সরকারি অনেক স্থাপনায় CSRM-এর রড

  • CSRM-এর (চাকদা স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলস প্রাইভেট লিমিটেড) যাত্রা শুরু ১৯৯২ সালে। এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মো. শাহজাহানের সঙ্গে কথা বলেছেন ইশতিয়াক হাসান
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
সরকারি অনেক স্থাপনায় CSRM-এর রড
মো. শাহজাহান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, CSRM

আপনাদের ব্যবসার শুরুটা কিভাবে?

এটি আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমার বাবাই প্রথমে মিল গড়ে তোলেন। বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ওই ফ্যাক্টরিগুলো অন্যান্য লোকের মাধ্যমে ভাড়ায় চালানো হতো। পড়াশোনা শেষ করে আমরা ব্যবসা করব—এই মানসিকতা অবশ্য ছিল।

কারণ বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রথমে আমরা ১৯৯৮ সালে ফ্যাক্টরিগুলোর দায়িত্ব নিই। তিন বছর অনেক পরিশ্রম করেছি; কিন্তু সফলতা পাইনি। অনেক টাকা লোকসান দিয়ে ব্যবসা থেকে একরকম বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
পরবর্তীকালে ২০০৫ সালে আবার শুরু করি। ওই সময় ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার মেলটিং স্ক্র্যাপ আমদানি করার সুযোগ করে দেয়। আমরা সুযোগ পেয়ে সারা বিশ্ব থেকে ন্যায্য মূল্যে স্ক্র্যাপ আমদানি করতে থাকি। এভাবেই নতুন করে শুরু করার পর আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।

দেশে বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিগুলো রডের চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে?

বর্তমানে আমরা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে খুবই মানসম্মত রড উত্পাদন করছি। দেশের রডের চাহিদা পুরোটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। দিন দিন যে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আছে। আমরাও উত্পাদন বাড়াচ্ছি। বর্তমানে আমাদের উত্পাদনক্ষমতা চাহিদার তুলনায় বেশিই আছে।

বিগত বছরগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হয়েছেন, যেসব বড় প্রকল্প হচ্ছে—সব কটির কাজই আমাদের দেশে তৈরি রড দিয়ে হচ্ছে। রডের বেশ বড় কিছু ইন্ডাস্ট্রিও আসছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে রড আমদানির প্রশ্নই আসে না; বরং আমরা রড রপ্তানির চিন্তাভাবনা করছি। বিশেষ করে, সরকার যদি আমাদের করের ব্যাপারে কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়, তাহলে অবশ্যই রপ্তানিতে যাব।

আপনাদের রডের এমন কী বিশেষত্ব আছে, যে কারণে ক্রেতারা কিনবে?

খালি চোখে আপনি এটি বুঝতে পারবেন না। সব রড দেখতে একই রকম মনে হয়। তবে বুয়েটে টেস্টের মাধ্যমে গুণগত মান বুঝতে পারবেন। আমাদের এ ধরনের প্রজেক্টগুলোর পেছনে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণ। কোয়ালিটিতে আমরা যদি কম্প্রোমাইজ করি, তাহলে আমাদের বিনিয়োগটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আর নীতিগত দিক থেকেও মানের ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যতটুকুই বাজারজাত করছি, সঠিক পরিমাণে কেমিক্যাল কম্পোজিশন দিচ্ছি। উন্নত মানের কোয়ালিটি প্রডাক্ট দিচ্ছি। নিশ্চিন্তে গ্রাহক আমাদের ঈঝজগ-এর রড কিনতে পারেন। 

যেহেতু বাংলাদেশ রড উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

রড উত্পাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের উত্পাদনসক্ষমতা আরো বেশি। প্রয়োজন হলে উত্পাদন আরো বাড়াতে সক্ষম আমরা। এ অবস্থায় কিছু তথ্য পেয়েছি এবং পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি মিরেরসরাইয়ে নতুন ইপিজেড হচ্ছে। সেখানে ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বিদেশি কম্পানি। তারা এখানে নতুন করে স্টিল ইন্ড্রাস্টি করবে। আমরা বিষয়টা নিয়ে শঙ্কিত। আমরা যে লং প্রডাক্ট রড করছি তারা যদি ইন্ড্রাস্টি করে এই লং প্রডাক্টই করে তাহলে আমাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তারা ইন্ড্রাস্টি করলে ১০ বছরের ট্যাক্স মওকুফ পাবে। এতে একটা বৈষম্য তৈরি হবে। আমার মনে হয় সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদের হুমকিতে ফেলে দেবে এই ইন্ড্রাস্টিগুলো। মূল্য কমিয়ে দিয়ে ডাম্পিং প্রাইসে পণ্য দিয়ে আমাদের কারখানাগুলোকে বসিয়ে দিতে পারে। পরে তারা একচেটিয়া ব্যবসা করবে। এতে বিপুল অর্থ দেশের বাইরে চলে যাবে। আমরা ব্যবসায়ীরা লাভের টাকা দিয়ে একটার পর একটা ইন্ডাস্ট্রি করছি। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দেশের টাকাও দেশে থাকছে। আমি বিশ্বাস করি এ বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।

যেহেতু রড দেখতে একই রকম, একজন সাধারণ ক্রেতাকে কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে?

আপনি যখন রড কিনতে যাবেন তখন টেস্ট রিপোর্ট চাইতে পারেন। ক্রেতা হিসেবে এটি চাওয়ার অধিকার আপনার আছে। এটি করলে আমার মনে হয় আপনি মানের বিষয়ে নিরাপদ থাকতে পারবেন।

তা ছাড়া যখনই কোনো কনস্ট্রাকশন করবেন, এর জন্য রড, সিমেন্ট, কংক্রিট, কিউরিং গুরুত্বপূর্ণ। আপনি ভালো রড, সিমেন্ট দিলেন; কিন্তু ডিজাইনটি ভালো হলো না কিংবা পাইলিংটি ভালো হলো না বা কিউরিং ঠিকমতো করলেন না, তখনই সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফাটল ধরবে বা সামান্য ভূমিকম্পে বিল্ডিং হেলে পড়বে। একজন ভালো আর্কিটেক্ট দিয়ে নকশা করিয়ে ভালো ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বিল্ডিং ভালোভাবে নির্মাণ করবেন।

রডের কাঁচামালের উত্স বা সোর্স কী কী? সেগুলো আমদানি করা হলে কোন কোন দেশ থেকে করা হয়?

মূলত আমাদের রডগুলোর কাঁচামাল দুটি সোর্স থেকে সংগ্রহ করি। নিজেরা আমদানি করি আবার স্থানীয় কিছু উত্সও আছে। তবে লোকাল সোর্স থেকে সংগ্রহ খুবই কম। শতকরা ৮০ ভাগই আমদানিনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামালগুলো আসে। এগুলোকে স্টিল মিলে গলিয়ে একটি শেইপে নিয়ে আসা হয়, যাকে বিলেট বলে। কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে কেমিক্যাল কম্পোজিশন দিতে হয়। বর্তমানে বাজারে তিনটি গ্রেডের রড পাওয়া যায়। টিএমটি ৫০০ ডাব্লিউ অথবা ৭২ গ্রেড, ৪০০/৬০ গ্রেড এবং ৩০০/৪০ গ্রেড।

এ মুহূর্তে কতজন লোক আপনাদের এখানে কাজ করছে?

আমাদের দুটি প্রজেক্টে সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ৩০০ লোক কাজ করে। এ ইন্ডাস্ট্রি এমনিতেই একটু ঝুঁকিপূর্ণ। সারা বিশ্বে একই অবস্থা। তার পরও নিরাপত্তার বিষয়ে শতভাগ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে সেফটি শু ও অন্য যেসব উপকরণ আছে, সেগুলো দিয়ে থাকি এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এতে আমাদের ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করছে তারা নিজেদের কাজ করতে নিরাপদ বোধ করেন। এ ছাড়া তাদের যেকোনো অসুখবিসুখ হলে সেটি দেখার চেষ্টা করি। তাদের কোনো উত্সব, বিয়ে, ঘর তৈরিসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করি। আমি বিশ্বাস করি, যারা আমাদের এখানে কাজ করে তারা সবাই মনে করে এটি তাদের ইন্ডাস্ট্রি। ওই জায়গাটিই আমরা তৈরি করার চেষ্টা করেছি।

আমরা রডের বিজ্ঞাপনে দেখি ভূমিকম্প সহনীয়। বিষয়টি নিয়ে একটু বলুন...

রডের মানভেদে প্রতিটি রডই ভূমিকম্প সহনীয়। রডের কারণে কোনো বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে—এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই। এসব ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারের ভুল ছিল কিংবা পাইলিং ঠিকমতো হয়নি। হয়তো নকশা অনুযায়ী রডের ব্যবহারটা ঠিকমতো হয়নি। এখন যেসব রড আমরা উত্পাদন করছি, সেগুলো আরো উন্নত। এগুলোর টলারেন্স বা সহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি। এ কারণে ভূমিকম্প একটু বেশি হলেও ভাঙে না।

উল্লেখযোগ্য কোন স্থাপনাতে আপনাদের রড ব্যবহার করা হচ্ছে?

আমাদের রড বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাধীনতা স্তম্ভ যেখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানে আমাদের রড যাচ্ছে। সরকারি অনেক স্থাপনাতেই আমাদের রড ব্যবহার করা হচ্ছে। পায়রা বন্দরে আমাদের রড ব্যবহার করা হয়েছে। রূপপুরের প্রজেক্ট এবং চট্টগ্রামেও আমাদের রড যাচ্ছে।

আপনাদের দুটি প্রজেক্টের উত্পাদনক্ষমতা কতটুকু?

আমাদের একটি ইন্ডাস্ট্রিতে উত্পাদনক্ষমতা প্রতি দিন ৩০০ মেট্রিক টন। আর অপর ফ্যাক্টরিটি টেকনোসাম স্টিলে ১৫০ মেট্রিক টন বিলেট উত্পাদন করছি। রডে এখনো যেতে পারিনি। রডের প্লান্টটি বসছে। আরো সাত-আট মাস লাগবে চালু হতে। আশা করছি সেখানে তখন ৩০০ মেট্রিক টন রড উত্পাদন করতে পারব।

ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা?

আসলে মানুষ যা কিছু করে, প্রয়োজনের তাগিদেই করে। আমরা যে পরিমাণ রড উত্পাদন করছি, আগে আরো কম করতাম। আরো বড় ইন্ডাস্ট্রি করার পেছনে এখানে অনেক ফ্যাক্টর জড়িত। প্রথমে হচ্ছে জমি। এই এলাকায় জমির সমস্যা রয়েছে। আবার দূরে গিয়ে করলে সেখানে বিদ্যুতের সমস্যা। বিদ্যুতের পেছনে বড় ধরনের টাকা খরচ হয়ে যাবে।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ