বাংলাদেশের মেলা

সাইমন জাকারিয়া
সাইমন জাকারিয়া
শেয়ার
বাংলাদেশের মেলা

বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব হিসেবে মেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। অতীতে মেলা মূলত গ্রামকেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করলেও পরে মেলা গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে নগর-শহরে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বছরের নানা সময়ে গ্রামে বা শহরে মেলা বসে না। তবে কবে থেকে এবং কীভাবে এ দেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে তা সঠিক করে বলার উপায় নেই।

গবেষকদের ধারণা, বাংলায় নানা ধরনের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি হয়েছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরেরও অধিক পুরনো। এদেশের প্রাচীন পর্যায়ের উৎসব ও কৃত্যানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে জীবন ধারণের আহার্য কৃষিশস্য এবং বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রোদ ও মেঘের কথা। রোদ মানে সূর্য।
প্রাচীন বাংলার মানুষ চাঁদ ও সূর্যকে ‘বুড়া-বুড়ি’ নামে যেখানে পূজা করেছে, সেখানে পূজা-উৎসবে পূজারিরা

 

সমবেত হতে থাকলে একসময় ধীরে ধীরে ‘বুড়া-বুড়ির মেলা’ প্রবর্তিত হয়। এর সঙ্গে আসে মেঘের জন্য বরুণ বা বারুণী। উল্লেখ্য, বুড়া-বুড়ির মেলাটি পরে সূর্য মেলা, সূর্য ঠাকুরের ব্রত, চৈত্রসংক্রান্তির ব্রতের মেলা, চড়ক মেলা, শিবের গাজনের মেলায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে মেঘের দেবতা বরুণ-বারুণীস্নানের মেলা হিসেবে রূপ গ্রহণ করে।

গবেষকদের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতিবছর এখনো পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পেছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয়তো ব্রত-পালা-পার্বণ অথবা যেকোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে। মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে—নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে একেকটি মেলায় নর-নারী, শিশু-কিশোর, এমনকি আবাল-বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়।
তবে মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে—ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহসামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্য যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ ইত্যাদির আসর। এ দেশের প্রচলিত মেলাগুলোর প্রকৃতি বহু ধরনের।

 

এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীকরণ দুঃসাধ্য। কিন্তু এ আলোচনার সুবিধার্থে এ দেশে প্রচলিত মেলাগুলোর একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশের মেলার প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এ দেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে। চারিত্র্য বিচারে এ দেশে প্রচলিত মেলাগুলোকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে—১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরস উপলক্ষে ফকিরি মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্‌যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৎতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসব মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণিবিন্যাসে কেবল সেসব মেলাকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাগুলোর এমন সরলীকৃত শ্রেণিবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেলাই ধর্মীয় উপলক্ষে প্রবর্তিত। মুসলিম, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী মিলে এ দেশে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ই তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, শিবপূজা, কালীপূজা, রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি উপলক্ষে মেলা বসে থাকে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ ও ধর্মীয় অনুষঙ্গে অনুষ্ঠিত মেলার মধ্যে রথের মেলা সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী। একটি জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা উপলক্ষে ৬২টির মতো মেলা বসে। তার মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ের রথের মেলাটি প্রাচীন ও জাঁকালো। সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করেই এ দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মেলা বসে থাকে, যার সংখ্যা ৭৩টির অধিক। সর্বজনীন দুর্গাপূজা সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব। ফলে দুর্গোৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে মহররমের মেলাগুলোই অধিক বর্ণাঢ্য। শিয়া মতবাদী মুসলিমরা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে শোভাযাত্রা বা তাজিয়া মিছিল বের করে এবং বিভিন্ন ধরনের কৃত্যাচার পালনের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোথাও জারিগানের আসরও করে থাকে। মহররমের মেলার ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।   মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মেলার সূত্র ধরে বৌদ্ধ ধর্মের অনুষঙ্গে যুক্ত মেলার কথা বলা যেতে পারে। তাদের মেলার সংখ্যা আরো অল্প। এই মেলাগুলোর সবই প্রায় তাদের মূল অনুষ্ঠান বৌদ্ধ পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, ‘চট্টগ্রামের বিজুড়ি গ্রামের আশ্বিনী পূর্ণিমায় বসে তিন দিনের মেলা, কুমিল্লার বড়ইয়ায় মাঘী পূর্ণিমায় একদিনের মেলা বসে। সবচেয়ে বড়টি মহামুনির, যার স্থিতিকাল পুরো বোশেখ মাস। ’ এ দেশের বেশির ভাগ কৃষি উপলক্ষের মেলা অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকধর্মীয় কৃত্যের যোগ থাকে। যেমন—গৌষ্ঠ মেলা, নবান্ন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কার্তিক মেলা, পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পৌষ মেলা, চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষের মেলা। কৃষি মেলার অন্য কয়েকটি রূপ আছে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের মধ্যে, কৃষিকেন্দ্রিক কৃত্যানুষ্ঠানের সূত্রে এ দেশের আদিবাসীরা প্রতিবছর বিজু, বৈজু বা বৈজু উৎসব মেলা এবং কারামপূজা উপলক্ষে একটি বিশেষ কৃষিভিত্তিক উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকে। এ ধরনের মেলা ও উৎসবের আয়োজন স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল। বাংলাদেশের মেলার আরেকটি শ্রেণিতে আছে ঋতুভিত্তিক জাতীয় মেলা, যেমন বসন্তবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বসন্ত-উৎসব ও মেলা, বর্ষবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। বাংলা বর্ষবরণ বা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলার চল এ দেশে বেশ পুরনো। তবে সম্প্রতি এ দেশের গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থ্থা’, ‘পর্যটন করপোরেশন’, ‘বাংলা একাডেমি’ এবং ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে’র পরিকল্পিত আয়োজনে বৈশাখী মেলা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিকের নামে নিয়মিত স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং সে উপলক্ষেও মেলা বসে। যেমন ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের জসীম মেলা, যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃৎতিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্ব্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। এই সাংস্কৃৎতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশে নিয়মিত বইমেলারও আয়োজন হয়। বাংলা একাডেমির বইমেলাকে কেন্দ্র করে একুশের মেলা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই বইমেলা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে ক্রমেই ঐতিহ্যের পথে অগ্রসরমাণ। বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবিগান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙের কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলায় ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ