<p>একদিন দেশে আর কাক রইল না। ঘরের চালে নেই, আকাশে নেই, ডাস্টবিনে নেই। নাড়িভুঁড়ি, পচা-বাসি খাবার শুকিয়ে যায়। খাওয়ার কেউ নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে বন বিভাগ বিজ্ঞপ্তি জারি করার আগেই ব্যাপারটি আমি জেনে যাই ঘটনাচক্রে।</p> <p>আষাঢ়ের একদিন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মিরপুর ১ নম্বরের পাখির বাজারে গেলাম। আমি শৌখিন পাখিপ্রেমী। পাখি কেনার মুড নেই। বাজারের এক কোণে কালো কাপড়ে ঢাকা একটি খাঁচা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। কৌতূহল জাগল।</p> <p>‘প্যাঁচা নাকি?’</p> <p>‘জি, না।’</p> <p>প্যাঁচারা সূর্যের আলো পছন্দ করে না। এই পাখি বিক্রি করাও অপরাধ।  কালো কাপড়ের ব্যবস্থা?</p> <p>‘এটা তাহলে কী?’</p> <p>‘এইটা ইসপিশাল। গোটা দ্যাশে এক পিস।’</p> <p>‘কী তাহলে?’</p> <p>‘কাউয়া। কালা কাউয়া।’</p> <p>লোকটার কথা শুনে আমার হাসি পেল কি না বা তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ালাম কি না, সেসব থাক। মূলকথা হলো, লোকটা যখন আমাকে বলল, ‘চাইরদিকে তাকাইয়া দেখেন। একটা কাউয়া দেখাইতে পারলে আমি কান কাইট্টা দিমু।’ তখন আমি সত্যি চারপাশে তাকালাম।</p> <p>রক্তাক্ত কাটা একটি কান পাব—এই উদ্দেশ্যে তাকাইনি। সত্যি যদি দেশে আর কাক না থাকে, তবে লোকটার খাঁচাবন্দি কাকটা আসলেই স্পেশাল!</p> <p>ঘটনা সত্য। আতিপাতি করে খুঁজেও কাকের দেখা পেলাম না।</p> <p>লোকটা খাঁচার কাপড় তুলে দেখাল। দাঁড়কাক। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বহুদূর। সামান্য চোখের নড়াচড়ায় বোঝা গেল ওটা সত্যিকারের কাক, মাটি বা পাথরের নয়।</p> <p>আশপাশে গুঞ্জন। জনাকয়েক দেখছে আর হাসছে। কানে এলো, ‘পাগল-ছাগল। কাউয়া আনছে বেচতে।’</p> <p>‘কত?’</p> <p>‘আপনি বলেন।’</p> <p>‘কাকের আবার দাম কিসের। কাক কেউ পালে?’</p> <p>‘দেশে আর নাই। এটাই লাস্ট।’</p> <p>‘১০০ দেব।’</p> <p>‘এক দাম পাঁচ হাজার।’</p> <p>‘লাস্ট ২০০। খাঁচাসহ ৩০০।’</p> <p>‘আমার কথাও থাকল, আপনার কথাও। ৫০০ দিয়েন।’</p> <p>আমি ফেঁসে যাওয়ার মতো মলিন মুখ করে খাঁচাটা হাতে নিয়ে ৫০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম। লোকজন ভুরু কুঁচকে আমার কাণ্ড দেখল। কারো কারো সুর বদলে গেল। কানে এলো—</p> <p>‘ঘটনা কী?’</p> <p>‘কাউয়াও লোকে কেনে?’</p> <p>‘এইটা বিদেশি কাউয়া।’</p> <p>‘অস্ট্রেলিয়ান কাউয়া মনে হয়। সাইজ দেখছেন?’</p> <p>দেরি করলাম না। বিরাট কিছু জয় করে ফেলার অনুভূতি নিয়ে হনহন করে হাঁটছি। লোকটা এত সস্তায় বাংলাদেশের শেষ কাকটা আমার কাছে বেচে দেবে—এ তো কল্পনাও করা যায় না। বোকার হদ্দ বলে একটি কথা আছে। হদ্দ মানে চূড়ান্ত। আর আমি বুদ্ধিমানের হদ্দ!</p> <p>কয়েক দিন আগে কেনা দামি গাড়িখানায় চড়লাম। গাড়ির জন্য নয়, কাকটার জন্যই নিজেকে বিরাট ধনী মনে হচ্ছে। সম্ভবত শুধু বাংলাদেশ নয়, এটা পৃথিবীরও শেষ কাক।</p> <p>মাস তিনেক গেল। এত দিনে সবাই টের পেল যে দেশটা কাকশূন্য। হাহাকার লেগে গেল। অলিগলিতে ময়লা, নাড়িভুঁড়ি। অনেক কবি কবিতা লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, কিছু আর্টিস্ট সিদ্ধান্ত নিল তারা আর বিদ্যুতের তারের ওপর কাকের ছবি আঁকবে না।</p> <p>আমি আমার আলিশান বাড়িতে শেষ কাকটাকে নিয়ে আছি মহা আনন্দে। পাখির ঘরের এক কোণে রাখা আছে ওটা। কেউ সেভাবে খেয়াল করেনি। কালোবাজার থেকে কেনা চোরাই পেইন্টিংয়ের মতো ওটাকে আগলে রেখেছি।</p> <p>পাখির ঘরে একচিলতে জানালা। এতে আকাশ দেখা যায়। দাঁড়কাকটা সারা দিন জানালাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবারও ডানা ঝাপটাতেও দেখলাম না ওটাকে।</p> <p>নিয়মিত এটা-ওটা খেতে দিচ্ছি। কাকটা বেশ সুবোধ। এখন পর্যন্ত একবারও ক্রা ক্রা করেনি। না ডাকলেই ভালো। কাকের ডাক মধুর কিছু নয়। কেউ শুনলে বরং বিপদ। বন বিভাগ তো আসবেই, ডাকাতরাও হামলা করতে পারে। কাকের এখন এতই দাম!</p> <p>কাকটা এর মাঝে বারকয়েক ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখেছে। ভাবখানা এমন যে আমাকে একটু দেখে নিল কেবল, বিশেষ কিছু বলার নেই। আমরা যেভাবে রাস্তায় জটলা দেখে মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকাই, তার চাহনিটা তেমনই।</p> <p>দিন দিন কেমন যেন তার আচরণ বদলে যেতে লাগল। দেখুন কাণ্ড! আমি এরই মধ্যে একটি কাককে ‘তাকে’ বলে সম্বোধন করছি। বলতে হবে ‘ওটাকে’। কাকটারই দোষ। সে এমন ভারিক্কি চালে খাঁচায় পায়চারি করে কেন! তার উচিত সারাক্ষণ ক্রা ক্রা করে সবাইকে জানান দেওয়া যে ‘গুলশানের শিল্পপতি আরশাদ চৌধুরীর কাক আমি। আমি অমূল্য!’</p> <p>আরো কিছুদিন গেল। স্পর্ধা বেড়েছে কাকটার। এখন ঘাড় ঘুরিয়েও তাকায় না। আমি সামনে গেলে সে বাঁ পাশে মাথা খানিকটা ঝুঁকিয়ে কী যেন ভাবে, তারপর অন্যদিকে মুখ ফেরায়, যেন সে অফিসের বড় কর্তা, আর আমি ছাপোষা কেরানি তার কাছে দুই দিনের ছুটি চাইতে গিয়েছি।</p> <p>কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়াশোনা করলাম। কী ভয়ানক! ওরা নাকি সাত বছরের মানবশিশুর মতো বুদ্ধি রাখে! আর এই খাঁচাবন্দি কাক মশাইকে দেখে তো মনে হয় বিজ্ঞানে দুখানা বড় ডিগ্রি নিয়ে বসে আছেন। খাঁচায় বসে কাল্পনিক গবেষণা করছেন, যেন তিনি আমার অধীনে নেই। আমিই তাকে দেখভাল করার চাকরি নিয়েছি, বিনা বেতনে!</p> <p>সত্যি তো! রোজ দুবেলা ফ্রেশ মাংস, বাদাম, ডিম, আঙুর, কী খাওয়াচ্ছি না তাকে! আমার মনে হলো, এই কাককর্তার দেখভাল আমাকে আরো বহুদিন চালিয়ে যেতে হবে।</p> <p>বছর কেটে গেল। হাঁপিয়ে গেছি বলা যায়। এর মাঝে একবারও ডাকেননি আমার মহান কাক। কেউ জানতেই পারছে না আমি কত দামি একটি কাকের খেদমত করছি।</p> <p>মাঝে একদিন কাশির মতো শব্দ করে আবার চুপ মেরে গেছেন কাক বাহাদুর। সেদিন তাঁর জন্য হালকা গরম পানির ব্যবস্থা করেছিলাম। </p> <p>মাঝেমধ্যে খাঁচার দরজা খুলে দিই। কাকবাবু বেরই হন না। বের হতে বললে বিরক্ত হয়ে এমনভাবে তাকান, যেন আমার অজ্ঞতায় তিনি দারুণ মর্মাহত।</p> <p>আরো কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম আমার ভয়ানক রোগ হয়েছে। কাকরোগ। কাকটাকে দামি দামি খাবার দিচ্ছি অঢেল। তাঁর খাঁচার ভেতর নরম তোশক পেতে না দিলে আমারই ঘুম হচ্ছে না। তাঁকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো থেকে চুলও আঁচড়ে দিচ্ছি। ভালোবেসে এসব করছি না। এ যেন আমার গুরুদায়িত্ব! কাকরাজাও এমনভাবে তাকান যে আমার কলজে কেঁপে ওঠে। তাঁকে উপেক্ষা করাই যায় না!</p> <p>একদিন মহান কাকের দিকে তাকিয়ে আমি ‘কা’ বলে ডেকে উঠলাম। বিরক্ত হলেন তিনি। আমি আবার গলাটাকে ভেঙে ‘ক্রা’ বলে ডাকলাম। এবার কিছুটা খুশি মনে হলো তাঁকে। আমি ক্রা ক্রা করে গেলাম দিনভর। কাকরাজাকে বেশ উত্ফুল্ল মনে হলো। সুন্দর করে কাকের মতো ডাকতে পেরে আমার যে কী খুশি লাগল বলে বোঝাতে পারব না।</p> <p>এখন হয়েছে কি, আমার আর ভালো ভালো খাবার খেতে ইচ্ছা করে না। সেদিন অনেকটা বাধ্য হয়েই এক টুকরা ময়লা মুখে নিলাম। এরপর গোগ্রাসে গিলে ফেললাম পুরোটা। সুযোগ পেলেই গভীর রাতে হানা দিচ্ছি ডাস্টবিনে। পচা-বাসি খাবারগুলোকে মনে হয় পাঁচ তারকার বুফে ডেজার্ট।</p> <p>আরেকটা বিষয় হলো, মানুষের সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগছে না একদমই। কথা বলা তো ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে!</p> <p>তারপর একদিন কাকটা আমার দিকে দুটি ডানা ভাঁজ করে ঘুরে দাঁড়াল। পরিষ্কার গলায় বলল, ‘এবার তুমি যেতে পারো।’ আমিও মাথা নিচু করে বললাম, ‘ক্রাঁ’। মানে ‘জি, হুজুর।’</p> <p>এরপর খোলা জানালাটা দিয়ে উড়ে গেলাম।</p> <p>ক্রাঁ ক্রাঁ ক্রাঁ।</p> <p> </p>