<p>কখনো ভবঘুরে, কখনো আবার টোকাই নামে পরিচিত ছিলেন। একসময় রাস্তায় বাদাম বিক্রি করতেন। কাজ করতেন অন্যের জমিতে। পড়ালেখা না করায় স্বাক্ষর করতে শেখেননি। সেই তিনি জমির দালালি করতে গিয়ে হাতে যেন পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। টাকার জোরে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে না চাইলে তার পরিবারে নেমে আসত অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ। এই কাউন্সিলরকে নিয়ে গণমাধ্যমে আগেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদক মামলাও করেছে। কিন্তু বরাবরই কোনো কিছুকে পাত্তা দেননি তিনি। </p> <p>তিনি হলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু। তাঁর বড় ছেলে সনি হোসেন এলাকায় চাঁদাবাজ। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাপ-বেটা দুজনই এলাকাছাড়া। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শাহুর ব্যক্তিগত কার্যালয় ভাঙচুরসহ তাঁর টাইলস ও রড-সিমেন্টের দোকানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। </p> <p>এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহুর টাইলস ও রড-সিমেন্টের ব্যবসা দেখতেন বড় ছেলে সনি। ওই দোকান থেকে বাজারদরের বেশি মূল্যে টাইলস ও রড-সিমেন্ট না কিনলে এলাকার কেউ শান্তিতে বাড়ি নির্মাণ করতে পারত না। জায়গা দখল কিংবা থানায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে জমির মালিককে নানাভাবে হয়রানির মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হতো নির্মাণকাজ। ব্যবসার নামে চাঁদাবাজি করে সনি হয়ে ওঠেন কোটিপতি। অন্যদিকে কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু সাধারণ মানুষের জমি দখল করে গড়েছেন অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ। অবৈধ এসব অর্থ-সম্পদের দাপটে বাপ-বেটা এলাকায় কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব।  </p> <p>গত বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো অংশ নেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু। হলফনামায় শাহু তাঁর কাছে নগদ ছয় কোটি টাকা ছিল বলে উল্লেখ করেন। আর বার্ষিক আয় দেখান এক কোটি টাকা। ব্যাংকে জমা দেখানো হয়েছিল তিন কোটি টাকা। </p> <p>সূত্র মতে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহুর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই অভিযোগে তাঁর স্ত্রী নাজমা আলীর বিরুদ্ধেও আলাদা আরেকটি মামলা করা হয়। দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করা হয়। দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন।</p> <p>দুদক সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়ে কাউন্সিলর শাহু ও তাঁর স্ত্রী নাজমা আলীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এক পর্যায়ে দুজনকে তাঁদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কাউন্সিলর শাহু তাঁর নামে ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৪ টাকার এবং নাজমার নামে এক কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৩৭৬ টাকার সম্পদ দেখান। এ ছাড়া শাহু তাঁর সম্পদ হিসেবে দেখান একটি প্রাডো জিপ গাড়ি, একটি পিস্তল, ২১ বিঘা জমি ও আটটি বাড়ির মালিকানা। এর মধ্যে রয়েছে নিজের নামে পাঁচটি এবং স্ত্রীর নামে তিনটি বাড়ি। নিজের নামে পাঁচটি বাড়ির মধ্যে তিনতলা একটি, পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন একটি, তিনতলা আবাসিক ভবন একটি, পাঁচতলা আবাসিক ভবন একটি এবং দোতলা আবাসিক দুটি। স্ত্রীর নামে তিনটির ভবনের মধ্যে রয়েছে ছয়তলা আবাসিক একটি এবং নির্মাণাধীন পাঁচতলা ও ১০ তলা একটি করে। </p> <p>তবে দুদকের অনুসন্ধানে শাহু ও তাঁর স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের খোঁজ মেলে। মামলায় উল্লেখ করা হয়, শাহুর নামেই ১১ কোটি ৯৩ লাখ ১৫ হাজার ৫০৪ টাকা এবং স্ত্রী নাজমা আলীর নামে দুই কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শাহু দুই কোটি ২৪ লাখ ৬২ হাজার এবং তাঁর স্ত্রী নাজমা ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ২৪৯ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। </p> <p>দুদক আরো জানায়, মোট সম্পদের মধ্যে কাউন্সিলর শাহুর সাত কোটি ২৮ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ টাকার সম্পদই তাঁর আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আর তাঁর স্ত্রীর আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ আছে এক কোটি ছয় লাখ ছয় হাজার ৯২৬ টাকার। অর্থাত্ মোট সম্পদের বড় অংশই তাঁরা অবৈধ উপায়ে অর্জন করেছেন।</p> <p>এদিকে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, দুদকের মামলার পর শাহু তাঁর নামে থাকা নগরীর সিলিন্দা এলাকায় রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ বাবদ এক দিনেই ৮১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁর জমির দাম বাবদ সরকার ওই টাকা পরিশোধ করেছে।</p> <p>স্থানীয় আব্দুল হালিম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শাহু যে সম্পদ গত ২০ বছরে গড়েছে, তা কোনোমতেই ৫০০ কোটি টাকার নিচে হবে না। তার রাজশাহী শহরে যে আটটি বাড়ি আছে, সেই বাড়িগুলোর দামই অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। এর বাইরে নিজেরসহ স্ত্রী ও দুই ছেলের নামে-বেনামে রয়েছে অন্তত ৫০ বিঘা জমি। এসব জমির দাম অন্তত ২০০ কোটি টাকা। অথচ এই শাহু ছোটবেলায় এলাকায় টোকাই ছিল। একটু বড় হলে পথে পথে বাদাম বিক্রি করত। কিছুদিন সাইকেল মিস্ত্রির কাজও করেছে। সেই শাহু ২৫ বছর আগে এলাকায় জমির দালালি শুরু করে। এরপর নিজেই জমির ব্যবসা শুরু করে। তখন থেকে এলাকার কিছু মাস্তানকে হাত করে মানুষের জমি দখল শুরু করে শাহু।’</p> <p>নওদপাড়া এলাকার আজিজুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘বিবদমান জমিগুলোর দিকে ছিল শাহুর নজর। যেখানেই জমির বিবাদ ছিল, সেখানেই মীমাংসার নাম করে অল্প টাকায় জমি কিনে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা তার ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। মীমাংসা না হলে সেই জমি নিজে দখল করত শাহু। কাউন্সিলর হওয়ার পর তার রাজত্ব আরো বেড়ে যায়। মীমাংসার নামে মানুষের জমি দখল করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে সে।’</p> <p>একই এলাকার ইখতেয়ার আলী নামের আরেক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, ‘শাহুর ছেলে সনিও দখলবাজিতে কম নয়। তার দোকান থেকে টাইলস, রড-সিমেন্ট না কিনলে কেউ বাড়ির কাজে হাত দিতে পারে না। আমি তার দোকান থেকে উচ্চমূল্যে রড-সিমেন্ট না কেনায় আমার জমিটিও দখলের চেষ্টা করে সে। উল্টো থানায় আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি ওই বাড়ির কাজ শুরু করি।’</p> <p>নাজমুল নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা ১৭ জন মিলে একটি জমি কিনি। একদিন দেখি আমাদের সাইনবোর্ড নেই। সেখানে কাউন্সিলর শাহুর নামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। পরে থানা পুলিশের সহযোগিতায় বেশ কিছু টাকা গচ্চা দিয়ে ওই সাইনবোর্ড সরাই। এভাবে জমি দখল ছিল শাহু ও তার ছেলের মূল ব্যবসা।’</p>