<p>টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষের পর থেকে মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকারে নেমে হতাশ হচ্ছেন জেলেরা। নিষেধাজ্ঞা শেষে যেখানে জালভর্তি ইলিশ মাছ পেয়ে জেলেদের মুখে হাসির ঝিলিক লেগে থাকার কথা। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ জেলের মুখ ছিল মলিন। কারণ, নদীতে ইলিশ শিকারের আয়োজনে তাদের খরচের টাকাই উঠছে না।</p> <p>ইলিশের মৌসুমের শুরুতেই ঋণের টাকায় নৌকা ও জাল কেনা। পাশাপাশি তা মেরামতের জন্য মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়েছিলেন জেলেরা। মৌসুম এলে চার-পাঁচ মাস ইলিশ শিকার করেন। সেই মাছ বিক্রির আয় দিয়ে দাদন ও কিস্তির মাধ্যমে ঋণ শোধ দেন তারা। বাকি টাকায় সংসার চলে। কিন্তু আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন, সেই দুঃচিন্তায় পড়েছেন জেলেরা।</p> <p>তবে মেঘনা নদীতে গত বছরের চেয়ে এবার প্রজনন মৌসুমে বেশি ইলিশ এসেছিল বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২২ দিন ইলিশ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় নদীতে অভিযান চালাতে গিয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন। তারা বলছেন, মা ইলিশ এবার মেঘনার স্রোতে আশপাশের নদীগুলোতে ঢুকেছিল। কিছু মা ইলিশ কতিপয় জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল। তবে অভিযানের কারণে অধিকাংশ জেলেরা মা ইলিশ ধরতে পারেনি। সেই ইলিশ ইতিমধ্যে সাগরে চলে গিয়েছে। ফিশিং বোর্ডের জালে সেগুলো আটকাবে।</p> <p>এদিকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ ধরায় ২২ দিনে ৬৮১ জন জেলের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান হয়েছে এক হাজার ৬১টি আর অভিযান চালানো হয়েছে তিন হাজার ৩৯৪টি। মামলা করা হয়েছে এক হাজার ১৫৭টি। এ সময়ে জরিমানা আদায় হয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা এবং মা ইলিশ উদ্ধার হয়েছে ১৮ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। বিভিন্ন নদ-নদীতে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়েছে এক কোটি ৭ লাখ মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল।</p> <p>পটুয়াখালীর দশমিনার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া লাগোয়া তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে অনেক জেলের নৌকা নোঙর করা রয়েছে। কেউ মাছ ধরতে জাল নিয়ে নেমে পড়ছেন। আবার কেউ জাল ফেলে তেমন মাছ না পেয়ে নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে আছেন। তাদেরই একজন শাহজাহান খান। তিনি বলেন, ‘তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার ইলিশের অভয়াশ্রম। নিষেধাজ্ঞা শেষে তিন ছেলে মিলে তেঁতুলিয়ায় ইলিশ শিকারে নামেন। রাতভর তিনবার তেঁতুলিয়ায় জাল ফেলে ৩০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম সাইজের ৭টি ইলিশ পেয়েছেন।’</p> <p>তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ের আরেক জেলে ফোরকান শরীফ। তিনিও তার দুই ছেলেকে নিয়ে তেঁতুলিয়ায় ইলিশ ধরেন। তিনি বলেন, ‘২২ দিন ইলিশ শিকার বন্ধ থাকার পর নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ পাবে বলে তার আশা ছিল।’ কিন্তু ইলিশ না পাওয়ায় দাদন ও কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়েছেন তিনি। তার মতো অন্যান্য জেলেরাও তেমন মাছ পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।</p> <p>মেঘনা তীরের চরফ্যাশন উপজেলার শামরাজ বাজারের জেলে আলী হোসেন জানান, অন্যান্য বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে অনেক ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ তার জালে আটকাতো। বিশেষ করে পাঙাশ মাছ বেশি পাওয়া যেত। এবারও পাঙাশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা খুবই কম। ভালো মাছ ধরা পড়বে এই আশায় অনেক জেলে ধারদেনা করে জাল ও নৌকা নামিয়েছেন। ইলিশ না মিললে কীভাবে তারা দাদনের টাকা পরিশোধ করবেন!</p> <p>বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘ইলিশের মতো পাঙাশও এ সময়টাতে নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য আসে। তাই এ সময়টাতে বাজারে পাঙাশ পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে বিগত সময়ের মতো বড় ইলিশের আমদানি তেমন একটা নেই, এবারে ছোট সাইজের মাছের আধিক্য বেশি, তবে এটি বলে দেয় মা ইলিশ প্রচুর ডিম নদ-নদীতে ছেড়েছে।’</p> <p>প্রথম দিনে বাজারে ইলিশের আমদানি কম মানে, নদ-নদীতে অভিযানের তৎপরতার কারণে তেমনভাবে ইলিশ শিকার করতে পারেনি কেউ বলে মন্তব্য করেন।</p> <p>বরিশাল মৎস্য বিভাগের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার মেঘনা নদীতে মা ইলিশ বেশি এসেছে। মেঘনায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধির কারণের শাখা নদীগুলোতে পানির অধিক্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযানের সময় শাখানদীতেও তারা ইলিশ পেয়েছেন। যেখানে সাধারণত ইলিশ পাওয়া যায় না।’</p> <p>মেঘনায় এবার পানির প্রবাহ বেশি থাকায় ইলিশ আসার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. লোকমান আলী। তিনি বলেন, ‘যে বছর পানির প্রবাহ বেশি থাকে, সেই বছর মেঘনার শাখা নদীগুলোতে পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যায়। এবার মেঘনায় পানির প্রবাহ বেশি হওয়ায় জন্য শাখা নদীগুলোতে পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে এবার মেঘনা নদীসহ আশপাশের নদীতে ইলিশের বিচরণ বেশি হতে পারে।’</p>