ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশে ফসলের মাধ্যমে জমিদারদের খাজনা প্রদানের একটি শোষণমূলক প্রথা প্রচলিত ছিল। ওই সময় সুসং দুর্গাপুর ছিল টংক প্রথার স্বর্গভূমি। জমিতে ফসল হোক বা না হোক টংকের ধান দিতেই হতো জমিদারদের। ১৯৩৭ সালে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কৃষকরা এ প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেন।
এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজং ও তাঁর স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ইতিহাসের সেই অধ্যায় হাজংদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল হিসেবে।
হাজংরা প্রধানত শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নালিতাবাড়ী, সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও বিরিশিরি এলাকায় বাস করে। এ ছাড়া শেরপুর, সিলেট ও নেত্রকোনা অঞ্চলেও কিছুসংখ্যকের বসবাস রয়েছে।
নৃবিজ্ঞানীদের মতে, হাজংদের আদি নিবাস উত্তর বার্মায়। কিছু ঐতিহাসিক মতবাদ অনুসারে, এই জনগণ মূলত পূর্ব আফগানিস্তান বা তাজিকিস্তান অঞ্চলের পাহাড়ি জাতি থেকে এসেছে এবং পরে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হাজংদের পূর্বপুরুষরা তাদের আদি নিবাস ত্যাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে বলে অনেকের ধারণা। সপ্তদশ শতকে মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তারা গারো পাহাড়ে আশ্রয় নেয় এবং পরবর্তী সময়ে সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করে।
প্রাচীনকাল থেকেই তারা গাড়ো পাহাড়ে জমিচাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। তাই অনেক হাজং বিশ্বাস করে যে গারোরা তাদের নামকরণ করেছে হাজং। গারো ভাষায় ‘হা’ মানে মাটি এবং ‘জং’ মানে পোকা, অর্থাৎ মাটির পোকা। তবে তাদের নামের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। হাজং জাতির ভাষা হচ্ছে ‘হাজং’ বা ‘হাজং-ভাষা’।
অস্ট্রো-এশিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত একটি প্রাচীন ভাষা এটি। ভাষাটির নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। তারা ভাষার লিখিত রূপ দিতে অসমীয়া বর্ণমালা ব্যবহার করে। যদিও হাজং জনগণ বাংলাদেশে এখন বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। হাজং পুরুষরা সাধারণত লুঙ্গি বা ধুতি পরে এবং নারীরা বিশেষ ধরনের সিল্কের শাড়ি বা কাপড় পরিধান করে।
নারীদের বিশেষ এই পোশাককে বলা হয় পাথিন। হাজংরা বিভিন্ন উৎসব, যেমন বর্ষবরণ, মাঘী পূর্ণিমা এবং বৈশাখী মেলায় অংশ নেয়। এই সময়গুলোতে তারা গানের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। তাদের গানে, নাচে ও মেলায় এক ধরনের প্রাচীন ইতিহাস ও সংগ্রামের ছাপ দেখা যায়। হাজংদের মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রচলন বেশি। তবে বেশ কিছুসংখ্যক হাজং স্থানীয় আদিবাসী ধর্মের অনুসারী।