<p>যৌন সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীকরণে যৌন নিপীড়ন সেলের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং রাতে নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণের পাঁয়তারা বন্ধসহ ছয় দফা দাবিতে ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা রাতের দখল নাও’ ব্যানারে মশাল মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্রীরা। </p> <p>সোমবার (১৯ আগস্ট) দিবাগত রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের সামনে থেকে একটি মশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে গিয়ে শেষে হয়। পরে সেখানে একটি সমাবেশ করেন তারা। এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন নারী শিক্ষকও অংশ নেন। সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অমান্য করে সারা রাত হলের বাইরে অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে নতুন কলা ভবনে সিনেমা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। </p> <p>শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- লিঙ্গ সংবেদনশীলতা প্রসঙ্গে একাডেমিক ও পেশাগত দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে এবং সেলের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে যৌন নিপীড়ন সেলে আসা অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রত্যেক অ্যাকাডেমিক ভবনে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্তসংখ্যক পাবলিক টয়লেট স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি হলে ও বিভাগে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। নিরাপত্তা ও রাতের অজুহাতে নারীদের হলের ছাদ ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আড্ডাস্থলসহ বিভিন্ন জায়গায় নারীদের বিচরণ সীমিত করার প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে এবং সান্ধ্য আইন প্রয়োগ করে নারী শিক্ষার্থীদের হলের প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ করার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে।</p> <p>সমাবেশে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা কখনো দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না, এখনো নেই। আমরা যেমন আমাদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের জবাব দিতে পারি, তেমনি অন্য কারো সঙ্গে হওয়া অন্যায়েরও জবাবও দিতে পারি। খুবই নিরাশাজনক বিষয় হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো আমাদের মেয়েদের এই প্রতিবাদী সত্ত্বাকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না বরং দমানোর চেষ্টা করে। </p> <p>গত পরশু ক্যাম্পাসের একজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এরকম ঘটনা প্রায় ঘটতে দেখা যায়। আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সেটির কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এই সেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, যেসব ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী সেখানে অভিযোগ করে উল্টো তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে যদি এত বড় ছিদ্র থাকে তাহলে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ আরো বিশাল। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অসংখ্য নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। আমরা চাই আমাদের দাবিগুলোকে দাবি হিসেবে না ভেবে মেয়েদের প্রতি সকল বৈষম্য ও সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’ </p> <p>শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রিজওয়ানা বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশের জন্য একটি উদাহরণস্বরূপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রায়ই ধর্ষক মানিককে নিয়ে কথা শোনা যায়, কিন্তু কেউই জানতে পারেনি যে আসলে কাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। প্রশাসন থেকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আসলে কাকে ধর্ষণ করা হয়েছে তখন জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা বলেছিল আমদের সবাইকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই ‘আমরা সবাই’ অনেক বড় একটা আওয়াজ। যদি আমরা ভাবি ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়াব না তখন সবাই দুর্বল হয়ে পরব। ধর্ষণের জন্য শরীর লাগে না, শরীর দেখে ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ করা হয় ক্ষমতা সম্পর্ক জায়েজ করার জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে মেয়ে মানুষের জন্ম শুধু বিনোদনের জন্য না, মেয়ে মানুষ শুধু শরীরের জন্য না। কোনো মেয়ের জন্ম শুধুমাত্র জন্মদানের জন্য না, কোনো মেয়ে কোনো পুরুষের থেকে কম না এটা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে।’ </p> <p>বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোমা ডুমরী বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে ঠিকই কিন্তু জানোয়ারগুলোর, নিপীড়কগুলোর পতন হয়নি। আজাদী এসেছে রাষ্ট্রের, কিন্তু আমাদের নারীদের আজাদী আসেনি। এখন আমাদের নারীদের সোচ্চার হওয়ার সময়। আমরা দেখি বিভিন্ন নিউজে, বিভিন্ন পেজে নারী ধর্ষণের নানা নিউজ আসে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না গ্রামে, গঞ্জে, পাহাড়ে, সমতলে বিভিন্ন জায়গায় যে নারী ধর্ষণগুলো হয় সেগুলো কখনো সামনে আসতে। নিপীড়কগুলো ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে তাদের বিচার এই রাষ্ট্রের কাছে চাই। আমরা দেখেছি রাষ্ট্র স্বৈরাচারমুক্ত হওয়ার পরেও বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই সব বিচার এই রাষ্ট্রের কাছে চাই।</p>