়, মা?’

বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছি অজানা অচেনার উদ্দেশে। তবে উদ্দেশ্য শিমুলের শেষটা দেখা। শিমুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তারপর ওর কোনো কথায় আর বিশ্বাস রাখা যায় না।

তার পরও আমি পথে নেমেছি। ওর আরেকটি কথার বিন্দুমাত্র সত্যতা পাওয়া যায় কি না সেই আশায় বাড়ি ছেড়েছি। হয়তো এ ক্ষেত্রেও প্রতারিত হব। তবু ক্ষীণ একটা আশা রয়ে গেছে মনে।
যদি মিলে যায় ওর ওই কথাটা? যদি সত্যি পেয়ে যাই ওর পরিবারের সন্ধান?

‘যদি’ কথাটা অনিশ্চিত। হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তবু আমি পথে নেমেছি।

আশায়। যদি...

ঢাকার কাছে গাজীপুর। সেই গাজীপুরের কথা বলেছিল শিমুল। গাজীপুর শহরের যে জায়গার বর্ণনা দিয়েছিল, আমি যাব সেখানে। স্টেশন রোডে ওদের নিজস্ব মার্কেটের কথা বলেছে।

ওর বাবা ওমর আলী সাহবের বড় দোকানের কথা বলেছে। ছয়তলা সুন্দর বাড়ির কথা বলেছে। নিশ্চয়ই লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে সেই দোকান বা বাড়ির হদিস পাওয়া যাবে। যদি...

মফস্বল ধরনের ছোট শহরে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। শিমুলদের বাড়িঘরের হদিস পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে হয় না। যদি...

তার পরও এ আমার অনিশ্চিত যাত্রা। ভাগ্যে কী আছে জানি না। শিমুল আমার সঙ্গে যা করেছে, ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আমার মন আর শরীর নিয়ে যা করেছে, অমনটা কোনো প্রকৃত প্রেমিক করতে পারে না। আমাকে পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত করে, সেই সুযোগে আমার শরীর তছনছ করে যেভাবে সে উধাও হয়ে গেল, এটা কোনো প্রেমিকের কাজ হতে পারে না। এটা প্রতারকের কাজ। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার সুন্দর চেহারা আর সুন্দর করে কথা বলা—এই দুটি বিষয়কে সে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। শেষ অস্ত্র ছিল গান। ওসব ব্যবহার করে আমাকে পাগল করেছে। তার ভিতরে ছিল বদ উদ্দেশ্য। প্রেমের অভিনয় করে একটি মেয়েকে ধ্বংস করে দেওয়া। সে বুঝে গিয়েছিল, মেয়েটি তাকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবেসেছে। মেয়েটি তার জন্য সব করতে পারে। এই দুর্বলতার সুযোগটা সে পুরোপুরি নিয়েছে।

কয়েক দিন ধরে শিমুলের কথা ভাবতে ভাবতে দুই রকম অনুভূতি হয়েছে আমার। প্রথমে দুঃখ বেদনায় বুক ভেঙে গেছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছি। এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি। তারপর অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হয়েছে মনের ভিতর।

কেন আত্মহত্যা করব আমি? কেন মরে যাব? এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হওয়া প্রায় সব মেয়ের মতো কেন ভেঙে পড়ব? আমি তো অত পুতুপুতু স্বভাবের মেয়ে না! জসিম আমার নাম দিয়েছে ‘ডাকাতকন্যা’। সেই ডাকাতকন্যা কি এভাবে ভেঙে পড়তে পারে?

হ্যাঁ, তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে, নেশাগ্রস্ত করে রাতভর শরীর নিয়েছে প্রেমিক। নিকৃষ্ট ধরনের প্রতারণা করেছে। আমি একটু দেখি না তাকে! খুঁজে বের করি না তাকে! নারীর হিংস্রতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা কোন পর্যায়ের হতে পারে, তাকে একটু দেখাই না! সে তো শুধু আমার ভালোবাসাটা দেখেছে। প্রেম আর মায়া মমতা দেখেছে। নরম নিরীহ চেহারা দেখেছে। অন্য আমাকেও দেখুক।

এ কারণেই আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি।

খালা আমাকে কালো রঙের সুন্দর একটা বোরকা কিনে দিয়েছে। এই ধরনের বোরকা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েরা অনেকেই পরে। বছরখানেক আগে বাড়ি আসার সময় খালা বোরকাটা এনেছিল। পরা হয়নি এক দিনও। কাল গভীর রাতে সেই বোরকা বের করেছি। গ্রামের মেয়ে হলেও এখনকার শহরের মেয়েদের মতো জিন্সও পরি আমি। জিন্সের সঙ্গে টপস পরি, লম্বা ধরনের শার্ট পরি। গ্রামের হাটবাজারে এসব ড্রেসের অভাব নেই। দামও কম। খালা টাকা পাঠায়, আর সেই টাকায় আমি পছন্দমতো ড্রেস কিনে নিই।

এখনকার মেয়েরা কেডস পরে। নরম ধরনের সুন্দর জুতা পরে। সব আছে আমার। দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য জিন্স, লম্বা হাতার শার্ট আর জুতাই ভালো। রাতেই ওসব বের করে রেখেছি।

ব্রা কিনতে গিয়ে কিছুদিন আগে প্যান্টিও কিনেছিলাম দুটি। একটা কালো রঙের, আরেকটা টকটকে লাল। জিনিসটা আমার পছন্দ না। পরলে নিচের দিকটায় ফাঁপর ফাঁপর লাগে। সেই প্যান্টিও পরেছি আজ। জিন্স আর লম্বা শার্ট পরেছি। শার্টটাও পাতলা জিন্সের। পায়ে নরম জুতা। তার ওপর বোরকা পরেছি এমনভাবে, দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না ভিতরে জিন্স পরা। মুখ মাথাও ঢেকেছি এমনভাবে, শুধু চোখ দুটি দেখা যায়।

ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম আগেই। শিমুলের ওই পাঁচ হাজার টাকা তো আছেই, নিজের জমানোও কিছু ছিল। সব নিয়েছি সঙ্গে।

বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ভোররাতে। আমার ডরভয় কম। তখনো অন্ধকার ছিল। চেনা পথ। হাতে মোবাইল আছে। মোবাইলের আলো জ্বালাতে হয়নি। বড় রাস্তায় উঠে দেখি অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। ফরসা হচ্ছে চারদিক। ভোরবেলার হাওয়াটা বইতে শুরু করেছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। মাথার ওপরকার আকাশ তার মতোই আছে। একটি দুটি রিকশা চলাচল করছে।

আমি রিকশা নিয়েছিলাম। বাসস্ট্যান্ডে এসেছি। সকালবেলার প্রথম বাসটাই পেয়েছিলাম।

দিনাজপুরে এসে ঢাকার বাসে চড়ার আগে মনে হলো, গত কয়েক দিন ঠিকঠাকমতো খাওয়া হয়নি। শরীর দুর্বল হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে পালিয়েছি, সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে মনের শক্তির সঙ্গে শরীরের শক্তিও প্রয়োজন। শরীর ঠিক না থাকলে কিছুই করতে পারব না।

আশ্চর্য ব্যাপার, কথাটা ভাবার পর আমার খুব খিদে পেল।

বাসস্ট্যান্ডের পাশে জমজমাট একটা রেস্টুরেন্ট। পরোটা ভাজা হচ্ছে, ডিম ভাজা হচ্ছে। রান্না করা মাংসের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। রেস্টুরেন্টটায় ঢুকে পরোটা, মাংস, একটা ডিমভাজা, পেট পুরে খেলাম। ঘন দুধের এক কাপ চা-ও খেলাম। দেখি শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। মনের সঙ্গে শরীরের শক্তিও যেন বেড়ে গেছে। বাসে চড়ার সময় মনে মনে বললাম, ‘শিমুল, আমি আসছি। তোমাকে আমি খুঁজে বের করবই। তোমাকে আমি দেখে নেবই।’

বাসের মাঝামাঝি দিককার জানালার ধারে বসেছি। যাত্রীরা তখন ধীরে ধীরে উঠছিল। আমার খালার মতো বয়সী এক মহিলা উঠলেন। সুপারভাইজার ভদ্রলোক সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা। পায়ে জুতা। কথাবার্তা ভালো। লেখাপড়া জানা লোক। মনে হলো সে মানুষ হিসেবেও ভালো। শয়তান বদমাশ টাইপের না। মহিলাকে আমার পাশের সিটে বসিয়ে দিল। ইচ্ছা করলে সে আমার পাশে একজন পুরুষকেও বসিয়ে দিতে পারত। তা সে করল না।

মহিলা আমার মতোই একা। মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ বোঝা যায়। পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি। সুন্দর একটা চাদর শাড়ির ওপর জড়ানো। চেহারায় মধ্যবিত্তের সম্ভ্রান্ত ভাব আছে। পরিচ্ছন্ন, শালীন ধরনের মানুষ। বাসের ক্যারিয়ারে আমার ব্যাগের পাশেই তাঁর ব্যাগ রাখলেন। ব্যাগটা ভালোই। সিটে বসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

বাস চলতে শুরু করেছে। শহর থেকে বেরিয়ে ফসলের মাঠ, আমের বাগান আর মানুষের ঘরবাড়ি। আঙিনায় খড়ের গাদা ভর্তি বাড়িগুলো রাস্তার দুপাশে। গরিব মানুষের গ্রাম এলাকার  ভিতর দিয়ে ছুটছে বাস। আমি সেইসব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছি। সিনেমার দৃশ্যের মতো সরে সরে যাচ্ছে দৃশ্যগুলো।

একসময় মহিলাটি প্রশ্ন করলেন। তাঁর ভাষা ভালো। মনে হলো লেখাপড়া জানেন। লেখাপড়া জানা মানুষের কথা শুনলেই বোঝা যায়। শিক্ষার আলোটা দেখা যায়।

প্রশ্ন শুনে আমি তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। ‘এটা তো ঢাকার বাস, তাই না?’

মহিলা হাসলেন। ‘হ্যাঁ, ঢাকার বাস। আমি ঢাকায় যাব।’

‘আমিও সেখানেই যাচ্ছি।’

‘গলা শুনে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কম।’

এ কথার কোনো জবাব দিলাম না আমি। মহিলা বললেন, ‘তুমি করে বললাম, কিছু মনে করলে না তো, মা?’

মহিলার কথা বলার ভঙ্গিটি সুন্দর ও আন্তরিক। এই ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আমার মনে হলো, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। সময়ও কাটবে, ঢাকায় গিয়ে কোথায় উঠব, বা কী করব—ওইসব ব্যাপারে তিনি হয়তো কিছুটা সাহায্যও করতে পারবেন। কারো না কারো সাহায্য আমার লাগবেই!

আমি কোনো দিন ঢাকা তো দূরের কথা, এত কাছে দিনাজপুর শহর, এত কাছে ঠাকুরগাঁও শহর, পঞ্চগড়—কোথাও যাইনি। হঠাৎ করেই চলে যাচ্ছি দেশের সবচেয়ে বড় শহর, রাজধানী ঢাকায়। আসলে যাব গাজীপুরে। ঢাকায় গিয়ে তারপর যাব গাজীপুরে। মহিলা নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। বললাম, ‘আপনি ঠিক বুঝেছেন। আমি আপনার মেয়ের বয়সীই হব।’

মহিলা মন খারাপ করা গলায় বললেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে নেই গো, মা। একটা মেয়ে ছিল, তিন মাস বয়সে মারা গেছে। ঢাকায় তুমি কোথায় যাবে?’

কী বলব বুঝতে পারি না।

আসলেই তো! ঢাকায় কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব? এসব কথা কি মহিলাকে বলা ঠিক হবে? মাত্র তো পরিচয়!

আজকাল কত রকম মহিলার কথা শুনি। যুবতি মেয়েদের ভুলিয়েভালিয়ে ঘর থেকে বের করে নানা রকম খারাপ কাজে লাগিয়ে দেয়। পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেয় শুনেছি। যদিও এই মহিলাকে তেমন মনে হচ্ছে না।

আবার মনে হয়, চেহারা দেখে কি মানুষ চেনা যায়? কথা শুনে কি মানুষ চেনা যায়? বইতে পড়েছি ‘দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথা’। দুষ্ট লোকের কথা কী রকম মিষ্ট হতে পারে তার বড় প্রমাণ শিমুল। যার জন্য আজ আমি পথে নেমেছি।

না, চট করেই মহিলার কাছে ধরা দেওয়া ঠিক হবে না। বললাম, ‘আমি আসলে যাব গাজীপুরে। এই বাস সরাসরি গাজীপুর যাবে না। যাবে ঢাকায়। বাস টার্মিনালে এক আত্মীয় আসবে আমাকে নিতে। আগে কখনো ঢাকায় যাইনি। ওই আত্মীয়দের বাসা যে কোথায় তা-ও জানি না। দু এক দিন ওদের বাসায় থেকে তারপর গাজীপুরে যাব।’

মহিলা তীক্ষ চোখে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম তাঁর কপালে ভাঁজ পড়েছে। অর্থাৎ তিনি কিছু ভাবছেন। বুঝে ফেললেন নাকি আমি মিথ্যে কথা বলছি?

কেউ কেউ মিথ্যে বলাটা সহজেই ধরে ফেলে। মহিলা কি সেই রকম? তবে শুধু চোখ দেখে কারো মিথ্যে বলা ধরতে পারা খুবই কঠিন। মুখ পুরোপুরি দেখতে পেলে মিথ্যে ধরা সহজ হয়। মুখ নিঃশব্দেও অনেক কিছু বলে দেয়।

নিজের কথা আমি তাঁকে আর বলতে চাইলাম না। ভাব জমিয়ে দেখতে চাইলাম তাঁর অবস্থাটা কী? স্বামী কী করেন, তিনি থাকেন কোথায়, কী বৃত্তান্ত?

‘ঢাকায় আপনি থাকেন কোথায়? আপনার স্বামী কী করেন?’

‘স্বামী নেই। থাকি উত্তরায়।’

‘আগে বললেন ছেলেমেয়ে নেই, এখন বলছেন স্বামীও নেই। তাহলে আপনার চলছে কী করে? আত্মীয়-স্বজনের কাছে থাকেন?’

‘না। তাঁরা আমার আত্মীয়-স্বজন না। আমি চাকরি করি।’

‘এত প্রশ্ন করছি, আপনি কিছু মনে করছেন না তো?’

‘না গো, মা। মনে করব কেন? তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। একা একা চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকা খুবই কষ্টের। এই যে তোমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছি, সময়টা ভালো কেটে যাচ্ছে। তোমার যা জানতে ইচ্ছা করে জিজ্ঞাসা করো আমাকে। কোনো সমস্যা নেই।’

আমি একটু নড়েচড়ে সহজ হয়ে বসলাম। কথা বলতে যাব, তার আগেই মহিলা বললেন, ‘অনেক বছর ধরে আমি এক সাহেবের বাড়িতে চাকরি করি। তবে কাজের বুয়ার চাকরি না। আমি কিছুটা লেখাপড়াও শিখেছিলাম। স্বামী মারা যাওয়ার পর আর বিয়েশাদি হয়নি। যে সাহেবের বাড়িতে চাকরি করি তাঁর ওখানে আমার স্বামীও চাকরি করত। সাহেবের বউ মানে ম্যাডাম আট বছর আগে পঙ্গু হয়ে গেলেন। কথা বলতে পারেন না, চলাফেরা করতে পারেন না। চব্বিশ ঘণ্টা বিছানায়। বাড়িতে তিনজন কাজের বুয়া আছে। অল্পবয়সী একটা মেয়ে আছে। তারা রান্নাবান্না আর সংসারের অন্যান্য কাজ করে। পুরুষ কাজের লোকও আছে। আমার কাজ হচ্ছে শুধু ম্যাডামের সেবাযত্ন করা। তাঁকে খাওয়ানো, গোসল করানো, সময়মতো ওষুধ দেওয়া, হুইলচেয়ারে বসিয়ে কখনো কখনো বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া—এটাই আমার চাকরি। থাকা খাওয়া বাদে ভালোই বেতন পাই। ভালো মানে কি, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় অনেকই ভালো। সাহেবের অবস্থা ভালো। ব্যবসা বাণিজ্য আছে। একটাই ছেলে। ছেলে থাকে আমেরিকায়। দেশে আসেই না। মাসে এক দুবার ফোন করে মায়ের খবর নেয়। আমি ওই বাড়িতে ভালোই আছি। অনেক ভালো।’

মহিলার অবস্থা দেখি অনেকটাই আমার খালার মতো। একজন পঙ্গু মহিলার সেবা করছেন আট বছর ধরে! মানুষ খারাপ হলে এ রকম কাজ করতেন না! চব্বিশ ঘণ্টা রোগীর সেবা করার চেয়ে কঠিন আর বিরক্তিকর কাজ হতে পারে না। তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা বেতন দিয়েও এ রকম কাজের লোক পাওয়া যায় না। তার মানে, মনের দিক দিয়ে মহিলা নিশ্চয়ই ভালো। মানুষের জন্য নিশ্চয়ই তাঁর দরদ অনেক।

‘আপনার বাড়ি কি দিনাজপুরেই?’

‘না। আমার বাবার বাড়ি ছিল গোয়ালন্দে। অনেক আগে নদীতে ভেঙে গেছে। কোনো ভাই ছিল না। আমরা দুটি মাত্র বোন। মা-বাবা মারা গেছে বহু আগে। বড় বোনটার বিয়ে হয়েছিল দিনাজপুরে। সেও মারা গেছে সাত বছর আগে। তার একটাই ছেলে। গরিব ঘর। ছেলেটার ছোট একটা চায়ের দোকান আছে। তিনটা ছেলেমেয়ে। যা রোজগার করে তাতে চলতে পারে না। সেই ছেলেটাকে দেখতে বছরে আমি এক আধবার আসি। অবস্থা বেশ খারাপ। যেটুকু পারি সাহায্য করি। যা বেতন পাই তার অনেকটাই ওদের দিয়ে দিই। আমার তো আর কেউ নেই। স্বামীর বাড়ি ছিল কাপাসিয়া। সে মারা যাওয়ার পর ওদিককার কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। আমি ঝাড়া হাত-পায়ের মানুষ। আছে শুধু বোনের ওই ছেলেটাই।’

সত্যি সত্যি আমার খালার মতো জীবন এই মহিলার।

খালার পাশাপাশি মামুর কথাও আমার মনে পড়ল। লালু মামু। আশ্চর্য ব্যাপার, যে মানুষগুলো জন্মের পর থেকে আমাকে ঘিরে রেখেছেন, তাঁরা সবাই দেখি প্রায় একই রকম। ভালো মানুষ, নিঃসঙ্গ মানুষ। যেমন—আমার খালা, যেমন—লালু মামু।

মানুষ হিসেবে মামা মামিও অতুলনীয়। আমার অসহায় মামিটির সঙ্গেও এই মহিলার অদ্ভুত মিল। মামিও তাঁর পঙ্গু অথর্ব ছেলেটিকে চব্বিশ ঘণ্টা আগলে রাখছেন। যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম, পথে বেরিয়ে যে মানুষটিকে পেলাম, সেও দেখি ও রকমই আরেকজন! একজন অথর্ব মহিলাকে দেখাশোনার চাকরি করেন।

মহিলার প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে গেল। মনে হলো এই মহিলার কাছে আশ্রয় প্রশ্রয় পাব। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন।

শিমুলকাঁটা

দুই

দুপুরের দিকে বাস একটা বড় চত্বরের মধ্যে ঢুকল।

সেখানে আরো বাস, গাড়ি থেমে আছে। নারী-পুরুষ সব ধরনের যাত্রী বাস থেকে নামছে, বাসে উঠছে। গাড়িতে উঠছে, নামছে। মুহূর্তেই দেখতে পেলাম, দোতলা সুন্দর বিল্ডিংটির সামনে বড় করে লেখা ‘ফুড ভিলেজ’। অর্থাৎ যাত্রীদের খাওয়াদাওয়া ও ফ্রেশ হওয়ার জায়গা। এখানে যাত্রীরা নামবে।  ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাওয়া সেরে আবার বাসে চড়বে।

সুপারভাইজার উঁচু গলায় যাত্রীদের বলল, ‘এখানে আমরা দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। ঠিক আধঘণ্টা সময়। কেউ দেরি করবেন না। আধঘণ্টার মধ্যে সব শেষ করে বাসে উঠতে হবে। আবারও বলছি, দেরি করা যাবে না।’

ততক্ষণে মহিলাকে আমি খালা ডাকতে শুরু করেছি। একফাঁকে দুজন দুজনার নাম জেনে নিয়েছি। তাঁর নাম নাজমা বেগম। সবাই নাজু বলে ডাকে। আমার চৈতি নামটা জানার পর একবারও তিনি আমার নাম ধরে ডাকেননি। মা মা করছেন। ভারি মায়াবী ডাক। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো গো মা, খাওয়াদাওয়া করে নিই। বাথরুমও সেরে নিয়ো।’

মা ডাকের সঙ্গে ‘গো’ কথাটা লাগানোর ফলে ডাকটা আরো মধুর লাগে। অন্তরঙ্গ ও মায়াবী লাগে। আমিও মাঝে মাঝে, গভীর আবেগের মুহূর্তে শিমুলকে ‘কী হয়েছে গো’ ইত্যাদি বলেছি। হায় রে আমার প্রেম!

খালার পিছন পিছন বাস থেকে নামলাম। একফাঁকে মনে হলো, ব্যাগটা কি সঙ্গে নেব? যদি চুরি হয়ে যায়?

কথাটা বললাম খালাকে। তিনি হাসলেন। ‘এইসব বাসে জিনিসপত্র চুরি হওয়ার ভয় নেই। দেখছ না, সবারই ব্যাগ স্যুটকেস বাসে রয়ে গেল! সুপারভাইজার লোকটা ভালো। সে সব দিকে খেয়াল রাখবে।’

খেতে বসার পর খালা আমার মুখটা পুরোপুরি দেখতে পেলেন। বোরকায় মুখ ঢেকে তো আর খাওয়া যায় না! মুখ থেকে আবরণ সরানোর পরই দেখি খালা মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওয়াশরুম ইউজ করে আমি শুধু হাত ধুয়েছিলাম, মুখ থেকে বোরকা সরাইনি। তখনো খালা আমার পাশেই ছিলেন। তবে এই প্রথম আমার মুখ দেখে তিনি যে খুব মুগ্ধ হয়েছেন তা বুঝতে পারি। আমার মুখ থেকে চোখ সরাচ্ছেনই না। চোখে তাঁর পলকও পড়ছে না।

এত মুগ্ধ হওয়ার কী হলো? আমি কি তেমন সুন্দরী? হ্যাঁ, আমার চোখ দুটি ডাগর। শ্যামলা রঙের মুখটা মিষ্টি। দাঁতের কারণে হাসি সুন্দর। তাই বলে এত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার কী আছে?

হাসিমুখে বললাম, ‘কী হলো, খালা? এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?’

খালার চোখে পলক পড়ল। মনে হলো মুগ্ধতা আরো বাড়ল তাঁর। বললেন, ‘তোমার চোখ দুটি ভারি সুন্দর, মা। সুন্দর চোখের মেয়েদের এমনিতেই খুব ভালো লাগে। এখন দেখছি তোমার চেহারাও খুব মিষ্টি। হাসিটি ভারি সুন্দর। বসা অবস্থায় মানুষের ফিগার বোঝা যায় না। বাস থেকে নেমে তুমি যখন আমার সঙ্গে হেঁটে এলে, সেই ফাঁকে আমি তোমার ফিগার খেয়াল করলাম। তোমার ফিগারও  সুন্দর। সব মিলিয়ে তুমি মা খুবই সুন্দরী মেয়ে।’

প্রশংসা শুনলে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বেশি খুশি হয়। আমিও হলাম। পাশাপাশি ভয়ও পেলাম। মহিলা এত মুগ্ধ আমার ব্যাপারে, এত সরাসরি প্রশংসা করছেন, লক্ষণটা কি ভালো?

‘দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথা’ প্রবাদটা আবার মনে পড়ে।

শিমুলকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর থেকে আমি যেন মানুষজনকে এক নতুন চোখ নিয়ে দেখতে শুরু করেছি। প্রতিটি মানুষকেই যেন সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে শুরু করেছি। আগে এ রকম করে ভাবতাম না। শিমুল যেন আমার চোখ খুলে দিয়ে গেছে। আমার মনের ভিতর যেন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে নতুন করে মানুষকে নিয়ে ভাবার অনুভূতি। আগের মতো খুব সহজেই যে কাউকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। ঘরপোড়া গরু হয়ে গেছি। সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পাই।

এই মহিলার মিষ্টি মিষ্টি কথা আর ব্যবহার আমাকে কোনো সর্বনাশের দিকে ডেকে নেবে না তো? যে উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছি, সেই উদ্দেশ্য থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে নেবে না তো আমাকে?

না, উদ্দেশ্য থেকে কেউ বোধ হয় আমাকে আর ফেরাতে পারবে না। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমি তৈরি। তবে সবকিছুর পরেও আমার মাথায় শুধু শিমুলের চিন্তা। তাকে আমি খুঁজে বের করবই। তার মুখোমুখি আমি দাঁড়াবই। জানতে আমি চাইবই, কেন সে আমার সঙ্গে এই প্রতারণা করল? প্রতারণার শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

‘থিংক পজিটিভ’ কথাটা মনে আসে। আমি যা ভাবছি, বা সেই রাতের পর থেকে যা ঘটে চলেছে, পুরো ব্যাপারটাই যদি উল্টো হয়? সেই আগের ভাবনা। যদি...

মানুষের জীবনে কত ঘটনা ঘটে!

লালু মামুর কাছ থেকে আনা নভেল পড়ে পড়ে কত বিচিত্র জীবনের গল্প জেনেছি! সিনেমা টেলিভিশনে দেখেছি। আমি কল্পনাও করিনি এমন কিছু যদি শিমুলের জীবনে ঘটে থাকে? যদি...

আমাকে নিবিড় করে, সারা জীবনের জন্য পাওয়ার পথ খুঁজতেই যদি ওভাবে উধাও হয়ে থাকে সে? যদি...

যে মিথ্যা মামলায় সে জড়িয়ে আছে, সেই ক্ষেত্রেও যদি হয়ে থাকে কোনো জটিলতা? যদি...

পুরনো মোবাইল অফ করে, অন্য ছদ্মবেশ ধরে যদি তাকে আরো কঠিন কোনো অজ্ঞাত স্থানে চলে যেতে হয়ে থাকে? যদি...

ও রকম হলে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে সে। তার সঙ্গে আমিও শিকার হয়েছি অদ্ভুত এক পরিস্থিতির।

খালা বললেন, ‘এত কী ভাবছ, মা? কী খাবে তার অর্ডারও তো দিচ্ছ না?’

খালার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। ‘না না, তেমন কিছুই ভাবছি না।’

‘তাহলে কী খাবে বলো?’

‘আপনি অর্ডার দেন। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি যা খাবেন, আমিও তা-ই খাব। ভাত মাছ ডাল, অথবা ভাত মাংস ডাল, যেটা হয়।’

খাওয়ার ফাঁকে খালা আমার পারিবারিক খোঁজখবর নিতে লাগলেন। ‘তোমার বাবা কী করেন? কয় ভাই-বোন তোমরা? তুমি গাজীপুরে যাচ্ছ কেন? কার কাছে যাচ্ছ? পড়াশোনা করো? কী পড়ো? তোমার তো বোধ হয় বিয়ে হয়নি?’

মুখে ভাত তুলতে গিয়েও তুললাম না। খালার মুখের দিকে তাকালাম। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে চাইলেই গড়গড় করে বলে যেতে পারি। খালা যা যা জানতে চাইছেন, তার প্রতিটি কথারই বানানো জবাব দিতে পারি। তা কি করব? নাকি পরিষ্কার হয়ে যাব মহিলার কাছে? যদি সে ক্ষেত্রে তাঁর কোনো সাহায্য পাই? নাকি আড়ালেই রাখব নিজেকে?

হাসিমুখে বললাম, ‘আমি আপনাকে সব বলব, খালা। তার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি! আমার কথা শুনে অন্য কিছু মনে করবেন না তো?’

মহিলা আগের মতোই মায়াবী গলায় বললেন, ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, মা। আমি মানুষ খারাপ না। তুমিই বলেছ, তুমি আমার মেয়ের মতো। আমাকে সব বলতে পারো। অবশ্য তোমার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।’

‘বলব, আপনাকে আমি সব বলব।’

তেমন কিছু না ভেবেই তাঁকে সবকিছু বলার প্রস্তুতি নিলাম। জানুক না মানুষটি আমার কথা! কী হবে তাতে? কী ক্ষতি তিনি আমার করবেন? বাস থেকে নেমেই তিনি চলে যাবেন তাঁর পথে, আমি যাব আমার পথে। এই জীবনে তাঁর সঙ্গে হয়তো আমার আর দেখাই হবে না। জানুক না একজন মানুষ আমার কথা! লালু মামু জেনেছেন, শিরিন জেনেছে, তৃতীয় আরেকজন জানুক!

তার পরই মনে হলো, এই যে ভাবলাম, ঢাকার বাস টার্মিনালে নেমে তিনি যাবেন এক দিকে, আমি যাব আরেক দিকে, কিন্তু কোন দিকে যাব আমি? আমার যাওয়ার জায়গাটা কোথায়? ঢাকার কিছুই চিনি না। রাতে থাকব কোথায়? পথেঘাটে মেয়েদের বিপদের অন্ত নেই! ঘরে-বাইরে কোথাও একটি মেয়ে সেই অর্থে নিরাপদ না। বিদেশে থাকা বাপ বহুদিন পর বাড়ি ফিরে নিজের মেয়েকে রেপ করেছে, এ রকম খবরও শুনি। চলন্ত বাসে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয় মেয়েদের। ট্রেনে করা হয়। সুযোগ পেলে কেউ আমাকে ছাড়বে না। নিজের শক্তি আর সাহস দিয়ে কতক্ষণ ধর্ষকদের আমি ঠেকিয়ে রাখব? কখনো কখনো থানাহাজতেও মেয়েরা সেভ না। তাহলে? আমার দেখছি পদে পদে বিপদ। কারো না কারো সাহায্য লাগবেই! এ ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বিশ্বাসী।

বাসে বসে নিজের সব কথা খালাকে আমি বলে দিলাম। তিনি খুব মন দিয়ে প্রতিটি কথা শুনলেন। এই ধরনের কথা বলতে গিয়ে মেয়েরা সাধারণত কেঁদে ফেলে। আমি কাঁদলাম না। বুক ফেটে যাচ্ছিল সব বলতে গিয়ে। নিজেকে শক্ত রেখে বললাম।

সব শুনে খালা প্রথমে কেমন দিশাহারা হলেন, তারপর নিজেকে সামলালেন। ধীর শান্ত গলায় বললেন, ‘অনেক বড় ঝুঁকি তুমি নিয়ে ফেলেছ। যেভাবে শিমুলকে খুঁজে বের করার কথা ভেবেছ, এই চিন্তাটা ঠিক হয়নি। যে ছেলে এমন প্রতারণা করেছে তোমার সঙ্গে, সে যে গাজীপুরেরই ছেলে তার কী নিশ্চয়তা আছে? ছয়তলা বাড়ি, নিজেদের মার্কেট, বড় দোকান। আমার মনে হয় তার এসব কথার একটিও সত্য না। পুরোটাই ভাঁওতাভাজি। পুরোটাই ধোঁকা। কথাবার্তা শুনে মনে হলো তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। পথে নামার আগে এই কথাটা কি একবারও মনে হলো না তোমার? বোকার মতো এই রকম সিদ্ধান্ত তুমি কেন নিলে? তোমার বয়সী একটি মেয়ে এইভাবে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায়? কত রকমের বিপদে তুমি পড়তে পারো তা কি তুমি জানো?’

‘আমি সব জেনেবুঝেই পথে নেমেছি, খালা। যা হওয়ার হবে। শিমুলকে আমি খুঁজে বের করবই।’

বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন খালা। ‘আমার মাথায় কিছুই আসছে না। কেমন করে ও রকম একজন মানুষকে তুমি খুঁজে বের করবে? যে নেতার কথা বললে, যাঁর আশ্রয়ে সে ছিল, সেই নেতাই তো, বা তাঁর লোকেরাই তো শিমুলকে চিনতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কোন সূত্র ধরে এগোবে তুমি? কোথায় পাবে তাকে? এ তো সুমদ্রে আলপিন খোঁজার মতো ব্যাপার।’

খালার এসব কথা আমার কানেই যাচ্ছিল না। আমার শুধুই মনে হচ্ছে, শিমুলকে আমি খুঁজে বের করব। যেভাবেই হোক, যেখান থেকেই হোক, তাকে আমি বের করবই। তার মুখোমুখি আমি দাঁড়াবই। এই মুহূর্তে আমার মাথায় অন্য কিছু নেই।

বাইরে দুপুর ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাস ছুটে চলেছে ঢাকার দিকে।

এখনকার ব্যাগগুলো পিঠে নেওয়ার সুবিধা আছে। গ্রামের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা এ রকম ব্যাগ ব্যবহার করে। বেশ একটা গালভরা নামও আছে ব্যাগগুলোর। হ্যাভারসেক। আমার ব্যাগটা ও রকমই। বাস থেকে নামার আগেই ওভাবে পিঠে নিয়েছি। পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাঁটাচলায় অনেক সুবিধা। হাত দুটি ফ্রি থাকে।

খালার পিছন পিছন বাস থেকে নেমেছি। তার আগে বোরকায় সুন্দর করে মুখ ঢেকেছি। শুধু চোখ দুটি দেখা যায়।

এখন আমি যাব কোথায়?

খালা আমার চোখের দিকে তাকালেন। ‘এখন কী করবে? কোথায় যাবে?’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে টাকা-পয়সা আছে। আশপাশের কোনো সস্তা হোটেলে গিয়ে উঠব।’

‘সেটা একদমই ঠিক হবে না। ওইসব হোটেলে বহু রকমের লোক থাকে। তোমার মতো একা একটা মেয়ের জন্য ও রকম হোটেল মোটেই নিরাপদ না। স্ত্রীকে নিয়ে স্বামী উঠেছে হোটেলে। স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে বেইজ্জতি করা হয়েছে। এ রকম ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।’

‘ওসব আমিও জানি, খালা।’

‘তোমার জানার কথা। আজকালকার দিনে যেখানে যা ঘটে, দেশের সবাই তা জেনে যায়। মেয়েমানুষের শরীর এমন, একবার সেই শরীর নষ্ট হলে, একবার শরীরের ও রকম ক্ষতি হয়ে গেলে সারা জীবনেও তা আর ঠিক হয় না। এমন দুর্নাম হয়, সেই দুর্নাম আর কাটানো যায় না।’

আমি অসহায় চোখে খালার মুখের দিকে তাকালাম। ‘তাহলে আমি এখন কী করব? কোথায় যাব?’

খালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘তোমার ঘটনা জানার পর থেকে তোমাকে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিরাট ভুল করে ফেলেছ। একটা কাজ তোমার জন্য আমি করতে পারি। আত্মীয় পরিচয় দিয়ে দু-তিন দিন তোমাকে আমার সঙ্গে রাখতে পারি। বা সাত দিনই তুমি থাকলে। সেই ফাঁকে আমিই না হয় তোমাকে নিয়ে গাজীপুরে গেলাম। তবে আমার অনুমান মিথ্যা হবে না, মা। গাজীপুরে শিমুলকে তুমি পাবে না। তার পুরোটাই ভাঁওতাবাজি। মিথ্যা। প্রতারণা। তার পরও সাত দিন আমার সঙ্গে স্যারের ফ্ল্যাটে থেকে তুমি বাড়ি ফিরে যেয়ো। এ ছাড়া আমি কোনো পথ দেখছি না।’

‘আপনার কথাগুলো ভালো। এভাবে কাজটা আমি করতে পারি। তবে বাড়িতে আমি আর ফিরে যাব না। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা একটি যুবতি মেয়ে সেই বাড়িতে ফিরে গেলে লোকে তাকে দুশ্চরিত্রা মনে করবে। বলবে, সাত দিন কোথায় কার সঙ্গে থেকে ফিরে এসেছে। যার জন্য বাড়ি ছেড়েছিল, সে লাথি মেরে বিদায় করে দিয়েছে। কোথাও জায়গা না পেয়ে আবার ফিরে এসেছে। দুর্নাম আমার দুদিকেই। পালিয়ে আসাটাও দুর্নাম, ফিরে যাওয়াটাও দুর্নাম। সুতরাং ফিরে আমি যাব না, খালা। আমি শিমুলকে খুঁজে বের করব। তার জন্য নষ্ট হতে হলে হব। সে আমার সঙ্গে যা করেছে, আমি তার প্রতিশোধ নেবই।’

খালা চঞ্চল হলেন। ‘ঠিক আছে, এখানে দাঁড়িয়ে এত কথা বলার দরকার নেই। এসব নিয়ে পরে কথা বলব। চলো আমার সঙ্গে। তুমি আমাকে খালা বলছ, তাতে একটা সুবিধা হয়েছে। স্যারকে আমি বলব, তুমি আমার খালাতো বোনের মেয়ে। কখনো ঢাকায় আসোনি। ঢাকা দেখার শখ। এ জন্য আমার সঙ্গে এসেছ। কয়েক দিন থেকে ফিরে যাবে।’

‘ঠিক আছে।’

একটা সিএনজি নিয়ে খালার সঙ্গে আমি উত্তরার সেই সাহেবের বাড়িতে এসে উঠলাম।

শিমুলকাঁটা

তিন

একই সীমানার ভিতর পাশাপাশি দুটি সাততলা বিল্ডিং। ধপধপে সাদা রং করা। প্রতি তলার বারান্দায়ই সুন্দর রেলিং দেওয়া। সাদা আলো জ্বলছে। নিচতলায় গ্যারেজ। গ্যারেজে অনেক দামি দামি গাড়ি। বাড়িতে ঢোকার মুখে নানা রকম ফুলের ঝাড়। দক্ষিণমুখী বাড়ির পাশেই রাস্তা। রাস্তার ওপারে লেক। লেকের ধারে প্রচুর গাছপালা। ফুলের ঝাড়। রাত হয়ে গেছে। তবু আলোয় ঝলমল করছে এলাকাটা।

খালা আমাকে নিয়ে প্রথম বিল্ডিংটায় ঢুকলেন। গাড়ি ঢোকার গেট বন্ধ। আমরা ঢুকলাম পকেট গেট দিয়ে। গেটের পাশেই সিকিউরিটি রুম। দুজন সিকিউরিটির লোক বসে ছিল। একজন চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে। সে একটু বয়স্ক। অন্যজন মধ্যবয়সী। খালাকে দেখে হাসল। ‘বেড়ানো কেমন হলো, নাজু আপা?’

খালা হাসলেন। ‘ভালোই হয়েছে, বাতেন ভাই। তোমরা ভালো আছ তো?’

‘হ, ভালোই আছি। স্যারের বাড়িতে ভালো না থাকলে আর কই থাকুম? লগে কারে লইয়া আইলা?’

‘আমার খালাতো বোনের মেয়ে। ঢাকায় কোনো দিন আসেনি। এবার আমার সঙ্গে বেড়াতে আসছে। কয়েক দিন থেকে চলে যাবে।’

আমি আগের মতোই মুখ ঢেকে রেখেছি বোরকায়। শুধু চোখ দুটি দেখা যায়। বাতেন লোকটাকে একটু খেয়াল করে দেখলাম। অমায়িক ধরনের মানুষ।

ভিতর দিকে পাশাপাশি দুটি লিফট। লিফটের এক পাশে সিঁড়ি। ঝকঝকে তকতকে সবকিছু। লিফটে করে দোতলায় এলাম। এই ধরনের বাড়ির গেটে যারা থাকে, অর্থাৎ পাহারাদার, তাদের এখন আর দারোয়ান বলা হয় না। বলা হয় সিকিউরিটির লোক। লিফটম্যান থাকে কোনো কোনো বাড়িতে। এই বাড়িতে বোধ হয় তার দরকার নেই। আমি প্রায় অজপাড়াগাঁয়ে বড় হয়েছি। তার পরও শহরের বাড়িঘর বা অফিস আদালতের এইসব ব্যবস্থার সবকিছুই জানি। সিনেমা আর টিভি নাটক দেখে জেনেছি।

যারা জীবনে প্রথম লিফটে চড়ে, তাদের অনেকেরই নাকি ভয় করে। কারো কারো শুনেছি মাথাও ঘোরায়। আমার ওসবের কিছুই হলো না। বরং অন্য রকমের একটা অনুভূতি হচ্ছে। এ আমার নতুন অভিজ্ঞতা। ঢাকায় আসা। এ রকম বাড়িতে আসা। সবকিছুই শিমুলের জন্য। নিজের পরিচিত ছোট্ট জগতের মধ্য থেকে শিমুল আমাকে টেনে এনেছে অন্য এক জগতে। সিনেমা নাটকে দেখা জগৎ।

দুবার ডোরবেল বাজালেন খালা। একজন লোক এসে দরজা খুলল। পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট পরা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার ঘন চুলে সামান্য পাক ধরেছে। তবে বয়স তেমন না। চল্লিশের কিছু ওপরে হবে। খালাকে দেখেই বলল, ‘সময়মতো আইসা ভালো করছ, নাজু আপা। ম্যাডাম খালি চারদিক তাকাইয়া তোমারে খোঁজে।’

‘খুঁজবেনই তো। আমিই তো সারাক্ষণ তাঁর দেখাশোনা করি। আমি যা পারি, অন্যে কি তা পারবে? তুমি আছ কেমন, জাহাঙ্গির?’

‘আল্লায় ভালো রাখছে। লগে কারে লইয়া আইলা?’

সিকিউরিটির বাতেনকে যা বলেছিলেন খালা, জাহাঙ্গিরকেও তা-ই বললেন। শুনে জাহাঙ্গির হাসিমুখে বলল, ‘ভালোই করছ। বইনঝি বেড়াক কয়েক দিন আমাগো এখানে। নাম কী বইনঝির?’

‘চৈতি।’

‘সোন্দর নাম। শোনো চৈতি, নাজু আপারে আমরা আপা ডাকি। এই বাড়ির বড় বইন। সেই হিসাবে তুমি আমাগো ভাগ্নি। যাও, ভিতরে যাও। আমাগো দলবলের লগে পরিচিত হও। বেবাকতেরেই তোমার পছন্দ হইব। স্যারের বাড়িতে কোনো খারাপ মানুষ থাকতে পারে না। আমরা প্রত্যেকেই পুরানা লোক।’

বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গেই প্রথমে পরিচয় হলো আমার। তিনজন মহিলা, আরেকটি কিশোরী মেয়ে। মেয়েটির নাম ময়না। সে দেখতে ভালোই। গায়ের রং শ্যামলা। চেহারা মন্দ না। মহিলা তিনজনের একজন ‘পাখির মা’। একজন পরিবানু, আরেকজনের নাম খুকি। বাড়ির কাজের লোকদের সাধারণ যেমন চেহারা হয়, তারা তেমনই। তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাপড়চোপড় ভালোই পরা। দুজন পরেছে শাড়ি। খুকির পরনে সালোয়ার কামিজ। অন্যদের তুলনায় সে সামান্য মোটা। মোটা না বলে স্বাস্থ্যবতী বলা ভালো। শক্তপোক্ত মহিলা। দেখলেই বোঝা যায় শরীরে বেদম শক্তি। আমাকে তারা বাড়ির অতিথি হিসেবে হাসিমুখে গ্রহণ করল। খালাকে তাদের তুলনায় উচ্চ পর্যায়ের মনে হলো আমার। বোধ হয় ম্যাডামের দেখভাল করেন বলে কাজের লোকদের কাছে অন্য রকমের মর্যাদা আছে তাঁর। সবাই তাঁকে বেশ সমীহ করে।

খালা আমাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন। পাশাপাশি দুটি রুম। সুন্দর পর্দা টানানো আছে। দুই রুমেরই পর্দা সরানো। একটা রুম বেশ বড়। মুখোমুখি দুটি খাট রাখার পরেও মাঝখানে অনেকখানি জায়গা। বুঝলাম ময়নাকে নিয়ে তিন মহিলা দুই খাটে ভাগ করে ঘুমায়। সুন্দর বড় আলমারি আছে রুমে। ড্রেসিং টেবিল আছে। অ্যাটাচড বাথরুম। দেয়ালে মাঝারি সাইজের একটা টেলিভিশন টাঙানো। একেবারে সাহেবি ব্যবস্থা।

আমি একটু অবাকই হলাম। বাড়ির কাজের লোকদের জন্যও এ রকম ব্যবস্থা? দারুণ তো!

খালার রুম দেখে সেই বিস্ময় আরো বাড়ল। এই রুমটা মাঝারি আকৃতির। খাটে চমৎকার বিছানা। সুন্দর চাদর, বালিশ। দেয়ালে টেলিভিশন। সুন্দর আলমারি আছে। লম্বা কাচ লাগানো আলমারিটি ড্রেসিং টেবিলেরও কাজ দিচ্ছে। একপাশে সুন্দর টেবিল চেয়ার। টেবিলের ওপর দু-তিনটা ফাইল, একটা ডায়েরি। কলমদানিতে কয়েকটা কলম। দু-তিনটা বই। এই রুমেও অ্যাটাচড বাথরুম।

খালা বললেন, ‘এই রুমে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে, মা। বাড়ির কাজের লোকজনদের দেখে বুঝেছ তারা কেমন? যে কদিন ইচ্ছা নিশ্চিন্তে থাকো। ম্যাডাম কথা বলতে পারেন না। তবে বোঝেন সবই। তাঁর সঙ্গে, স্যারের সঙ্গেও তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। একটু বসো। আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি। বাইরে থেকে এলে ফ্রেশ না হয়ে ম্যাডামের কাছে যাওয়া যায় না। ডাক্তারের নিষেধ। আমি তাঁর রুমে গেলে তুমি ওয়াশরুমে ঢুকো। ফ্রেশ হয়ে এখানেই বসো। টিভি ছেড়ে দিচ্ছি। টিভি দেখো। এখন চা বিস্কুট খাও। নাকি একবারে রাতের খাবার খেয়ে নেবে?’

আমি বোরকা খুলে রেখেছি। ভিতরের পোশাক দেখে খালা অবাক। মুগ্ধ গলায় বললেন, ‘তোমাকে তো গ্রামের মেয়ে মনেই হয় না। পোশাক-আশাক, চাল-চলন, কথাবার্তা—সবই শহুরে মেয়েদের মতো। শিমুল কি আর সাধে পাগল হয়েছিল তোমার জন্য?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

পরদিন পুরো ফ্ল্যাট খালা আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরে দুটি করে ফ্ল্যাট। শুধু দোতলা আর একতলায় দুই ফ্ল্যাট একত্র করে একটি করে বিশাল ফ্ল্যাট করা হয়েছে। দোতলায় সাহেব-ম্যাডাম থাকেন। সাহেবের নাম রাশিদুল হাসান। বড় ব্যবসায়ী। তিনটা গার্মেন্টেসের মালিক। ফ্যাক্টরিগুলো কোনাবাড়ি নামের একটা জায়গায়। নিজে থাকার জন্য ফ্ল্যাটটি রাজকীয়ভাবে সাজিয়েছেন। সব মিলিয়ে সাত-আটটার কম হবে না রুম। ড্রয়িংরুমটি বিশাল। যেসব শোপিস ড্রয়িংরুমে আছে, দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ঝাড়বাতিটার দাম হবে কয়েক লাখ টাকা। শোপিস রাখার আলমারিগুলো অপূর্ব। সোফা-কার্পেটের দিকে তাকালেই মনে হয় টাকা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সেই রুমের পাশে দুটি রুম। একটা সাহেবের একান্ত নিজস্ব। বিশেষ কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য রুমটি তিনি ব্যবহার করেন। অন্য রুমটিতে তাঁর পিএস বসেন। সেটা আসলে অফিসরুম। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন বাড়িতে বসেই অফিস করেন তিনি। পিএসের নাম জুনায়েদ। স্যুট-টাই পরা স্মার্ট তরুণ। একজন পিয়ন আছে। মনসুর সাহেব। সকাল ন’টায় আসে তারা, বিকেল পাঁচটায় চলে যায়। অনেকটাই সরকারি অফিসের নিয়ম। সপ্তাহে দুদিন ছুটি। শুক্র, শনি। দোতলার অফিসেও একজন পিএস আছে। মেহেদী সাহেব। আরো দুজন পিয়ন আছে। হান্নান আর মুরাদ। অফিসরুম, ড্রয়িংরুম ও তাঁর নিজস্ব রুমটির দেয়ালে সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং টাঙানো। এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়ার প্যাসেজেও আছে পেইন্টিং। এ রকম একটা ফ্ল্যাটে জীবনে কোনো দিন ঢুকতে পারব ভাবতে পারিনি।

শিমুলের জন্য। সব শিমুলের জন্য।

তখনও সাহেবকে আমি দেখিনি। তিনি একটু সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন। আমাকে যখন খালা নিচের ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন ডাইনিংরুমে দেখেছিলাম সাহেবের চা নাশতার প্লেট, গ্লাস আর মগ তুলছে জাহাঙ্গির।

তারপর খালা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ম্যাডামের রুমে। এই রুম আসলে সাহেব আর ম্যাডামের বেডরুম। বেশ বড়। তখন পর্যন্ত জানি এক বিছানায় তাঁরা থাকেন না। মুখোমুখি দুটি অনেক দামি খাট। সাহেবের বিছানা শূন্য। অন্য খাটে ম্যাডাম শুয়ে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে বসে ছিল ময়না। আমাদের ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল।

ম্যাডামের বিছানার পাশে রাখা হুইলচেয়ারটার দিকে আমার চোখ গেল। ম্যাডাম সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন। অতি শীর্ণ শরীর। যেন বিছানায় মিশে আছেন। ফরসা মুখখানি ফ্যাকাসে। চোখের কোণে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। চুল কপালের দিক থেকে বেশির ভাগই উঠে গেছে। কপাল চওড়া। চুল যেটুকু আছে তার ফাঁকে ফাঁকে সাদা মাথাটা করুণ ও বিষণ্ন দেখায়।

আহা রে, এ রকম ফ্ল্যাট, এত বিত্ত-বৈভব—এসবের যিনি কর্ত্রী তাঁর এই অবস্থা? কী লাভ এই বিত্ত-বৈভবের? কী লাভ এই শান-শওকতের? এত টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি—কী হয় এসব দিয়ে? এভাবে বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? এ কেমন জীবন?

আমাকে দেখে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন ম্যাডাম। তার আগে খালা আমাকে ম্যাডামের নাম বলেছেন। রেশমা হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছিলেন। সাহেবের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দুই পরিবারের ইচ্ছাতেই বিয়ে হয়েছে। ম্যাডাম অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। স্মার্ট ছিলেন। পরিবারের অবস্থা খুবই ভালো। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করতেন। বিয়ের পর সুন্দর জীবন। সাহেব তখন উঠতি ব্যবসায়ী। ম্যাডামকে নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। সাহেবের অফিসে গিয়েও মাঝে মাঝে বসতেন ম্যাডাম। ছেলে এলো সংসারে। আনন্দ উৎসব আরো বেড়ে গেল সেই ছেলেকে ঘিরে। ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে লাগলেন ম্যাডাম। দেশের বড় বড় ডাক্তার দেখানো হলো। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের নামি হাসপাতালে চিকিৎসা হলো। লাখ লাখ টাকা খরচ হলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না। ম্যাডাম ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে গেলেন। কী কী সব কঠিন নাম আছে তাঁর অসুখের। খালা দু-একটা নাম আমাকে বললেনও। আমি মনে রাখতে পারলাম না।

কী করে পারব? আমার মন আর মাথা জুড়ে শুধু শিমুল। অন্য কিছু মাথায় থাকে কী করে? তা ছাড়া ওসব মনে রাখার দরকারই বা কী! এই পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। খালা মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এখানে তুলেছেন। ঢাকায় আমার আসার মূল উদ্দেশ্য গাজীপুরে গিয়ে শিমুলকে খোঁজা। মনে হয় না তাকে পাব। না পেলে কী করব তা আমার মাথায় নেই। ওসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি। আর পেলে...।

ম্যাডাম তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

খালা হাসিমুখে বললেন, ‘আমার খালাতো বোনের মেয়ে। চৈতি। দিনাজপুরের বিরামপুর কলেজে অনার্স পড়ে। কোনো দিন ঢাকায় আসেনি। এবার আমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। কয়েক দিন থাকবে। খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে আসার আগেই আপনাকে বলা উচিত ছিল। বলতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন। তাহলে এই বাড়িতে আমি ওকে রাখব না। আমাদের আত্মীয়-স্বজন আছে ঢাকায়, তাদের কারো কাছে পাঠিয়ে দেব।’

ম্যাডাম পর পর দুবার চোখে পলক ফেললেন। দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন খালা। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ম্যাডামের প্রতিটা ইশারা আমি বুঝি। তিনি রাগ করেননি। তোকে এই ফ্ল্যাটেই থাকতে বলেছেন। তোকে তিনি পছন্দও করেছেন। দেখছিস না মুখটা হাসি হাসি।’

খালা ইচ্ছা করেই আমাকে ‘তুই’ করে বললেন। কেন বললেন আমি তা বুঝলাম। এ আরো ভালো হলো। সম্পর্কটা সবারই স্বাভাবিক মনে হবে। তার মানে খালাকে আমার ‘তুমি’ করে বলতে হবে। যেমন আমার খালা মামিকে বলি । মামা আর লালু মামুকে বলি।

বেডরুমের দেয়ালে সাহেব-ম্যাডামের বড় একটা ছবি টাঙানো। ভারি উচ্ছল ভঙ্গি দুজনার। নিশ্চয় বিয়ের পর তোলা। সত্যিই ম্যাডাম অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। কী মিষ্টি চেহারা! কী মিষ্টি হাসি! মাথা ভর্তি চুল। টানা টানা চোখ। আহা রে, সেই মানুষটির এই অবস্থা!

সাহেবও দেখতে বেশ সুন্দর। বেশ পুরুষালি চোখমুখ। সুন্দর চেহারা। স্বাস্থ্যও ভালো। তখন বয়স নিশ্চয় শিমুলের মতো। দুজনার তুলনা করলে শিমুলের থেকে যেন সাহেবই বেশি সুন্দর ছিলেন। যদিও আমার চোখে শিমুল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ।

সেই চেহারা, শরীর এখন কি আর আছে সাহেবের? তাঁর বয়স নিশ্চয় পঞ্চাশের ওপর। ছেলে যেহেতু আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ছেলের বয়সও পঁচিশ-ছাব্বিশের কম হবে না। শিমুলের কাছাকাছি।

কিন্তু সাহেবকে দেখে আমি হতভম্ব। এই বয়সেও দেখতে দারুণ। চুলে পাক ধরেনি। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি। গলার চামড়া ঝুলে যায়নি একটুও। চমৎকার স্বাস্থ্য। লম্বা ছয় ফুটের কাছাকাছি। চোখে চশমা আছে। চশমায় তাঁকে বেশ মানিয়েছে। ইয়াং ছেলেদের মতো টাউজার্স আর টি-শার্ট পরে আছেন। বয়স বোঝার উপায়ই নেই। সত্যি বলতে কি, আমি ভিতরে ভিতরে সাহেবকে দেখে মুগ্ধ। এই বয়সে নিজেকে তিনি কী করে এমন রেখেছেন?

পরে অবশ্য জেনেছি তাঁর ও রকম থাকার মন্ত্র।

এই বাড়ির ছাদে নিজের জন্য জিম তৈরি করেছেন সাহেব। ছাদেই করেছেন সুইমিংপুল। নিয়মিত জিম করেন। সাঁতার কাটেন। খাওয়াদাওয়া খুবই অন্য রকম। শরীরসচেতন বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই। শতভাগ নিয়ম মেনে চলা মানুষ।

সকালবেলা ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন সাহেব। পাশে ছোট্ট সুন্দর টেবিলে চায়ের মগ। মগের পাশে কলিংবেল। কাউকে ডাকার দরকার হলে মুখে ডাকেন না তিনি। কলিংবেল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে লোক হাজির। খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। খালা আমাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের পায়ের শব্দে তিনি চোখ তুলে তাকালেন। ‘কিছু বলবে, নাজু?’

ম্যাডামকে আমার কথা যেভাবে বলেছিলেন খালা, সাহেবকেও সেভাবেই বললেন। সেই ফাঁকে আমি লক্ষ করলাম, সাহেব অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরুষ মানুষের চোখের মুগ্ধতা মুহূর্তে বুঝে যায় মেয়েরা। সাহেবের মুগ্ধতাও আমি বুঝলাম। শিমুলের কথা মনে পড়ল। প্রথম দিন তার চোখেও এই রকম মুগ্ধতাই ছিল।

সাহেব বললেন, ‘তোমার বোনের মেয়ে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে, অসুবিধা কী? থাকুক। আমাদের এত বড় দুটি ফ্ল্যাট। থাকার জায়গার তো অভাব নেই। তোমার সঙ্গে তোমার রুমে থাকবে।’

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার নামটা খুব সুন্দর। চৈতি। থাকো যে কদিন ইচ্ছা। কোনো অসুবিধা নেই। কোথাও বেড়াতে যেতে হলে জাহাঙ্গিরকে বোলো। সে ড্রাইভারকে বলে দেবে। গাড়ি নিয়ে যেয়ো। আমাদের গাড়িগুলো তো বসেই থাকে।’

আমি মনে মনে বললাম, ‘আমার কোথাও বেড়াতে যেতে হবে না। আমি যাব গাজীপুরে। শিমুলকে খুঁজতে।’

শিমুলকাঁটা

চার

আনন্দ উত্তেজনায় ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়ছি আমি। আজ সকালে খালাকে নিয়ে রওনা দিয়েছি গাজীপুরে। উত্তেজনার কারণ, যে উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছি, সেই উদ্দেশ্য সফল করা। আনন্দের কারণ, যদি শিমুলের কথা সত্য হয়? যদি তাকে পেয়ে যাই?

আবার সেই ‘যদি’। আমি পড়ে আছি ‘যদি’র মধ্যেই। সবকিছুই অনিশ্চিত। যেভাবে শিমুল আমাকে ফেলে উধাও হয়েছে, যা যা করেছে আমার সঙ্গে, তারপর তার কোনো কথায়ই আর আস্থা রাখা যায় না। ‘যদি’র প্রশ্নটা আসবেই।

খালাও তা-ই বলেছেন। গাজীপুরে আমরা যাচ্ছি ঠিকই, শিমুলকে পাওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। অত সুন্দরভাবে প্রেমের জালে জড়িয়ে যে মানুষটি আমার সর্বনাশ করল, তার কোনো কথাই কি আর বিশ্বাস করা যায়?

তবু মনের ভিতর টিমটিম করে জ্বলে এক আলো। যদি এই কথাটা সত্য হয় শিমুলের। যদি...

সাহেব আমাদের গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। খালাকে বলেছিলেন, ‘চৈতিকে নিয়ে গাজীপুর যাবে, গাড়ি নিয়ে যাও। এতগুলো গাড়ি আমাদের, তিনজন ড্রাইভার। জাহাঙ্গিররা যেই গাড়িটা নিয়ে বাজারে যায়, ওই গাড়ি নিয়ে তোমরা চলে যাও।’

খালা বুদ্ধি করে বলেছেন, ‘আমাদের আত্মীয়-স্বজন স্যার গরিব মানুষ। তাদের কাছে গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বাসে করেই যাই। সন্ধ্যার আগে আগেই ফিরে আসতে পারব।’

সাহেব আর কোনো কথা বলেননি।

আমরা বাসে চড়ে রওনা দিয়েছি। দিনাজপুর থেকে আসার পথে যেভাবে খালা আর আমি পাশাপাশি বসেছিলাম, আজও সেভাবে বসেছি। তিন দিন সাহেবের বাড়িতে কাটানোর পর আজ আমরা পথে বেরিয়েছি। এমনিতেই খালা বেশ কয়েক দিন দিনাজপুরে ছিলেন। ম্যাডামের দেখভাল তিনি করতে পারেননি। তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। খালা না থাকলে ম্যাডামকে দেখে ময়না আর খুকি নামের মহিলাটি। ম্যাডামের কাজগুলো তারাও ভালোই করতে পারে। খাওয়া, গোসল, সময়মতো ওষুধ দেওয়া, মাথায় বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া—সবই। খুকি শক্তপোক্ত মহিলা। স্বামী পরিত্যক্তা। সন্তানাদিও নেই। পিরোজপুরের মানুষ। এগারো বছর ধরে সাহেবের বাড়িতে আছে। ম্যাডামকে কোলে করে বাথরুমে নেওয়া, হুইলচেয়ারে বসানো—এই কাজগুলো সে করে। খালার শরীর একটু দুর্বল ধরনের। ম্যাডামকে নিয়ে বড় গাড়িটায় করে বাইরে বেড়াতে গেলেও খুকিকে সঙ্গে নেন। দুজনে মিলেমিশে ম্যাডামকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন। কখনো কখনো ময়নাও সঙ্গে যায়।

গত তিন দিনে এসব আমি জেনেছি।

সাহেবের বাড়িতে বিস্তর কাজের লোক। দুজন মানুষের জন্য কাজের লোক দশ-বারোজন। তিনজন মহিলা আর ময়না। তাদের ওপর আছেন খালা। জাহাঙ্গিরও একা না। তার সঙ্গে আছে ফজল নামের আরেক লোক। আমি যেদিন এলাম, তার পরদিন ফজল এসে হাজির। সে মানিকগঞ্জের লোক।     হরিরামপুরের বাড়িতে বউ বাচ্চা থাকে। ছুটি নিয়ে তাদের কাছে গিয়েছিল। জাহাঙ্গিরের বাড়ি ফরিদপুরে। দু-তিন মাস পর পর সেও কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যায়। বউ ছেলেমেয়ে মা বাবা আর একটা ছোট ভাই আছে বাড়িতে।

তিনজন ড্রাইভার সাহেবের। তার ওপর আছে দুজন গানম্যান। জাহেদ আর বেলাল। সকাল থেকে তারা এসে শটগান হাতে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহেব বাড়ি থেকে বেরোলে তারা আছে সাহেবের সঙ্গে। একজন ম্যানেজার আছেন মধ্যবয়সী। হারুন সাহেব। তিনি দুই বিল্ডিংয়ের বিশটি ফ্ল্যাটের ভাড়া তোলেন। ভাড়াটেদের সুবিধা-অসুবিধা, সাহেবের লোকজনের বেতন, পানি আর ইলেকট্রিকের বিল—মোটকথা অর্থকড়ির ব্যাপারটা দেখেন হারুন সাহেব। নিচতলার ফ্ল্যাটে তাঁর অফিস। জাহাঙ্গির আর ফজল থাকে নিচতলার ফ্ল্যাটে। পুরুষরা নিচতলায়, মহিলারা ওপরতলায়। সিকিউরিটির লোকদের থাকার ব্যবস্থা গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওখানটায় একটা নামাজের সুন্দর রুমও আছে।

খালা বলেছেন, ‘এই ধরনের বড়লোকদের শত্রু অনেক। রাস্তাঘাটে তো বটেই, বাড়িতেও হঠাৎ আক্রান্ত হতে পারেন তাঁরা। এ জন্য বডিগার্ড বা গানম্যান তাঁদের লাগে। তবে গত তিন দিনে সাহেবকে আমি বাড়ি থেকে তেমন বেরোতে দেখিনি। নাশতা করে অনেকক্ষণ চেয়ার নিয়ে ম্যাডামের সামনে বসে থাকেন। অনেক কথা বলেন ম্যাডামকে। চা খান। খালা বলেছেন, তাঁদের দুজনের সম্পর্ক অসাধারণ। যেভাবে সাহেব স্ত্রীর সেবা করেন, তা ভাবাই যায় না। অনেক সময় নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ান। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ভালো-মন্দ, আত্মীয়-স্বজনের কথা—সবই বসে বসে স্ত্রীকে বলেন। ম্যাডাম অপলক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে সব কথা শোনেন। কখনো কখনো চোখে পলক ফেলেন। মৃদু হাসি ফোটে মুখে। আবার কখনো কখনো মুখ ম্লান হয়। তার মানে সাহেবের সব কথা তিনি মন দিয়ে শোনেন। শুধু কথা বলতে পারেন না, এই যা।

এসব কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। সাহেব এখনো দেখতে যেমন, শরীর স্বাস্থ্য সব মিলিয়ে খুবই আকর্ষণীয় পুরুষ। টাকা-পয়সারও অন্ত নেই। এই ধরনের পুরুষকে পাওয়ার জন্য বহু নারী পাগল হয়ে থাকবে। অল্পবয়সী মেয়েরাও লাইন দেবে। আজকাল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়া অনেক মেয়ে একটু বয়স্ক লোক পছন্দ করে। তাঁদের বিয়ে করতে চায়। সাহেবের মতো পুরুষ হলে তো কথাই নেই। খালা বলেছেন, ওসব দিকে সাহেবের নজরই নেই। তিনি একেবারেই অন্য জাতের মানুষ।

খালা আমাকে ‘তুই’ করে বলার পর থেকে আমিও খালাকে ‘তুমি’ করে বলতে শুরু করেছি। তাতে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়েছে। বাড়ির লোকজনের কোনো রকমের কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই।

দিনের বেলার বেশির ভাগ সময়ই খালা ম্যাডামকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর সঙ্গে আমার সব কথাই হয় রাতের বেলা। সেই ফাঁকে আমি কাজের লোকজন প্রত্যেকেরই খবর নিয়েছি। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মহিলাটি ‘পাখির মা’। ওই একটিমাত্র মেয়েই তার। বিয়ে হয়ে গেছে। বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে। স্বামী মারা গেছে পাখিকে অনেক ছোট রেখে। তার পর থেকে মহিলাটি এই বাড়িতেই কাজ করছে। দেখতে ভালো না। এক বাচ্চা নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া কঠিন ছিল। সেই আশাও মহিলা করেনি। রংপুর থেকে কাজে চলে এসেছিল সাহেবের বাড়িতে। আর পরিবানু যে মহিলাটির নাম, তার জীবনটা সিনেমা নাটকের মতো। বাড়ি মাদারীপুরে। এক টাউটকে ভালোবেসে তার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। লোকটা তাকে নিয়ে তুলেছিল পতিতাপল্লীতে। সে ছিল পাড়ার দালাল। প্রেমের ফাঁদে ফেলে, বিয়ে করে গ্রামের অবুঝ মেয়েগুলোকে ভাগিয়ে পাড়ায় নিয়ে বিক্রি করত।

পরিবানুর ভাগ্য ভালো। নষ্ট হওয়ার আগেই সে পাড়া থেকে পালাতে পেরেছিল। গ্রামে ফেরার পর পরিবার তাকে গ্রহণ করেনি। গ্রামের এক মহিলা ছিল, যার কাজ ঢাকার মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত বাড়িতে কাজের লোক বা কিশোরী মেয়ে জোগাড় করে দেওয়া। সেই মহিলা পরিবানুকে এনে এই বাড়িতে দিয়েছিল। তারপর সে আর নড়েনি। এরা দেখতে কেউ তেমন ভালো না। পরিবানুর আর বিয়েশাদি বা ঘর সংসারের শখ হয়নি। তার ইচ্ছা এই বাড়িতেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে।

কী অদ্ভুত জীবন আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র অসহায় মেয়েগুলোর।

এই কথাটি ভেবে নিজের কথা মনে পড়েছিল আমার। আমার জীবনই বা কেমন? পরিবানুদের সঙ্গে আমার আসলে ব্যবধান কোথায়? সেই অর্থে কি কোনো ব্যবধান আছে? আমার খালাও তো ওদের মতোই কোনো এক সাহেবের বাড়ির কাজের বুয়া। তার রোজগারে আমি বড় হয়েছি। তারপর ঘটল শিমুলের ঘটনা। শিমুলকে না পেলে কী অর্থ থাকবে আমার এই জীবনের? কোথায় ভেসে যাব আমি? চৌঘরিয়ায় ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে আমার জীবন কোন দিকে বাঁক নেবে? কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব?

খালা এই শহরেই কাজ করে। ধানমণ্ডিতে। চাইলেই আমি তার কাছে চলে যেতে পারি। হয়তো তার কাছে বেশিদিন থাকা যাবে না। দেখা করে আসা যাবে। ফোন করে ধানমণ্ডির ঠিকানাটা নিলেই চলে যাওয়া যাবে। অথবা উত্তরায় এই বাড়ির ঠিকানা দিলে খালাও চলে আসতে পারে আমার কাছে। তাতে লাভ কী?

না। আমি কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না। তীব্র এক স্রোতের নদীতে পড়ে গেছি। জীবননদীর এই স্রোত যেদিকে টেনে নেবে, সেদিকেই ভেসে যাব। তবে শিমুলের শেষটা আমি দেখে নেব। ওকে আমি খুঁজে বের করবই। আমাকে ঠকানোর, আমার সঙ্গে প্রতারণা করার ফল তাকে ভোগ করতেই হবে। এ জন্য যদি কাউকে খুনও করতে হয়, শিমুলকেও যদি খুন করে ফেলি, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। যদি খুনের দায়ে ফাঁসি হয়, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। যাবজ্জীবন হলে জেলেই জীবনটা কাটিয়ে দেব। কোনো দুঃখ থাকবে না।

খালা গম্ভীর হয়ে আছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী ভাবছ?’

খালাও আমার মুখের দিকে তাকালেন। ‘তোর কথা ভাবি।’

তা আমি বুঝতে পারছি। তার পরও জিজ্ঞেস করি, ‘কী ভাবছ?’

‘অযথা আমরা গাজীপুরে যাচ্ছি।’

‘অযথা কেন? আমি তো গাজীপুরে যাওয়ার জন্যই ঢাকায় এসেছি।’

‘তা জানি। তুই সবই আমাকে বলেছিস। যদি তুই শিমুলের ব্যাপারে সত্য কথা বলে থাকিস, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘরের ব্যাপারে শিমুল যা বলেছিল, তার কোনোটাই সত্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

‘আমি তোমার কাছে কোনো কথা লুকাইনি, খালা। শিমুলের ব্যাপারে আমার প্রতিটি কথাই সত্য।’

‘তাহলে তুই দুঃখ পেলেও বলি, গাজীপুরে শিমুলকে তুই পাবি না। ওর পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যা।’

‘আর যদি এমন হয়, শিমুলের এই কথাটাই সত্য হলো! আমরা একটু শুভচিন্তা করে দেখি না। যদি শিমুলকে পেয়ে যাই?’

খালা হাসলেন। ‘আশা করা ভালো। মানুষ বাঁচে আশায়। আমি মনেপ্রাণে দোয়া করি, আল্লাহ তোর আশা পূরণ করুক।’

গাজীপুরের স্টেশন রোডে এসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি। শিমুল তার বাবার নাম বলেছিল ওমর আলী। তাঁর নাম বললেই নাকি মার্কেটটা সবাই দেখিয়ে দেবে।

হলোও তা-ই। আমি না, একজন পথচারীর সঙ্গে কথা বললেন খালা। ‘ভাই, এখানে ওমর আলী সাহেব নামের কেউ আছেন? যাঁর বড় মার্কেট আছে?’

লোকটি সহজ-সরল গলায় বলল, ‘আছে। ওই যে ওই পুব দিককার বড় মার্কেটটা। ওটাই ওমর আলী সাহেবের মার্কেট।’

আমি উত্তেজনায় খালার একটা হাত চেপে ধরলাম। আমার পরনে সেদিনকার মতো বোরকা। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

খালা সেই লোকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ওমর আলী সাহেব কয় তলায় বসেন?’

‘নিচতলায়ই বসেন। নিচতলার এক পাশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকানটাই তাঁর।’

গভীর উত্তেজনায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। দুবার ঢোক গিললাম। খালার হাত ধরে ওমর আলী সাহেবের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

একজন কর্মচারীকে খালা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি ওমর আলী সাহেবের দোকান?’

‘জি।’

‘তিনি আছেন?’

‘জি আছেন। ওই যে দোকানের দক্ষিণ পাশে কাচের দরজা দেখছেন, ওটা স্যারের রুম। তিনি রুমেই আছেন।’

‘আমরা একটু স্যারের সঙ্গে দেখা করব।’

‘আপনেরা কি স্যারের আত্মীয়? আসছেন কোথা থেকে?’

‘না, ঠিক আত্মীয় না। ঢাকা থেকে আসছি। তবে আসছি বিরাট দরকারে।’

‘দাঁড়ান। আমি স্যারকে গিয়ে বলি।’

প্রথমে কাচের দরজায় আঙুলের টোকা দিল লোকটি। তারপর ভিতরে ঢুকল। মিনিট দেড়েকের মধ্যে বেরিয়ে এলো। ‘আসেন আপনারা। আসেন।’

খালার সঙ্গে ওমর আলী সাহেবের রুমে গিয়ে ঢুকলাম।

মাঝারি সাইজের গোছানো রুম। এসি চলছে। সুন্দর চেয়ার টেবিল আছে রুমে। সোফা আছে। ওমর আলী সাহেব বসে আছেন তাঁর চেয়ারে। টেবিলের ওপর দামি একটা মোবাইল ফোন। ফোন তাঁর কানে লাগানো। সেই ফোনে কথা বলছেন। আমাদের দেখে হাত ইশারায় বসতে বললেন।

বসলাম। আমার অবস্থা আগের মতোই। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে বুক। গলা শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেছে। একটু পানি খেতে পারলে ভালো হতো।

ওমর আলী সাহেব ফোনে কথা বলছেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁকে দেখছি। প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সাদা পাঞ্জাবি পরে আছেন। গোলগাল সাদা ধপধপে মুখ। বেশ ব্যক্তিত্ববান।

ফোন শেষ করে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন। ‘ঢাকা থেকে এসেছেন শুনলাম। কী ব্যাপার বলুন?’

খালা সামান্য দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা এসেছি আসলে শিমুলকে খুঁজতে...’

‘ও, শিমুল তো আজ দোকানে নেই। দুদিন ধরে জ্বর ছেলেটার। দোকানে আসতে পারে না। আপনারা কি ওকে ফোনে যোগাযোগ করে আসেননি?’

খালা আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘না। আমাদের কাছে তার নতুন নাম্বারটা নেই। পুরনো নাম্বারে অনেকবার ফোন করেছি। সেই নাম্বার নাকি এখন আর ব্যবহার করা হয় না।’

ভদ্রলোক অবাক হলেন! ‘শিমুলের তো দুটি ফোন। আপনারা কোন নাম্বারে ফোন করেছিলেন?’

এবার কথা বললাম আমি। শিমুলের নাম্বারটা মুখস্থ ছিল। বললাম। শুনে তিনি চিন্তিত। ‘শিমুলের এ রকম কোনো নাম্বার আছে, তা তো জানি না। অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের ফোনের হদিস পাওয়াও মুশকিল। কখন কোন নাম্বার রাখে, কোনটা বদলায়, এটা শুধু তারাই জানে। ওর কাছে কী দরকার বলুন তো?’

খালা বেশ বুদ্ধি করে সব জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। বানিয়ে বানিয়ে ভালোই চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারও তা-ই করলেন। ‘শিমুল সাহেব কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। সেই ভাইয়ের মুখে শুনলাম, শিমুল সাহেব নাকি একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি করবেন। আমরা দুজন এসেছি আসলে তাঁর কাছে চাকরির জন্য। আরো কিছু কথা আছে। সরাসরি তাঁকে বলতে পারলে ভালো হয়। ফোনে বলতে চাই না।’

ওমর আলী সাহেব তীক্ষ চোখে খালার দিকে তাকালেন। ‘শিমুল গার্মেন্টস করবে, এ কথা শুনিনি। আমাকে না বলে সে কিছু করে না। যদি গার্মেন্টস করার প্ল্যান করেও থাকে, সেটা করতে সময়ও লাগবে। তার আগেই আপনারা কাজের আশায় এসেছেন?’

খালা একটু প্যাঁচে পড়লেন। আমতা গলায় বললেন, ‘অন্য কিছু কথাও তাঁর সঙ্গে ছিল। তবে কোনো সাহায্য-টাহায্যের ব্যাপার না। টাকা-পয়সা চাইতে আমরা আসিনি। এত দূর থেকে যেহেতু এসেছি, একটু দেখা করতে পারলে ভালো হতো।’

‘বললাম না ওর জ্বর।’

‘আপনার বাড়ি শুনেছি এই মার্কেটের কাছেই। আপনি যদি অনুমতি দেন, আর একজন লোক সঙ্গে দেন, তাহলে বাড়িতে গিয়ে শিমুল সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেব না।’

খালা বললেন এমন অনুনয়ের সুরে, বোঝা গেল ওমর আলী সাহেবের মন নরম হয়েছে। ‘ঠিক আছে, যান। আমি লোক দিচ্ছি।’

বেল বাজালেন। সেই কর্মচারীটা এলো। তাকে বললেন আমাদেরকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে। শিমুলের সঙ্গে দেখা করব।

বাড়ির কাছেই। সেই লোক আমাদের নিয়ে এলো। আমার বুক আগের মতোই ধুকধুক করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখন হাত-পাও কাঁপছে। তাহলে শিমুলকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করলাম! কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার দেখা হবে? আমাকে দেখে কেমন হবে তার মুখভঙ্গি? কেমন হবে চেহারা? চোখের দৃষ্টি? কী কথা সে প্রথমে আমাকে বলবে? আমি কী বলব?

এসব ভাবতে ভাবতে পথটা পেরিয়ে এলাম।

বিশাল ছয়তলা বাড়ি। লিফট আছে। দোতলার ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। সঙ্গের লোকটি কলিংবেল বাজাল।

উত্তেজনায় আমার এখন দম বন্ধ হয়ে আসছে। কে দরজা খুলবে? নিশ্চয় শিমুল না। হয়তো তাদের বাড়ির কাজের ছেলেটি বা মেয়েটি। বয়স্ক বুয়াদেরও কেউ হতে পারে। শিমুলের জ্বর। সুতরাং সে উঠে নিশ্চয় দরজা খুলবে না। কাজের লোকজনই খুলবে।

আমার অনুমানই ঠিক হলো। একটা কিশোরী মেয়ে দরজা খুলল। সঙ্গের লোকটি বলল, ‘ছোট স্যারের কাছে ঢাকা থেকে লোক আসছে। প্রথমে দোকানে গিয়েছিল। সেখান থেকে বড় স্যার আমাকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে। স্যারকে গিয়ে বলো।’

মেয়েটি বুদ্ধিমতী। দেখতেও মন্দ না। হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা ভিতরে আসেন। ড্রয়িংরুমে বসেন। আমি ভাইরে গিয়া বলতেছি।’

আমি যেন আমার বুকের ধুকধুকানি শুনতে পাচ্ছি। আমাদের গ্রামে বড় একটা হিন্দুপাড়া আছে। দুর্গাপূজার সময় সেই পাড়ায় নন্দঢাকি বেদম শব্দে ঢাক বাজায়। আমার বুকের শব্দ এখন নন্দঢাকির ঢাক।

সেই অবস্থায় ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। খালা বসেছেন আমার পাশে। কেন যে তখন আমার এত নার্ভাস লাগছিল, বুঝতেই পারছি না। এত সাহসী মেয়ে আমি! ডাকাতকন্যা! সেই ডাকাতকন্যার একি অবস্থা আজ! প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হবে। যাকে খুঁজতে খুঁজতে এত দূর এসেছে সে, এত মাঠঘাট পেরিয়ে এসেছে যার জন্য, তার বাড়িতে এসে এমন অবস্থা হচ্ছে কেন ডাকাতকন্যার?

আমি এক হাতে খালার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। খালা একপলক আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার অবস্থা বুঝলেন। কোনো কথা বললেন না।

শিমুলদের ড্রয়িংরুমটি মোটামুটি ভালোই। সোফাগুলো দামি। কার্পেট দামি। সেন্টার টেবিলটা কাচের। বেশ সুন্দর। মাথার ওপর ফ্যান আছে। সাহেবের বাড়ির মতো স্পিল্ট এসি আছে। তবে সেই বাড়ির ড্রয়িংরুমের সঙ্গে এই ড্রয়িংরুমের কোনো তুলনাই চলে না। সাহেবের ড্রয়িংরুম অনেক গর্জিয়াস। তিনি অবশ্য শিমুলদের চেয়ে শতগুণ বেশি বড়লোক। তাঁর বাড়িঘর তো এই বাড়িঘরের চেয়ে উন্নতমানের হবেই।

একজন যুবতি বউ এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। তার পেট উঁচু। অর্থাৎ বাচ্চা হবে। বোধ হয় সাত-আট মাস চলছে। গায়ের রং ফরসা। তেমন লম্বা না। চুল ঘন। চেহারা মোটামুটি। পরনে সুতির হালকা রঙের ম্যাক্সি। তার হাত ধরে রেখেছে বছর চারেকের একটা ছেলেশিশু।

বউটিকে দেখে আমি অবাকই হলাম। এ কে?

সে প্রথমে খালার দিকে তাকাল, তারপর তাকাল আমার দিকে। ‘আব্বা দোকান থেকে ফোন করেছিলেন। বলেছেন আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন। খুব নাকি জরুরি দরকার। ওর জ্বর। এখন অবশ্য জ্বরটা একটু ছেড়েছে। ওয়াশরুমে ঢুকেছে। মিনিট পাঁচেক হয়তো লাগবে।’

বউটির কথা শুনে আমার দম প্রায় বন্ধ হয়ে এলো। হতবাক চোখে খালার দিকে তাকালাম। খালা তাকালেন আমার দিকে। তাঁর চেহারায়ও দিশাহারা ভাব।

মানে কী? বউটি তাহলে শিমুলের বউ? তার একটা ছেলে আছে। আরেকজন আছে বউয়ের পেটে। সে তাহলে বিবাহিত। এক বাচ্চার বাপ, আরেক বাচ্চা আগমন অপেক্ষায়। বলে কী!

এতটা উত্তেজিত ততক্ষণে আমি হয়েছি, আমার শরীরের ভিতর থেকে অদ্ভুত এক উষ্ণতা যেন ফেটে বেরোচ্ছে। কালো রঙের পোশাক সব সময়ই অন্য পোশাকের তুলনায় উষ্ণ। আমি কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢেকে আছি। তার ওপর এ রকম মানসিক চাপ, উষ্ণতা তো বাড়বেই।

ঝট করে আমি মুখ থেকে বোরকার আবরণ সরিয়ে ফেললাম। পুরোটা খুলে ফেলার ইচ্ছা থাকলেও খোলা হলো না। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়ালাম। ‘আপনি, আপনি শিমুলের বউ?’

বউটি অবাক! ‘হ্যাঁ। সাত বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার ছেলের বয়স সাড়ে চার বছর। বুঝতেই পারছেন আরেকজন আসার অপেক্ষায়। আমরা দুজন যা চেয়েছি, আল্লাহ আমাদের তা-ই দিচ্ছেন। এবার আমাদের মেয়ে হবে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা কী? আপনি এভাবে চমকে উঠলেন কেন?’

আমি কঠিন গলায় বললাম, ‘শিমুল এলেই তা বুঝতে পারবেন। ডাকুন তাকে।’

খালাও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, চৈতি। স্থির হ। শিমুল এলে তার সঙ্গে কথা বল।’

রাগে ক্রোধে আমার শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। নাকমুখ দিয়ে ফোঁসফোঁস করে গরম শ্বাস বেরোচ্ছে। আমি যেন আর ধৈর্য রাখতে পারছি না। ইচ্ছা করছে ছুটে ভিতরে ঢুকে যাই। শিমুলের বাথরুমের দরজা লাথি মেরে ভাঙি। তাকে টেনে বের করে অবিরাম চড় থাপড় মারতে থাকি দুই গালে। চিৎকার চেঁচামেচি আর গালাগাল করে পুরো এলাকার লোক জড়ো করি। খবর পেয়ে তার বাবা আসুক। মা আসুক। সবার সামনে বলি, শিমুল আমার সঙ্গে কী করেছে! আমার নতুন করে হারানোর কিছু নেই। যা হারানোর তা তো আমি হারিয়েছিই। আর ভয় কী? তবে শিমুলের বারোটা আমি বাজিয়ে দিয়ে যাব। এলাকায় ওর সম্মান ধূলিসাৎ করে দেব। বউ বাচ্চা সংসার ভেঙেচুরে একাকার করে দেব। সুখের জীবন তাকে আমি কাটাতে দেব না। আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়ে সে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকবে, আমি তা হতে দেব না। হৈচৈ বাধিয়ে এলাকার লোকজনের কাছে, শিমুলের মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনের কাছে তার মুখোশ তো খুলে দেবই, থানায়ও যাব। পুলিশকে জানাব সে আমার সঙ্গে কী করেছে? সঙ্গে এও জানাব, শিমুল মার্ডার কেসের আসামি। প্রয়োজনে বানিয়ে বলব খুনটা সে-ই আসলে করেছে। হয়তো টাকা-পয়সা খরচ করে সব ম্যানেজ করেছে। অর্থাৎ তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা বানিয়ে বলা যায়, সবই আমি বলব। ওকে আমি ফাঁসাবই। কিছুতেই ছাড়ব না। কিছুতেই না।

এ সময় শিমুল এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। পরনে হালকা নীল রঙের ট্রাউজার আর সাদা লুজ একটা টি-শার্ট। জ্বরকাতর মুখটা বিষণ্ন। চেহারায় ক্লান্ত ভাব।

তাকে দেখে আমি থতমত খেলাম। এ কে? এ তো শিমুল না! এ তো অন্য লোক!

থতমত খাওয়া গলায় বললাম, ‘আপনি, মানে আপনিই শিমুল?’

কথা বলল বউটি। ‘হ্যাঁ, শিমুল। আমার হাজব্যান্ড।’

খালা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। শিমুল নামের মানুষটিও তাকিয়ে আছে। সে বেশ অপ্রস্তুত হয়েছে। বলল, ‘আমার নাম শিমুল। আপনি কোন শিমুলকে খুঁজছেন?’

আমি ততক্ষণে একেবারে নিভে গেছি। ঢোক গিলে বললাম, ‘আপনার পুরো নাম কি শিমুল মাহমুদ?’

‘হ্যাঁ। শিমুল মাহমুদ। কেন বলুন তো?’

আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম। না না। এ কেমন করে হয়? এ তো একেবারেই অবিশ্বাস্য। নাম-ঠিকানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাবার নাম—সব মিলে যাচ্ছে, শুধু আসল মানুষটাই মিলছে না। ঘটনা কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সবই তালগোল পাকিয়ে গেছে।

শিমুল আর তার স্ত্রী মুখোমুখি সোফায় বসল। বউটি তার আগে কী কী বলে ছেলেটিকে ভিতরে পাঠিয়ে দিল। খালাও ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছেন। তাঁর মুখে গভীর হতাশা।

শিমুল বলল, ‘আপনাদের ব্যাপারটা আমি কিছুটা অনুমান করেছি। শিমুল নামের কাউকে খুঁজতে এসে আপনারা আমাদের দোকানে এসেছেন প্রথমে। তারপর এসেছেন বাড়িতে। যে শিমুলকে খুঁজতে এসেছেন, সেই মানুষটা আমি না। ভাবতে খুবই অবাক লাগছে, কোন শিমুল হুবহু আমাদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এ রকম ব্লাফ দিল আপনাদের? ঘটনাটা কী আমাকে একটু খুলে বলবেন?’

আমার তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। আমার অবস্থা সেদিনকার মতো। শিমুলের সঙ্গে রাত কাটানোর পরের সকালটি যেমন ছিল, আমার অবস্থা এখন সেই সকালের মতো। মাথা কাজ করছে না। কিছুই ভাবতে পারছি না। একজন মানুষ কত বড় প্রতারক হলে এমন করতে পারে? সে আবার রবীন্দ্রনাথ পড়ে। রবীন্দ্রসংগীত গায়। এমন অসহায় কান্না কাঁদে, যেভাবে কাঁদা অনেক বড় অভিনেতার পক্ষেও কষ্টকর। এমন মানুষকে ভালোবেসে তার ফাঁদে পড়লাম আমি? আমার মতো শক্ত মেয়েটিকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করাল সে?

নিজের অজান্তে চোখের জলে আমার তখন দুই গাল ভেসে যাচ্ছে। খালা আমার হাত ধরে মৃদু চাপ দিলেন। অর্থাৎ আমি যেন সংযত হই।

শিমুল বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি আপনার সঙ্গে কেউ খুব বড় রকমের প্রতারণা করেছে। নিশ্চয় আমাদের ঠিকানা-পরিচয় সবই তার জানা, সেই কারণে আমার নাম ভাঙিয়ে প্রতারণাটা সে করতে পেরেছে। আমাদের মার্কেট আর বাড়ি তো আপনারা চিনেই গেলেন। আমার ফোন নাম্বারও দিয়ে দিচ্ছি। যদি সেই প্রতারকটিকে খুঁজে পান, তাহলে দয়া করে আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমিও তাকে ধরব। আমার যা করার আমি করব। কারণ খুব সামান্য হলেও সে আমার ক্ষতি করেছে। মা-বাবা ও স্ত্রীর কাছে আমাকে বড় রকমের একটা প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিতে চেয়েছে। সবাই আমাকে ভুল বুঝতে পারত। বাজে সন্দেহ করতে পারত। বিশেষ করে আমার স্ত্রী। এইসব ব্যাপারে মেয়েরা খুবই সন্দেহপ্রবণ হয়। আপনার ব্যাপারটি যে প্রেম ভালোবাসার তা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার জন্য আমার সহানুভূতি আছে। ফ্রডটার কোনো হদিস পেলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন।’

শিমুল তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। ‘বাবলি, উনাদের চা নাশতা দাও। আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি আবার ঘুমাব।’

শিমুল উঠে দাঁড়াল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা চা নাশতা খেয়ে যাবেন। আমাদের বাড়িতে এসে কেউ না খেয়ে যায় না।’

শিমুল ভিতরে চলে গেল।

আমার তখন নড়াচড়ার শক্তি নেই। যেন হাত-পাও অবশ হয়ে গেছে। যেন আমি আর বেঁচে নেই। ঠিক সেই সকালের মতো অবস্থা। কান্না থামছেই না।

শিমুলের বউ কাজের মেয়েটিকে ডাকল। ‘সীমা, এখানে চা নাশতা দে।’

খালা ছটফটে গলায় বললেন, ‘না না, আমরা কিছু খাব না। আমরা এখন যাব। কী রকম একটা ব্যাপার হলো বলুন তো? অযথা এত দূর থেকে এসে আপনাদের বিরক্ত করলাম।’

বাবলি বলল, ‘পুরো ব্যাপারটাই আমি বুঝতে পেরেছি। আপনাদের আসলে কোনো দোষ নেই। দোষ সেই বদমাশটার। আমাদের নাম ভাঙিয়ে এই অবস্থায় ফেলেছে আপনাদের। যদি অসুবিধা না থাকে, ঘটনাটা আমাকে বলুন। ঘটনা আপনার সঙ্গের জনকে নিয়ে। তার নাম কী?’

‘মেয়েটি আমার বোনের মেয়ে। চৈতি। হ্যাঁ, ঘটনা তাকে নিয়েই।’

‘এত সুন্দরী মেয়ে চৈতি। আহা, কোন বদমাশ তার সঙ্গে এমন প্রতারণা করে গেল? পুরো ঘটনা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। দুপুর হয়ে এসেছে। এখন চা বিস্কুট খান। দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করেন। বিকেলের দিকে চলে যাবেন। কোনো অসুবিধা নেই। এত দূর থেকে এসেছেন, তার ওপর এত বড় আঘাত পেলেন! একটু স্থির হন। আমাকে সব খুলে বলুন। খুব জানতে ইচ্ছা করছে সবকিছু। চৈতির মতো মেয়েটির জীবন কে নষ্ট করে দিয়ে গেল? আহা রে! এত সুন্দর চেহারার মেয়ে!’

অনেকক্ষণ কেঁদে আমি শান্ত হয়েছি। চোখ গাল মুছে স্থির হয়েছি। মুখ থমথম করছে। খালা সংক্ষেপে আমার কথা বাবলিকে বললেন। আমার তো চা বিস্কুট মুখে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খালা দুই চুমুক চা খেলেন। তারপর সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমরা।

ফেরার সময় সারাটা পথ আমি শুধু ভাবলাম, ধোঁকা কত রকম হতে পারে।

 

 

পাঁচ

গাজীপুর থেকে ফিরে সরাসরি খালার রুমে ঢুকে গেছি। সেই যে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছি, আর উঠিনি। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। দুপুরে খাওয়া হয়নি কিছুই। তার পরও খিদে আমার ছিল না। খিদে টেরও পাইনি। আমার জন্য বেচারি খালারও খাওয়া হয়নি। এতটা পথ বাসে এলাম। একটাও কথা বলিনি খালার সঙ্গে। মনে হয় সারাটা ক্ষণই কেঁদেছি। কান্নার পর মুখ থমথমে হয়ে যায় মানুষের। চেহারা দেখে যে কেউ বুঝে যায়, মানুষটা কেঁদেছে। খালা আমাকে নানা রকমভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সান্ত্বনায় আমার কী হয়? পজিটিভ চিন্তা করে ঢাকায় এসেছিলাম। ছিলাম একটা দোলাচলের মধ্যে। শেষ ভরসা ছিল গাজীপুর। সেখানে গিয়ে ঘটল আরেক ঘটনা। সেই ঘটনা নাটক সিনেমাকেও হারিয়ে দেয়।

এমনও হয়! হতে পারে! ও রকম সুন্দর চেহারার আড়ালে এত বড় প্রতারণা কোনো মানুষ কি তার প্রেমিকার সঙ্গে করতে পারে! সে কি মানুষ!

শিমুলকে এখন আর আমার মানুষ মনে হয় না। মনে হয়, সে ছিল মানুষের রূপধরা পিশাচ। পিশাচের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।

গাজীপুরে শিমুলের বাবাকে দেখে, শিমুলের বউ বাবলিকে দেখে আর শিমুলকে দেখে অন্য রকমের এক বেদনায়ও আচ্ছন্ন হয়েছিলাম আমি। আহা রে, কত সুখী আনন্দময় জীবন তাদের। শিমুল তো আমাকে এই রকম জীবনেরই স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

হায় রে আমার প্রেম! হায় রে আমার স্বপ্ন!

বিকেলবেলা ফিরে এসে খালা আমাকে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছিলেন। আমি কিছুতেই উঠিনি। খালা বলেছিলেন, ‘তোর মুখ দেখে সবাই বুঝে যাবে তুই অনেক কান্নাকাটি করেছিস। কাজের মহিলারা নানা রকমের প্রশ্ন করবে। ভেবে পাচ্ছি না কী জবাব দেব। গাজীপুরে গেলাম আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। সেখানে কী এমন ঘটল যে আমার মুখটাও শুকিয়ে গেছে, তুইও কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিস। এসব তো মানুষ খেয়াল করবে। কী জবাব দেব?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আমি এ জন্যই ওদের সামনে আজ আর যেতে চাচ্ছি না। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও। ওদের বলো, এতটা জার্নি করে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। শরীরটা ভালো নেই। জ্বর জ্বর লাগছে। এ জন্যই এসে শুয়ে পড়েছি। রাতেও কিছু খাব না।’

খালা ঠিক আমার খালার মতো মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ‘না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে, মা। আমি এই ঘরেই তোর খাবার এনে দেব। খেয়ে নিস। তোর সব কথা শোনার পর আমার ধারণাই হয়েছিল, গাজীপুরে শিমুলকে আমরা পাব না। তাই বলে এই রকম একটা ঘটনা ঘটবে, ভাবতেই পারিনি। তোর শিমুল যা যা বলেছিল, তার প্রায় সবই মিলে গেছে। শুধু বউ বাচ্চা মেলেনি। আর আসল মানুষটা মেলেনি। তোর সঙ্গে আমারও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। এ রকম অভিজ্ঞতা যে হতে পারে, কল্পনাও করিনি।’

আমি গভীর দুঃখ পাওয়া শিশুর মতো দুহাতে খালাকে জড়িয়ে ধরলাম। হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘আমার এখন কী হবে, খালা? আমি এখন কী করব? কোথায় যাব? কার কাছে যাব? শিমুলকে যে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।’

খালা চিন্তিত গলায় বললেন, ‘এসব আমিও ভেবেছি। এমন কোনো সূত্র তো নেই, যে সূত্র ধরে শিমুলের হদিস করা যেতে পারে। আন্দাজে কোথায় তুই তাকে খুঁজবি?’

‘ওই যে লিডারের কথা বলেছিল শিমুল। হাকিম সাহেব। তাঁর ডান হাতের নাম এনায়েত সাহেব। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার লোক। তাঁদের কি খুঁজে বের করা যায় না?’

‘সেটাও খুব কঠিন কাজ। হাকিম সাহেবের পুরো নাম কি তুই জানিস?’

‘না।’

‘এনায়েত সাহেবের পুরো নাম?’

‘না। তা-ও জানি না।’

‘কোন দলের নেতা হাকিম সাহেব?’

‘জানি না।’

‘তোর ওই লালু মামু নিশ্চয় জানেন। ফোনে তাঁর কাছ থেকে কি জেনে নিবি?’

‘আমি কখনোই আর লালু মামু, আমার খালা, মামা মামিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না। শিরিনের সঙ্গেও না। তাদের কাউকে জানতে দেব না, আমি কোথায় আছি, কার কাছে আছি। কোনো দিন আর চৌঘরিয়ায় ফিরে যাব না। সবাই জানবে, চৈতি মেয়েটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। লালু মামুকে ফোন করলেই ঘটনা অন্য রকম হয়ে যাবে। আমার খালা, মামা-মামি, শিরিন—সবাই সব জেনে যাবে।’

‘তোর ফোন করার দরকার নেই। আমিই ফোন করে হাকিম সাহেবের, এনায়েত সাহেবের পুরো নাম জানার চেষ্টা করি। তাঁরা কোন দল করেন, তা-ও জানি।’

‘এসব করে আসলে কোনো লাভ নেই, খালা। এনায়েত সাহেব তো বলেছেনই, শিমুল নামের কাউকে তাঁরা লালু মামুর কাছে পাঠাননি। অন্য কারো জায়গায় শিমুল গিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। ওর পুরো ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভাঁওতাবাজি।’

‘তাহলে কিভাবে শিমুলকে খুঁজে বের করবি, বল আমাকে?’

‘আমার মাথায় কিছুই আসছে না, খালা। চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে।’

‘এই বাড়িতে তুই দিন সাতেক থাকবি, এমনটাই আমি সবাইকে বলেছি। সাত দিনের জায়গায় না হয় দশ দিন থাকলি। তারপর তো চলে যেতে হবে। কোথায় যাবি? তোর মতো একটা মেয়ে একা এই শহরে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে? কে তাকে আশ্রয় দেবে? কেন দেবে? হ্যাঁ, শিমুলের মতো বহু টাউট বাটপাড় আছে সমাজে। তোর মতো এ রকম একটা মেয়ে পেলে তারা নানাভাবে ফুসলাতে থাকবে, তোর সর্বনাশ করে ছাড়বে। তোকে নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। তাদের হাত থেকে কিভাবে তুই নিজেকে রক্ষা করবি? কত দিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবি? তোর জীবন হয়ে যাবে নষ্ট মেয়ের জীবন।’

আমি কোনো কথা বলি না। মাথা নিচু করে বসে থাকি। কখন কাঁদতে শুরু করেছি টের পাইনি। চোখের জল টপটপ করে পড়ছে খালার বিছানায়।

খালা আমার পিঠে হাত রাখলেন। ‘আমার কথা শোন, মা। আর কয়েকটা দিন এই বাড়িতে থেকে চৌঘরিয়ায় ফিরে যা। এই বাড়িতে থেকেই খালাকে ফোন কর। সে এসে দেখুক, তুই আমার কাছে আছিস। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। ওই খালাই তোকে নিয়ে গ্রামে যাক। তোকে রেখে আসুক। বিয়েশাদির চেষ্টা করে তোর বিয়ে দিয়ে দিক। বিয়ে হয়ে গেলে, স্বামী সংসার হয়ে গেলে, ধীরে ধীরে তুই শিমুলের কথা ভুলতে পারবি। এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’

চোখ মুছে কঠিন গলায় বললাম, ‘না, এই মুখ চৌঘরিয়ার কাউকে আমি আর দেখাব না। তুমি বললে কালই এই বাড়ি থেকে চলে যাব। তারপর যা হওয়ার হবে।’

খালা আর কোনো কথা বললেন না। চিন্তিত চোখে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

খালা বললেন, ‘তোর জন্য আমার খুব মায়া লাগে, মা। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই যেন আমারই মেয়ে। তিন মাস বয়সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি। অনেক বছর পর আবার যেন আমার কাছে ফিরে এসেছিস। কেন যে এমন হয়!’

বিকেলবেলা খালা আমাকে নিয়ে ছাদে এসেছেন। সাহেব আজ বাড়িতে নেই। দুপুরের পর বেরিয়ে গেছেন। খুকি আর ময়না আছে ম্যাডামের কাছে। খালা নিশ্চয় আমার মন ভালো করার জন্য ছাদে নিয়ে এসেছেন।

এ রকম ছাদ আমি ইন্ডিয়ান সিনেমায় দেখেছি। নীল জলের সুন্দর একটা সুইমিংপুল। এক পাশের একটা রুমে জিম করার অনেক যন্ত্রপাতি। এই বাড়িতে আটজন ভাড়াটিয়া আছে। তারা সাধারণত কেউ ছাদে আসে না। ছাদের দরজা লক করা থাকে। চাবি থাকে জাহাঙ্গির কিংবা ফজলের কাছে। খালা তাদের কাছ থেকে চাবি চেয়ে এনেছেন।

ছাদের দরজা খোলার পর মনে হলো, আমি একটা অন্য জগতে চলে এসেছি। বুকের ভিতর চাপ ধরা অবস্থাটা যেন অনেকটাই কেটে গেল। মনটা যেন ভালো হয়ে গেল। খোলা আকাশ, গাছপালা, স্বচ্ছ জল আর হাওয়া বোধ হয় মানুষের মন প্রফুল্ল করে ফেলে।

ছাদে তার সবকিছুই আছে। ফুলের ঝোপঝাড় আর লতা আছে অনেক। ফুল আছে অনেক। দেয়াল ঘেঁষে সবুজ ঘাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফুলের গাছ আর লতাগুলো সেই ঘাসের মধ্যেই জন্মেছে। আসলে জন্মানো হয়েছে। টাকা থাকলে কত কিছু করা যায়! তবে তার জন্য চাই রুচি। টাকা অনেকেরই থাকে, রুচি সবার থাকে না। রশিদুল হাসান সাহেবের রুচি আছে। নিশ্চয় তাঁর স্ত্রীও রুচিশীল। এই দেশে কত মানুষ কত সুখে আছে। কত মানুষ আছে দুঃখ বেদনা নিয়ে। কত মানুষ থাকে অনাহারে। আমাদের গ্রামেই কত দুঃখী দরিদ্র মানুষ আমি দেখেছি। এক দিন খেতে পায় তো আরেক দিন পায় না। বিনা চিকিৎসায় মরে কত মানুষ। খিদের কষ্টে ঘুমাতে পারে না কত শিশু।

আমার এসব ভেবে কী লাভ! আমি তো পুড়ছি আমার অনলে। আমি তো আছি এক অনিশ্চিত জীবনে। জীবনের সামনের পথ ঢেকে আছে গভীর গভীরতর অন্ধকারে। অন্যের কথা ভেবে আমার কী লাভ?

লেকের ধারে সুন্দর সুন্দর কাঠের বেঞ্চ। ও রকম একটা বেঞ্চে খালা আমাকে নিয়ে বসলেন। এই সময়টাকে বলে গোধূলিবেলা। ফাগুন চৈত্র মাসের গোধূলিবেলা বড় মায়াবী হয়। অদ্ভুত এক আলোয় ভরে ওঠে আকাশ। সেই আকাশের দিকে তাকালে মন কেমন করে।

শহরের আকাশ যেন তেমন নয়। চৌঘরিয়ার আকাশ ছিল অন্য রকম। যেন সেখানকার আকাশ অনেক বড়। অনেক বেশি মায়াবী। সেই আকাশ যেন ছিল আমার বেশি আপন। আজ আমি বসে আছি এক অচেনা আকাশের তলায়। চৌঘরিয়ার কোনো পুকুরপারে নয়। কোনো গাছপালা কিংবা বনের ছায়ায় নয়। আমি বসে আছি এক বড়লোকের ছাদে। সুইমিংপুলের ধারে। বসে আছি এক অচেনা মানুষের সঙ্গে, যিনি ধীরে ধীরে আমার আপনার চেয়েও আপন হয়ে উঠছেন।

কথাগুলো শুনে আমি খালার মুখের দিকে তাকালাম। ‘আমাকে তুমি তাহলে তোমার মেয়েই ভাবো। মনে করো, তোমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি ফিরে এসেছে।’

খালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সে রকম ভাবনা হচ্ছে বলেই বেশি অস্থির লাগছে তোর জন্য। কোথায় যাবি তুই? কিভাবে কাটবে তোর বাকি জীবন? কেন যে তোর সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হলো? কেন যে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে তোকে আমি এই বাড়িতে এনে তুললাম? এখন যে তোকে বিদায় করে দেব, কিভাবে করব? আমার তো বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’

খালা কাঁদতে শুরু করলেন।

আমি অবাক হয়ে খালার কথা ভাবছি। মাত্র চার দিনের পরিচয়। তিনি আমাকে কতটুকু চিনেছেন বা আমিই তাঁকে কতটুকু চিনেছি? এত অল্প সময়ের মধ্যে, এইটুকু চেনাজানায় মানুষ মানুষের এত আপন হয়ে উঠতে পারে? এভাবে ভাবতে পারে একজন মানুষ নিয়ে? এভাবে কাঁদতে পারে তার জন্য?

লোকে যে বলে দেশে ভালো মানুষের সংখ্যা কম। বদ আর খারাপ মানুষে ভরে গেছে দেশ। গিজগিজ করছে চারদিক। কোথায়, কোথায় সেইসব খারাপ মানুষ? আমার চারপাশে যারা ছিল, খালা, মামা-মামি, লালু মামু আর শিরিন, ওরা যে কী ভালো মানুষ সবাই! কী মায়াবী মানুষ! তারপর যে মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হলো, প্রেম ভালোবাসা হলো, সে হলো জগতের নিকৃষ্টতম মানুষ। তাকে খুঁজতে এসে যাকে পেলাম, সেই মানুষটি আবার অসাধারণ। চৌঘরিয়ার আমার প্রিয় পাঁচজন মানুষের মতোই ভালো।

আমি খালার একটা হাত ধরলাম। ‘আমাকে চার মাস বয়সের রেখে মা মারা গেছে। মায়ের জায়গা পূরণ করেছে খালা। তাদের সবাইকে ছেড়ে এসে আমি তোমাকে পেয়েছি। তোমার কথা শুনে আজ আমার মনে হচ্ছে, আমার মা যেন মরে যায়নি। আমার মা যেন আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল। যেন হারিয়ে গিয়েছিল আমার জীবন থেকে। যেন পথে বেরিয়ে হঠাৎ করেই সেই মাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। তুমিই আমার হারিয়ে যাওয়া মা।’

‘এভাবে বলিস না, মা। এভাবে বলিস না।’ বলেই খালা দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। আমিও কাঁদছি তাঁর বুকে মুখ রেখে। কাঁদতে কাঁদতে টের পেলাম, আমার বুক হালকা হচ্ছে। চাপ ধরা বেদনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নাজু খালাকে নিয়ে আমার আপনজন সাতজন। খালা, মামা-মামি, শিরিন আর লালু মামু। এদের মাঝখানে এসে ঢুকেছিল শিমুল। আমার আপন থেকে আপন হয়েছিল। তারপর এলেন নাজু খালা। সাতজনের মধ্যে ছয়জনেরই কোনো তুলনা হয় না। এত ভালো তারা! খারাপ শুধু এই একটাই। শিমুল। যাকে আমি জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসলাম। আমার শরীর মন সব নিয়ে নিল সে। নিয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কাজটি করল। প্রতারণা। ওই একজনের খারাপ কাজই আমার জীবনে অনেক বড় হয়ে গেল। চৌঘরিয়ার ভালো মানুষগুলো দূরের মানুষ হয়ে গেল। এই বিচারে জগত্সংসারে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। দুধের মতো ভালো মানুষ ভর্তি যে বালতিটি, সেই বালতিতে শিমুলের মতো এক ফোঁটা গরুর চোনাই যথেষ্ট। পুরো দুধের বালতিটাই সে নষ্ট করে দিয়েছে।

অনেকক্ষণ কেঁদে নিজেকে সামলালেন খালা। কান্নার পর দীর্ঘশ্বাস পড়ে অনেক মানুষেরই। খালারও পড়ল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে না, মা। আমা

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ